নিজের ঘরে বসে হিসেবপত্র দেখছে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা, এমন সময়ে ঘরে ঢুকল তার বুড়ি মা। মহিলার মুখে পুরু গোঁফ, অত্যন্ত বিরক্তিকর একটা দৃশ্য। বিশ্রী লাগে তাকে দেখতে। তেমনই তার স্বভাবও বিদঘুটে। অত্যাচারী। ছেলের বউ উিয়ারাকে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। ছেলের ঘরে ঢুকেই বুড়ি বলে উঠল, হ্যাঁ, ওই মেয়ের রূপ আছে ঠিকই, কিন্তু দেখিস, ও নিয়ে ঝামেলাও কম পোহাতে হবে না। তার চেয়ে স্প্যানিশ মেয়ে বিয়ে করলে অনেক ভাল করতি। এমেয়ের রূপের কি গর্ব, বাপরে! হাতের তালু ধরে দেখলাম, নরম তুলতুলে। ওর বাপ কি বসিয়ে খাওয়াত ওকে, জমিদারের মেয়ে? দেখিস, ওকে দিয়ে ঘরসংসারের কোন কাজকর্মই হবে না।
হিসেব থেকে মুখ তুলল পেদরো, মাকে শান্ত করার জন্যে বলল, সব ঠাণ্ডা করে দেবো।
কিছুটা শান্ত হয়ে গজগজ করতে করতে বাগানে গেল বুড়ি। আজ জ্যোত্সা রাত। বাগান মৌ-মৌ করছে ফুলের সুবাসে। একটা বেঞ্চে বসে সংসারের চিন্তায় ডুবে গেল বুড়ি। পাশের বাগানটা তার কেনাই চাই। সেখানে কয়েকটা চালাঘর তুলবে সে। সেই চালাঘরগুলোতে মিহি লোমের ভেড়া রাখবে।
কুটকুট কুট! কুট!
ঠাস!! ঠাস!
এদের জ্বালায় একটু যদি শান্তি পেতাম। গজ গজ করে উঠল বুড়ি। মশা মারতে গিয়ে নিজের গালেই দুটো চাপড় বসিয়েছে সে। মাথাটা ঘুরে গেছে। সেজন্যেই কিনা কে জানে, হঠাৎ তার চোখে পড়ল ব্যাপারটা। পাথরের পাঁচিলের ওপরে ওটা যেন কার মাথা! কে যেন হাতকড়া পরা দুটো হাত সামনে নিয়ে লাফ দিয়ে দেয়ালের এপারে চলে এলো।
সাঙ্ঘাতিক ভয় পেল বুড়ি। নির্ঘাত কোন জেল পালানো বদমাশ। কয়েদী। ছুটে গেছে। ঢুকেছে এসে এখানে। চিকার করতে চেষ্টা করল বুড়ি। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। পালাতে চেষ্টা করল। ভয়ে তার শরীর নড়ল না। পা দুটো যেন আর কারও বেঞ্চে বসেই লোকটা কি করে দেখতে বাধ্য হলো বুড়ি। বড় বড় তার চোখ পুরুষমানুষ হলে হয়তো গোঁফে তা দিয়ে কোন না কোন সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করত। গোঁফ আছে বুড়ির, কিন্তু তা দেয়া বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।
সে যাই হোক, লোকটা এগিয়ে গেল বাড়ির জানালার কাছে। জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিল ভেতরে। আস্তে আস্তে ডাকছে।
গুট্টিয়ারা! গুট্টিয়ারা?
ডাকটা কানে যাওয়া মাত্র সাহস ফিরে এলো বুড়ির। সুন্দরী বউ সম্বন্ধে যেসব নোংরা সন্দেহ তার মনে এসেছিল সেসব যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। মনে মনে সে বলল, আচ্ছা! এই হচ্ছে রূপসী বউয়ের
কীর্তি! জেল পালানো বদমাশের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক? দাঁড়াও, বারোটা যদি আমি না বাজিয়েছি।
বাড়ির দিকে ছুট দিল বুড়ি। ছেলের উদ্দেশে মোটা গলায় হাঁক ছাড়ল, পেদারা রে, বাগানে একটা চোর ছুঁকেছে। তোর বউকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি আয়, কই গেলি!
ঘরদোর পুড়ে ছারখার হলো বুবি,এমন ভাবে বাগানের দিকে ছুটে গেল পেদরো জুরিতা। বাগানে একটা বেলচা পড়ে ছিল। পথে ওটা তুলে নিল।
লোকটা তখনও জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, ডাকছে, গুট্টিয়ারা! গুট্টিয়ারা!
গায়ের জোরে লোকটার মাথার ওপর বেলচা নামিয়ে আনল পেদরো। দাঁতে দাঁত চেপে হিসিয়ে উঠল, হারামজাদা! মানুষের বউয়ের সঙ্গে পিটিস পিটিস?
দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল জানালায় দাঁড়ানো লোকটা। আঘাতটা এত জোরে আর আচমকা পড়েছে তার মাথায় যে মুখ দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করারও সুযোগ হয়নি তার!
বড় করে শ্বাস ফেলল পেদরো বলল, শালা শেষ!
মেরে ফেলেছিস? আঁতকে উঠল বুড়ি।
পেদরো জুরিতা ভাবতে পারেনি ঘটনা এভাবে এতদূর গড়াবে। বিচলিত হয়ে পড়ল সে। মাকে সামনে দেখে তার কাছেই বুদ্ধি চাইল, কি করি এখন লাশটা নিয়ে?
দিঘিতে তৈরি জবাব দিল বুড়ি। ছেলের বিপদ তার মাথা খুলে দিয়েছে।
ভেসে উঠলে?
একটু দাঁড়া, ওটার পায়ে পাথর বেঁধে দিচ্ছি।
বাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকল বুড়ি। লাশ ঢোকার মতো বড় বস্তা না পেয়ে শেষে একটা বালিশের ওয়াড় আর দড়ি সঙ্গে নিয়ে ফিরল। এদিকে কয়েদীর লাশ নিয়ে দিঘির পাড়ে চলে এসেছে পেদরো। মায়ের কাছ থেকে ওয়াড়টা নিল সে, কয়েকটা ওজনদার পাথর ভেতরে পুরে ওটা কয়েদীর পায়ের সঙ্গে বেঁধে লাশটা দিঘিফেলে দিল।
আকাশের দিকে একবার তাকাল পেরা। মেঘ জমেছে। আকাশে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। একটু পু্রেই বোধহয় বৃষ্টি নামবে। ভাল। ঘাসের ওপর থেকে রক্তের দাগ মুছে যাবে। পরনের পোশাকের দিকে চাইল। এটা বদলে ফেলতে হবে। গায়ে রক্তের ছিটে লেগে আছে। গুট্টিয়ারার কথা মনে আসতেই দাঁত কিড়মিড় করল পেদরো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, হারামজাদী, হারামির বাচ্চি।
এবার দেখ কেমন মানুষ তোর সুন্দরী বউ, তাকে আরও উস্কে দিল বুড়ি।
বাড়ির চিলেকোঠায় গুট্টিয়ারার থাকার ঘর দেয়া হয়েছে। রাতে তার ঘুম আসে না। ভ্যাপসা গরম, হাজার হাজার মশা আর মাথার ভেতর শত শত দুশ্চিন্তার মাঝে রাত জাগে ও ইকথিয়ান্ডারের সেই আত্মহত্যা আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ও! ফলে স্বামীকে ও ভালবাসতে পারেনি। আর শাশুড়ির ব্যবহারের কথা না বললেও চলে।
আজ রাতে তার একবার মনে হয়েছিল ইকথিয়ান্ডারের গলা শুনতে পেয়েছে। তার নাম ধরে যেন ডাকছিল ইকথিয়ান্ডার। তার একটু পরই বাগানের ভেতর হুটোপুটির স্লাওয়াজ হলো। কে যেন চাপা স্বরে কি বলল।
উত্তেজিত লাগছে, আজ রাতে আর ঘুম আসবে না, কাজেই বাগানে চলে এলো গুট্টিয়ারা মন শান্ত করতে।
ভোর প্রায় হয়ে এসেছে। বাগানটা যেন ঝিম মেরে আছে। কেটে গেছে মেঘ আকাশ খালি করে। বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত হয়নি। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল গুট্টিয়ারার।
বাগানের মাটিতে রক্তের দাগ!
ঘাসের ওপর একটা রক্তমাখা বেলচাও পড়ে আছে।
রাতে নিশ্চই এখানে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে গেছে!
রক্তের দাগ অনুসরণ করে দিঘির পাড়ে চলে এলো কৌতূহলী গুট্টিয়ারা। বুঝতে পারছে এখন, খুন করে লাশটা নিশ্চই দিঘির ভেতর ফেলে দেয়া হয়েছে। সবুজ জলাধারের দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকল গুট্টিয়ার।
ও কি ভুল দেখছে চোখে?
মনে হচ্ছে দিঘির ভেতর থেকে তারই দিকে চেয়ে আছে ইকথিয়ান্ডার! এও কি সম্ভব? পানির নিচে থেকে ইকথিয়ান্ডার তাকে দেখছে? পাগল তো হয়ে যাচ্ছে না ও? চোখ কি তাহলে ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে?
ধীরে ধীরে পানির ওপরে উঠে এলো ইকথিয়ান্ডারের মুখ। হাতে হাতকড়া, উঠে এলো ও দিঘির পাড়ে, হাত দুটো যতটা সম্ভব প্রসারিত করে আবেগ জড়িত গলায় ডাকল, গুট্টিয়ারা!
আতঙ্কে কেঁপে উঠল গুট্টিয়ারা। ফিসফিস করে বলল, তুমি! কিন্তু তুমি তো মারা গেছ! কেন এসেছ তুমি? অশরীরী হয়ে আমাকে ভয় দেখাতে? না, না, তুমি চলে যাও; চলে যাও, ইকথিয়ান্ডার!
আমি মরিনি, গুট্টিয়ারা। শোনো, গুট্টিয়ারা! পালিয়ে যেয়ো না। সবই তো জানো, চেনো আমাকে, কিন্তু একটা কথা তোমাকে কখনও বলা হয়নি। গুট্টিয়ারার বিস্ময় লক্ষ করে ব্যাখ্যা করল ইকথিয়ান্ডার। আমি বেঁচে আছি, গুট্টিয়ারা। পানির নিচেও আমি বাঁচতে পারি। আর সব মানুষের মতো নই আমি। পানির নিচে ইচ্ছে করলে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। সেদিন সাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম কারণ ওপরে বাতাসে আর থাকতে পারছিলাম না, অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। বলতে বলতে ধরে এলো ইকথিয়ান্ডারের গলা। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। কাল রাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকছিলাম। তোমার স্বামী পেছন থেকে এসে আমাকে আঘাত করে। জ্ঞান হারাই আমি। সে আমার হাত-পা বেধে দিঘিতে ফেলি য়ে। থলেতে পাথর ভরে সেটা আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল। সেসব খুলে ফেলেছি, কিন্তু হাতকড়াটা কিছুতেই খুলতে পারছি না। হাত তুলে হাতকড়াটা দেখাল সে।
গুট্টিয়ারা নিরবে দাঁড়িয়ে আছে। এখন ওর বিশ্বাস হচ্ছে ইকথিয়ান্ডার মারা যায়নি। জিজ্ঞেস করল, হাতকড়া কেন তোমার হাতে?
পরে তোমাকে সব খুলে বলব, জবাবে বলল ইকথিয়ান্ডার। গলায় তাগাদার সুর। এখন চলো, পালিয়ে যাই আমরা। আমার বাবার বাড়িতে তুমি আর আমি থাকব। সেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। অলসেনের মুখে জানলাম সবাই নাকি আমাকে সাগর-দানো নামে চেনে। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করো, গুট্টিয়ারা, আমি আসলে মানুষ ছাড়া আর কিছু নই।
ক্লান্তি বোধ করছে, ঘাসের ওপর বসে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। কাছে এগিয়ে এলো গুট্টিয়ারা, ওর মাথায় আলতো করে হাত রাখল। কোমল স্বরে বলল, সত্যি, অনেক কষ্ট তোমার মনে, ইকথিয়ান্ডার!
হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো পেদরো জুরিতোর টিটকারি মেশানো কণ্ঠস্বর। বাহ, বাহ্, ভালই জমেছে দেখছি! প্রেম!
কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। ওদের আলাপ শুনেছে। জেনে গেছে, যাকে এতদিন খুঁজেছে সেই সাগর-দানো এখন ওর আওতার ভেতর। বন্দি করলেই হয় এখন। মনের খুশি মনেই চেপে বিদ্রুপ মেশানো স্বরে সে বলল, তোমার বাবার বাড়িতে গুট্টিয়ারাকে নিয়ে যাবে? আরে বাপু, তুমি নিজেও তো ওখানে কোনদিন ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ।
কেন? জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার শান্ত গলায়। আমি তো অপরাধ করিনি!
তা বলতে পারবে পুলিশ। অপরাধ না করলে পুলিশের হাতকড়া তোমার হাতে কেন? এখন আমার উচিত পুলিশের হাতে তোমাকে তুলে দেয়া।
ওকে তুমি পুলিশে দেবে? ভয় মেশানো স্বরে জিজ্ঞেস করল গুট্টিয়ারা।
সেটাই উচিত, কঠোর চেহারায় বলল পেদরো জুরিতা।
সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ করতে এসময়ে সেখানে হাজির হলো বুড়ি ডলোরেস। এসেই তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠল। স্বামীকে অনুরোধ করছে গুট্টিয়ারা কাতর হয়ে যাও
ওকে তুমি ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও ঈশ্বরের শপথ, আমার কোন ক্ষতি ও করেনি কখনও।.
খনখনে গলায় বলে উঠল বুড়ি, খবরদার, ওর কথা শুনবি না, পেদরো। যে বউ কয়েদির সঙ্গে সম্পর্ক রাখে সে কেমন চরিত্রের মেয়েলোক সেটা বুঝতে আমার আর বাকি নেই।।
হঠাৎ করেই আচরণ বদলে গেল পেদরোর। নরম গলায় মাকে বলল, কি করব, বলো, মা। মেয়েরা অনুরোধ করলে সে অনুরোধ আমি না রেখে পারি না।
গজগজ করে উঠল বুড়ি ডালোরেস। বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের পায়ের তলায় চলে গেছিস দেখছি!
মাকে আশ্বস্ত করতে হাসল পেদরো জুরিতা। কর্তব্যপরায়ণতার চূড়ান্ত দেখাচ্ছে এমন স্বরে বলল, একটু অপেক্ষা করো, মা। একটু অপেক্ষা করো। দেখোই না কি হয়। ওর হাতকড়া আমি কেটে দেব, তারপর ভাল পোশাক পরিয়ে ধরে নিয়ে যাব আমার জাহাজে। গোঁফে তা দিল সে। মায়ের চেয়ে তার গোফ খানিক পুরু। স্ত্রীর উদ্দেশে বলল, কি, সেটাই ভাল হবে, তাই না?
গুট্টিয়ারার মনে হলো পেদরোকে সে যতটা খারাপ লোক বলে মনে করেছিল আসলে সে হয়তো ততটা খারাপ লোক নয়। কৃতজ্ঞতাবোধে অন্তর ছেয়ে গেল ওর।
কিন্তু বুড়ি ডলোরেস ছেলেকে ভাল করেই জানে। বুঝতে তার দেরি হলো না, ছেলে তলায় তলায় কোন একটা মতলব ভঁজছে। তবুও বুড়ি বউকে শুনিয়ে গজগজ করতে ছাড়ল না। একেবারে গেছিস তুই, গেদরো। একেবারে বউয়ের পায়ের তলায় চলে গেছিস।