একদিন ঝড় পরবর্তী সময়ে সাঁতার কাটছে ইকথিয়ান্ডার সাগরে, পানির ওপর মাথা জাগাতেই চোখে পড়ল সাদা মতো কি একটা জিনিস। যেন মাছ-ধরা কোন জাহাজ থেকে পালের টুকরো খসে পড়েছে। কাছে যেতেই অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। যাকে ছেড়া পালের টুকরো মনে করেছিল সে আসলে এক যুবতী মেয়ে। মেয়েটার দেহ একটা তক্তার সঙ্গে বাঁধা আছে বলেই এখনও সে ভেসে আছে। মেয়েটি কি মারা গেছে? বিচলিত বোধ করল ইকথিয়ান্ডার। খুব রাগ। হলো কেন কে জানে ওর সমুদ্রের ওপর। জীবনে এই প্রথম সাগরের ওপর ওর এই রাগ।
শুধুই কি জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা? মেয়েটির মাথা তক্তার ওপর সোজা করে তুলে দিল ও, তত্ত্বাটাকে ঠেলে নিয়ে চলল তীরের দিকে। মাঝে মাঝেই ঢেউয়ের দোলায় মেয়েটার মাথা হেলে পড়ছে। সাঁতার থামিয়ে ওর মাথা ঠিক মতো তক্তায় রাখে ইকথিয়ান্ডার। সৈকতে আটকা পড়া মাছদের প্রতি যে দরদ মাখানো স্বরে সে কথা বলে ঠিক তেমনি করেই মেয়েটির কানের কাছে মুখ এনে সে ফিসফিস করে বলল, আর সামান্য দূর সহ্য করো। আমি তীরের কাছে এসে পড়েছি।
ইকথিয়ান্ডারের মনে প্রবল বাসনা জাগল, মেয়েটি যদি কথা বলত, একটু চোখ খুলে তাকাত! আবার ভয়ও পাচ্ছে ও, মেয়েটি ওকে দেখে ভড়কে যেতে পারে। আচ্ছা, গগ আর গ্লাভস্ খুলে ফেলবে নাকি? সেটা ঠিক হবে না। তাতে সাঁতরাতে অসুবিধে হবে। তাছাড়া কাজটা সময় সাপেক্ষ। তক্তাটাকে সামনে নিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে চলেছে ইকথিয়ান্ডার।
সাগরের এখানটায় ঢেউগুলো বড় বড় আর উত্তাল। সাবধানে সাঁতার কাটছে ও। ঢেউয়ের ধাক্কায় আপনাআপনিই এখন তীরের দিকে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে পা নামিয়ে পায়ের তলায় বালির স্পর্শ পেতে চাইছে ইকথিয়ান্ডার।
বেশ কিছুক্ষণ পর ওর পায়ে নিতে বালি পেল। তীরে পৌঁছে মেয়েটিকে সে তক্তার বাঁধন খুলে সৈকতে ঝোপঝাড়ের আড়ালে শুইয়ে দিল। আস্তে আস্তে শরীর মেসেজ করে দিচ্ছে যাতে শ্বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে। একটু পর মেয়েটির চোখের পাতা একটু যেন কেঁপে উঠল। মেয়েটির বুকের কাছে কান পাতল ও। মৃদু ধুকপুক শব্দে চলছে হৃৎপিণ্ড। বেঁচেই আছে মেয়েটা। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো ওর
একটু পরই চোখ মেলল মেয়েটা। ইকথিয়ান্ডারকে দেখে চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়ল। একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনার ছোঁয়া লাগল ইকথিয়ান্ডারের বুকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, মেয়েটি বেঁচে আছে। তাহলে!
এবার ইকথিয়ান্ডারকে চলে যেতে হয়। কিন্তু কিভাবে যাবে সে। অসহায় একটি মেয়েকে একা ফেলে! মেয়েটি যদি ভয় পায়?
বেশি ভাবনা চিন্তার সুযোগ মিলল না ওর, শুনতে পেল, কেউ। একজন আসছে বালিয়াড়ি পেরিয়ে। আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। ঢেউয়ে ডুব দিল ইকথিয়ান্ডার। সামান্য দূরে গিয়েই থামল। একটা পাথরের আড়ালে থেকে নজর রাখল সৈকতের দিকে।
বালিয়াড়ি মাড়িয়ে আসতে দেখা গেল কৃষ্ণবর্ণ এক লোককে। নাকের নিচে তার গোঁফ, চিবুকে ছাগলা দাড়ি। মাথায় বড় একটা টুপি। মেয়েটিকে দেখে লোকটি বলে উঠল, মা মেরি! যিশু। এই তো ও! এই তো পেয়েছি!
এবার সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। ঝট করে সাগরে একটা ডুব দিয়ে দেহ ভিজিয়ে নিল। তারপর মেয়েটির কাছে গিয়ে কৃত্রিম ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করল। তার দুচারটে কথা ইকথিয়ান্ডার শুনতে পেল।
…তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম।…এসব কি ধরনের পাগলামো!…কপাল ভাল তক্তার সঙ্গে বেঁধেছিলাম।
মেয়েটি চোখ মেলে তাকাল। সামান্য পরেই উঠে বসল। চেহারা দেখে মনে হলো না লোকটিকে দেখে একটা খুশি হচ্ছে সে। কিন্তু মেয়েটির চেহারার অনুভূতি পড়ার সময় নেই লোকটির, সে উত্তেজিত স্বরে কথা বলে চলেছে। মেয়েটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল একবার। মেয়েটি অতিরিক্ত দুর্বল, দাঁড়াতে পারল না। আরও আধঘণ্টা লাগল তার শক্তি সঞ্চয় করে দাঁড়াতে। যে পাথরের পেছনে ইকথিয়ান্ডার আছে সেটাকে পাশ কাটিয়ে চলল দুজন। মেয়েটি তখন। বলছে:
আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ঈশ্বর আপনাকে পুরস্কৃত করুন।
লোকটি বলল, ঈশ্বর কেন! আপনিই তো আমাকে পুরস্কৃত করতে পারেন।
কথাটায় গুরুত্ব দিল না মেয়েটি, বলল, আমার যেন মনে হলো একটা দানব দেখেছি।
ওটা স্বপ্নের ঘোর ছাড়া আর কিছু নয়, বলল লোকটি। কিম্বা অশরীরীও হতে পারে। হয়তো আপনাকে মরার কাছাকাছি দেখে আত্মা চুরি করতে এসেছিল। ঈশ্বরের নাম নিন। দুর্বল লাগছে? আমার গায়ে হেলান দিন। আমি আপনার কাছে থাকলে কোন ভূত-প্রেতই আপনাকে ছুঁতে পারবে না।
কৃষ্ণবর্ণ ছাগলা দাড়িওয়ালাকে মোটেই ভাল লোক বলে মনে হলো না ইকথিয়ান্ডারের। মিথ্যে বলে মেয়েটিকে প্রভাবিত করতে চাইছে লোকটা। কিন্তু করার কিছু নেই ওর। সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানানো চলবে না। মানুষের সামনে যেতে তাকে নিষেধ করা আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইকথিয়ান্ডার! যা হোক করুক ওরা। তার আর কিছু করার নেই। সে তার দায়িত্ব ঠিক মতোই পালন করেছে।
সাগরটা সুবিশাল আর ফাঁকা লাগছে এখন ওর। আবার বালিয়াড়ির দিকে তাকাল ইকথিয়ান্ডার। কাউকে দেখা গেল না। পাথরের আড়ালে চলে গেছে মেয়েটি আর ছাগলা দাড়িওয়ালা লোকটা।
একটা বিরাট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল সৈকতে। পানি সরে যেতেই ইকথিয়ান্ডার দেখতে পেলএকটা রুপোলি মাছ বালির ওপর ছটফট করছে। চারদিকে একবার দেখে নিল ইকথিয়ান্ডার। কেউ নেই কোথাও। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ও, মাছটাকে তুলে সমুদ্রে ছেড়ে দিল। মাছটা চলে যাওয়ার পর নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হলো ওর। কেন কে জানে! অনেকক্ষণ সৈকতে ঘুরে বেড়াল ও। বালিয়াড়িতে ঢেউয়ের ধাক্কায় যেসব প্রাণী উঠে এসেছে, একটু পর মারা যাবে, সেগুলোকে সে সাগরে ছেড়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ পর মনটা একটু শান্ত হলো ওর। ফিরে এলো স্বাভাবিক ফুর্তি। বাতাসে ওর কানকো শুকিয়ে যাচ্ছে, কাজেই মাঝে মাঝে সাগরে ডুব দিয়ে আসতে হচ্ছে ওকে। মনটা এখন ওর প্রসন্ন।