ক্রিস্টোর মনে আশা জেগেছিল, সে যা করেছে তাতে করে ওকে একেবারে বুকে টেনে নেবেন ডাক্তার সালভাদর বলবেন তাঁর সমস্ত রহস্য। হয়তো এটাও বলতে পারেন যে এসো, ক্রিস্টো, তোমাকে আমার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারটা দেখাই। আমার সাগর-দানো দেখে তাজ্জব হয়ে যাবে।
কিন্তু ক্রিস্টোর আশা পূরণ হলো না। বিপদ থেকে উদ্ধার করার কারণে ক্রিস্টোকে চাহিদার বেশি পুরস্কার দিলেন তিনি। এরপর ডুবে। গেলেন গবেষণার কাজে। সাগর-দানবের প্রসঙ্গ আর উঠলোই না।
এভাবে হবে না বুঝে মরিয়া হয়ে উঠল ক্রিস্টো। গোপনে সে চতুর্থ দেয়াল আর গোপন দরজা সময় সুযোগ মতো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। শিগগিরই রহস্য আর রহস্য থাকল না। দরজার গায়ে হাত বুলাতে গিয়ে উঁচ কি একটা যেন তার হাতে বাধল। জিনিসটাতে চাপ পড়তেই নিজে থেকে খুলে গেল দরজা। ব্যাঙ্কের ভল্টের মতো। মজবুত আর ভারী সেই দরজা। একার সাহায্যে খোলা মুশকিল হতো। যাই হোক, কৌতূহলবশত ক্রিস্টো ঢুকে পড়ল দরজা দিয়ে। সে মাত্র ঢুকেছে, অমনি পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। ভয় ধরে গেল ক্রিস্টোর প্রাণে। পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করল আর কোন বোতাম দিয়ে দরজাটা আবার খোলা যায় কিনা। বারবার খুঁজল, কিন্তু তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না। খুলল না অনড় দরজা। ক্রিস্টো স্বগতোক্তি করল, ফাঁদে পড়ে গেলাম নিজের দোষে।
করার কিছু নেই এখন। মনটাকেও ব্যস্ত রাখা দরকার, নইলে ভয়। দূর করা যাবে না। কাজেই ভেতরের বাগানে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল ক্রিস্টো। এখানে ফল-ফুলের গাছের চেয়ে ঝোপঝাড়ই যেন বেশি। বোঝা যায় যত্ন নেয়া হয় না তেমন বাগানটার। পুরোটা একটা দেয়াল ঘেরা গর্তের মতো। দেয়াল তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম পাহাড় প্রাচীর দিয়ে। পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। পাথুরে বেলাভূমিতে ঢেউয়ের বাড়িতে ছিটকে এসে লাগা নুড়ি পাথরের খটমটর আওয়াজটাও পাওয়া যাচ্ছে।
গাছপালা বাগানে যা আছে সব নোনা মাটিতে জন্মে তেমন। প্রকাণ্ড সব গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় সূর্যের আলো চুরি করে এসে পড়েছে মাটিতে। বাগানে চারধারে অন্তত বারোটা ফোয়ারা আছে। কাজ করছে প্রত্যেকটা শীতল জলের কণার কারণে এখানে বাতাসও ঠাণ্ডা। মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আর পরিবেশটা একেবারেই মিলে যাচ্ছে মিসিসিপির অববাহিকার সঙ্গে। বাগানের ঠিক মাঝখানে আছে সমতল ছাদের একটা পাথরের বাড়ি। তার চারধারের নিচু দেয়ালগুলো আগাছায় প্রায় ঢাকা পড়েছে। বাড়ির সবুজ রঙের কাঠের দরজা সবগুলোই বন্ধ। কেন কে জানে, ক্রিস্টোর মনে হলো এই বাড়িতে কেউ না কেউ থাকে। পুরোটা বাগান চষে বেড়াল সে। বাগান আর সাগরু খড়ির মাঝখানে সে দেখতে পেল একটা চৌকো পুকুর। আয়তনে পঞ্চাশ বর্গমিটার হবে। পানির গভীরতা অন্তত পাঁচ। মিটার। পুকুরের পাড় ঘিরে গাছ লাগানো হয়েছে। ওগুলো ছায়া দিচ্ছে পুকুরে।
ক্রিস্টো পুকুরের কাছাকাছি আসতেই কি যেন একটা প্রাণী ঝপ করে পানিতে নেমে গেল। কি না কি হয় ভেবে থমকে দাঁড়াল সতর্ক ক্রিস্টো। মনে একটাই চিন্তা: ওটাই বোধহয় সাগর-দানো। শেষ পর্যন্ত তাহলে ওটার দেখা পাওয়া গেল!
পুকুর পাড়ে এসে পানির নিচে তাকাল ক্রিস্টো। একদম কাচের মতো পরিষ্কার পানি। তলা পর্যন্ত দেখা যায়। দেখল একটা ডুবন্ত সাদা পাথরের ওপর চুপ করে বসে আছে একটা বড়সড় সাদা বাঁদর। চোখে ভয় আর কৌতূহল নিয়ে ক্রিস্টোকেই দেখছে। বিস্মিত না হয়ে পারল।
ক্রিস্টো। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পানির নিচে শ্বাস নিচ্ছে ওটা। শ্বাসের তালে তালে ওঠানামা করছে প্রশস্ত বুক।
হাসি পেল ক্রিস্টোর। ভাবছে, যে দানোর ভয়ে সবাই তটস্থ সে কিনা আসলে একটা বাঁদর! তবে এটা একটা অদ্ভুত বাঁদর। পানির ওপরে নিচে দুজায়গাতেই শ্বাস নিতে পারে।
প্রায় পুরো বাগান ক্রিস্টোর দেখা হয়ে গিয়েছে। উভচর বাঁদরটাকে দেখে তার বেশ হতাশ লাগছে। ভেবেছিল উত্তেজনাময় একটা কিছু আবিষ্কার করবে, আর করল আবিষ্কার একটা নিরীহ ভীতু বাঁদর। আসলে বাঁদরটার ব্যাপারে লোকের মুখে মুখে মিথ্যে বদনাম ছড়িয়েছে। সাধারণ এক বাঁদরকে কোরাকি বানিয়ে ছেড়েছে। অজানাকে ভয় পায় বলেই মানুষ কাল্পনিক দানব বানায়।
ক্রিস্টোর মাথায় ফেরার চিন্তা এলো। হাজারো চেষ্টা করল সে, কিন্তু দরজা আর খুলল না। বাধ্য হয়ে প্রাচীরের পাশের একটা বড়, গাছে উঠল সে, তারপর পা ভাঙার ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল প্রাচীরের ওপারে।
মাটি ছেড়ে সে তখনও ওঠেনি আত্মাটা লাফ দিল তার ডাক্তার সালভাদরের গলা শুনে।
ক্রিস্টো! ক্রিস্টো। তুমি কোথায়?
হাতের কাছে পাতা সরাবার একটা আঁচড়া পেয়ে চট করে ওটা তুলে নিল বুদ্ধিমান ক্রিস্টো। পাতা সরাতে সরাতে জবাব দিল, এই তো, আমি এখানে, ডাক্তার সাহেব।
ক্রিস্টোকে নিয়ে সেই গোপন দরজার সামনে থামলেন ডাক্তার। ফোলা জায়গাটায় চাপ দিয়ে দরজা খুলে বললেন, এই দরজা এভাবেই খোলে, বুঝলে?
ক্রিস্টো মনে মনে বলল, দেখাতে একটু দেরি করে ফেলেছেন। এই দানব আমার আগেই দেখা সারা।
ক্রিস্টোকে নিয়ে বাগানে ঢুকলেন সালভাদর। পাথুরে বাড়িটা ছাড়িয়ে চলে এলেন সেই পুকুরের কাছে। বাঁদরটা তখনও পানির তলাতেই বসে আছে। তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে পানির ওপর বুদ্বুদ উঠে আসছে। ক্রিস্টো ভান করল যেন সে এই মাত্র আশ্চর্য এই ব্যাপারটা দেখেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে সত্যি সত্যি অবাক হতে হলো।
বাঁদরকে হাতের ইশারা করলেন ডাক্তার সালভাদর। উঠে এলো বাঁদরটা, গা ঝাড়া দিয়ে পানি ঝেড়ে একটা গাছের ওপর চড়ে বসল। সালভাদর উৰু হলেন। ঘাসের মধ্যে লুকানো একটা সবুজ রঙের লোহার পাতে হাতের চাপ দিলেন। চাপা একটা হলো পুকুরের পানি কয়েকটা সুইস গেট দিয়ে হড়হড় করে বেরিয়ে গেল। এবার দেখা গেল একটা লোহার সিঁড়ি। পুকুরের তলা পর্যন্ত নেমে গেছে। ওটা।
এসে, ক্রিস্টো, ডাকলেন সালভাদর।
পুকুরের নিচে নামল ওরা দুজন। এবার আরেকটা লোহার পাতে চাপ দিলেন ডাক্তার। রহস্যের যেন কোন শেষ নেই। পুকুরের মাঝখানে খুলে গেল লোহার আরেকটা চৌকো দরজা। দেখা গেল সেখান থেকেও সিঁড়ি নেমেছে। এবার ওটা গেছে পাতালে।
ডাক্তারের পিছু পিছু সাবধানে নামতে শুরু করল ক্রিস্টো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামল। ওপরের দরজা দিয়ে যে সূর্যের আলো আসছিল এখানে সেই আলো পৌঁছোয়নি। চারদিকে কালিগোলা জমাট অন্ধকার। চোখের সামনে হাত নিলেও দেখা যায় না। এগিয়ে যাচ্ছেন সালভাদর। পেছনে ক্রিস্টো। গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদের জুতোর শব্দ। সাবধান, ক্রিস্টো, গম্ভীর গলায় সতর্ক করলেন ডাক্তার। হুমড়ি খেয়ে পোড়ে না। আমরা প্রায় এসে গেছি।
থেমে দাঁড়িয়ে একদিকের দেয়ালের গায়ে একটা সুইচ টিপলেন। সালভাদর। ইলেক্ট্রিক বালবের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হলো গুহা। ক্রিস্টো দেখল তারা উপস্থিত হয়েছে লাইম স্টোনের একটা সুড়ঙ্গের
মধ্যে। সুড়ঙ্গের সামনে একটা ব্রোঞ্জের দরজা দেখা গেল। দরজার পিতলের তৈরি সিংহের মুখ থেকে একটা কড়া ঝুলছে। ওটা ধরে টান দিলেন সালভাদর। সহজেই খুলে গেল ভারী ব্রোঞ্জের পাল্লা। ক্রিস্টোকে নিয়ে অন্ধকার একটা হলঘরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার।
সুইচ কোথায় তা তার নখদর্পণে। আবার একটা সুইচ টিপলেন। গোলাকার একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠল হলঘরে। ক্রিস্টো দেখল ঘরের একদিকের দেয়াল সম্পূর্ণ কাঁচ দিয়ে তৈরি।
আরেকটা সুইচ টিপলেন ডাক্তার। হলঘরের ভেতর অন্ধকার নামল, কিন্তু কাঁচের ওপাশটা দেখা গেল উজ্জ্বল একটা সার্চ লাইটের আলোয়। দেখে মনে হলো কাঁচের ওপারে এটা বুঝি বিশাল একটা আঁকুইরিয়াম। অথবা সমুদ্রের নিচের একটা কাচের বাড়িও বলা যায় ওটাকে। মাটিতে জন্মেছে অজস্র সামুদ্রিক উদ্ভিদ। প্রবালের স্তৃপও আছে। ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে অগুনতি ছোট মাছেরা। হঠাৎ ক্রিস্টো দেখল একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষের মতো। একটা প্রাণী। চোখ দুটো তার দেখার মতো। মনে হয় দুটো কাচের গ্লাস বসিয়ে দেয়া হয়েছে চোখের বদলে। পায়ের পাতগুলো একদম ব্যাঙের পায়ের মতো। গায়ে তার নীলচে-রুপোলি আঁশ। কাঁচের। দেয়ালের কাছে চলে এলো প্রাণীটা সাঁতরে। একবার মাথার ইশারা করল ডাক্তারকে, তারপর দরজা খুলে অন্য একটা কক্ষে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল আবার। হিসহিস করে বেরিয়ে গেল সেই কক্ষের সমস্ত পানি। অন্য একটা দরজা খুলে হলঘরে এসে দাঁড়াল সাগর-দানো!
চশমা আর গ্লাভস্ খুলে ফেলো, নির্দেশ দিলেন ডাক্তার।
নির্দেশ পালন করল প্রাণীটা। গগলস্ আর দস্তানা খুলতেই বিস্মিত ক্রিস্টো দেখল তার সামনে দাঁড়ানো সাগর-দানো আসলে সুদর্শন এক সুঠামদেহী তরুণ।
এ হচ্ছে, ক্রিস্টো, ইকথিয়ান্ডার। যাকে লোকে নানা নাম দিয়েছে। কারও কাছে ও সাগর-দানো, কারও কাছে মৎস্য-মানব আবার কারও কাছে উভচর-মানব।…আর এ হচ্ছে আমার সহকর্মী, ক্রিস্টো।
আন্তরিক হেসে ক্রিস্টোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তরুণ। ক্রিস্টোও হাত বাড়াল, কিন্তু তার বিস্ময় এখনও কাটেনি। সাগর
দানোকে স্প্যানিশ ভাষা বুঝতে দেখে ওর মাথা গরম হয়ে উঠছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ইকথিয়ান্ডারের নিগ্রো কাজের মানুষটার অসুখ হয়েছে। আগামী কয়েক দিন তার বদলে তুমিই এখানে ওর কাজ করবে, ক্রিস্টো। কাজে যদি সন্তুষ্ট করতে পারো তাহলে এখানেই তোমাকে রেখে দেয়া যাবে।
নিরবে মাথা দোলাল ক্রিস্টো।