ডাকাতদের পাল্লায় পড়ার পরও ডাক্তার সালভাদর তার আন্দেজ পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করেননি। তবে পরিকল্পনায় সামান্য পরিবর্তন এনেছেন তিনি। ঠিক করেছেন ক্রিস্টোকে বাড়িতেই রেখে যাবেন। ইতিমধ্যে ইকথিয়ান্ডারের চাকর হিসেবে বেশ ভাল দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে ক্রিস্টো। ডাক্তারের কথা শুনে সে-ও পুব খুশি। সালভাদর না থাকলে তো খুবই ভাল হয়। এবার নিয়মিত বালথাযারের সঙ্গে দেখা করতে আর কোন বাধা থাকবে না। বালুখার্যারকে জানানো হয়ে গেছে যে সাগর-দানোর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন ঠিক মতো তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।
লতাপাতা জড়ানো ইকথিয়ান্ডারের বাড়িতে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হয় ক্রিস্টোর। দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। একাকী ইকথিয়ান্ডার খুব সহজেই ভালবেসে ফেলেছে ক্রিস্টোকে। তার কাছে ও শোনে পৃথিবীর কথা, মানুষের কথা, জীবনের কথা। বিনিময়ে ক্রিস্টোকেও সাগর-তলের গল্প বলে ও। সমুদ্রের এমন সব রহস্য ইকথিয়ান্ডার জানে যেগুলো কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেও জানা সম্ভব নয়। কোথায় কি আছে সাগরের তলায় তা ওর নখদর্পণে। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রাথমিক জ্ঞানও তার যথেষ্ট। নৌবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা বা পদার্থ বিজ্ঞান সম্বন্ধে বেশ ভালই জানা আছে ওর। কিন্তু অভাব হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানের। সেই ঘাটতিই ও ক্রিস্টোর কাছ থেকে পুষিয়ে নিতে চায়। ইতিহাস সম্বন্ধেও তার তেমন কোন ধারণা নেই। রাজনীতি আর অর্থনীতি সম্বন্ধেও তার জ্ঞান একেবারেই নেই।
দিনের বেলা যখন খুব গরম পড়ে, পানির নিচের সুড়ঙ্গ পথে। কোথাও না কোথাও শীতল পানিতে ভেসে যায় ইকথিয়ান্ডার। গরম কমলে ফিরে আসে। তখন সকাল পর্যন্ত সাদা বাড়িটাই থাকে। যদি বৃষ্টি হয় বা ঝড় ওঠে তাহলেও অবশ্য সে বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ সময়। মাটির ওপরের এই ভেজা পরিবেশ ওর একেবারে খারাপ লাগে না।
ইকথিয়ান্ডারের বাড়িটা খুব একটা বড় নয়। চারটে মাত্র ঘর। রান্নাঘরের কাছাকাছি নিজের জায়গা বেছেছে ক্রিস্টো। তার পাশেই ডাইনিং রূম। তারপর বিরাট একটা লাইব্রেরি। প্রচুর বই তাতে। ইংরেজি আর স্প্যানিশ, এই দুটো ভাষার ওপরই ভাল দখল আছে ইকথিয়ান্ডারের। লাইব্রেরির পর যে বড় ঘরটা আছে সেটাই ইকথিয়ান্ডারের শোবার ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা বাথটাবের মতো জলাধার আছে। খাট আছে দেয়ালের গায়ে লাগানো অবস্থায়। অবশ্য ঘুমাবার সময় খাটের তুলনায় জলাধারটাকেই বেশি পছন্দ ইকখিয়াল্ডারের।
এবার আন্দেজ পাহাড়ে যাবার আগে ডাক্তার সালভাদর ক্রিস্টোকে বলে গেছেন যাতে সে খেয়াল রাখে যে ইকথিয়ান্ডার যেন সপ্তাহে অন্তত তিনদিন খাটে ঘুমায়। সেটা নিশ্চিত করতে প্রতিদিন সন্ধেতে ইকথিয়ান্ডারের সামনে হাজির হতে হয় ক্রিস্টোকে। ইকথিয়ান্ডার খাটে শুতে না চাইলে জোর করে সে। অনুরোধ করে। প্রয়োজনে হুমকিও দেয়।
কিন্তু পানির তলায় ঘুমাতে আমার ভাল লাগে, ক্রিস্টো, প্রায়ই আপত্তি আর অনুযোগ জানায় ইকথিয়ান্ডার।
জবাবে ধমক দেয় ক্রিস্টো। ডাক্তার সাহেবের হুকুম, তোমাকে খাটেই শুতে হবে। তাঁর কথা শোনা উচিত। তারপর গলা নরম করে বলল। এসো তো, লক্ষ্মী ছেলের মতো শুয়ে পড়ো দেখি।
ডাক্তার সালভাদরকে ইকথিয়ান্ডার বাবা বলে ডাকে। কিন্তু। আসলেই তারা বাবা-ছেলে কিনা সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে ক্রিস্টোর। ইকথিয়ান্ডার ডাক্তার সালভাদরের চেয়ে অনেক ফর্সা। হতে পারে সেটা দীর্ঘ কাল পানির নিচে থাকার ফল। কিন্তু চেহারাতেও কোন মিল নেই ওর ডাক্তারের সঙ্গে। ইকথিয়ান্ডারের মুখের গড়ন ডিম্বাকৃতি, নাকটা খাড়া আর দীর্ঘ, ঠোঁট দুটো পাতলা, দুচোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। ও যেন আসলে আরাউকানি ইন্ডিয়ান! ক্রিস্টো নিজেও আরাউকানি, কাজেই ইকথিয়ান্ডারের চেহারার বৈশিষ্ট্য তার চোখে সহজেই ধরা পড়েছে। নানা সন্দেহের দোলায় দোলে ক্রিস্টোর মন।
বারবার মনে হয় যদি ইকথিয়ান্ডারের গায়ের রং দেখা যেত। তা আর হয়ে ওঠে না। একটা আঁশ সমৃদ্ধ পোশাক মতো পরে থাকে ইকথিয়ান্ডার সর্বক্ষণ। সারা দেহ আবৃত পোশাকটায়। কিছু বোঝার উপায় নেই যে আসলে উভচর মানুষটা কি বর্ণের। এ
ইকথিয়ান্ডারকে জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো, রাতেও ঘুমাবার সময় তুমি এই পোশাক খোলো না?
জবাবে ইকথিয়ান্ডার বলল, দরকার কি খোলার। আঁশের এই অবরণে আমার ভাল লাগে, আরাম পাই। কানকো দিয়ে নিঃশ্বাস নিতেও অসুবিধে হয় না। তাছাড়া আঁশগুলো অনেকটা বর্মের কাজ করে। হাঙরের দাঁত বা ছুরির মতো ধারাল কিছু এটা কাটতে পারে না।
গগল্স্ আর গ্লাভস্ কিসের জন্যে?
গ্লাভস পরলে দ্রুত সাঁতার কাটা যায়। আর সাগরের ঝড় তুফানে পানিতে বালির পরিমাণ বেড়ে গেলে গগলস্ আমার চোখ বাঁচায়। এটার আরও কাজ আছে। এটা পরলে আমি ভাল দেখতে পাই, না পরলেই সব ঝাঁপসা।
ক্রিস্টোকে বিশ্বাস করে ইকথিয়ান্ডার, কাজেই সব কথা বলে। খোলা মনে।
স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলল, ছোট ছিলাম যখন, বাবা আমাকে পাশের বাগানে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতে পাঠাতেন। গ্লাভস ছাড়া ওরা কিভাবে সাঁতার কাটে দেখে আমি অবাক হতাম। গ্লাভূসের কথা ওদের আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম, কিন্তু আমার কথা ওরা বুঝতেই পারেনি। গ্লাস্ কি সেটা ওরা জানত না। তারপর আর কখনও আমি ওদের সামনে সাঁতার কাটিনি।
সাগরের সেই খাঁড়িটায় তুমি কি এখনও সাঁতার কাটো? কৌশলে জানতে চাইল ক্রিস্টো। মতলব হাসিলের ফন্দি আঁটছে।
কাটি, জবাবে বলল ইকথিয়ান্ডার, তবে সুড়ঙ্গের কাছ থেকে বেশি দূর যাই না। একবার তো কারা যেন জাল দিয়ে আমাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল। সেই থেকে আমি সাবধান হয়ে চলাফেরা করি।
ক্রিস্টো মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছে। জানতে চাইল, তাহলে সাগরের নিচে একটা সুড়ঙ্গও আছে?
একটা নয়, অনেকগুলো আছে। ভাবতে আমার খারাপ লাগছে যে তুমি আমার সঙ্গে সাগরের তলায় ডুব দিয়ে আশ্চর্য সব জিনিস দেখতে পারবে না। জানো, কত কি আছে সাগর-তলায় আচ্ছা, ক্রিস্টো, তোমরা পানির নিচে থাকতে পারো না কেন?আহা, যদি পারতে তাহলে তোমাকে লিডিঙের পিঠে চড়িয়ে কত জায়গা যে ঘুরিয়ে আনতে পারতাম!
লিডিং! লিডিংটা কে?
আমার পোশ ডলফিন। এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছি যে ধরে নাও ও আমার পানির ঘোড়া। খুব সুন্দর সাঁতার কাটে। একবার বিরাট এক বিপদে পড়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় ডাঙায় উঠে পড়েছিল। অনেক কষ্টে ওকে আবার পানিতে নামাতে পারি। ডাঙায় যেন ওর ওজন বেড়ে গিয়েছিল। ডাঙায় নিজেকেও আমার ভারী বলে মনে হয়। যাই হোক, মাস খানেক নিয়মিত খাইয়ে লিডিংকে আমি সুস্থ করে তুললাম। সেকারণেই ও আমার সাঙ্তিক ভক্ত। অবশ্য সাগরের সব ডলফিনের সঙ্গেই আমার খাতির আছে। ওদের সঙ্গে খেলতে দারুণ মজা! জাননা, ক্রিস্টো, আমার কিন্তু অনেক মাছ বন্ধুও আছে। আমি যখন সাগরে সাঁতার দিই তখন তারা ঝাক বেঁধে আমার পেছনে ছোটে।
আচ্ছা, সাগরে তোমার কোন শত্রু নেই? জানতে চাইল ক্রিস্টো। সব সময় শুধু নিজের উদ্দেশ্য পূরণের পথ খুঁজে চলেছে ওর মগজ। জানতে চায় সমস্ত রহস্য।
হ্যাঁ, তা আছে। হাঙর আছে। অক্টোপাস আছে। তবে ওদের আমি ভয় পাই না। সঙ্গে সবসময় ছোরা রাখি আমি।
কিন্তু ওরা যদি তোমাকে পেছন থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে, তখন?
অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। কি যে বলো! আমি তো অনেক আগেই ওদের আসার আওয়াজ টের পেয়ে যাই। শুধু কি কান, আমি তো সারা শরীর দিয়ে শুনতে পাই, বুঝতে পারি। যে-ই সাঁতার দিয়ে আমার কাছে আসুক না কেন, তক্ষুণি আমি টের পেয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমি হুঁশিয়ার।
আর ঘুমের সময়?
তখনও সব টের পাই। কেমন যেন একটা চেতনা থাকে।
মনে মনে ক্রিস্টো ভাবল, পেদরো জুরিতা এই সাগর দানোকে…নাহ, দানো একে কিছুতেই বুলা যায় না। মানুষের সমস্ত কোমল অনুভূতি আর মানবিক গুণ রয়েছে এর। বেশির ভাগ মানুষই এর তুলনায় অনেক নিচু শ্রেণীর। তাছাড়া ইকথিয়ান্ডার কারও ক্ষতি করে না, অথচ সাহসী আর শক্তিশালী। শিশুর মতোই সরলও। পেদরো ঠিকই করছে, একে ধরার জন্যে অর্থব্যয় মোটেই বাজে খরচ নয়। এবার যা যা জানা গেছে সেগুলো পেদরো জুরিতাকে জানাতে হয়।
ইকথিয়ান্ডারের কথা শেষ হয়নি। আবার শুরু করল ও, ক্রিস্টো, পানির নিচের জগন্টা যে কী সুন্দর! ওপরের পৃথিবী ধুলো আর ময়লায় ভরা, আমার মোটেই পছন্দ নয়। বিষাক্ত আর গুমোট ওপরের পৃথিবীর পরিবেশ। পানির নিচের জীবনই আমার ভাল লাগে। তোমাদের এই ওপরের জীবনটা যেন, অসহ্য!
আমাদের ওপরের জীবন বলছ কেন? বলল ক্রিস্টো। তুমিও কি। ওপরের মানুষ নও? তোমার মা কোন জগতের মানুষ ছিলেন?
কথাটা খানিকের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। তারপর বলল, তা বলতে পারি না। বাবার কাছে শুনেছি আমার জন্মের সময়েই মা মারা যান।
তাহলে নিশ্চয়ই ওপরের পৃথিবীরই মানুষ ছিল সে, মন্তব্যের ঢঙে বলল ক্রিস্টো।
তা হতে পারে, বলল চিন্তিত এবং অন্যমনস্ক ইকথিয়ান্ডার।
ক্রিস্টো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, জেলেদের সঙ্গে তুমি বাঁদরামো করো কেন? ওদের জাল কেটে দাও, নৌকো থেকে মাছ ফেলে দাও। কেন?
এজন্যে যে ওরা দরকারের তুলনায় অনেক বেশি মাছ ধরে।
কিন্তু সেতো ধরে বিক্রির জন্যে!
কথাটা বুঝতে পারল না ইকথিয়ান্ডার। সেটা বলায় ক্রিস্টো ভেঙে বলল: অন্য লোকরা খাবে বলেই ধরে ওরা।
পৃথিবীতে তাহলে অনেক মানুষ? বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করল ইকথিয়ান্ডার। পর মুহূর্তে বলল, ডাঙায় তো পশু-পাখির অভাব নেই। তাহলে ওরা সাগরের মাছ ধরে কেন?
সে তোমাকে বোঝানো যাবে না, বিরাট একটা হাই তুলল ক্রিস্টো। খুব ঘুম পেয়েছে। আমি গেলাম তাহলে। তুমি আবার পানির নিচে ঘুমিয়ো না, ডাক্তার সাহেব খুব রাগ করবেন।
ক্রিস্টো বিদায় নিল। ফিরল পরদিন সকালে। এসে দেখে ইকথিয়ান্ডার খাটে নেই। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে পানির ফোঁটা। আপন মনে গজর গজর করল সে, আবার পানির নিচে ঘুমিয়েছে। সকাল হতে না হতেই সাগরে গিয়ে হাজির! যত্তসব!
খাবার সময় পার হয়ে যাবার অনেক পরে ফিরল ইকথিয়ান্ডার। কেমন যে মনমরা হয়ে আছে। বাসন থেকে এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে বলল, আবার সেই মাংস? মাংস আমার ভাল লাগে না, ক্রিস্টো।
জবাবে ধমক দিল ক্রিস্টো, মাংসই তোমাকে খেতে হবে, ডাক্তার সাহেবের নির্দেশ আছে। কাঁচা মাছ খেতে পারবে না তুমি।…কি হলো, খেয়ে এসেছ বুঝি? আর পানির নিচেও ঘুমিয়েছ, তাই না? ডাক্তার সাহেব বলেছেন এমন ভাবে চললে পৃথিবীর ওপরে শ্বাস নেয়ার ক্ষমতা। তোমার একেবারে চলে যাবে। বাতাসের মধ্যে তোমার বুক ব্যথা করবে। আজকে ডাক্তার সাহেব আসুন, তোমার অবাধ্যতা সব বলব তাকে বলব আমার কথা তুমি এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দাও।
চুপ করে কি যেন ভাবল ইকথিয়ান্ডার, তারপর অনুরোধের সুরে বলল, কিছু বোলো না বাবাকে, ক্রিস্টো। আমি চাই না বাবা মনে কষ্ট পান। একটু থেমে বলল, জানো, ক্রিস্টো, সৈকতে আমি একটা মেয়েকে দেখেছি। কী যে সুন্দর দেখতে! মনে হচ্ছে ওপরের পৃথিবী বুঝি পানির তলার চেয়েও ভাল। ওই মেয়ের মতো অত সুন্দর কিছু পানির তলায় নেই।
হাসল ক্রিস্টো। তাহলে ওপরের পৃথিবীর অত দুর্নাম করো কেন?
জবাবটা এড়িয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার। বলল, লিডিঙের পিঠে বসে আমি যাচ্ছিলাম সাগরের তীর ঘেঁসে। প্রায় বুয়েন্স আয়ার্স বন্দরের কাছে চলে এসেছি, এমন সময় দেখলাম সেই মেয়েটিকে। নীল তার চোখ। চুলগুলো সোনালী! এত সুন্দর! কিন্তু আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। আমার তখন মনে হলো কেন যে গ্লাভস আর চশমা পরেছি! একটু বিরতি। কি যেন ভাবছে ইকথিয়ান্ডার। তারপর আবার বলল, একবার পানিতে ডুবে যাচ্ছিল একটা মেয়ে। তাকে আমি বাঁচিয়েছিলাম। তখন অত খেয়াল করে ওকে দেখিনি। আজ যেন মনে হলো এই মেয়েটিই সেই মেয়েটি। সেই মেয়ের চুলগুলোও সোনালী ছিল। চোখও নীল ছিল। এবার একটু নিশ্চিত গলায় বলল, হ্যাঁ, এ-ই সে। এই মেয়েই সে-মেয়ে। আমার মনে পড়েছে… আয়নার সামনে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। আপন মনে নিজের চেহারা দেখল আয়নায়।
তুমি তারপর কি করলে? জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো।
করুণ হাসল ইকথিয়ান্ডার। আকুলতা চাপতে পারল না। বলল, অপেক্ষা করলাম। অনেক, অনেকক্ষণ। কিন্তু ও আর ফিরল না। আচ্ছা, ক্রিস্টো, আর কি মেয়েটা কখনও সাগর সৈকতে আসবে না?
ক্রিস্টোর মাথায় তখন অন্য চিন্তা চলছে। বহুবার চেষ্টা করেছে সে ইকথিয়ান্ডারের মনে বুয়েন্স আয়ার্স সম্বন্ধে কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে। চেয়েছে ওকে নিয়ে কোনভাবে ওখানে পৌঁছোতে। কখনোই ইকথিয়ান্ডারকে উৎসাহী মনে হয়নি। আজ মনে হচ্ছে ওকে বাগে পাওয়া যাবে। একবার ওকে বুয়েন্স আয়ার্সে নিয়ে যেতে পারলেই হয়, তাহলেই ওকে ওখান থেকে গায়েব করে দিতে পারবে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা।
কৌশল করল ক্রিস্টো, বলল, মেয়েটা হয়তো আর সাণৰু-সৈকতে আসবে না। কিন্তু তাতে কি আছে! শহরে যাবার মতো পোশাক পরে আমার সঙ্গে বুয়েন্স আয়ার্সে চলো তুমি, ঠিকই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পারব আমরা।
আনন্দে দিশেহারা দেখাল ইকথিয়ারকে। তাহলে…শহরে গেলে ওকে দেখতে পাব তো?
নিশ্চই পাবে, নিশ্চয়তা দিল ক্রিস্টো।
ইকথিয়ান্ডার আকুল গলায় বলল, তাহলে এখনই চলো।
আপত্তি করল ক্রিস্টো। আজ নয়। আজকে দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া…
শুনল না ইকথিয়ান্ডার। বলল, আজই, ক্রিস্টো। আজই। তুমি যাও হাঁটাপথে? আমি লিডিঙের পিঠে চেপে চলে যাব।
এত উৎসাহ কেন! হাসল ক্রিস্টো। বুঝতে পারছে প্রেমে পড়েছে উভচর মানব। যুক্তি দিয়ে বলল, আজ আর নয়। আজ গিয়ে কোন লাভ হবে না। কোথায় ওকে খুঁজব রাতে? তারচেয়ে কালকে ভোরে আমরা রওনা হবো। তুমি খাঁড়ির কাছে চলে এসো, তোমার জন্যে পোশাক নিয়ে এখানে আমি হাজির থাকব। এখন সেঁটে ঘুম দাও। শরীরটা চাঙা থাকা দরকার।
মনে মনে ভাবছে ক্রিস্টো, আজ রাতেই বালথায়ারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। জানাতে হবে উভচর মানব প্রায় তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে।