কদিন পরই কথামতো ডাক্তার সালভাদরের কাছে ফিরে এলো বৃদ্ধ ক্রিস্টো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করে দেখলেন ডাক্তার, তারপর বললেন, ঠিক আছে, ক্রিস্টো, তোমাকে আমি কাজে নিচ্ছি। তোমার খাবার-দাবার সব এখানেই হবে। মাইনেও ভাল পাবে।
সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানাল ক্রিস্টো। আমার তো বেতনের দরকার নেই, ডাক্তার সাহেব, আমি শুধু আপনার সেবা করতে চাই। এভাবেই আমার মৃত্যুর পর হয়তো ঋণ শোধ হবে।
বেশ, বললেন ডাক্তার, তবে একটা কথা, এখানে যা দেখবে বা শুনবে তা কখনোই বাইরে প্রকাশ করতে পারবে না।
ক্রিস্টো বলল, আমি বরং মুখ খোলার চেয়ে কুকুর দিয়ে নিজের জিভ খাওয়াব, তবু বাইরে কোন কথা বলব না।
কথা বলে নিজের সর্বনাশ না করে সেদিকে খেয়াল রেখো, বললেন ডাক্তার সালভাদর। আমার আর কিছু বলার নেই।
এবার ঢোলা পোশাক পরা নিগ্রো লোকটাকে তিনি ডাক দিলেন, সে আসতে ক্রিস্টোকে দেখিয়ে বললেন, জিম, ওকে নিয়ে বাগানের সব কাজ বুঝিয়ে দাও।
ডাক্তার বিদায় নিতে নিগ্রোর পাশে পা চালিয়ে বাইরে চলে এলো ক্রিস্টো। চত্বর পার হয়ে লোহার দরজায় টোকা দিল জিম। দরজার ওপাশে কয়েকটা হাউন্ড ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। হালকা শব্দ করে ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজাটা। ক্রিস্টো দেখল দরজার ওপাশে আরেকজন নিগ্রো দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম নিগ্রো ক্রিস্টোকে বাগানের দিকে এগিয়ে দিয়ে অজানা ভাষায় দ্বিতীয় নিগ্রোকে কি যেন বলল। কথা শেষে চলে গেল প্রথম নিগ্রো।
ভয়াবহ হিংস্র গর্জন করতে করতে আজব কয়েকটা জানোয়ার তেড়ে এলো ক্রিস্টোর দিকে। তাড়াতাড়ি দেয়ালের কাছে গিয়ে কোণঠাসা হলো ক্রিস্টো।
জানোয়ারগুলোর গায়ের রং হলদেটে। হলদের ওপর কালো কালো ছোপও আছে। পম্পাস প্রেয়ারিতে এদের দেখতে পেলে ক্রিস্টো নিশ্চিত ভাবেই এগুলোকে কুগার ভাবত। আশ্চর্য! দেখাত বাঘের মতো হলেও এদের ডাক একেবারেই কুকুরের মতো। কিন্তু এতসব খেয়াল করার মানসিক অবস্থা এখন ক্রিস্টোর নেই জীন বাঁচানো ফরজ। তাড়াতাড়ি ক্রিস্টো একটা উঁচু গাছে চড়ে বল।
বাগানের নিগ্রো মালীক মুখ দিয়ে একরকম চাপা শব্দ করল, যেন সাপ ফুসছে। সঙ্গে সঙ্গে জল্পগুলো একেবারে শান্ত সুবোধ হয়ে গেল। গর্জন তো থেমেছেই, এবার সামনের দুপায়ের ওপর মাথা রেখে তারা শুয়ে পড়ল। সবকটার চোখ নিগ্রো মালীর দিকে।
ক্রিস্টোকে গাছ থেকে নামতে ইশারা করল নিগ্রো। ক্রিস্টো নামতে রাজি নয়। গাছের ওপর থেকেই বলল, তোমার কি জিভ নেই, ভাই? অমন সাপের মতো হিসহিস আওয়াজ করছ কেন? আমাকেও তো শুধু ইশারা করছ দেখছি!
ক্রিস্টোর কথার জবাবে নিগ্রোর মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বের হলো শুধু।
ডাক্তার সালভাদরের সতর্কবাণী ওর মনে পড়ে গেল। হতে পারে নিগ্রোটা আসলেই বোবা। ভেতরের কথা যাতে বাইরে না যায় সেজন্যে ডাক্তার হয়তো চাকরদের জিভ কেটে নেন। এই নিগ্রোরও হয়তো জিভটা গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে ক্রিস্টো। ফলে অসতর্ক হয়ে পড়ছে। আরেকটু হলেই গাছ থেকে পড়ে যেত। এখন ওর মাথায় শুধু এখান থেকে পালানোর চিন্তা ঘুরছে। গাছটা থেকে দেয়ালটা কতদূরে সেটা আন্দাজ করে দেখল সে, না ওই দেয়াল যথেষ্ট দূরে। দেয়াল টপকে পালাবার উপায় নেই। বিপদের ওপর বিপদ! গাছের নিচে এসে নিগ্রো ব্যাটা ক্রিস্টোর পা ধরে টেনে নামাতে চাইছে। আর কোন উপায় নেই দেখে আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্যে লাফ দিয়ে গাছ থেকে নামল ক্রিস্টো, মুখে হাসি টেনে এনে নিগ্রোর সঙ্গে করমর্দন করতে করতে জিজ্ঞেস করল, তোমার নামই তো জিম?
মাথা দুলিয়ে সায় দিল নিগ্রো। তার সঙ্গে করমর্দন করতে করতে ক্রিস্টো ভাবল, দোজখে যখন হাজির হয়েই গেছি তো ইবলিশকে যতটা সম্ভব হাতে রাখাই ভাল। মুখে বলল, তুমি কি বোবা, ভাই?
জবাব দিল না নিগ্রো। ক্রিস্টো আবার জিজ্ঞেস করল, জিভ নেই। তোমার?
এবারও চুপ করে আছে নিগ্রো।
নিগ্রোর মুখের ভেতরটায় একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পারলে বোঝা যেত, ভাবল ক্রিস্টো। কিন্তু জিমের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে না খাতির জমানোর কোন ইচ্ছে তার আছে। ক্রিস্টোর হাত আঁকড়ে ধরে হলদে বাঘা কুকুরগুলোর কাছে ওকে নিয়ে চলল নিগ্রো। মুখ দিয়ে আবার হিসহিস আওয়াজ করল। আওয়াজটা শুনতেই উঠে এগিয়ে এলো জম্ভগুলো, ক্রিস্টোকে একবার এঁকে দেখে শান্ত ভাবে চলে গেল। এতক্ষণে আটকে রাখা দম ছাড়ল ক্রিস্টো।
এবার জিম তাকে নিয়ে চলল বাগান দেখাতে। পাথর দিয়ে বাধানো চত্বর পার হয়ে বাগানটা দেখে অবাক হয়ে গেল ক্রিস্টো। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সাজানো গোছানো। ফুলে ভরে আছে গাছ। মিষ্টি গন্ধ বাতাসে। লাল ঝিনুকের গুঁড়ো ফেলা পথে হাঁটছে ওরা। কখনও কখনও গাছের সারির মাঝ দিয়ে গেছে পথ। বাগান না মাড়িয়ে পুরোটা ঘুরে দেখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কি গাছ নেই বাগানে! ফুলের সমারোহ তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে হরেক ফলের গাছ। পীচ, জলপাই আর মূল্যবান আগাভা গাছ বাগানে ছায়া দিচ্ছে। ছায়ার নিচে রঙিন ফুলে ভরা ঘন ঘাসে ঢাকা লন। সেই লনের মাঝে একটু পরপর সুন্দর ছোট জলাশয়। সেই জলাশয়গুলো থেকে উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে ফোয়ারার সূক্ষ্ম পানির কুয়াশা। পানির কারণে পরিবেশটা স্নিগ্ধ আর শীতল লাগছে। মনে হচ্ছে এ যেন পৃথিবীর বুকে স্বর্গ।
হরেক রকমের পাখি কিচিরমিচির করে বাগানটাকে প্রাণের প্রাচুর্য দিয়েছে। নানা রকম জন্তুও আছে। তারাও ডেকে ডেকে নিজেদের–অস্তিত্ব জাহির করছে। এত রকমের প্রাণী আগে কোথাও কখনও দেখেনি ক্রিস্টো।
হলদে-সবুজ রঙের ঝিলিক দেখিয়ে এই মাত্র ছুটে চসে গেল। একটা ছয় পাওয়ালা গিরগিটি। একটা গাছে অলস ভাবে ঝুলছে একটা দুমুখো অজগর সাপ। সাপটা হিসহিস আওয়াজ করতেই ভয়ের চোটে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল ক্রিস্টো। কিন্তু জিম যেই আরও জোরে হিসহিস আওয়াজ করল, অমনি অজগর চট করে লুকিয়ে পড়ল ঘন পাতার আড়ালে। একটু পরই দুটো পাওয়ালা একটা সাপও দেখতে পেল ক্রিস্টো। লোহার জালের খাঁচায় একটা শুয়োর ছানা দেখা গেল। তার কপালে মাত্র একটাই চোখ।
লাল ঝিনুকের গুঁড়া মেশানো পথ ধরে ছুটে গেল দুটো সাদা ইঁদুর। ওদের দেহ একই সঙ্গে–জমজ। একটাই দেহ, কিন্তু মুখ দুটো। আটটা পা। ওদের মাঝে একটু পর পর, মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। ডানেরটা যেতে চাইছে বাঁয়ে, আবার বাঁয়েরটা যেতে চাইছে ডানে। ইচ্ছে পূরণ না হওয়ায় রাগ করে দুটোই কিচকিচ করে বিরক্তি প্রকাশ করছে। মাঝে মাঝে লড়াই বাধছে। শেষ পর্যন্ত মনে হলো এবারের লড়াইয়ে ডানেরটা জিতেছে। কারণ বয়ে যাচ্ছে ওরা এখন।
ইঁদুরদের মতোই জোড়া লাগা দুটো ভেড়াকেও দেখা গেল। ওরা। ইঁদুরদের মতো ঝগড়া করছে না। মতামতের ব্যাপারগুলো এরা বোধহয় আগেই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধা করে ফেলেছে। এবার দেখা গেল একটা রোমহীন গোলাপী কুকুর। ওটার পিঠের ওপর বাদরের মতো কি একটা জীব। ওটা মাথা নাড়ছে সর্বক্ষণ। সেই সঙ্গে চাপড় মারছে কুকুরটার পিঠে। ক্রিস্টোকে দাঁত খিচাল বাঁদরটা। পকেট থেকে লজেন্স বের করে ওটাকে দিতে যাচ্ছিল ক্রিস্টো, কিন্তু কে যেন ঝাঁপটা দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টো, আর কেউ নয়, নিগ্রো জিম। লোকটা ইশারায় বুঝিয়ে দিল বাঁদরটাকে খাবার দেয়া চলবে না। লজেন্সটা আবার পকেটে রাখবে সেই সৌভাগ্য হলো না ক্রিস্টোর। টিয়া পাখির মতো মাথাওয়ালা একটা চড়ই কোখেকে যেন উড়ে এসে লজেন্সটা কেড়ে নিয়ে দূরের একটা ঝোপে গিয়ে বসল। পাখির কাণ্ড দেখে খুব মজা পেল ক্রিস্টো।
এ এক আশ্চর্য বাগান! আজব যত জন্তুর সমারোহ এখানে। দূরে একটা ঘোড়া বাঁ-বাঁ করে ডেকে উঠল। ক্রিস্টো খেয়াল করে দেখল ঘোড়াটার মাথাটা অবিকল গরুর মতো।
ঘোড়ার মতো লেজ দুলিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল দুটো লামা। ঘাসের মাঝে থেকে, গাছের ভেতর থেকে বিচিত্র সব প্রাণী উঁকি দিয়ে ক্রিস্টোকে দেখছে। বেড়ালের মুণ্ডওয়ালা কুকুর, মোরগের মুণ্ডুওয়ালা হাঁস, শিংওয়ালা শুয়োর, ঈগলের ঠোঁট সমেত উট পাখি, পুমার মতো দেহের ভেড়া–কি নেই তাদের মধ্যে।
স্বপ্ন দেখছি না তো! মনে হলো ক্রিস্টোর। জোরে জোরে দুচোখ কচলে আবার চারপাশে তাকাল। মাথায় দিল ফোয়ারার সুশীতল পানি। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে মাথাটা তার আরেকটু গরম হলো। মাছের পাখনা আর মাথাওয়ালা সাপ, ব্যাঙের মতো পা সহ মাছ, টিকটিকির মতো লম্বা কোলাব্যাং–কি নেই!
সব দেখেশুনে পালিয়ে যাবার মতলবটা জোরাল হয়ে উঠল ক্রিস্টোর মনে। একি আজব পাগলের এলাকা। এখানে থাকলে কখন কি বিপদ ঘটবে বলা যায় না!
বালিময় প্রশস্ত একটা চত্বরে ক্রিস্টোকে নিয়ে এলো জিম। চত্বরের মাঝখানে খেজুর গাছ। গাছগুলোর ছায়ায় মুর স্থাপত্যরীতিতে গড়া একটা শ্বেতপাথরের বাড়ি। খেজুর গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে বাড়িটার থাম আর খিলান দেখা যাচ্ছে। সামনে একটা ফোয়ারা! সেটা থেকে, চারদিকে সূক্ষ্ম পানির কণা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে! ফোয়ারাটা তামার তৈরি। আকৃতি একেবারেই ডলফিনের মতো। ফোয়ারার নিচের জলাশয়ে সাঁতার কাটছে অসংখ্য সোনালী মাছ! সদর দরজার কাছে যে বড় ফোয়ারাটা আছে, সেটার মাঝখানে ক্রিস্টো দেখল ভলফনের পিঠে বসা এক তরুণের মূর্তি। মনে হয় উপকথার কোন দেবতা হবে। বোধহয়। দেবতার মুখে একটা বড় শঙ্খ। আশ্চর্য শিল্পকর্ম। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় যেন জীবন্ত। অত্যন্ত প্রতিভাবান কোন শিল্পির হাতে কাজ নিঃসন্দেহে।
শ্বেতপাথরের বাড়ির পেছনে বেশ কয়েকটা থাকার ঘর আছে। সেগুলোর পেছন থেকে শুরু হয়েছে ফণীমনসার কাঁটাভরা ঝোপ-জঙ্গল। দেয়ালের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে সে জঙ্গল।
হাঁটতে হাঁটতে ক্রিস্টোর সামনে আরও একটা দেয়াল পড়ল। শ্বেতপাথরের বাড়িটার পেছনের একটা ঘরে ক্রিস্টোকে নিয়ে এলো, জিম, ইশারা করে বুঝিয়ে দিল এই ঘরটিই তার থাকার জায়গা হিসেবে বরাদ্দ হয়েছে।