দুপাশে ভুট্টা আর গমের খেত, মাঝখানে ধুলোময় রাস্তা। রোদ অগ্রাহ্য করে সেপথে হেঁটে চলেছে এক বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। ক্ষীণকায় মানুষ সে, পরনে জীর্ণ মলিন পোশাক। দুহাতে আলতো করে ধরে রেখেছে বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চাটাকে। রোদ যাতে না লাগে সেজন্যে ওর মুখ ঢেকে রেখেছে পুরোনো একটা কম্বল দিয়ে।
বাচ্চার দুচোখ আধবোজা। দেখে মনে হয় অসুস্থ। গলার এক পাশে আলুর সমান বড় একটা ফেঁড়া। সামান্য ঝুঁকিতেই কাতর স্বরে আর্তনাদ করছে। যতটা সম্ভব সাবধানে এগোচ্ছে বৃদ্ধ, তারপরও মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। তার নিজের অবস্থাও খুব একটা ভূয়। তবু বাচ্চাটার দিকে খেয়াল আছে ঠিকই। ব্যথায় কাতরে উঠলে মুখে ফুঁ দিচ্ছে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে। আপন মনে স্বগতোক্তি করল, এখন সময় মতো পৌঁছুতে পারলে হয়।
চলার গতি বাড়িয়ে দিল ক্লান্ত বৃদ্ধ! আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এক সময় এসে দাঁড়াল প্রকাণ্ড লোহার দরজাটার কাছে। বাচ্চাটাকে বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে জোরে জোরে দরজার গায়ে আঘাত করল।
দরজার ফুটোর ওপর থেকে ঢাকনি সরে গেল, ফুটোয় চোখ রেখেছে কে যেন। সামান্য বিরতি, তারপরই খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল শঙ্কিত বৃদ্ধ। সামনে সাজানো বাগান। দরজা খুলেছে এক বয়স্ক নিগ্রো। চুলগুলো ধবধবে সাদা তার, পরনের আলখেল্লাটাও একই রঙের।
ডাক্তার সাহেবের কাছে এসেছি, নরম সুরে বলল বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। বাচ্চার অসুখ।
মাথা দোলাল নিগ্রো, দরজা বন্ধ করে সঙ্গে আসতে ইশারা করে পা বাড়াল।
একটা পাথুরে চত্বরে এসে থামল ওরা। চারপাশে তাকাল বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। মনে হলো ঠিক যেন একটা জেলখানায় এসে ঢুকেছে সে। এক ধারে একটা সাদা রং করা বাড়ি। বড় বড় জানালা তাতে। সেই বাড়ির উঠানে বসে আছে বেশ কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান। তাদের মধ্যে মহিলাও রয়েছে। আর আছে বাচ্চা ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গেই বসার জায়গা হলো বৃদ্ধের। তার হাতের বাচ্চাটির মুখ ক্রমেই নীল হয়ে উঠছে। যন্ত্রণা বাড়ছে। কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় মেয়েটির মুখে ঘনঘন ফুঁ দিতে শুরু করল বৃদ্ধ।
তার পাশে বসে আছে এক বৃদ্ধা রেড ইন্ডিয়ান মহিলা। পা বেটপ ভাবে ফুলে গেছে তার। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে বৃদ্ধের কাছে জিজ্ঞেস করল, তোমার মেয়ে?
আমার নাতনী।
চিন্তা কোরো না, সব রোগের চিকিত্সাই করতে পারেন ডাক্তার সাহেব। দেখবে ঠিকই সেরে গেছে তোমার নাতনী ডাক্তার এমনকি ভূত তাড়াতেও ওস্তাদ।
কিছু বলল না বৃদ্ধ, আস্তে করে মাথা দোলাল।
তার কোলের বাচ্চাটির দিকে নজর পড়তেই এগিয়ে এলো সাদা আলখেল্লাধারী নিগ্রো বুঝতে পেরেছে শীঘ্রি বাচ্চাটিকে ডাক্তার সাহেবের কাছে না নিয়ে গেলে বাঁচবে না মেয়েটি। বৃদ্ধকে একটা। দরজা দেখিয়ে যেতে ইশারা করল সে। আপত্তি জানাল না কোন রুগী। যথাসময়ে ডাক্তার দেখবেন তাদের।
নাতনীকে কোলে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেশ বড় একটা ঘরে উপস্থিত হলো বৃদ্ধ। ঘরের মেঝে পাথরের। ঘরের মাঝখানে সাদা চাদরে ঢাকা লম্বা একটা সরু টেবিল। ওটার ওপরে বোধহয় রোগী পরীক্ষা করা হয়।
এক মুহূর্ত পরে অস্বচ্ছ কাচের একটা দরজা খুলে ঘরে এলেন ডাক্তার সালভাদর। পরনে তার সাদা আলখেল্লা। চমৎকার সুঠাম দেহ। গায়ের রং একটু ফ্যাকাশে। কুচকুচে কালো। মাথায় এক গাছি চুল নেই। পুরো টাক। দেখলে মনে হয় কামানো। মাথা কামিয়ে রাখা তার অভ্যেসও হতে পারে! নেড়া মাথার রং একেবারে মুখের রঙের মতোই। বাদামী চোখে তার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন চাহনি। পলকহীন দৃষ্টি। ব্রিত বোধ করল বৃদ্ধ ইন্ডিয়ান। সামনে ঝুঁকে সম্মান দেখাল, তারপর ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিল নাতনীকে।
বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন ডাক্তার, প্রথমেই ওর পরনের ময়লা পোশাক খুলে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেললেন। এবার মেয়েটিকে সরু টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। এককোণে জড়সড় হয়ে ডাক্তারকে দেখছে বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ান। তার মনে হলো সামনে এই লোকটা বুঝি ডাক্তার নয়, বিরাট একটা শকুন, ছোট্ট একটা বাচ্চা পাখির ওপর ছো মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দারুণ! আঙুল দিয়ে ফোড়াটা টিপে মন্তব্য করলেন ডাক্তার।
ভাব দেখে মনে হলো খুব আনন্দ পাচ্ছেন ফোঁড়াটা টিপতে পেরে। ডাক্তারের আচরণ কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হলো বৃদ্ধের। হাতের আঙুলগুলোও যেন কেমন। বড় বেশি দীর্ঘ।
মেয়েটিকে পরীক্ষা শেষে মুখ তুললেন ডাক্তার, বৃদ্ধকে বললেন, আজ তো অমাবস্যা। পরের অমাবস্যায় এসে তোমার রুগীকে নিয়ে যেয়ো। আশা করছি ও ভাল হয়ে যাবে।
বিদায় নিল বৃদ্ধ। মেয়েটিকে নিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। অস্বচ্ছ কাঁচের দরজার ওপাশেই আছে গোসলখানা, অপারেশন ঘর আর রুগীদের থাকার ব্যবস্থা।
*
আটাশ দিন পর হাজির হলো বৃদ্ধ। মনে তার আশা নিরাশার নিরন্তর দোল। খুবই শঙ্কিত সে। ডাক্তার সাহেব ওর নাতনীকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন তো?
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে, অস্বচ্ছ কাঁচের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ডাক্তার সাহেব, সেই সঙ্গে বাচ্চা মেয়েটি। এখন তার গায়ে নতুন জামা। ফুটফুটে একটা পরীর মতো লাগছে, দেখতে। চেহারা ফিরেছে, গালে রক্তিম আভা।
মুহূর্তের জন্যে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকল বৃদ্ধ নাতনীর দিকে, তারপর ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নিল। কপালে চুমু খেয়ে গ্রীবা দেখল উৎসুক চোখে। লাল একটা দাগ ছাড়া আর কিছু নেই।
কৃতজ্ঞ বৃদ্ধের দিকে চেয়ে হাসলেন ডাক্তার। এবার তাহলে এসো। একেবারে ঠিক সময়ে এসেছিলে, আরেকটু দেরি হলে আমার পক্ষে কিছু করা বোধহয় সম্ভব হতো না।
টপটপ করে জল পড়ছে বৃদ্ধের দুগাল বেয়ে। নাতনীকে বুকে, জড়িয়ে ডাক্তার সাহেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল সে। আবেগ কম্পিত স্বরে বলল, আমার নাতনীকে আপনি জীবন দিয়েছেন। জানি না এই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করব। গরীব মানুষ আমি। নিজের জীবন ছাড়া আপনাকে দেয়ার মতো আর কিছু নেই।
হাসলেন ডাক্তার আবারও বললেন, তোমার জীবন নিয়ে কি করব আমি?
বুড়ো মানুষ আমি, ডাক্তার সাহেব, বিনীত স্বরে বলল বৃদ্ধ,–আপনি আমার যে উপকার করেছেন তা শোধ দেবার ক্ষমতা আমার নেই। বাকি জীবনটুকু আমি দিতে চাই আপনার সেবা করেই যেন বাকি জীবন কাটে। অক্ষমের এই আবেদন আপনি ফিরিয়ে নিয়েন না।
চিন্তিত বোধ করলেন ডাক্তার সালভাদর। নতুন মানুষ রাখার ব্যাপারে তিনি খুবই সাবধানী। তাছাড়া নতুন কাউকে রাখার ইচ্ছেও তার আপাতত নেই। রাখলে তিনি নিগ্রো লোকই রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু এই বৃদ্ধের আন্তরিকতা তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। শেষে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হলেন। তাঁর মালী জিম বাগানটা ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারছে না একা, বৃদ্ধকে তার সহযোগী হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
ঠিক আছে, এসো তুমি, বললেন ডাক্তার, কবে থেকে কাজে লাগাতে পারবে?
আমার নাম ক্রিস্টোফার…
ঠিক আছে তাহলে, নাতনীকে রেখে চলে এসো। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।
নিরবে সায় দিল ক্রিস্টোফার, নাতনীকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।