বুয়েন্স আয়ার্সের পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন স্থানীয় গির্জার আর্চ বিশপ, হুয়ান দ্য গার্সিলাসো।
আদালতে বিশপের আগমন একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।
বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষ প্রসিকিউটর। চোখ-মুখ ফোলা ফোলা। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। গোঁফের দুপ্রান্ত মোম দিয়ে পালিশ করে ছুঁচাল করা। দেখলেই তাঁকে দক্ষ লোক বলে মনে হয়। আর্চ বিশপকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন তিনি, সসম্মানে স্বাগত জানালেন, তারপর বসতে সাহায্য করলেন চামড়ার গদিমোড়া আসনে।
বিশপের চেহারা প্রসিকিউটরের প্রায় উল্টো বললেই হয়। শীর্ণ মুখটা ফ্যাকাশে। নাকটি সরু ও খাড়া। চিবুকটাও শুকনো। নীলাভ বর্ণ ঠোঁটের। কথা বলার সময় তিনি কারও দিকে তাকান না, অথচ সবাইকেই মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেন। বুয়েন্স আয়ার্সে তার প্রচণ্ড পতিপত্তি। ধর্মীয় বিষয়াদি বাদ দিয়ে মাঝে মধ্যেই তিনি নামেন রাজনীতির নোংরা ময়দানে।
অভিবাদন বিনিময় শেষ হতে না হতে কাজের কথায় চলে এলেন বিশপ।
জানতে এলাম ডাক্তার সালভাদরের মামলাটা এখন কোন পর্যায়ে।
হ্যাঁ, ডাক্তার সালভাদর, সৌজন্য দেখাতে কার্পণ্য করছেন না প্রসিকিউটর, ওই মামলাটা সত্যিই চাঞ্চল্যকর। আপনিও বেশ কৌতূহলী, তাই না? মোটা একটা খাতার পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন তিনি। মুখও চলছে সেই সঙ্গে। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতার জবানবন্দি নিয়ে প্রফেস সালভাদরের ওখানে খানাতল্লাশি চালাই আমরা। দেখলাম ক্যাপেনের জবানবন্দি সঠিক। জীবজম্ভর ওপর আশ্চর্য সব অস্ত্রপচার করেছেন তিনি। ডাক্তার সালভাদরের বাগানটা বিকৃত প্রাণীদের বিরল একটা আবাস। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে ওখানে।
হ্যাঁ। সেসব তো কাগজেই দেখেছি, বললেন বিশপ। এবার বলুন, ডাক্তার সালভাদরকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?
হয়েছে, জানালেন প্রসিকিউটর। তাছাড়া সাক্ষি হিসেবে ইকথিয়ান্ডার নামের এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে এসেছি আমরা। সাগর দানো নিয়ে এই যে এত হৈ-চৈ, হট্টগোল, লেখালেখি, সেসবই নাকি এই যুবককে নিয়ে। এই যুবকই নাকি আসলে সাগর-দানো। কে ভাবতে পেরেছিল ডাক্তার সালভাদরের সংগ্রহে রাখা একটা আজব মানুষ সে! এখন বড় বড় ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা বিকৃত প্রাণী নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। সালভাদরের বাগান বা চিড়িয়াখানা যেটাই বলুন, মস্ত বড়। পুরো বাগান খালি করে শহরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়! কাজেই তা করা হয়নি। শুধু ইকথিয়ান্ডারকে আনা হয়েছে। আদালতের নিচের তলার একটা কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে। এই নিয়ে ঝামেলারও অন্ত নেই। মস্ত বড় একটা চৌবাচ্চা বানাতে হয়েছে তরি জন্যে। পানি ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। দেখলাম পানি নেই বলে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল তার। বোঝা যায়, ডাক্তার সালভাদর তার শরীরে অস্বাভাবিক সব পরিবর্তন এনেছেন। যুবক এখন উভচর মানব। আমাদের বিজ্ঞানীরা ওকে পরীক্ষা করে দেখছেন, চেষ্টা করছেন পরিষ্কার ভাবে সমস্যাটা বুঝতে।
এসব জানতে আমি আসিনি, শান্ত স্বরে জানালেন বিশপ। আমি জানতে চাই প্রফেসরের কি শাস্তি হবে। আইনের কোন ধারায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে? আপনার ব্যক্তিগত মতামতও জানতে চাই। তার কি শাস্তি হয়ে যাবে?
সালভাদরের মামলা আইনের চোখে এক অসাধারণ ঘটনা, বললেন প্রসিকিউটর। আইনের কোন ধারায় এই ভদ্রলোককে ফেললে সেটা ন্যায্য হবে তা আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে আমাদের কাজ সোজা হয়ে যাবে যদি বেআইনী অঙ্গ ব্যবচ্ছেদের অভিযোগ আনা হয় ডাক্তারের বিরুদ্ধে। ওই ইকথিয়ান্ডারকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন বিশপ, আপনার ব্যক্তিগত মতামত কি, প্রসিকিউটর, সালভাদরের এই সব কর্মকাণ্ডের পেছনে অপরাধের কোন ব্যাপার নেই?
আছে, ধীরে ধীরে বললেন প্রসিকিউটর। একথাও বলব যে অপরাধ প্রবণতা থাকতে বাধ্য। কিন্তু তা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। একটা আবেদন এসেছে, বালথাযার নামের এক রেড ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে, তার দাবি ইকথিয়ান্ডার তারই ছেলে। কিন্তু জোরাল প্রমাণ নেই তার হাতে। বিশেষজ্ঞরা যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে ইকথিয়ান্ডার তারই ছেলে তাহলে তাকে আমরা সাক্ষি হিসেবে কাজে লাগাতে পারব।
বিরক্ত চেহারায় শুনছিলেন বিশপ! এবার প্রসিকিউটর থামতে বললেন, তার মানে সালভাদরের বিরুদ্ধে চিকিৎসাবিধি অমান্য করার অভিযোগ আনা হবে। বলা হবে মা-বাবার অনুমতি না নিয়েই সে ইকথিয়ান্ডারের ওপর অস্ত্রপচার করেছিল, ব্যস? এই তো?
জ্বী। মোটামুটি এভাবেই মামলা সাজানো হচ্ছে। আসলে বিশেষজ্ঞদের হাতে পাড় মামলার মোড় ঘুরে গেছে। ওঁদের ধারণা ডাক্তার সালভাদর উন্মাদ, নইলে পশু-পাখির ওপর এমন ধরনের অপারেশন করে তাদের দেহ বিকৃত করতে পারতেন না। স্বাভাবিক কোন মানুষের আসলে এমন ইচ্ছেই জাগবে না অন্তরে। সালভাদরের পাগলামি জীবজন্তুদের বিকৃত করেই থেমেছে তা নয়, মানুষ ইকথিয়ান্ডারকেও সে বিকৃত করে তুলেছে। এখন আশঙ্কা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা হয়তো ডাক্তার সালভাদরকে উন্মাদ বলে ঘোষণা দেবেন।
পাতলা, নিলাভ ঠোঁট চাপলেন বিশপ, নিচু স্বরে বললেন, আপনার কাছ থেকে এতটা নির্বুদ্ধিতা আমি আশা করিনি, প্রসিকিউটর সাহেব।
থতমত খেয়ে গেলেন প্রসিকিউটর। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, ইয়োর হোলিনেস!
বিশপ বললেন, আপনি নিজেও নিশ্চিত নন যে ডাক্তার পাগল কি স্রষ্টার অবাধ্য এক অধার্মিক। আমার ধারণা কিন্তু পরিষ্কার। ঈশ্বরের একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে দুটো ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, শুনে রাখুন।
অবশ্যই, অবশ্যই!
ধর্মের কথা যেগুলো তার উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে তা থেকে সামান্য কিছু ঝাড়তে শুরু করলেন বিশপ। ক্রমেই তার গলার স্বর চড়ছে, সেই সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন।
…আপনি বলছেন সালভাদরের কর্মকাণ্ডের পেছনে কোন যুক্তি থেকে থাকতে পারে। যাদের ওপর সে অপারেশন করেছে তাদের কিছু নতুন গুণ অর্জিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কী সেটা আপনি ভেবে দেখেছেন? ঈশ্বর কি জীবজন্তু আর মানুষকে এতই অসম্পূর্ণ করে বানিয়েছেন যে ডাক্তার সালভাদরকে হস্তক্ষেপ করতে হয়?
মুখ নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন প্রসিকিউটর। তাঁর মনে হলো ধর্মীয় কাঠগড়ায় তারই বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তিনিই আসলে অপরাধী। অস্বস্তি লেগে উঠল তাঁর বিশ্বাস হতে চাইছে সামনে এসব ঘটছে।
বিশপ বলে চলেছেন, আপনি কি বাইবেলের কথা ভুলে যাচ্ছেন, প্রসিকিউটর? বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ে ছাব্বিশ নম্বর শ্লোকে কি বলা আছে মনে পড়ে? বলা আছে: মানুষকে আমি সৃষ্টি করব আমার মতো করে। এবার ভাবুন সাতাশ নম্বর শ্লোকে। ওখানে কি বলা নেই, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করলেন নিজের আদর্শে! তাহলে বুঝুন এই ঐশ্বরিক আদর্শ এবং সাদৃশ্যকে বিকৃত করেছে, করার স্পর্ধা দেখিয়েছে ডাক্তার সালভাদর। আর আপনারা তাকেই সমর্থন করতে চাইছেন। তার শয়তানীর পেছনে কৈফিয়ত খুঁজে বের করে তাকে ক্ষমা করানোর চেষ্টাও করছেন। সেই বিচারে আপনি নিজেও কম বড় অপরাধী নন। আপনিও পাপের ভাগী।
চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন প্রসিকিউটর, এবার মস্ত একটা ঢোক গিললেন। জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না। নরম স্বরে বললেন, আসলে ব্যাপারটা আমরা এভাবে ভেবে দেখিনি। আমাকে মাফ করবেন, ইয়োর হোলিনেস।
দৃপ্ত কণ্ঠে বিশপ শুরু করলেন আবার। ঈশ্বর কি নিজের সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ বলে মনে করেননি? শুনুন প্রসিকিউটর, পার্থিব আইন আপনার মনে থাকলেও ঐশ্বরিক আইনের ধারাগুলো আপনি ভুলে বসে আছেন। একবার একত্রিশ নম্বর শ্লোকের বাণী মনে করুন। ঈশ্বর যা সৃষ্টি করলেন তার দিকে চেয়ে দেখলেন। এবং বললেন, বাহ, চমৎকার হয়েছে। আর আপনাদের ঐ সালভাদর ভেবেছে খোদার ওপর খোদকারি করা দরকার। তার বুঝি ধারণা মানুষকে হতে হবে উভচর, যাতে পানিতেও সে দাপিয়ে বেড়াতে পারে! সে যা করার তো কারেইছে, এখন আপনাদের মতো বুদ্ধিমান মানুষরা ভাবছেন সে ঠিকই করেছে। আরও দুঃখের কথা, তার পক্ষ টেনে যুক্তিগুলো আপনারাই দাঁড় করাচ্ছেন? একটু ভেবে দেখুন, এসব কি ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ নয়? সালভাদর সৃষ্টিকে বিকৃত করছে আর আপনারা তাকে আইনের কোন ধারায় ফেলবেন সেটাই এখনও ঠিক করতে পারেননি।
মনে মনে আর্চ বিশপ মহা খুশি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, ভেঙে পড়েছে প্রসিকিউটরের প্রতিরোধ। চুপ করে শুনছেন ভদ্রলোক। মুখটা ফ্যাকাশে। আবার শুরু করলেন বিশপ। একটু একটু করে গলা চড়াচ্ছেন।
সালভাদরের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেটাই আমার আসল জানার দরকার। কিন্তু তাই বলে ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্যে কি হবে সেব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইকথিয়ান্ডার নামটাও খ্রিস্টান নাম নয়, গ্রীক নাম। গ্রীক ভাষায় ইকথিয়ান্ডার মানে হচ্ছে মৎস্যকুমার। সে যাই হোক, দোষ যদি কারও হয়ে থাকে সে সালভাদরের, ইকথিয়ান্ডারের নয়। আরেকজনের অপরাধের শিকার হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তারপরও আমি বলব ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ আর মানুষের ধৃষ্টতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সে। ওর অস্তিত্ব মানুষের মনকে দ্বিধান্বিত করে তুলতে পারে। সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ব্যাপারে মানুষের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। নানা জটিলতা দেখা দেবে। প্রসিকিউটর, সবচেয়ে ভাল হয় যদি স্রষ্টা ওকে নিজের কাছে ডেকে নেন। যদি নিজের বিকৃত অঙ্গের কারণে ছেলেটা মারা যায়… অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রসিকিউটরের দিকে তাকালেন বিশপ। বুঝতে পারছেন? স্বেচ্ছাচারিতার এক জলন্ত সাক্ষি হিসেবে তারও শাস্তি পাওয়া দরকার। সে মুক্ত থাকলে ঐশ্বরিক আইনের ঐতিহ্য নষ্ট হবে। তাছাড়া ও নিজেও তো বেশ কিছু অপরাধ করেছে। জেলেদের মাছ চুরি করা, জাল কেটে দেয়া, তাদের ভয় দেখানো, শহরে মাছের দুর্ভিক্ষ তৈরি করা—এসবের জন্যে তাকে দায়ী করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সে নাস্তিক সালভাদরের কুকীর্তির সাক্ষি। সালভাদরের এই অন্যায় আমার গির্জা সহ্য করবে না। ওদের দুজনকেই স্রষ্টার কাছে প্রোঠাননা অত্যন্ত জরুরী।
বিষণ্ণ মনে মাথা নিচু করে বসে আছে প্রসিকিউটর। বিশপের কথায় বাধা দিচ্ছেন না। তাঁর ভাল করেই জানা আছে এই লোকের প্রভাব কতখানি সুদূরপ্রসারিত।