ডাক্তার সালভাদরের সঙ্গে সাবমেরিনে করে গিয়েও ইকথিয়ান্ডারকে না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছে বালথাযার। এদিকে খবর নেই গুট্টিয়ারারও। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা তাকে নিয়ে কোথায় যে ডুব মেরেছে তার কোন হদিস নেই। ইকথিয়ান্ডারকেও এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দোকানে বসে আছে বালথাযার, এসব নানা দুর্ভাগ্য নিয়েই মগ্ন হয়ে ভাবছে। এখন সে সাদা মানুষ দুচোখে দেখতে পারে না। রেড ইন্ডিয়ানদের ওই সাদা মানুষরাই নিজেদের দেশে পরবাসী করে রেখেছে। গোটা দক্ষিণ আমেরিকাই তারা দখল করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, রেড ইন্ডিয়ান মেয়েদেরও লুঠ করে নিয়ে যায় তারা, গিনিপিগের প্রতি বিজ্ঞানীরা যেমন আচরণ করে ঠিক তেমনি আচরণ করে ওরা রেড ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের ওপর। ধরে ধরে বিকলাঙ্গ করে দেয়।
মনের মাঝে অনেক ক্ষোভ জনেছে বালথাযারের। রাগে আজকাল অস্থির হয়ে পড়ে সে।
বাইরে থেকে ক্রিস্টোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল বালথায়ারের।
বালথাযার, আছিস নাকি? শীঘ্রি আয়, দারুণ একটা খবর আছে। ইকথিয়ান্ডারকে পাওয়া গেছে।
ব্যস্ত হয়ে ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে এলো বালথাযার। দোকান ঘরে চলে এলো। কি বললি, ক্রিস্টো? কি বললি? আবার বল। আমি ভুল শুনলাম নাতো?
আরে দাঁড়া। বলছি। বলছি। কথার মধ্যে কথা বলবি না তাহলে আমার সাজানো কথা সব গুলিয়ে যাবে। হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডারকে পাওয়া গেছে। ওই ডুবে যাওয়া জাহাজের মধ্যে ছিল ও। পেদবরা ওকে ওখানে পাঠিয়েছিল। আমরা হতাশ হয়ে ফিরে আসার পর ইকথিয়ান্ডারও বাড়ি ফিরেছে।
ও এখন কোথায়?
সালভাদরের কাছেই আছে।
এবার আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছেলেকে দাবি করব। বলব ভালয় ভালয় সে যেন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়।
তা বোধহয় সে দেবে না। সাগরে বেরুতে ওকে একেবারে বারণ করে দিয়েছে ডাক্তার। ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গলা নিচু করে বলল ক্রিস্টো, তবে আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে ওকে সাগরে ছেড়ে দিই।
দিবিই তো, খ্যাপাটে গলায় বলল বালথাযার ওকে বেরোতে দিলে সালভাদরকে আমি খুন করে ফেল। উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। চল এখনই গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া সেরে ফেলি।
হাতের ইশারায় ভাইকে শান্ত করতে চেষ্টা করল ক্রিস্টো। বলল, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর। নাতনীর সঙ্গে দেখা করার নাম করে ছুটি নিয়েছি আমি। কাল ঠিক করা যাবে কি করব।
বালথাযারের তর সইছে না। ছেলেকে দেখার জন্যে মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে আছে। যেভাবে হোক, একনজর হলেও, ইকথিয়ান্ডারকে তার দেখাই চাই।
ক্রিস্টোকে আর কিছু বলল না। ক্রিস্টো বিদায় নেয়ার পর সাগরের সৈকতে চলে এলো সে। সারারাত সাগরের দিকে চেয়ে থাকল, যদি কোন ঢেউয়ের মাথায় নিজের ছেলেকে দেখতে পায়?
রাত যত বাড়ছে, উত্তাল হয়ে উঠছে সাগর। দক্ষিণের হাওয়া। হুটোপুটি শুরু করেছে, সেই দামাল হাওয়ায় মত্ত হয়ে উঠছে ঢেউগুলো, ক্রমশই বাড়ছে তাদের উচ্চতা, প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে এসে সাগর-সৈকতে।
আকাশে মেঘের চাদরের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ মামা। এই জ্যোৎস্না তো এই অন্ধকার। ঢেউগুলো একবার দেখাচ্ছে নীলাভ, পরক্ষণেই ঘুটঘুটে কালো। ঢেউয়ের মাথায় নাচছে সাদা ফসফরাস। একটা ঢেউ এসে চড়ে বসছে আগেরটার ওপর নিয়ত চলছে নতুন পুরাতনের ভাঙাগড়ার খেলা। একদৃষ্টে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বালথাযার! সারারাত তাকিয়ে থাকল, কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। টের পেল না কখন ভোর হয়ে এসেছে। নিশ্চল বসে আছে সৈকতে। একসময় সাগরের পানিতে নীলাভ-ধূসর সুরে ছায়া পড়ল।
হঠাৎই চমকে উঠল বালথাযার। ঢেউয়ের গায়ে কালো মতো ওটা কি?
মনে হচ্ছে যেন মানুষ! তাহলে ডুবে যাওয়া কোন মানুষ? না, তেমন তো মনে হচ্ছে না। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে মাথার নিচে হাত দিয়ে আয়েস করে শুয়ে আছে একজন নিশ্চিন্তে চলেছে ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে। তাহলে ও-ই কি ইকথিয়ান্ডার?
বালথাযার চোখে ভুল দেখেনি। আসলেই ও ইকথিয়ান্ডার। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালথাযার, প্রাণপণে চেঁচাল, ইকথিয়ান্ডার! ইকথিয়ান্ডার! আমার ছেলে!
সাগরে ঝাঁপ দিল বালথাযার, কিন্তু ঢেউ আজ এতই বেশি যে ওর মতো দক্ষ সাঁতারু সাগরের সঙ্গে যুঝতে পারল না। প্রকাণ্ড একটা ঢেউ তাকে ছুঁড়ে দিল সৈকতে। ভেজা শরীরে উঠে দাঁড়াল বালথাযার, প্রমত্তা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিশ্চিত গলায় বলল, আমি কি তাহলে ভুল দেখেছি।
সকাল হয়ে গেছে। কখন যেন ওর অজান্তে আকাশের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছে সূর্যিমামা। এখন বেশ রোদ।
ভিজে কাপড় রোদে শুকিয়ে ডাক্তার সালভাদরের বাড়ির দিকে চলল বালথাযার। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ওই নির্জন বাগান বাড়িতে যাবেই যাবে ও।
বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছোতে। দরজায় জোরে জোরে টোকা মারল সে। একটু পর নির্দিষ্ট ফুটোয় উঁকি দিল এক নিগ্রো চাকর।
কাকে চাই?
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করব। জরুরী দরকার।
ডাক্তার সাহেব এখন কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। কথা শেষ করেই ফুটো বন্ধ করে দিল চাকর।
রাগে দমাদম দরজা পিটাল বালথাযার, দরজা খুলতে বলে চেঁচাতে শুরু করল। গেট খুলছে না। ওপাড় থেকে শোনা গেল ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুরের রক্ত হিম করা ডাক। ক্রিস্টোর কাছে শুনেছে বালথাযার, ওগুলো সাধারণ কুকুর নয়, আসলে জাগুয়ার, বশ মানানো হয়েছে অপারেশন করে কুকুরের মগজ ভরে দিয়ে।
বন্ধ ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চাপল বালথাযার, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শয়তান স্প্যানিয়ার্ড, তোর যদি বারোটা না বাজিয়েছি আমি!
কোর্ট থেকে সামান্য দূরেই রেস্টুরেন্টটা নাম লা পামেরা। পাথরের তৈরি নিচু বাড়ি, মোটা মোটা দেয়াল। সামনে সরু একটা বারান্দা। সেখানে ডোরাকাটা সামিয়ানার নিচে কাস্টোমারদের খাবার ব্যবস্থা-সারি সারি টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। সাজসজ্জা বলতে তেমন কিছু নেই টবে রাখা কয়েকটা ক্যাক্টাস গাছ ছাড়া। ওগুলো টেবিলের ফাঁকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই বারান্দায় আসর জমে সন্ধের পর। দিনের আলোয় খদ্দেরদের যাতায়াত নিচু ঘরগুলোতেই বেশিরভাগ সময় সীমাবদ্ধ।
দেখে মনে হয় রেস্টুরেন্টটা সামনের ওই কোর্টেরই বৰ্দ্ধিত একটা অংশ { মামলার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের লোকজন চা-নাস্তার ফাঁকে এখানেই আড্ডা জমায়। আদালত থেকে ডাক আসার আগে পর্যন্ত অনেকেই মদ গেলে। আদালতের নোংরা পরিবেশের চেয়ে এখানে একটু আরামে থাকাই তাদের লক্ষ্য।
বাচ্চা একটা চটপটে ছেলে বারবার আদালত আর রেস্টুরেন্টের মাঝে যাতায়াত করছে, জানিয়ে দিচ্ছে আদালতে এখন কোন মামলার কাজ চলছে। এতে করে অনেক সুবিধে। লোকজনকে দৌড়াদৌড়ি কম করতে হয়। সেকারণে কিছু আয়ও হয় ছেলেটার। লা পারো রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের লোক আসে। তাদের মধ্যে শয়তান মামলাবাজ লোক, দালাল আর মিথ্যে সাক্ষিরাও রয়েছে। মক্কেল শিকারের রয়েছে তাদের নানা রকমের ফন্দি।
দোকানের কাজে অনেকবার এখানে আগেও এসেছে বালথাযার। সে জানে মামলার আর্জি লেখার লোক এখানেই পাওয়া যাবে। ডাক্তারের নামে মামলা করতেই এখানে এসেছে সে।
বারান্দা পার হয়ে হলঘরের মতো বড় একটা ঘরে ঢুকে হাতের উল্টোপিঠে কপালের ঘাম মুছল বালথাযার। কাছেই সংবাদদাতা ছেলেটা ছিল, তাকেই ও জিজ্ঞেস করল, লারা এসেছে নাকি?
দেরি না করে চটপট জবাব দিল ছেলেটা। ডন ফ্লোরেন্স দ্য লারা? হ্যাঁ, এসে গেছেন। নিজের জায়গাতেই আছেন। যান, গেলেই পাবেন।
ডন ফ্লোরেন্স দ্য লারা নামে যাকে আজকাল ডাকা হয়, সে আসলে ছিল আদালতের এক নিম্ন কর্মচারী। ঘুষ নেয়ার অপরাধে তার চাকরি যায়। চাকরি যাবার পর তার রাত খুলেছে, নিজের জন্যে চমৎকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে সে। অগুনতি মক্কেল তার। যাদেরই মামলা গোলমেলে, তারাই এসে লারাকে ধরে। ঠেকায় পড়ে বালথাযারও কয়েকবার এসেছে তার কাছে।
মোটা চৌকাঠ দেয়া একটা জানালার সামনে বসে আছে লারা। তার সামনের টেবিলে বীয়ারের বোতল আর একটা গ্লাস। পাশেই চামড়ার একটা ব্যাগ। কৈাটের বুক পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে ঝর্না কলম। লারা দেখতে মোটাসোটা, লালচে রঙ চামড়ার, মাথায় টাক, ক্লিন শেভড় মুখে প্রচণ্ড গর্বের স্থায়ী ছাপ। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে মাথার দুপাশের হালকা চুলগুলো ফুরফুর করে উড়ছে তার। দেখলে তাকে নতুন যে কেউ ভাববে স্বয়ং বিচারক বোধহয় বসে আছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন।
বালথাযারকে দেখে অবহেলার সঙ্গে মাথা দোলাল লোকটা। সামনের বেতের চেয়ারের দিকে ইশারা করল।
বসো। কি ব্যাপার? কথার ফাঁকে একটু বীয়ার চলবে নাকি?
বালথাযারের জানা আছে, লারা বীয়ারের অর্ডার দিলেও দামটা তার মক্কেলদেরই মেটাতে হয়। সেটাই নিয়ম। সেজন্যেই লারার কথা শোনেনি এমন নির্বিকার চেহারা করে বসল সে চেয়ারে। সরাসরি কাজের কথায় এলো। সাগর-দানোর গল্প শুনেছ, লারা?
হ্যাঁ, অনেক শুনেছি। দেখিনি তাকে কখনও।
তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু এটুকু জানা তোমার দরকার, তার নাম ইকথিয়ান্ডার। সে আমারই ছেলে।
বালথাযার, এসব কি বলছ? বেশি মদ টেনে আসোনি তো আজকে? বসো, সসা, বালথাযার, একটু ঠাণ্ডা হও। আজকে অবশ্য গরমটাও একটুগই পড়েছে।
বিরক্ত হয়ে রেগে গেল বালথাযার, টেবিলের ওপর প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসাল। কাল থেকে সাগরের দুএক ফোটা পানি ছাড়া আর কিছুই আমার পেটে পড়েনি। না, লারা, আমি মদ খেয়ে আসিনি।
ঠাট্টার সুরে লারা বলল, তাহলে অবস্থা এতই খারাপ যে তুমি মদ না খেয়েই…
তাকে থামিয়ে দিয়ে বালথাযার বলল, ভেবো না আমি পাগল হয়ে গেছি। মাথা আমার ঠিকই আছে। যা বলছি মন দিয়ে শোনো।
কিছু বাদ না দিয়ে পুরো কাহিনী লারাকে খুলে বলল বালথাযার। বাধা না দিয়ে পুরোটা শুনল লারা, মাঝে মাঝে কুঁচকে গেল। ধীরে ধীরে প্রভাবিত হয়ে পড়ল। টেবিল চাপড়ে ডাক দিল বয় ছেলেটাকে।
অ্যাই কোথায় গেলি!
সাদা অ্যাপ্রন পরা একটা ছেলে ময়লা তোয়ালে হাতে ছুটে এলো। কিছু আনতে হবে, স্যার?
দুবোতল বরফ দেয়া সর্টেন। তাকাল বালথাযারের দিকে। দারুণ একটা ঘটনা বললে তো! নিজের মাথা থেকেই এই পরিকল্পনা বের করেছ, নাকি কেউ ফন্দিটা শিখিয়ে দিয়েছে? জবাবের আশায় দেরি না করে বলল, তবে তোমার পিতৃত্বের দাবি খুব কাঁচা। প্রমাণ করা কঠিন হবে। অবশ্য কাঁচাকে পাকা করাই তো আমার কাজ। যদি মামলা টিকে যায় তাহলে প্রচুর টাকা-পয়সা আসবে তোমার পকেটে।
আপত্তি জানাল বালথাযার। টাকা-পয়সার দরকার নেই আমার। আমার ছেলেকে আমি ফিরে পেতে চাই।
টাকার সবারই দরকার,বলল গম্ভীর লারা। বিশেষ করে তোমার মতো লোকদের, যাদের সংসারের সদস্য বাড়ছে। ভ্রূ কুঁচকাল লারা। কপালে কয়েকটা ভঁজ ফেলে বলল, কি ধরনের অপারেশন ডাক্তার করছে সেটা জানা গেছে এটা একটা ভরসার কথা। তবে আসল কথা হলো, এই বিরাট বড়লোক ডাক্তারকে কোন প্যাঁচে ফেলে টাকা বের করতে হবে সেটা আমাদের আগে ঠিক করতে হবে। সেটাই আসল।
আমি আমার ছেলেকে চাই। ওকে পেলেই আমি খুশি। তা যাতে পাই সেরকম একটা মামলা করো তুমি।
আঁতকে উঠল লারা। বলো কী! ভুলেও মামলা করতে যেয়ো না। সব পণ্ড হবে। মামলা হচ্ছে শেষ পথ, আর কোন উপায় না দেখলে তখন।
তাহলে কি করতে বলো? জিজ্ঞেস করল ক্লান্ত বালথাযার। মাথায় কিছু আসছে না তার।
মোটা মোটা আঙুলগুলো মটকে নিয়ে লারা বলল, প্রথমে খুব নরম ভাষায় একটা চিঠি লিখব ডাক্তার সালভাদরকে। চিঠিতে বলব, তার বেআইনী অস্ত্রপচারের ঘটনা আমরা জানি। এসব দুঃখজনক ঘটনা আমরা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেব। তবে তিনি যদি আমাদের সঙ্গে কোন আর্থিক চুক্তিতে আসতে চান তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে কিছু টাকা খরচ করতে হবে তাকে। কিছু মানে ধরো এক লাখ। তার কম হলে চলবে না।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে বালথাযারের দিকে তাকাল লারা। আশা করল বালথাযার কিছু বলবে। ডুবুরি চুপ করে চেয়ে আছে দেখে সে বলল, আমাদের দুনম্বর কাজ হচ্ছে টাকা পাবার পর। তখন আমরা দ্র ভাষায় সালভাদরকে আরেকটা চিঠি লিখব। সেটাতে বলব, ইকথিয়ান্ডারের আসল বাবাকে পাওয়া গেছে। আমাদের হাতে প্রমাণও আছে। বাবা তার ছেলেকে ফিরে পেতে চায়। দরকার হলে মামলা করতেও তার আপত্তি নেই। আর এই মশলা সে করলে জনগণ জেনে যাবে কিভাবে অস্ত্রপচার করতে গিয়ে ইকথিয়ান্ডারকে বিকৃত করে দিয়েছেন ডাক্তার। সেটা বিরাট সর্বনাশা ব্যাপার হবে তার জন্যে। সুতরাং ডাক্তার যদি সত্যিই ইকথিয়ান্ডারকে নিজের হেফাজতে রাখতে চান, তাহলে যেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির হাতে নির্দিষ্ট জায়গায় দশ লাখ ডলার তুলে দেন।
লারার শয়তানী বুদ্ধির দিকে বালথাযারের খেয়াল নেই। রাগ হচ্ছে ওর এসব শুনতে। ইচ্ছে করছে বীয়ারের বোতলটা তুলে লারার মাথা ফাটায়। চোখের দৃষ্টি বদলে গেল তার। চোখ থেকে যেন বিষবাষ্প বের হচ্ছে।
চাহনির পরিবর্তনটা লারা লক্ষ করেছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তার আগেই বালথাযার চিৎকার করে বলল, কি বললে, টাকার জন্যে ছেলে বেচে দেব আমি! তুমি কি মানুষ? তুমি একটা কাঁকড়া বিছের চেয়েও খারাপ! বাবার স্নেহ কাকে বলে তুমি জানো না।
চুপ করে মোড়লী হাসি হাসছে লারা। হাত তুলে বালথাযারকে বসার ইঙ্গিত করে বলল, ধৈর্য ধরো, বালথাযার। ধৈর্য ধরো। আগে সালভাদরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করে নাও, তারপর দেখাও বাবার স্নেহ তোমার কত আছে। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় কোন কিছুই হয় না।
বীয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শেষ করল লারা, সবজান্তার মতো চেহারা করে বালথাযারের দিকে তাকাল, যেন তার যুক্তি কিছুতেই খণ্ডানো যাবে না। কিন্তু তার এত পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। সোজা হয়ে বসল বালথাযার, দৃঢ় স্বরে বলল, মামলার আর্জিটা লেখো। না লিখলে বলে দাও, অন্য উকিল ধরি।
লারা হতাশ। বুঝতে পারছে তার কথায় বালথাযার কাজ করবে। ব্যাগ থেকে কাগজ আর পকেট থেকে কলম নিয়ে অগত্যা সে মামলার আর্জি লিখতে বসল। বেশিক্ষণ লাগল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল আর্জি।
উকিলের অফিসে আর্জি জমা দিয়ে বেরোতেই বালথাযারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পেদরো জুরিতার। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বালথাযারকে দেখল পেদরো, গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার নামেই মামলা করলে নাকি?
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে বালথাযারের। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, তোমাদের সবার নামেই মামলা করা দরকার।
দিন যতই যাচ্ছে সাদা চামড়ার স্প্যানিয়ার্ডদের প্রতি ঘৃণা আর আক্রোশের পরিমাণ বাড়ছে বালথাযারের। তোমাদের বলতে স্প্যানিয়ার্ডদেরই বুঝিয়েছে সে। পেদরো তাকিয়ে আছে দেখে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, অভাব পড়েছে তোমাদের মতো লোকদের শায়েস্তা করার মতো মানুষের। আমার মেয়েকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
কি বললে? কথা শুনে রাগে শরীর জ্বালা করে উঠল পেদরোর, আমাকে তুমি করে বলছ? সাহস তো মাত্রাছাড়া বেড়েছে দেখছি। তুমি আমার শশুর, সেকারণে ক্ষমা পেয়ে গেলে। অন্য কেউ হলে পিটিয়ে তোমার হাড়গোড় গুঁড়ো করতাম।
বালথাযারকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিল সে। প্রকাণ্ড একটা ওক কাঠের দরজার ওপাশে চলে গেল। তাকে আর দেখা গেল না।