দোকানে বসে আছে দুই ভাই, বালথাযার আর ক্রিস্টো। বেশ অনেকদিন পর আলাপ করছে মন খুলে। কথায় কথায় ক্রিস্টো জানাল, কাল আন্দেজ পাহাড় থেকে ফিরে আসছে ডাক্তার সালভাদর। এতদিন দেখা করতে পারিনি জ্বরের কারণে। অনেক কথা জমে আছে, বলতে হবে। মন দিয়ে শুনবি। মাঝখান থেকে কথা বলে আমার খেই হারিয়ে দিবি না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছে ক্রিস্টো। একটু পর শুরু করল, পেদরোর লোভ কিন্তু দিনকে দিন মাত্রা ছাড়িয়ে বেড়ে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখছে লোকটা। সেজন্যেই তার সাগর-দানোকে দরকার।
বালথাযার কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, ধমক দিয়ে তাকে থামাল ক্রিস্টো। চুপ করে শোন। বকবক করলে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে অসুবিধে হয় আমার। সে যাই হোক, যা বলছিলাম,সাগর দানোকে হাতের নাগালে পাওয়ার মানে বুঝিস? এক কথায় হাতে সব সম্পদ একবারে পাওয়া। দুনিয়ার বুকে স্বর্গ পারে যে তাকে ধরতে পারবে। সাগরের তলা থেকে রত্নের পাহাড় তুলে আনবে ওই দানো। শুধু মণি-রত্নই নয়, যেসব জাহাজ ডুবেছে, সেগুলোর সব সম্পদও তখন আহরণ করা যাবে। পেদরো সেই মতলবই করেছে।
বালথাযার আবার কি যেন বলতে হাঁ করেছিল, হাতের ঝাঁপটা আর ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে ক্রিস্টো বলে চলল, ছটফট না করে যা বলছি চুপ করে শোন্! পেদরো কেন সাগর-দানোকে ব্যবহার করে বড়লোক হবে? আমাদের বড়লোক হতে বাধা কোথায়? সমস্ত ধনরত্ন তো আমাদের জন্যেই তুলে আনতে পারে ওই দানো। বালথাযারের কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো ক্রিস্টো, ফিসফিস করে বলল, আর ওই দানো তো আসলে দানো নয়। ও হচ্ছে অসাধারণ এক মানুষ। ওর নাম ইকথিয়ান্ডার। তোর পালক মেয়ে গুট্টিয়ারাকে ভালবাসে ইকথিয়ান্ডার। জামাই হিসেবে পেরোর চেয়ে লক্ষগুণে ভাল হবে সে।
ভেবেচিন্তে দেখে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বালথাযার। কোন কথা বলল না।
ক্রিস্টো বলল, আরও বেশ কিছু ব্যাপার আ:ে তুই জানিস না। আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা, তোর মনে, তোর বউকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরছিলাম আমি? মনে নেই? মায়ের কবর দেখতে গিয়েছিল তোর বউ। মনে পড়ে? তোর বউয়ের একটা ছেলে হয়েছিল ফেরার পথে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়েই তো মারা গেল। বেচারি। আমার ধারণা হয়েছিল ছেলেটাও মারা গেছে। কিন্তু আসলে তা নয়। পরে বুঝেছি, ঘটনা পঁাচ খেয়ে গেছে। ঘটনাটা ঘটে একটা রেড ইন্ডিয়ান গ্রামে। সেই গ্রামের কাছে থাকত ডাক্তার সালভাদর। ছেলের মা মারা গেলেও ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচে যায়। গ্রামের লোকরা আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলল যদি ভাতিজাকে বাঁচাতে চাও তাহলে ওই ডাক্তার সালভাদরের কাছে নিয়ে যাও। উনি স্বয়ং স্রষ্টারই প্রতিরূপ। তোমার ভাতিজা যদি বাঁচে তাহলে ওই ডাক্তার সালভাদরের কারণেই বাঁচবে। ভেবে দেখলাম আমার হাতে থাকলে তোর ছেলে মারা যাবে। শেষে সবদিক চিন্তা করে ডাক্তারের হাতেই তাকে তুলে দিই আমি।
মুখ হাঁ করে ভাইয়ের কথা গিলছে লালথার। চোখ চকচক করছে প্রবল উত্তেজনায়। তবে কি…
ক্রিস্টো বলে চলেছে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমি বসে থাকলাম ডাক্তারের দরজার সামনে। তারপরও অনেকক্ষণ কেটে গেল। একসময় ডাক্তারের নিগ্রো চাকর এসে খবর দিল, ছেলেটা মারা গেছে। ওখানে থেকে তাকে কবর দেয়ার মানসিক অবস্থা তখন ছিল না আমার। ভাঙা মন নিয়ে তোর এখানে ফিরে আসি। আসল ঘটনা এখানেই প্যাঁচ খেয়েছে। তোর ছেলের ঘাড়ে একটা লাল জন্মদাগ ছিল। জন্মদাগটা ঠিক কেমন তা আজও আমার মনে আছে। কয়েকদিন আগে ওই একই দাগ দেখলাম আমি ইকথিয়ান্ডারের ঘাড়ে। একটা চোট নিয়ে বাড়িতে ফিরেছিল ও, সেকারণেই দেখার সুযোগ হয়।
তাহলে কি ইকথিয়ান্ডার আমার ছেলে? আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না বালথাযার।
গম্ভীর হয়ে গেল ক্রিস্টোর চেহারা। বলল, আমার বিশ্বাস সেদিন ডাক্তার সত্যি কথা বলেনি। তোর ছেলে আসলে মরেনি। তাকেই সাগর-দানো বানিয়েছে ডাক্তার সালভাদর।
ওকে খুন করব আমি! উত্তেজিত স্বরে বলল বালথাযার। ওই ডাক্তারকে নিজের হাতে শেষ করে দেব।
ক্রিস্টো তার স্বাভাবিক বুদ্ধি হারায়নি। ভাইকে শান্ত করে সে বলল, এখন একদম চুপচাপ থাকতে হবে আমাদের। মুখ একদম বন্ধ! তোর চেয়ে ডাক্তারের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশি। তুই যা-ই বলিস তোর কথা বিশ্বাস করবে না কেউ। আর এমনও তো হতে পারে যে আমার কোন ভুল হচ্ছে? ওই ছেলে তোর, এটা যেমন সত্যি, তেমনি মিথ্যেও হতে পারে। খুব সাবধানে কাজ। এগোতে হবে আমাদের।
তাহলে এখন আমাদের কি করা উচিত?
প্রথম কাজ ডাক্তার সালভাদরের কাছে যাওয়া। তাকে বলতে হবে যে ছেলে আসলে তোর। দরকারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাহায্য করব আমি। সাক্ষ্যও দেব। তাতেও যদি ডাক্তার ইকথিয়ান্ডারকে তোর হাতে তুলে না দেয় তাহলে তোকে মামলা করতে হবে ডাক্তারের নামে। কোর্টে দাঁড়িয়ে বলবি তখন, তোর ছেলেকে ডাক্তার নিজের ইচ্ছেমতো বিকলাঙ্গ করেছে। একটা কথা মনে রাখিস, যদি প্রমাণ হয় ইকথিয়ান্ডার তোর ছেলে নয়, তাহলেও গুট্টিয়ারার সঙ্গে ওকে বিয়ে। দিতে হবে। তোর মেয়েকে সে ভালবাসে। গুট্টিয়ারাকে বিয়ে করে আজীবন তোর নির্দেশ-পরামর্শ মানবে সে।
ছেলে! আমার ছেলে! ইকথিয়ান্ডার! কি কপাল আমার, হায়রে! বিড়বিড় করছে আর পায়চারি করছে বালথাযার। উত্তেজিত।
আহাজারি শুনে বিস্মিত হলো ক্রিস্টো। জিজ্ঞেস করল, কপাল নিয়ে সমস্যা কিরে, তোর কপাল তো খুলে গেল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বালথাযার। ধরা গলায় বলল, এতক্ষণ তোর কথা শুনলাম, নিজের কথা কিছু বলিনি। এবার শোন, আমার কপালের দোষ আছে রে। তুই তো গত কয়েকদিন আসিসনি। এরই মধ্যে গুট্টিয়ারার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে পেদরোর।
খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল ক্রিস্টো। ক্ষুব্ধ বালথাযার বলে চলল, আরও খারাপ খবর আছে। আমার ছেলে ইকথিয়ান্ডার এখন ক্যাপ্টেন পেদোর বন্দি।
চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল ক্রিস্টো। আপনমনে বলল, না, এ হতে পারে না।
জেলিফিশ জাহাজে ইকথিয়ান্ডার এখন বন্দি, জোর দিয়ে বলল বালথাযার। আজ সকালেই পেদরো এসেছিল। খুব গালাগালি করে গেল আমাকে। বলল আমরা নাকি তাকে চুষে ছিবড়ে বানিয়েছি শুধু, কোন কাজে আসিনি। আমাদের সাহায্য ছাড়াই সে ইকথিয়ান্ডারকে বন্দি করেছে। এখন থেকে সে আর এক পয়সা দিয়েও আমাদের সাহায্য করবে না। গুট্টিয়ারার চরিত্র নিয়েও বাজে বাজে কথা বলল।
বালথাযারের হতাশা প্রবল প্রভাব ফেলল ক্রিস্টোর মনে। সে নিজেও চরম হতাশা বোধ করছে। ভেবেছিল ইকথিয়ান্ডারের কাধের জন্মদাগের রহস্য জানিয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নেবে, কিন্তু ঘটনা যে এভাবে মোড় ঘুরবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বালথায্যারের কথায় এখন রীতিমতো ভয় লাগছে তার। ইকথিয়ান্ডার যদি সত্যিই বন্দি হয়ে থাকে তাহলে ডাক্তার কি আর তাকে আস্ত রাখবে? কালই ফিরছে ডাক্তার আন্দেজ পাহাড় থেকে। তখন? তার আগেই একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প দাঁড় করিয়ে নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিতে হবে তাকে। এই বয়সে নিশ্চিন্ত একটা চাকরি খোয়ানোর অর্থ পথে পথে ফকিরে মতো ঘুরে বেড়ানো। সে জীবন থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
পরদিন ভোর।
ডাক্তার তাঁর বাড়িতে ফিরেছেন। আগেই তৈরি হয়ে আছে ক্রিস্টো, চোখেমুখে তার শোকের চিহ্ন। আনুগত্য প্রকাশে আজ সে মহা পটু। ডাক্তারকে দেখেই প্রায় হাহাকার করে উঠল:
একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, স্যার! বারবার করে কতবার বললাম যাতে ইকথিয়ান্ডার খাঁড়ির দিকে সাঁতার কাটতে না যায়, কিন্তু ও শুনল না। হায়…
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন উৎকণ্ঠিত ডাক্তার, কি হয়েছে ইকথিয়ান্ডারের?
ধরা পড়ে গেছে। একটা জাহাজ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি…।
আর কোন কথা বলার সুযোগ ডাক্তার তাকে দিলেন না, একবার শুধু সামান্য নিয়ন্ত্রণ হারালেন, ক্রিস্টোর কাঁধে চেপে বসল এর হাতের আঙুলগুলো, পরমুহূর্তেই শিথিল হয়ে গেল বজ্রআঁটুনি। নিগ্রো চাকরকে ডাকলেন তিনি। অজানা একটা ভাষায় তাকে বেশক্ষিছু নির্দেশ দিয়ে ক্রিস্টোর দিকে ফিরলেন। আমার সঙ্গে তুমি যাচ্ছ, ক্রিস্টো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
কাপড় না বদলেই বাগানের দিকে চলে গেলেন ডাক্তার সালভাদর। তাঁর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে প্রায় দৌড়োতে হচ্ছে ক্রিস্টোকে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল সে, আমি স্যার কুকুরের মতো করে ইকথিয়ান্ডারকে পাহারা দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু…
তার কথা ডাক্তার শুনছেন বলে মনে হলো না। বাঁদর বসে ছিল যে পুকুরের নিচে সেখানে চলে এলেন তিনি। গোপন বোতামে চাপ দিয়ে পুকুরের সমস্ত পানি বের করে দিলেন। নিচে নামার সিঁড়িটার দিকে পা ব্যড়িয়ে বললেন, আমার সঙ্গে এসো, ক্রিস্টো।
অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছেন ডাক্তার সালভাদর। পেছনে হোঁচট খেতে খেতে ক্রিস্টো। সে বুঝতে পারল এই গুহা আর অন্ধকার সবই ডাক্তারের নখদর্পণে।
নিচে নেমে আর কোন সুইচ টিপলেন না ডাক্তার সালভাদর, অন্ধকারেই ডানদিকের একটা দরজা খুললেন, সামনে আরেকটা সুড়ঙ্গ পথ। ক্রিস্টোকে নিয়ে এগিয়ে চললেন সেই পথ ধরে।
অনেকক্ষণ পর ক্রিস্টোর মনে হলো ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এবার সালভাদর আলো জ্বাললেন। ক্রিস্টো দেখল তারা দুজন আংশিক পানি ভরা বিরাট একটা লম্বাটে গুহায় এসে উপস্থিত হয়েছে। গুহার গোল ছাদ দুপাশে ঢালু হয়ে পানির সঙ্গে মিশে গেছে। ওরা পাথর দিয়ে বাঁধানো যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার ঠিক ধারেই পানির ওপর ভাসছে একটা ছোট সাবমেরিন। সোজা সেটায় চড়লেন সালভাদর। ক্রিস্টোকেও উঠতে হলো। কেবিনের আলো জ্বাললেন ডাক্তার। একজন নিগ্রো চাকর ওপরের ঢাকনাটা এঁটে দিল, আরেকজন বসল এঞ্জিনে। সে এঞ্জিন স্টার্ট দিতেই সাকমেরিনটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, ধীরে ধীরে সামনের দিকে বাড়ছে
দুই মিনিটও লাগল না, সাগরের ওপরে শরীর জাগাল সাবমেরিন। এমন বাহনে চড়ার অভিজ্ঞতা ক্রিস্টোর কখনও হয়নি। সাবমেরিনের দ্রুতগতি দেখে ওর মনে হলো যন্ত্রের এঞ্জিনটা খুব শক্তিশালী।
ক্রিস্টোকে জিজ্ঞেস করলেন সালভাদর, ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে কোনদিকে গেছে সেই জাহাজটা?
উত্তর তীর বরাবর, জবাব দিল ক্রিস্টো। কিন্তু একটা কথা, স্যার…
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন সালভাদর। ক্রিস্টো ইতস্তত করছে দেখে তাগাদা দিলেন, কই, কি হলো! বলো?
আমার ভাই বালথাযারকেও আপনি সঙ্গে নিন, বলল ক্রিস্টো। বালথাযরি জানে জেলিফিশ জাহাজের মালিক পেদরো জুরিতা ইকথিয়ান্ডারকে জোর করে আটকে রেখেছে। ও আরও জানে যে ইকথিয়ান্ডারকে দিয়ে ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন পেনরো জুৰ্ধিতা মুক্তো তোলাবার স্বপ্ন দেখছে। সাগরে কোথায় ভাল মুক্তো পাওয়া যাবে সেখবরও জানে আমার ভাই। ও সহজেই বলতে পারবে কোথায় থাকতে পারে জেলিফিশ জাহাজ।
কথাগুলো একবার ভেবে দেখে বললেন ডাক্তার সালভাদর, ঠিক আছে, তোমার ভাইকেও সঙ্গে নেব। থাকে কোথায় সে?
আমি তাকে বলে রেখেছি, স্যার। বাঁধের ওপর তৈরি হয়ে অপেক্ষা করবে সে।
উপকূলের দিকে এগিয়ে চলল সাবমেরিন। সাঁতার কেটে সাবমেরিনে উঠে এলো বালথাযার। আপনাআপনি তার জ কুঁচকে গেল ডাক্তার সালভাদরকে দেখে, ভুলতে পারছে না এই ডাক্তারই তার ছেলেকে অপারেশন করে বিকলাঙ্গ করেছে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারকে সালাম জানাল সে। সালামের জবাব দিলেন ডাক্তার।
তীব্র গতিতে সাগরের পানি চিরে দিয়ে ছুটতে শুরু করল সাবমেরিন।