পুরু গোঁফে তা দিতে দিতে অস্থির পায়ে পায়চারি করছে ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা। তার পরনে এখন শহুরে পোশাক। মাথায় পানামা হ্যাট। তার সামনেই দাঁড়িয়ে বালথাযার।
বুয়েন্স আয়ার্স শহরের প্রান্তে যেখানে কৃষিজমি শুরু হয়েছে সেখান থেকেই পম্পাস প্রেয়ারির শুরু। শুধু ঘাস আর ঘাসজমি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে পেদরো বলে উঠল, সে যদি আজকেও না আসে তাহলে তোমার ভরসায় আর থাকা যাবে না, আরও দক্ষ আর যোগ্য কাউকে পাঠাতে হবে আমার।
মাথা নিচু করে ঘাসের ডগা ছিড়ছে বালথাযার অপরাধী ভঙ্গিতে। এখন তার আফসোস হচ্ছে কেন ডাক্তার সালভাদরের বাড়িতে গুপ্তচর হিসেবে নিজের বড় ভাইকে পাঠাল। বড় ভাই ওর চেয়ে দশ বছরের বড়, কিন্তু স্বভাবে মানুষটা অস্থির প্রকৃতির। তার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় না। ক্রিস্টোর কথা চিন্তা করে বালথাযার ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করল।
তোমার কি মনে হয়, বলল পেদরো! যে, বেলুনটা তুমি ছেড়েছিলে সেটা তোমার ভাইয়ের চোখে পড়েছে?
জবাব কি দেবে ঠিক করতে পারল না বালথাযার। এখন তার ইচ্ছে করছে এই ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে।
একটু পর টিলার ওপরে দেখা গেল ধুলো। কে যেন আসছে। সুরও ভঁজছে মৃদু স্বরে শিস দিয়ে।
মুহূর্তে সচেতন হয়ে উঠল বালথাযার! বলল, ওই তো! ও এসে, গেছে!
এলো তাহলে, আগের চেয়ে একটু উষ্ণ গলায় বলল দেরো।
দ্রুত পায়ে আসছে ক্রিস্টো ওদের দিকে। এখন তাকে বৃদ্ধ একটা রুগ্ন ভীতু রেড ইন্ডিয়ান বলে মনে হচ্ছে না, যেন চপল কোন তরুণ। শিস দিতে দিতে মন ভরা ফুর্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে। পেদরো আর বালথাযারের সামনে এসে থামল।
সরাসরি কাজের কথায় এলো পেদরো। সাগর-দানোর কোন খবর পাওয়া গেল?
না। এখনও কিছু পাইনি। তবে এটা ঠিক যে সে ওখানেই আছে। ডাক্তার তাকে একটা দেয়ালের ওপাশে রাখে। সেখানে যাওয়া সহজ নয়। অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। ডাক্তার এখন আমাকে বিশ্বাস করে। ঠিকই কাজ উদ্ধার করে আসতে পারব। নাতনীর উদ্বিগ্ন দাদা সেজে যে অভিনয়টা করেছিলাম তাতে পুরোপুরি পাশ করেছি আমি। ডাক্তারের মনে কোন সন্দেহই হয়নি।
নাতনী জোটালে কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করল পেদরো।
হাসল ক্রিস্টো। টাকা জোগাড় করতে যত কষ্ট। মেয়ে জোগাড় করা আর কতক্ষণের ব্যাপার। আমাদের দুপক্ষেরই উপকারও হলো মাঝখান থেকে। আমি পেলাম টাকা আর মেয়েটার মা পেল সুস্থ মেয়ে। নিজের ব্যাপারে ক্রিস্টো এতই তৃপ্ত যে মুচকি মুচকি হাসছে।
ডাক্তারের কাছ থেকে সোনার মোহর পাওয়ার কথাটা সে। বালথাযার আর পেরোকে জানাল না। মোহরের ভাগ কাউকে দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার।
ধীরেসুস্থে পেদরো আর বালথার্যারকে সে খুলে বলল ডাক্তারের বাগানের আজব অভিজ্ঞতা। তার কথা শেষ হওয়ার পর পেদরো জুরিতা বিরক্ত হয়ে বলল, এসব তো শুনলাম। আসল কাজের কি হবে! সাগর-দানোর খবরটাই তো তুমি আনতে পারলে না। কিছু ভেবেছ কিভাবে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে?
ক্রিস্টো বলল ডাক্তার সাহেব আর কয়েকদিনের মধ্যেই আন্দেজ পর্বতে যাবেন পশু-পাখি সংগ্রহ করতে, তখন যদি বা কিছু করা যায়।
কথাটা শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল পেদরো জুরিতা। বলল, দারুণ! সালভাদরের বাড়ি জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সে যখন থাকবে না তখন হামলা চালাব আমরা, সাগর-দানোকে ধরে পাকড়াও করে নিয়ে আসব।
আপত্তির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ক্রিস্টো। অসম্ভব নয়। ডাক্তারের পোষা কুগারগুলো আপনাকে স্রেফ ছিঁড়েখুঁয়ে খেয়ে ফেলবে। তাছাড়া সাগর-দানো কোথায় থাকে সেটা এতদিন ওখানে থেকেও আমি এখনও জানতে পারিনি। হঠাৎ করেগিয়ে আপনি তাকে পাবেন কি করে!
কিছুক্ষণ জ্ব কুঁচকে ভাবল পেদরো, তারপর বলল, তাহলে আরেক কাজ করা যায়। সালভাদর যখন শিকারে যাবে সেই সুযোগে তাকে আমরা বন্দি করব। মুক্তিপণ হিসেবে তার কাছে সাগর-দানোকে দাবি। করব।
পেদরোর কোটের পকেট থেকে একটা চুরুটের প্রান্ত বেরিয়ে আছে। এটা দেখতে পেয়েই আলগোছে হাতে তুলে নিল ক্রিস্টো, চুরুটটা ধরিয়ে বুক ভরে ধোয়া টেনে নিয়ে অলস গলায় বলল, বুদ্ধিটা ভাল। কিন্তু কথা রাখবে না সালভাদর। বলবে সাগর-দানোকে দেব, কিন্তু আসলে দেবে না। ওর মতো স্প্যানিশগুলো উহ উহহু… খারাপ
একটা কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না ক্রিস্টো চুরুটের ধোঁয়ায়। কাশি পাওয়ায়।
তাহলে কি করা উচিত? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল জুরিতা।
ধৈর্য ধরতে হবে, বলল ক্রিস্টো। ধৈর্য ধরতে হবে, ক্যাপ্টেন। ডাক্তার আমাকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসের সীমা ওই চার নম্বর দেয়াল পর্যন্তই। বিশ্বাসটা আরও বাড়ক, নিজের লোকদের মতোই বিশ্বাস করতে শুরু করুন, নিশ্চয়ই তিনি সাগর-দানোকে দেখাবেন।
সে তো সময়ের ব্যাপার, হতাশ গলায় বলল পেদরো জুরিতা। তাহলে কি করা?
বুকের মাঝে আঙুল দিয়ে টোকা দিল ক্রিস্টো। ডাকাত পড়বে। ডাক্তারের যাত্রায়। আর মামি ভূমিকা নেব আরাউকানি প্রভুভক্ত এক সাহসী রেড ইন্ডিয়ানের। আমি ডাক্তারকে বাঁচাব। এর ফলে আমি তার আরও বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠব। তাহলেই আমার জানা হয়ে যাবে ডাক্তারের আস্তানার গোপন সব খবর।
বুদ্ধি খারাপ না, বলল পেদরো জুরিতা।
ক্রিস্টো কোন রাস্তা দিয়ে ডাক্তার সালভাদরকে নিয়ে পাহাড়ে যাবে সেকথা জুরিতাকে বলে দিল ক্রিস্টো আরও বলল রওনা হবার আগের দিন দেয়ালের ওপাশে একটা লাল পাথর ছুঁড়ে সে জানিয়ে দেবে যে তারা রওনা হচ্ছে আগামীকাল।
ক্রিস্টোর পরিকল্পনা নিটোল হলেও একটুর জন্যে মার খেয়ে যাচ্ছিল। পম্পাস প্রেয়ারির গাউচা উপজাতীয়দের মতোই পোশাক পরে ছদ্মবেশ ধরল পেদরো জুরিতা। বালথাযার বন্দর এলাকা থেকে ভাড়া করে আনল জনা দশেক মার্কামারা খুনী। প্রত্যেকেই সশস্ত্র।
অপেক্ষা করছে তারা সালভাদরের বাড়ির কাছ থেকে খানিক দূরে এক। সুবিধে মতো জায়গায়।
প্রত্যেকের কান খাড়া। ডাক্তার এলে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যাবে। সবই ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু ক্রিস্টো জানে না আগের মতো আর ঘোড়ায় চড়ে শিকারে যান না ডাক্তার। এখন তিনি মোটর গাড়ি ব্যবহার করেন।
একটু পরই গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে। তারপর দেখা গেল হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো। পেরার দল কিছু বোঝার আগেই চোখের পলকে ওদের পাশ কাটাল গাড়িটা। পেনরোরা ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ওগুলোর সাধ্য নেই গাড়ির গতির সঙ্গে পাল্লা দেয়। নিরুপায় হয়ে এ ওর দিকে তাকাল তা।
খিস্তিখেউড় শুরু করল পেদরো। বালথাযার হাসছে। পেরোকে সান্ত্বনা দিল, চিন্তার কিছু নেই। নির বেলা গরম হলে ডাক্তার রাতে বেরিয়েছেন। কিন্তু দিনে তো? কোথাও না কোথাও বিশ্রাম নিতে হবে। সেসময়ে তাকে আটক করব আমরা।
বালথাযারের পরামর্শে ঘোড়া নিয়ে এগোল পেদরো ভাড়া করা ডাকাত-দল। ধীরেসুস্থে চলেছে তারা। দুই ঘণ্টা পর সামনে একটা অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেল। সবাইকে থামতে নির্দেশ(দিল বালথাযার। বলল, ব্যাপারটা কি বোঝা দরকার। সবার যাওয়ার দরকার নেই। আমি একা গিয়ে দেখে আসি ঘটনা কি?
ঘোড়া থেকে নেমে ক্রল করে এগোল বালথাযার। অন্ধকারে তাকে আর একটু পরই দেখা গেল না। ফিরল সে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে। যা জানাল তা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, ডাক্তারের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, সেটা এখন মেরামত চলছে। ক্রিস্টো ডাক্তারের সঙ্গেছে। পাহারা দিচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, হাতে বেশি সময় নেই। গাড়ি মেরামত হয়ে গেলেই আর ডাক্তারকে ধরা যাবে না সহজে।
এবার খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করল একের পর এক উত্তেজনাময় ঘটনা। পেদরো জুরিতার ভাড়াটে ডাকাতরা হঠাৎ করেই হামলা করে বসল ডাক্তার সাহেবের শিকারী দলের ওপর। মুহূর্তে বন্দি হয়ে গেলেন ডাক্তার। ক্রিস্টো আর ডাক্তারের তিন সহকারীও বাদ গেল না। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হলো তাদের। ক্যাপ্টেন পেদরো নিজেকে আড়ালে রেখেছে, যাতে তার জড়িত থাকা ডাক্তার না জানেন। ভাড়াটে ডাকাতদের মাধ্যমে ডাক্তারের কাছে মোটা অংকের মুক্তিপণ চেয়ে পাঠাল সে।
টাকা যা লাগে দেব, বললেন ডাক্তার, কিন্তু আমাদের ছেড়ে দাও।
এক ডাকাত বলল, বুঝলাম তোমার জন্যে টাকা দেবে। তোমার সঙ্গীদের জন্যে কিন্তু আলাদা ভাবে টাকা দিতে হবে।
কি একটু চিন্তা করলেন ডাক্তার, তারপর সত্যি কথাটাই বললেন, সবার টাকা একসঙ্গে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
একথা শুনে ডাকাতদের সর্দার চড়া গলায় বলল, তাহলে ওদের মরতে হবে। আর আমাদের ইচ্ছে মোতাবেক চলতে হবে তোমাকে, নইলে কাল ভোর হবার আগেই খতম করে দেব?
আমার অত টাকা নেই, সরাসরি স্বীকার করলে ডাক্তার।
সালভাদর ভয় পাননি মোটেও। তাঁর দৃঢ়তা ডাকাতদের অবাক–করল।
বন্দিদের বেঁধে রেখে টাকার সন্ধানে খোঁজাখুঁজি শুরু করল ডাকাতরা। গাড়ির পেছনের সীটের তলায় পাওয়া গেল খানিকটা স্পিরিট। মাতলামির শখ চাপল ডাকাতদের। মদের বদলে স্পিরিট গিলতে শুরু করল তারা বেহিসাবী মাত্রায়। একটু পরই কারও আর হুঁশজ্ঞান থাকল না।
ভোর হওয়ার আগে সালভাদরের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এলো এক লোক। সে আর কেউ নয়, ক্রিস্টো। ফিসফিস করে বলল, আমার বাঁধন খুলে ফেলেছি। ডাক্তার সাহেব, যে ডাকাতের কাছে বন্দুক ছিল তাকে মেরে ফেলেছি। অন্যরা নেশার ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। ড্রাইভারের বাঁধনও আমি খুলে দিয়েছি। গাড়ি নিয়ে সে তৈরি। এঞ্জিন মেরামত হয়ে গেছে। চলুন শিগগির। তাড়াতাড়ি!
দেরি না করে গাড়িতে ঢুকে বসল ডাক্তার সালভাদরের শিকারি দল। গাড়ি স্টার্ট দিল নিগ্রো ড্রাইভার। খুব দ্রুত স্পীড নিল গাড়ি, সাঁ সাঁ করে ছুটে চলল ঝড়ের বেগে। আবেগে কম্পিত হাতে ক্রিস্টোর হাত চেপে ধরলেন ডাক্তার।
বিরাট একটা সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে গেল পেদরো জুরিতার। কিন্তু আর উপায়ই বা কী! ক্রিস্টোর কাছ থেকে অনুকূল পরিবেশের খবর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা তাকে করতেই হবে।