বালথাযারের দোকানে নীল নয়না সুন্দরীকে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল ইকথিয়ান্ডার, তারপর কি যে হলো, কোথায় যাবে, কি করবে, বুঝতে না পেরে সোজা সাগরে এসে নামল ও। অথচ প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছিল যেন ফিরে যায়। এখন সেই বোধ আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে, তীক্ষ্ণধার একটা ছুরি যেন, খুঁচিয়ে চলেছে ওকে। বাড়ি ফেরার পর মেয়েটির কাছে ফেরার তাগাদা আরও বেড়েছে ওর। ক্রিস্টোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় ক্রিস্টো উপস্থিত থাকবে এটা চাইছে না ও। প্রতিদিন সৈকতের সেখানে ফিরে যায় ও, যেখানে সেদিন দেখেছিল নীল নয়নাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একটা পাথরের আড়ালে বসে অপেক্ষা করে ও, যদি দেখা মেলে সেই মেয়েটির! এখন আর সে গ্লাভস এবং গগলস পরে না, পরে সেই সাদা স্যুট, যাতে মেয়েটি আবার ভয় না পায়। কখনও কখনও ওর সারা রাত কেটে যায় সাগর সৈকতে।
সেই দোকানে যাবে একবার? ভাবে ইকথিয়ান্ডার। একবার গেলও। কিন্তু দোকানে তখন এক বুড়ো ছাড়া আর কেউ ছিল না। এবার সৈকতে চলে এলো ও হতাশ হয়ে। চমকে যেতে হলো ওকে। ওই তো! ওই তো! ওই যে সেই মেয়েটি!!! আজ ওর পরনে সাদা একটা পোশাক। মাথায় খড়ের টুপি। চমৎকার লাগছে দেখতে। কিন্তু ও যেন একটু উৎসুক? মেয়েটি পায়চারি করছে সৈকতে, বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে, যেন কারও প্রতীক্ষায় আছে। ইকথিয়ান্ডারকে সে দেখেনি। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ইকথিয়ান্ডার।
কার উদ্দেশে যেন হাত নাড়ল মেয়েটি। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মেয়েটার হাত নাড়া লক্ষ্য করে তাকাল ইকথিয়ান্ডার। দেখল স্বাস্থ্যবান এক সুদর্শন যুবক দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে এদিকেই। মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়াল সে। কণ্ঠে মধু ঝরল।
শুভ সন্ধে, আমার গুট্টিয়ারা।
শুভ সন্ধে, অলসেন, জবাবে রিনিঝিনি করে উঠল গুট্টিয়ারার মিষ্টি কণ্ঠ।
হাতে হাত ধরল দুজম। বুকের ভেতর কি যেন নড়ে গেল ইকথিয়ান্ডারের। চোখে নিরব নিষেধ আর অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকল ও। নিজের অনুভূতি নিজেই বুঝতে পারছে না। চোখে অশ্রু চলে এলো।
যুবকের দৃষ্টি গুট্টিয়ারার গলার ওপর। একটা মুক্তোর মালা ঝিলমিল করছে বরাদে।
এনেছ, গুট্টিয়ারা?
মাথা দোলা মেয়েটি। এনেছি।
তোমার বাবা জানবে না তো?
না। এটা আমার নিজের জিনিস। বাবা কিছু বলবে না। যা খুশি আমি করতে পারি এটা নিয়ে…
আলাপ করতে করতে সাগরের কিনারায় চলে এলো যুবক-যুবতী। গলা থেকে মালাটা খুলল গুট্টিয়ারা, সূর্যের সোনালী আলোয় ওটা চোখের সামনে ধরে প্রশংসার সুরে বলল, দেখো, কি চমৎকার লাগছে রোদে। নাও, অলসেন…
হাত বাড়াল অলসেন। কিন্তু কপাল মন্দ তার! গুট্টিয়ারার হাত ফস্কে সাগরে পড়ে গেল মালা, মুহূর্তে ফিরতি ঢেউয়ের স্রোতে পড়ে হারিয়ে গেল সাগরের মাঝে।
গুঙিয়ে উঠল গুট্টিয়ারা। কি হবে এখন?
থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল দুজন। হতাশ হলেও অলসেন বলল, পানির তলায় একবার খুঁজে দেখলে হয়।
মাথা নাড়ল গুট্টিয়ারা। এখানে সাগর বেশ গভীর। আমাদের কপাল খারাপ। ওই মালা আর পাওয়ার আশা নেই।
বিমর্ষ গুট্টিয়ারাকে দেখে স্থির থাকতে পারল না। ইকথিয়ান্ডার, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল যুবক-যুবতীর সামনে উপস্থিত হয়ে গেছে সে। পাথরের আড়াল থেকে তাকে বের হতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল অলসেন। চোখে কৌতুক আর বিস্ময় নিয়ে গুট্টিয়ারাও তাকাল। ইকথিয়ান্ডারকে সে চিনতে পেরেছে। এই যুবকই সেদিন দোকানে অদ্ভুত আচরণ করেছিল, তাকে দেখে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল দোকান থেকে।
আমি কি আপনার মুক্তোর মালা সাগর থেকে তুলে দিতে পারি? অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে জানতে চাইল ইকথিয়ান্ডার। চেয়ে আছে গুট্টিয়ারার নীল চোখে।
আপত্তি জানাল গুট্টিয়ারা। পারবেন বলে মনে হয় না। আমার বাবা নামকরা ডুবুরি, কিন্তু সে-ও এত গভীর পানিতে মনে হয় কিছু করতে পারবে না।
একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক, বিনয়ের সঙ্গে কথাটা বলল। ইকথিয়ান্ডার, পর মুহূর্তে ওদের অবাক করে দিয়ে কাপড় না ছেড়েই ঝাঁপ দিল সাগরে, তলিয়ে গেল গভীর পানিতে।
কিছু বুঝতে না পেরে অলসেন বলল, কে লোকটা? হঠাৎ করে কোথেকে হাজির হলো?
দেখতে দেখতে অধীর প্রতিক্ষায় তিন মিনিট পার হয়ে গেল। উঠছে না লোকটা! উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে অস্থির হয়ে গেল দুজন। গুট্টিয়ারা বিড়বিড় করল, ডুবে গেল নাকি লোকটা?
যতক্ষণ ইচ্ছে পানির তলায় থাকতে পারে এটা গুট্টিয়ারা বা আর কাউকে জানানোর কোন ইচ্ছে ছিল না ইকথিয়ান্ডারের। কিন্তু সময়ের হিসেব ভুল হয়ে গেছে তার। মালাটা খুঁজে পেতে একটু দেরিই হয়ে যাচ্ছে।
দমের কথাটা মাথায় আসতেই শ্বাস নেবার জন্যে একবার পানির ওপর মাথা জাগাল ও। গুট্টিয়ারার উদ্দেশে হাসিমুখে বলল, আরেকটু দাঁড়ান। পানির নিচে পাথরের খাঁজ আর ভাঁজে ভরা। কোথায় যে মালাটা আছে তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু চিন্তা করবেন না, ঠিকই ওই মালা আমি তুলে আনব।
আবার তলিয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার।
ভাসল আবার দুমিনিট পর। অনিন্দিত দেখাচ্ছে তাকে। হাত তুলে মালাটা দেখাল গুট্টিয়ারাকে। উঠে এলো সাগর থেকে। গুট্টিয়ারার দিকে মালাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নিন।
ধন্যবাদ। মালাটা নিল গুট্টিয়ারা, দুচোখে বিস্ময়। চেয়ে আছে সুঠামদেহী ইকথিয়ান্ডারের দিকে।
বুকটা গর্বে ভরে উঠল ইকথিয়ান্ডারের। অলসেনকে পাত্তা না দিয়ে গুট্টিয়ারাকে বলল, আপনি বোধহয় মালাটা এই ভদ্রলোককে দিতে। চাইছিলেন?
হ্যাঁ। বিব্রত বোধ করছে গুট্টিয়ারা। বুঝতে পারছে তার উপস্থিতি দুই পুরুষকে মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
লসেনের হাতে মালাটা দিল ও। নিরবে সেটা নিল অলসেন, পকেটে ভরে রাখল।
একবার মাথা নোয়াল ইকথিয়ান্ডার গুট্টিয়ারার উদ্দেশে, তারপর সরে এলো ওদের কাছ থেকে। ওর মনে এখন অনেক অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। চিন্তার স্রোতে ডুবে যাচ্ছে ও, কোন খেই পাচ্ছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে, পৃথিবীর স্বাভাবিক মানুষ সম্বন্ধে তার জ্ঞান সত্যি খুব কম। বারবার মনের মাঝে প্রশ্ন জাগছে, গুট্টিয়ারার সঙ্গে ওই সুদর্শন সুদেহী যুবকটি কে? নিজের গলার মালা কেন তাকে খুলে দিয়ে দিচ্ছে গুট্টিয়ারা? কি নিয়ে কথা বলছিল ওরা?
অশান্ত মন আর শান্ত হতে চায় না। মনের আকাশে জমেছে ঘন কালো মেঘ, বজ্রবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে হৃদয়ের নরম জমিতে। বজ্র করতে চাইছে আঘাত, জল চাইছে হৃদয়ের জমিকে আরও কোমল করে দিতে।
সারারাত লিডিঙের পিঠে চেপে সাগরে ছুটে বেড়াল ইকথিয়ান্ডার। মাঝে মাঝেই চিৎকার করে ভয় দেখাল সে জেলেদের অন্ধকার চিরে দিল তার কণ্ঠস্বর। কিন্তু কিছুতেই আজ শান্ত হলো না ওর মন। অবুঝ আবেগে কাঁদছে হৃদয়।
পরেরদিনটা সাগরের তলায় কাটাল ইকথিয়ান্ডার। আজকে সে খুবই ব্যস্ত। সাগর-তলের বালির মাঝ থেকে মুক্তো-ভরা ঝিনুক খুঁজে খুঁজে বের করল। বাড়ি ফিরল অনেক রাত করে। ক্রিস্টোর বকাবকির পালা শেষ হলে প্রয়োজন মনে হলে দায়সারা জবাব দিল। তারপর সকাল হতেই ফিটফাট হয়ে চলে এলো ও যেখানে দেখেছিল গুট্টিয়ারা আর সেই যুবককে গুট্টিয়ারাকে খুব দরকার ওর। অনেক কথা জমে আছে বুকের মাঝে। আর…
বিকেলে সূর্যাস্তের সময় এলো গুট্টিয়ারা সৈকতে। দেরি না করে পাথরের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে তার সামনে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার।
ওকে দেখে হাসল গুট্টিয়ারা। ভদৃতার হাসি। তারপর উপহাসের সুরে জানতে চাইল, আমার পিছু নিয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ, সরল মনে স্বীকার করল ইকথিয়ান্ডার। যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই… চুপ হয়ে গেল ও। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি মুক্তো খুব ভালবাসেন, তাই না?
মাথা দোলাল গুট্টিয়ারা। কোন মেয়ে না মুক্তো ভালবাসে!
তাহলে আমার এই মুক্তোটা আপনি নিন, বলে একটা মুক্তো বাড়িয়ে ধরল ইকথিয়ান্ডার।
মুক্তো ব্যবসায়ীর মেয়ে গুট্টিয়ারা। মুক্তোর দাম সম্বন্ধে ভাল ধারণা রাখে। ধবধবে সাদা বিশাল আকারের অপূর্ব সুন্দর মুক্তোটা দেখে চোখ কপালে উঠল ওর। এত সুন্দর জিনিস আগে কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অন্তত দুশো ক্যারেট হবে ওটার ওজন। দশ লাখের কম হবে দাম, বেশি হতে পারে। ইকথিয়ান্ডারের দিকে গ্রহ নিয়ে তাকাল গুট্টিয়ারা। সামনে দাঁড়ানো লোকটা সুদর্শন, সুগঠিত দেহ, পরিপূর্ণ এক যুবক! অথচ কেমন যেন লাজুক ধরনের। লজ্জা পাচ্ছে তা পরিষ্কার বোঝাও যাচ্ছে। সে যে একটা সুন্দরী মেয়ের সামনে আছে, এখন যে তাকে পৌরুষ দিয়ে মেয়েটির মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে সে বিষয়ে যুবক যেন পুরোপুরি সচেতন নয়। বুয়েন্স আয়ার্সের বড়লোকের উদ্ধত ছোকরাদের মতো নয় মোটেও। অবাক লাগছে গুট্টিয়ারার। তার মতো স্বল্প পরিচিত একটি মেয়েকে কি করে উপহার দিতে চাইছে যুবক এত দামি একটা মুক্তো?
দয়া করে এটা নিন আপনি, বলল ইকথিয়ান্ডার।
আপত্তি জানাল গুট্টিয়ারা। না, না, তা কি করে সম্ভব! এত দামি উপহার আমি আপনার কাছ থেকে নিতে পারি না।
কে বলল দামি, উত্তেজনায় প্রায় হাঁফাচ্ছে ইকথিয়ান্ডার। একটু বাড়িয়েই বলল, সাগর-তলে এরকম হাজার হাজার মুক্তো পড়ে আছে। দয়া করে ওটা নিন আপনি।
না, না। তা হয় না।
বুকের মাঝে অজানা কষ্টে ছেয়ে গেল ইকথিয়ান্ডারের। জ কুঁচকে গেল অজান্তে। একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ঠিক আছে, নিজের জন্যে যখন দরকার নেই আপনার, নাহয় যাকে আপনি মালাটা দিয়েছেন সেই অলসেনকেই দিয়ে দেবেন।
এবার গুট্টিয়ারাও রেগে গেল। বলল, যা বোঝেন না তা নিয়ে খোঁচাতে আসবেন না। অলসেন নিজের জন্যে মালাটা নেয়নি। এব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না।
পুরুষমানুষ, জেদ চেপে গেছে ইকথিয়ান্ডারেরও। সে বলল, আপনি তাহলে মুক্তোটা নেবেন না?
না।
সাগরের পানিতে মুক্তোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ইকথিয়ান্ডার। ঘুরে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল সাগর-তীরের রাস্তাটা ধরে।
একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ল গুট্টিয়ারা। কে এই যুবক! কে এ? কে এমন যে দশ লাখের মুক্তো সামান্য একটা ঢিলের মতোই গভীর সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সামান্য কারণে? কেমন যেন লজ্জা লাগল গুট্টিয়ারার অভিমানী যুবকের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বুঝে পেছন থেকে ডাকল, এই যে, শুনুন! এই যে? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
অভিমানে ঠোঁট ফুলে গেছে ইকথিয়ান্ডারের, হেঁটেই চলেছে, মাথা নিচু করে। ছুটে এসে পেছন থেকে ইকথিয়ান্ডারের হাত ধরে ফেলল গুট্টিয়ারা। অবাক হয়ে লক্ষ করল ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে অভিমানী যুবকের দুগাল বেয়ে।
আগে কখনও কাঁদেনি ইকথিয়ান্ডার, কাজেই বুঝতে পারছে না বুকের মাঝে কেন এত কষ্ট, কেন চোখের সামনে ঝাঁপসা দেখাচ্ছে সবকিছু। মনে হচ্ছে যেন গগলস ছাড়া সাগরের কাদা-পানিতে সাঁতার কাটছে ও।
ইকথিয়ান্ডারের হাতে চেপে বসল গুট্টিয়ারার চাপা কলার মতো সুন্দর আঙুল। বিড়বিড় করে বলল গুট্টিয়ারা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি না বুঝে আপনার মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।