মামলা হওয়ায় মনোবল মোটেও হারাননি ডাক্তার সালভাদর। তাঁর ধীরস্থির আত্মমগ্ন ভাবে কোন পরিবর্তন হয়নি। মামলার তদন্তকারী অফিসার এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন শিশুদের সঙ্গে কথা বলছেন।
অলস হয়ে পড়েননি তিনি। জেলে চুপচাপ বসে থাকতে পারেন। প্রচুর লেখালিখি করেন, আর করেন জেল-হাসপাতালে রোগীদের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সব অস্ত্রোপচার। তার অন্যতম রোগিণী হলেন জেলার সাহেবের স্ত্রী। বিষাক্ত কার্বাঙ্কলে তার মৃত্যু ছিঃ সুনিশ্চিত। অন্য ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন আগেই। ডাক্তার সালভাদই তাকে অপারেশন করে সুস্থ করলেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অসামান্য পারদর্শিতা ডাক্তার সালভাদরের। কিন্তু সেজন্যে রেহাই পেলেন না তিনি। বিচারের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতেই হলো।
আদালতের প্রকাণ্ড হলঘরে সেদিন আর স্থান সংকুলান হয় না। হলঘর ছেড়ে করিডরেও ভিড় করে দাঁড়িয়েছে অগণিত মানুষ। সামনের চত্বরও ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে। খোলা জানালা দিয়ে অনেকে উঁকি দিচ্ছে হলের ভিতরে কি ঘটছে তা দেখার জন্য কিছু উৎসাহী লোক আবার উঠে বসেছে আদালত প্রাঙ্গণের গাছের ডালে।
আসামীর আসনে শান্ত ভাবে বসে রয়েছেন ডাক্তার সালভাদর। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো আইনজীবীকে তিনি নিয়োগ দেননি। তার চেহারা অবয়ব এমনই ভাবগম্ভীর যে মনে হয়, তিনিই বুঝি আজকের বিচারক, আসামী নন।
অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি তার ওপর। তাঁর ব্যক্তিত্বময় দৃষ্টির সামনে কারও চোখ পড়লেই তাকে চোখ নামিয়ে নিতে হচ্ছে তখুনি।
মানুষের ঔৎসুক্য ইকথিয়ান্ডারকে নিয়েও কম নয়। তবে আদালতে তাকে আনা হয়নি। তার স্বাস্থ্য বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। একটা চৌবাচ্চার মধ্যে তাকে রাখা হয়েছে। অসংখ্য কৌতূহলী চোখের দৃষ্টির যন্ত্রণা থেকে সে বেঁচে গেছে।
এই মামলায় তার ভূমিকা কেবল সাক্ষির ও প্রসিকিউটরের ভাষায় তার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাকে ধরে নেয়া হয়েছে জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে।
অবশ্য ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে অন্য মামলা আছে। সেগুলোর শুনানী হবে সালভাদরের মামলা নিষ্পত্তির পরে, আলাদাভাবে। আর্চ বিশপের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রসিকিউটরকে দুটো মামলা আলাদা ভাবেই সাজাতে হয়েছে। ভবিষ্যতে ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে যে মামলা হবে তার জন্য প্রসিকিউটরের লোকরা গোপনে এখনও তথ্য সংগ্রহ করছে।
আর্চবিশপ প্রথম থেকেই সেই এক কথা বলে চলেছেন, হতভাগ্য ইকথিয়ান্ডারকে ঈশ্বর যদি নিজের কাছে টেনে নেন তাহলে সব দিক থেকে মঙ্গল হয়।
সম্ভবত এই কারণেই কথাটার উপরে তিনি জোর দিয়ে চলেছেন। যে, সেক্ষেত্রে ভালভাবেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে মানুষে হস্তক্ষেপে ঈশ্বরের সৃষ্টির ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয় না। যেমন শিশুর হাতে কাঁচের গ্লাস তুলে দিলে অবধারিতভাবেই সেটা ভাঙবে।
বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনজন বৈজ্ঞানিক এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদালতকে তাঁদের বক্তব্য পাঠ করে শোনালেন। নিস্তব্ধ আদালতের প্রতিটি মানুষ অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে সে সমস্ত বক্তব্য শুনল।
বিশেষজ্ঞ দলের মুখপাত্র হিসাবে বিজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শেইন শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য: যে সমস্ত জীব-জন্তুর ওপরে অপারেশন চালিয়েছেন প্রফেসার সালভাদর, মহামান্য আদালতের নির্ধেশানুক্রমে তাদের আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। ইকথিয়ান্ডারকেও আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। প্রফেসার সালভাদরের ল্যাবোরেটরি আর অপারেশান থিয়েটারও আমরা দেখে এসেছি। আমরা সেখানে লক্ষ্য করেছি যে প্রফেসার সালভাদর শুধু বিদ্যুৎ-প্রয়োগে ব্যবচ্ছেদ পদ্ধতি আর আলট্রা ভায়োলেট-রশ্মি দিয়ে স্টেরিলাইজেশন ইত্যাদি সর্বাধুনিক পদ্ধতিতেই এই সমস্ত অপারেশন করেন না, তাঁর ঘরে এমন সমস্ত যন্ত্রও আছে যেগুলোর ব্যবহার দূরের কথা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সার্জনরাও ওগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে পর্যন্ত জানেন না।
প্রফেসারের অপারেশন সম্পর্কে আমি বেশি কিছু বলব না। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে এইটুকু বলব যে তাঁর পরিকল্পনা অসাধারণ ভাবে দুঃসাহসী আর সেগুলো কাজে পরিণত করাও হয়েছে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে। টিস্যু এবং সম্পূর্ণ অঙ্গের অন্য দেহে সংস্থাপনের যে নিদর্শন তিনি দেখিয়েছেন তা অসামান্য। তাঁর অপারেশন পদ্ধতি দেখে মনে হয়েছে দুটি প্রাণীকে একসঙ্গে জোড়া লাগানো, একশ্বাসী প্রাণীকে দ্বিশ্বাসী প্রাণীতে পরিণত করা, কিংবা দ্বিশ্বাসী প্রাণীকে একশ্বাসী প্রাণীতে পরিণত করা, পুরুষ-প্রাণীকে স্ত্রী-প্রাণীতে পরিণত করা, প্রাণীদের পূর্ণ- যৌবন ফিরিয়ে দেয়া-এ সমস্ত ব্যাপার প্রফেসার সালভাদরের কাছে কোন বড় ব্যাপার নয়। প্রফেসারের বাগানে কয়েক মাস বয়স থেকে শুরু করে চোদ্দ বছর পর্যন্ত নানা বয়সের কিছু রেড ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়েদেরও আমরা দেখেছি।
প্রসিকিউটর প্রশ্ন করলেন, প্রফেসার, দয়া করে বলুন কি অবস্থায় তাদের দেখেছেন?
সবাই তারা বেশ সুস্থ সবল। বাগানে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে তারা। অনেককেই প্রাণে বাঁচিয়েছেন প্রফেসার সালভাদর। সমস্ত রেড ইন্ডিয়ান সমাজই এখন বিশ্বাস করে প্রফেসার সালভাদর স্বয়ং স্রষ্টা প্রেরিত মানুষ। তারা ওঁকে ঈশ্বরের মতই বিশ্বাস করে। তাই আলাস্কা থেকে টিয়েরা-ডেল-ফিউগো পর্যন্ত সারা ভূখণ্ডের এস্কিমো, ইয়াগান, অ্যাপাচি, তুলিপাঙ্গি, পানো আর আরাউকানি উপজাতির মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসে সালভাদরের কাছে…
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অধ্যাপক শেইন। প্রসিকিউটরও অস্থির হয়ে উঠলেন। বিশপের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি এখন আর শান্তভাবে সালভাদরের প্রশংসা শুনতে পারেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মনে করেছেন, অধ্যাপক শেইন, সালভাদরের অপারেশনগুলো মানুষের জন্যে মানব সভ্যতার জন্যে মঙ্গলজনক হয়েছে? সেগুলোর স্বপক্ষে কি কোনো যুক্তি থাকতে পারে?
অধ্যাপক শেইন যদি হ্যা বলে বসেন এই আশঙ্কায় বৃদ্ধ বিচারপতি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, বিজ্ঞানের প্রশ্নে বিশেষজ্ঞের ব্যক্তিগত মতামতে আদালতের কোনো আগ্রহ নেই। আপনি বলে যান ডা. শেইন, আরাউকানি উপজাতির তরুণ এই ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করে আপনারা কি বুঝলেন?
শেইন বললেন, আমরা দেখতে পেলাম, ইকথিয়ান্ডারের সারা শরীর এক ধরনের কৃত্রিম আঁশে ঢাকা। খুবই নমনীয় আর মজবুত সেই আঁশ। কিন্তু কোন উপাদানে এই আঁশ তৈরি করা হয়েছে সেটা আজও বিশ্লেষণ করা যায়নি। পানির নিচে ইকথিয়ান্ডার যে গগলস ব্যবহার করে সেটাও এক বিশেষ ধরনের ফ্লিট-কাচের তৈরি। ওটার রিফ্রাশন ইনডেক্স, অর্থাৎ প্রতিসরাঙ্গ প্রায় দুই। তার ফলে পানির নিচে সে। চমৎকার দেখতে পায়। ইকথিয়ান্ডারের শরীরের আঁশ ছাড়িয়ে নিয়ে আমরা দেখেছি তার কাঁধের হাড়ের নিচে দুদিকে রয়েছে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসের দুটো ফুটো। পাঁচটা পাতলা আস্তরণ দিয়ে সেগুলো। ঢাকা রয়েছে, অনেকটা হাঙরের কানকোর মতই।
বিস্ময়ের অস্ফুট গুঞ্জন শোনা গেল আদালত কক্ষের মধ্যে।
অধ্যাপক শেইন বলতে লাগলেন, অবিশ্বাস্য হলেও একথা বৈজ্ঞানিকভাবেই সত্য যে ইকথিয়ান্ডারের দেহে মানুষের ফুসফুসও, যেমন আছে, ঠিক তেমনিই তার দেহে হাঙরের কানকোও আছে। পানি আর ডাঙায়-দুজায়গাতেই ইকথিয়ান্ডার থাকতে সক্ষম।
বিদ্রুপাত্মকভাবে প্রসিকিউটর বলে উঠলেন, তাহলে কি ধরা হবে, ইকথিয়ান্ডার উভচর প্রাণী?
ডা. শেইন বললেন, হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডার নিঃসন্দেহে উভচর-মানব।
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে হাঙরের কানকো কোত্থেকে পেল ইকথিয়ান্ডার?
এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক শেই একবার হতাশভাবে হাত ঘোরালেন। অর্থাৎ, ব্যাপারটা তার জানা নেই। একটু থেমে ধীরে ধীরে বললেন, এ একটা অদ্ভুত রহস্য। হয়তো প্রফেসর সালভাদর আমাদের বুঝিয়ে দেবেন এই কানকো আর ফুসফুসের রহস্য! তবে আমাদের অভিমত এই রকম: হেকেলের সূত্র অনুযায়ী আমরা জেনেছি যে কোন প্রাণী তার যুগ-যুগান্তরের বিবর্তনে যে সমস্ত রূপ অতিক্রম করে বর্তমান রূপে এসে পৌঁছেছে-মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সে সমস্ত রূপের মধ্যে দিয়েই সে পূর্ণাবয়বে এসে পৌঁছোয়। সেদিক থেকে নিঃসংশয়ে আমরা জেনেছি যে মানুষের পূর্ব-পুরুষ একদা কানকো দিয়েই নিঃশ্বাস গ্রহণ করত।
প্রসিকিউটর কি যেন একটা বলবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই প্রধান বিচারপতি তকে ইঙ্গিতে থামিয়ে দিলেন।
অধ্যাপক শেই আবার বলতে লাগলেন, বিশ দিনের মাথায় মাতৃগর্ভে মানব ভ্রূণের দেহে পরপর চারটে কাকোর মত আস্তরণ গড়ে ওঠে। কিন্তু তারপরেই সেগুলো বদলে যায়। কানকোরূপী প্রথম আস্ত রণটার ওপরের অংশ পরিণত হয় শ্রবণ নালীসহ কানের হাড় আর ইউস্টেসিয়াম টিউবে। আর নিচের অংশটা পরিণত হয় মানুষের নিচের চোয়ালে। দ্বিতীয় আস্তরণটা পরিণত হয় হিয়য়েড অস্থিতে এবং তৃতীয় আস্তরণটা থাইরয়েড কার্টিলেজ প্রক্রিয়ায় পরিণতি হয় মানবদেহে।
আমরা মনে করি না যে ভ্রূণ অবস্থাতেই ইকথিয়ান্ডারের এই বিকাশ রোধ করতে পেরেছিলেন প্রফেসর সালভাদর। অবশ্য এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে পরিণত মানুষের দেহেও অবিকশিত কানকোর ছিদ্র রয়ে গেছে দেহের বিভিন্ন অংশে, যেমন-গলা, চোয়ালের নিচে ইত্যাদি-অর্থাৎ অ্যাঙ্কিয়াল ফিস্টুলায়। কিন্তু তার ফলে পানির নিচে শ্বাস নেবার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। জ্বণের বিকাশ যদি অস্বাভাবিক হয় তাহলে হওয়া উচিত দুয়ের একটি অর্থাৎ হয় কানকো বাড়তেই থাকবে এবং শ্রবণেন্দ্রিয় ও অন্যান্য দেহাংশের ক্ষতি হতে থাকবে। কিন্তু তাই যদি হত তাহলে ইকথিয়ান্ডার হতো আধা-মাছ এবং আধা মানুষের মাথাওয়ালা এক অদ্ভুত প্রাণী। কিংবা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশই তার দেহগঠনে প্রাধান্য পেত এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত তার কানকো। কিন্তু ইকথিয়ান্ডার স্বাভাবিক বিকশিত মানুষ। তার। শ্রবণেন্দ্রিয় স্বাভাবিক, নিচের চোয়ালের হাড় সুগঠিত, ফুসফুস স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সবকিছুর সঙ্গেই তার দেহে আছে সুপরিণত কানকো, যা কিনা একমাত্র জলচরদের শ্বাসকার্যেই লাগে। তার সেই কানকো আর ফুসফুস একই সঙ্গে কাজ করে কিভাবে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। ইকথিয়ান্ডারের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে তবেই হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব। আবার আমি বলছি, এ একটা গূঢ় রহস্য, এবং এই রহস্যের সমাধান একমাত্র প্রফেসার সালভাদরই করতে পারবেন। তিনিই একমাত্র বলতে পারবেন কি করে সম্ভব হলো কুকুরের দেহে জাগুয়ারের মাথা জোড়া লাগানো, কিংবা ইকথিয়ান্ডারের দোসর ওই উভচর বানরগুলোকে সৃষ্টি করা।
তাহলে আপনাদের শেষ সিদ্ধান্ত কি? জিজ্ঞেস করলেন প্রধান বিচারপতি।
অধ্যাপক শেইন নিজেও একজন বড় বিজ্ঞানী। শল্য চিকিৎসক হিসেবেও তিনি বিখ্যাত। দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই তিনি বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, কিছু আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না? শুধু এইটুকু বলতে পারি যে প্রফেসার সালভাদর যেসব ব্যাপার ঘটিয়েছেন তা কোন বিরাট, প্রতিভাবান মানুষের পক্ষেই শুধু সম্ভব। এটুকুও আমরা বুঝতে পেরেছি যে প্রফেসার সালভাদরের ধারণা হয়েছে যে সার্জারিতে তিনি এমনই অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন যে জীবজন্তু বা মানুষের দেহকে তিনি যেভাবে খুশি কেটে-কুটে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। তবে ব্যাপারটার মধ্যে চমৎক্ষরিত্ব থাকলেও, এবং কাজগুলোর মধ্যে দুঃসাহসের এবং কল্পনাশক্তির পরিচয় থাকলেও সেগুলো পাগলামিরই নামান্তর।
অবজ্ঞার হাসি হাসলেন সালভাদর ডক্টরের কথা শুনে। একথা তিনি বুঝতেই পারছেন না যে বিশেষজ্ঞরা তঁর মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তুলে কারাবাসের বদলে হাসপাতালের ব্যবস্থা করে তার দণ্ড লঘু করতে চেষ্টা করছেন।
সালভাদরের অবজ্ঞার হাসিটা লক্ষ করলেন অধ্যাপক শেইন। উদাত্তভাবেই আদালতকে তিনি জানালেন, আমি জোর দিয়ে একথা বলতে চাই যে প্রফেসার সালভাদর উন্মাদ। আমাদের ধারণা মানসিক চিকিৎসার স্যানাটরিয়ামে দীর্ঘদিন রেখে ওঁর মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করা। দরকার।
প্রধান বিচারপতি আপত্তি তুলে বললেন, মানসিক বিকারের প্রশ্নটা নতুন। বর্তমান মামলায় এটা আমাদের বিচার্য বিষয়ের বাইরে। এ ব্যাপারে নতুন কোন কথা উঠলে তখন আমরা আলাদাভাবেই তার বিচার করব। সালভাদরের দিকে ফিরলেন প্রধান বিচারপতি, প্রশ্ন করলেন, প্রফেসার সালভাদর, আদালতের বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক প্রসিকিউটরের কিছু প্রশ্নের উত্তর আপনি দেবেন কি?
দেব, দৃঢ় কণ্ঠে সালভাদর বললেন, কিন্তু সে-ই হবে আমার চূড়ান্ত উত্তর! তারপর আমাকে যেন আর বিরক্ত করা না হয়?
আদালতের অভিযোগ ও প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য শান্তভাবেই উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার সালভাদর। চারিদিকে তাকিয়ে কাকে যেন একবার খুঁজলেন। দর্শকদের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন বালথাযার, ক্রিস্টো আর ক্যাপ্টেন জুরিতা পেরোকে। সামনের সারিতে বসে ছিলেন আর্চ বিশপ। কিছুক্ষণ তার উপরে দৃষ্টি রাখলেন সালভাদর। চোখে তাঁর ফুটে উঠল ক্ষীণ হাসির রেখা। আবার যেন কাকে খুঁজছে তাঁর চোখ। তারপর একসময় বললেন, আমি যার ক্ষতি করেছি সেই লোকটিকে দেখছি না তো এখানে?
হঠাৎ লাঠিয়ে উঠল বালথাযার। চিৎকার করে সে বলল, ক্ষতি করেছ তুমি আমার! আমিই সেই লোক!
ভাইয়ের আস্তিন ধরে ক্রিস্টো তাকে টেনে বসিয়ে দিল।
প্রধান বিচারপতি সালভাদরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ ক্ষতির কথা বলছেন আপনি? যদি আপনার বিকৃত দেহ জীবজন্তুগুলোর কথা আপনি ভেবে থাকেন, তাহলে বলছি যে এই আদালত তাদের এখানে হাজির করার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর যদি সেই উভচর মানব ইকথিয়ান্ডারের কথা বলেন তাহলে আমি বলছি, এই আদালত ভবনেই সে আছে।
শান্তভাবে এবং কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সালভাদর বললেন, আমি বলছি ঈশ্বরের কথা।
উত্তর শুনে হতবাক হয়ে গেলেন প্রধান বিচারপতি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিনি ভাবলেন, সত্যিই কি সালভাদর উন্মাদ? কারাদণ্ড এড়াবার জন্য পাগলামির ভান করছেন নাকি? বিচারপতি আবার প্রশ্ন করলেন, আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন?
সালভাদর বললেন, আমার তো মনে হয়, এই আদালতের কাছে সেটা অজানা থাকার কথা নয়। আদালতের অভিযোগ অনুযায়ী আমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সেই ব্যক্তিটি হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। অভিযোগেই প্রকাশ করা হয়েছে যে আমার ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে তাঁর প্রতিষ্ঠা আমি ক্ষুণ্ণ করেছি। অনধিকার প্রবেশ করেছি তাঁর পবিত্র এখতিয়ারে। নিজের সৃষ্টি নিয়ে ভদ্রলোক নাকি বেশ ভালোই ছিলেন। হঠাৎ উটকো এক ডাক্তার এসে বলল, এসব ভালো করে সুষ্টি হয়নি, ঢেলে সাজানো দরকার। তারপর ঈশ্বরের সৃষ্টিকে নিজের মত করে অদল-বদল করতে শুরু করল সে…
নিজের ধর্মবোধে আঘাত লেগেছে, ফলে রুখে দাঁড়িয়ে প্রসিকিউটর জানালেন, ধর্মাবতার, এসব কথা বলে পরিষ্কার ঈশ্বরদ্রোহিতা করা হচ্ছে। আসামীর কথাগুলো নথিভুক্ত করে রাখা হোক।
শ্রাগ করে সালভাদর বললেন, আমার নামে অভিযোগপত্রে যা লেখ্য আছে তার মূল কথাটাই আমি বলেছি। আমার বিরুদ্ধে সমস্ত নালিশ কি কেবল এই একটা কথাকেই তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলছে না? নথিটা আমি পড়েছি। আমার বিরুদ্ধে প্রথমে শুধু এই অভিযোগই ছিল যে অপারেশন করে জীবজন্তুদের আমি দেহবিকৃতি ঘটিয়েছি। কিন্তু পরে দেখলাম আবার যোগ করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে ঈশ্বরের পবিত্রতাহানির অভিযোগ। এই হাওয়াটি এল কোথা থেকে? গির্জা থেকে নয়তো? আর্চ বিশপের দিকে একবার তাকালেন সালভাদর, তারপর বললেন, আপনারাই এই মামলাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে অদৃশ্য ফরিয়াদীর স্থান নিতে হয়েছে স্বয়ং ঈশ্বরকে। আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সঙ্গে সঙ্গে চার্লস ডারউইনও। আদালতে উপস্থিতদের মধ্যে কেউ হয়তো আমার কথায় আর একবার আহত হবেন, কিন্তু একথা আমি বার বার করেই বলে যাব যে পশুদের দেহ, এমনকি মানুষের দেহও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাদেরও সংশোধন দরকার। আশা কলি আদালত কক্ষে উপস্থিত গির্জার আর্চ বিশপ হুয়ান-দ্য গার্সিলাসো একথা সমর্থন করবেন।
একটা গুঞ্জন উঠল আদালত কক্ষে। পরিবেশে চাপা উত্তেজনা এখন টানটান উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে।
সালভাদর আবার বলতে শুরু করলেন, উনিশ শো পনেরো সালে আমি যুদ্ধে যাবার কিছু আগে শ্রদ্ধেয় বিশপের দেহে সামান্য একটু সংশোধন করতে হয়েছিল আমাকে। বিশপ-মহাশয়ের অ্যাপেনডিক্স নামের ক্ষতিকর ও নিপ্রয়োজনীয় অঙ্গটাকে পবিত্র দেহ থেকে আমাকে কেটে বাদ দিতে হয়। রোগ নিরাময়ের প্রয়োজনে মহামান্য বিশপের পবিত্র দেহের একাংশ ঐভাবে ছেঁটে ফেলে দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর দেহসাদৃশ্যের যে বিকৃতি আমি দুটিয়েছিলাম, আমার মনে পড়ে অপারেশন টেবিলে শোয়ার আগে আমার আধ্যাত্মিক রোগী তার কোন প্রতিবাদ জানাননি। বিশপের ওপর ঘুরে এলো তাঁর দৃষ্টি। চোখ দুটো হাসছে। আমি ঠিক বলছি কিনা, মহামান্য বিশপ?
আর্চ বিশপের দিকে আরও একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন সালভাদর।
নিশ্চল হয়ে বসে আছেন হুয়ান-দ্য-গার্সিলাসো। লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। সরু সরু হাতের আঙ্গুলগুলো তাঁর থরথর করে কাঁপছে।
সালভাদর আবার শুরু করলেন, তাছাড়া আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে প্র্যাকটিস করতাম, এবং বিশেষ করে নবযৌবন লাভের জন্য এক বিশেষ অপারেশান করতাম তখন সেই নবযৌবন লাভের আশাতেই আমার কাছে এসেছিলেন শ্রদ্ধেয় পাবলিক প্রসিকিউটর সিনর আগুস্তো দ্য…
কথাটার প্রতিবাদ করতে গেলেন প্রসিকিউটর, কিন্তু শ্রোতাদের তুমুল হাসির আওয়াজে তাঁর কথা চাপা পড়ে গেল।
কড়া সুরে বিচারপতি জানালেন, আপনি প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছেন, প্রফেসার সালভাদর।
সালভাদর বললেন, আমি নিরূপায়। কেননা, আদালত প্রসঙ্গটা এইভাবেই রেখেছেন। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখানে উপস্থিত সকলেই কিন্তু বিবর্তনের পূর্বযুগে মাছ, কিংবা বানর ছিল; তাঁরা কথা বলতে পারছেন কিংবা শুনতে পাচ্ছেন কেবল তাদের কানকোর উজগুলো বাগযন্ত্র ও শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হওয়ায়। কথাটা শুনে কেউ আঁৎকে উঠবেন না এখন, বর্তমান অবস্থায় ঠিক মাছ কিংবা বানর না হলেও সকলেই আমরা তাদেরই বংশধর।
প্রসিকিউটর অধৈর্য হয়ে উঠছেন দেখে সালভাদর তার দিকে ফিরে বললেন, চঞ্চল হবেন না, সিনর আগুস্তো। আমি এখানে বিবর্তনবাদ প্রচারের বক্তৃতা দিতে আসিনি। আমি শুধু বলতে চাইছি একটা নতুন কথা; আর কথাটা হলো এই যে, পশু থেকে মানুষ এসেছে এটা যেমন সত্য কথা তেমনি আরও রূঢ় সত্য এই যে মানুষ আসলে পশুই থেকে গেছে। রূঢ়তা, হিংস্রতা, নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদি পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো কিছুতেই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না।
প্রসিকিউটর এবার আর থাকতে পারলেন না, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে আমি প্রসঙ্গে ফিরে আসতে অনুরোধ করছি, প্রফেসার সালভাদর।
সালভাদর বললেন, হ্যাঁ, তাই আসছি। আমি সার্জন। আমার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ছুরি। সেই ছুরির সাহায্যে প্রায়ই আমাকে জীবদেহে নতুন করে বসাতে হয়েছে টিস্যু, প্রত্যঙ্গ আর বিভিন্ন গ্ল্যান্ড। আর সেই পদ্ধতিকে নিখুঁত করে তোলবার জন্যে জীবজন্তুর দেহে আমাকে বহু পরীক্ষাই চালাতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শেইন এবার প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ইকথিয়ান্ডারের। কেস্টার কি ব্যাখ্যা আপনি দিতে চান, প্রফেসার সালভাদর?
সালভাদর বললেন, হ্যাঁ, ইকথিয়ান্ডার। সে আমার গর্বের ধন। মানুষের দেহের গোটা প্রক্রিয়াটাই বদলে দেবার একটা আইডিয়া নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। আর সেই পরীক্ষার চরম পর্যায়ে আমি অপারেশান চালাই ইকথিয়াল্ডারের দেহে! একটা বাচ্চা হাঙরের কানকো আমি বসিয়ে দিই তার দেহে। ফলে সে পানিতে-স্থলে, দুজায়গাতেই থাকার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
শ্রোতাদের মধ্যে বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠল। হেড-অফিসে টেলিফোন করে এই বিস্ময়কর ব্যাপারটা জানাতে সাংবাদিকরা দ্রুত ছুটে গেলেন বাইরে।
ছুটোছুটি ও চাঞ্চল্য একটু কমতে উঠে দাঁড়িয়ে বিচারপতির উদ্দেশ্যে প্রসিকিউটর বললেন, আসামীকে আমি প্রশ্ন করতে চাই, এই উভচর মানব গড়ার আইডিয়াটা কোথায় তিনি পেলেন, কি তাঁর উদ্দেশ্য?
সালভাদর বললেন, এই আইডিয়ার মূল কথা আমি তো আগেই বলেছি। মানুষ সম্পূর্ণ নয়। বিবর্তনের ধাপ বেয়ে উঠে এসে মানুষ তার পূর্বপুরুষ জীবদের তুলনায় অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেও নিম্নস্তরের প্রাণীদের অনেক গুণই হারিয়েছে। যেমন, মাছের মত পানিতে বাস করতে সে পারে না। ভাবলাম, দেয়া যাক না কেন তাকে সেই সুযোগটা। তাছাড়াও মানুষ যদি আজ সাগরবাসী হতে পারত, তার জীবন হয়ে উঠত একেবারেই অন্যরকম। পানি নামক এই মহাপরাক্রান্ত ভৌতশক্তি তখন হত মানুষের বশীভূত। তাছাড়া বসবাসের একটা মস্ত বড় সমস্যার সুরাহা হত। কোটি কোটি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা হতে পারত সাগরের স্তরে স্তরে। তাছাড়া সাগরগর্ভে–খাদ্যের ব্যবস্থাও রয়েছে অফুরন্ত। চিরদিনের জন্যেই খাদ্যের অভাব মিটে যেত।
সাগরে রয়েছে এক অসীম শক্তিভাণ্ডার। মহাসাগর যে পরিমাণে সৌরভেজ শোষণ করে নেয় তা সাত হাজার নয়শো কোটি অশ্বশক্তির সমতুল্য। কিন্তু মানুষ কি তাকে কাজে লাগাচ্ছে? পারছে কাজে লাগাতে? না, পারছে না।
এছাড়া আছে সমুদ্রের তরঙ্গ, জোয়ার ভাটা আর সাগরস্রোতের শক্তি। তাকেই বা মানুষ কাজে লাগাচ্ছে কই?
মহাসাগরের অসীম সম্পদই বা মানুষ কাজে লাগাচ্ছে কই? বড় জোর সে মাছ ধরে, আর স্পঞ্জ, প্রবাল আর মুক্তো খুঁজে বেড়ায়। এবং এতেই তার উদ্যম শেষ। এটা কিন্তু তার দোষ বা অণ কিছু নয়। তার শরীর প্রকৃতিই তাকে পানির জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ডুবুরির পোশাক কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই যদি সে পানির নিচে থাকতে পারত আর নানা কাজ করতে পারত তাহলে সেটা হত এক অভূতপূর্ব ব্যাপার! কত সম্পদ সে আবিষ্কার করত সেখানে আমার ইকথিয়ান্ডারই তো আমাকে এনে দিয়েছে কত সব বিরল ধাতু আর আকরিকের নমুনা। এর কারণেই আমি সাগরতলের জিরাট সম্ভাবনাময় জীবনের নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছি।
আরও ধরুন না কেন, ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোর কথা। উনিশশো ষোলো সালে লুজিতানিয়া জাহাজকে জার্মানিরা আয়ারল্যান্ডের কাছে ডুবিয়ে দেয়। সেই জাহাজের সম্পদের পরিমাণ ছিল বিশ কোটি ডলার। এছাড়াও লুজিতানিয়া জাহাজে ছিল দুটো বাক্স ভর্তি হীরে, যার দাম ছিল আরও কয়েক কোটি ডলার। বিশ্বের অন্যতম সেরা হীরে কালিফ ছিল সেই জাহাজে। আমি চেয়েছিলাম প্রাকৃতিক সম্পদ ও শক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার এই হারানো সম্পদগুলেও ফিরে পাবার শক্তি অর্জন করুক। তাই শুধু একজন ইকথিয়ান্ডার কেন, হাজার হাজার ইকথিয়ান্ডার সৃষ্টি করবার পরিকল্পনাই আমি করেছি।
আমার ইকথিয়ান্ডার খুব গভীর সাগরে নামতে পারে না। আরও উন্নত ধরনের ইকথিয়ান্ডার তৈরি করে তাদের আমি গভীর সাগরে নামিয়ে দিতাম, এই ছিল আমার…।
প্রসিকিউটর টিপ্পনি কেটে বললেন, আপনি কি তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকাই নিতে চাইছিলেন?
এই টিপ্পনি গ্রাহ্য না করেই সালভাদর বলে চললেন, মানুষ যদি পানিতে থাকতে পারত তাহলে মহাসাগর ও সাগরগর্ভকে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিত। সেদিন ওই সাগর আর ভয়ানক বিপদের কারণ হয়ে থাকত না মানুষের কাছে। আর ডুবে যাওয়া মানুষদের জন্য কাঁদবার প্রয়োজনও আমাদের ফুরিয়ে যেত।
সমস্ত আদালত কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে রইল। মনে হলো যেন শ্রোতাদের সকলের সামনেই ভেসে উঠেছে এক অপূর্ব কাল্পনিক ছবি! দুরন্ত ও ভয়াল মহাসাগর বিজিত হয়েছে।
বিচারপতি এবার প্রশ্ন করলেন, আপনার পরীক্ষার ফলাফলগুলো আপনি তাহলে প্রকাশ করেননি কেন?
হেসে জবাব দিলেন সালভাদর, আসামীর কাঠগড়ায় পৌঁছবার তাড়া ছিল না আমার। তাছাড়া ভয় ছিল, বর্তমান সামাজিক অবস্থায় আমার এই আবিষ্কার উপকারের চেয়ে মানুষের অপকারই করবে বেশি। এই তো দেখুন না, ইকথিয়ান্ডারকে দখল করবার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ওই তা ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো ইকথিয়ান্ডারকে চুরি করেছিল আমার কাছ থেকে।
সম্ভবত ওর কাছ থেকে ইকথিয়ান্ডারকে আবার চুরি করতেন নৌবহরের মহামান্য অ্যাডমিরালরা। ওকে তাঁরা শত্রু জাহাজ ডোবানোর কাজে লাগাতেন। হ্যাঁ, এইভাবেই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর লোভ মহত্তম আবিষ্কারগুলোকে পরিণত করে অভিশাপে, বাড়িয়ে তোলে মানুষের যন্ত্রণা। সেই কারণেই ইকথিয়ান্ডারের ব্যাপারটাকে আমি সাধারণ্যে প্রকাশ করতে চাইনি। লোকে ভাবে আমি উন্মাদ! কিন্তু না, উন্মাদ আখ্যালাভের সম্মানটুকু আমি সবিনয়েই প্রত্যাখ্যান করছি, এমনকি তার সঙ্গে প্রতিভাধর বিশেষণটুকু জুড়ে দিলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি। আসলে উন্মাদ আমি নই। বাতিকগ্রস্তও নই। আমি যা চেয়েছিলাম তাই করেছি। আমার কাজগুলো আপনারা উপস্থিত সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। এখন যদি মনে করেন সেগুলো। অপরাধ, তাহলে আইন অনুযায়ী যথার্থ দণ্ডই আপনারা আমাকে দেবেন। কোনরকম সুবিধা কিংবা ক্ষমা আমি চাই না।
সালভাদর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। তার কথা শেষ হবার পরও অনেক অনেকক্ষণ ধরে আদালত কক্ষে বিরাজ করতে লাগল এক থমথমে নিরবতা।
যে সব বিশেষজ্ঞরা ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করেছেন তারা যে শুধু তার দৈহিক বিশেষত্বই লক্ষ করেছেন তা নয়, তার মানসিক অবস্থাও তারা দেখেছেন।
এটা কোন সাল? কোন মাস? আজ কত তারিখ, কি বার? সাধারণ এসব প্রশ্ন ইকথিয়ান্ডারকে তারা করেছেন।
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে সেও জবাব দিয়ে গেছে একই কথায়, আমি জানি না।
অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতেও তার খুব অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু তবুও তাকে অপরিণত মস্তিষ্ক বলে ঘোষণা করা চলে না। যেভাবে তার জীবন গড়ে উঠেছে তাতে পার্থিব অনেক বিষয় তার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা শেষ পর্যন্ত তার সম্পর্কে রায় দিলেন: ইকথিয়ান্ডার অস্বাভাবিক। ইকথিয়ান্ডারের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়ে আদালত তাকে অভিভাবকের হাতে সমর্পণ করতে নির্দেশ দিল।
আদালতের ঘোষণা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিভাবক হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো আর বালথাযার। আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দামী মুক্তো উপহার দিয়ে পেদরো তাদের হাত করে ফেলেছে। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার পথে আর বিশেষ বাধাও নেই। আপাতত ইকথিয়ান্ডারকে রাখা হলো জেলখানার নিরাপদ হেফাজতে।
এদিকে লারার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বালথাযারকে ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব দেয়া হলো না।
সেই থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থম মেরে বসে থাকে বালথাযার। আহার-নিদ্রা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তার! কখনও কখনও উত্তেজিত হয়ে। পায়চারি করে দোকানের ভিতরে। দুহাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে বলে, ছেলে আমার ছেলে আমার! প্রাণপণে সে গালিগালাজ করে শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিয়ার্ডদের।
হঠাৎ একদিন ক্রিস্টোকে ডেকে সে বলল, শোন ক্রিস্টো, একটা উপায় বের করেছি। আমার সেরা মুক্তোগুলো দিয়ে জেলখানার। সেপাইদের হাত করে ছেলের সঙ্গে দেখা করব। তাকে আমি বোঝাব। যে আমিই তার সত্যিকার বাবা। ছেলে কখনও বাবাকে না মেনে পারে? আমার রক্ত যে ওর মধ্যে কথা কইবে!
ক্রিস্টো অনেক চেষ্টা করল তার ভাই যাতে পাগলামি না করে। কিন্তু বালুথারের মতামত পরিবর্তিত হলো না। সে যাবেই।
শেষ পর্যন্ত গেল সে জেলখানায়। অনেকগুলো দামি মুক্তো প্রহরীদের ঘুষ দিয়ে ইকথিয়ান্ডারের জেল কুঠুরিতে গিয়ে পৌঁছল সে।
চৌবাচ্চার পানিতে ডুবে ছিল ইকথিয়ান্ডার। কাছে এসে বালথাযার আস্তে আস্তে ডাকল, ইকথিয়ান্ডার! ইকথিয়ান্ডার।
পানির ওপরে একটা কম্পন দেখা গেল, কিন্তু ইকথিয়ান্ডার উঠল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বালথাযার তার হাতটা ডুবিয়ে দিল চৌবাচ্চার পানিতে। তার হাত ঠেক ইকথিয়ান্ডারের কাঁধে।
পানি থেকে ভিজে মাথাটা তুলে ইকথিয়ান্ডার জিজ্ঞেস করল, কে? কে আপনি? কি চান?
আকুল স্বরে দুহাত বাড়িয়ে বালথাযার বলে উঠল, আমিই তোর সত্যিকার বাবা, ইকথিয়ান্ডার। ওই ডাক্তার তোর বাবা নয়। তোর জীবন সে নষ্ট করেছে। আমার দিকে একবার ভাল করে চেয়ে দেখ, বাবা! নিজের বাপকে তুই চিনতে পারছিস না?
অবাক হয়ে বৃদ্ধ বালথাযারের দিকে চেয়ে রইল ইকথিয়ান্ডার। তারপর ধীরে ধীরে সে বলল, আপনাকে তো আমি চিনি না।
কাতর কণ্ঠে বালথাযার বলল, ইকথিয়ান্ডার, বাবা আমার! ভাল করে চেয়ে দেখ আমাকে!
তারপর হঠাৎ ইকথিয়ান্ডারের মাথাটা নিজের বুকের কাছে টেনে আনল বালথাযার, সজল চোখে বারবার চুমু খেল কপালে।
এমন সময়ে কার একটা হাত এসে সজোরে বালথাযারের কলার চেপে ধরল এবং তাকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের এক কোণে। দেয়ালে জোরে মাথা ঠুকে যাওয়ায় ধপাস করে মেঝেতে পড়ল বালথাযার। দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন জুরিতা পেদরো। মুঠোর মধ্যে কি যেন একটা কাগজ ধরে বিজয়ীর মত সেটাকে নাড়াচ্ছে সে, চিৎকার করে বলছে, এই দ্যাখ, ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব কোর্ট আমাকেই দিয়েছে। সেজন্যে আমি ওকে নিয়ে যেতে এনেছি।
একটা চাপা গর্জন করে উঠল বালথাযার। পর মুহূর্তেই সে বাঘের মত লাফিয়ে পড়ল ক্যাপ্টেন পেনরোর ওপরে। দুজনের অধ্য শুরু হয়ে গেল হুলস্থূল লড়াই।
জেলখানার গার্ড দুপক্ষ থেকেই ঘুষ খেয়েছে তাই সে নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে। তবে পেদরো যখন বালথাযারকে মাটিতে ফেলে তার গলা টিপে ধরে শ্বাস রোধ করবার চেষ্টা করল তখন সে কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল।
কারাকক্ষের মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল সালভাদরের শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠস্বর: চমৎকার! চমৎকার অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছ তো ক্যাপ্টেন পেরো!
কখন তিনি এসে ঢুকেছেন তা কেউ লক্ষ করেনি। এবার গার্ডের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, হা করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? নিজের কর্তব্য ভুলে গেছ?
কথা শুনে মনে হলো সালভাদরই জেলখানার কর্তাব্যক্তি। তার ধমক শুনতে পেয়ে আরও কয়েকজন গার্ড ছুটে এলো। পেদরো আর বালথাযারকে দুদিকে সরিয়ে দিল তারা।
গার্ডদের হুকুম দিয়ে সালভাদর বললেন, গুণ্ডা দুটোকে তোমরা বাইরে নিয়ে যাও। আমি এখন ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে একা কথা বলতে চাই।
গার্ডরা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে ইকথিয়ান্ডারকে পরীক্ষা করলেন সালভাদর। দেখলেন, অনিয়মের ফলে তার শ্বাস-যন্ত্র বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন সালভাদর। মুখে বললেন, জেলখানা থেকে তোমাকে তাড়াতাড়ি বের করতে আমি চেষ্টা করছি, ইকথিয়ান্ডার। ভেঙ্গে পোড়ো না একদম!
ইকথিয়ান্ডারের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সালভাদর বেরিয়ে গেলেন।
কারাগারে নিজের সেলে বসে চিন্তায় ডুবে আছেন সালভাদর। ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্যের জন্য তিনি নিজেই দায়ী। ইকথিয়ান্ডার তার গর্ব, তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু জেলখানার এই বদ্ধ আবহাওয়ায় সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন সালভাদর। এ
দরজায় মৃদু টোকার শব্দ হলো।
সালভাদর বললেন, ভেতরে আসুন।
সেলের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব। আপনার অসুবিধা ঘটালাম না তো প্রফেসার?
সালভাদর বললেন, না, মোটেই না। আপনার বাড়ির সব খবর ভালো তো?
জেলার সাহেব সকৃতজ্ঞভাবে বললেন, হ্যাঁ, ভালই আছে। আপনি আমার স্ত্রীর জীবন দান করেছেন। আপনার এই ঋণ…
বাধা দিয়ে সালভাদর বললেন, এটা আমার কর্তব্য!
জেলার বললেন, কিন্তু ডাক্তার, আর সবাই যা বলে বলুক, আমি বুঝি আপনার মূল্য কত! তাই যখন শুনলাম আপনাকে ওরা চোর ডাকাতদের সঙ্গে এই জেলেই আটকে রাখবে বলে ঠিক করেছে তখন থেকেই ব্যাপারটা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বারবার মন বলছে, না, না, এ হতে পারে না।
তারপর মুখটা সালভাদরের কানের কাছে এনে জেলার ফিসফিস করে বললেন, বাড়ির লোকজনদের আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার শ্বশুরবাড়িতে। এবার আপনার পালাবার ব্যবস্থা করে আমি নিজেও পালিয়ে যাব। টাকার জন্যেই আমাকে এই চাকরি করতে হয়। কিন্তু এ চাকরিকে আমি ঘেন্না করি। আমাকে ওরা খুঁজে পাবে না, আর আপনিও দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, ডাক্তার। সালভাদরের কানের কাছে মুখটা আরও সরিয়ে এনে জেলার বললেন, আমি ভাল করেই খবর জেনেছি, যতই ওরা ঘুষ দিক না কেন, পেদারো বা বালথাযার কাউকেই ইকথিয়ান্ডারের অভিভাবকত্ব দেয়া হবে না। ইকথিয়ান্ডারকে মেরে ফেলা হবে বলেই ঠিক করেছে সরকারী কর্তারা।
চমকে উঠলেন সালভাদর।
জেলার আবার বলতে লাগলেন, ইকথিয়ান্ডারকে হত্যার জন্যে বেশি জেদ ধরেছেন আর্চ বিশপ হুয়ান দ্য গার্সিলাসো। আমাকে বিষ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওটা পটাসিয়াম সায়ানাই। আজ রাতেই ইকথিয়ান্ডারের চৌবাচ্চার জলে সেটা মিশিয়ে দেবার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সব দিক থেকে ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখেছি, ডাক্তার। আপনার পালাবার ব্যবস্থাও আমি করে ফেলেছি। ইকথিয়ান্ডারের জন্যে কি করতে পারব জানি না। তবে আপনাকে পালাতেই হবে। আপনার জীবন অনেক মূল্যবান। আপনি বেঁচে থাকলে আরও অনেক ইকথিয়ান্ডার তৈরি করতে পারবেন, কিন্তু দ্বিতীয় সালভাদর সৃষ্টি করতে কেউ পারবে না।…আপনার পালাবার ব্যবস্থা করে আমিও পালিয়ে যাব।
সালভাদর বললেন, আপনার আত্মত্যাগের জন্য ধন্যবাদ, জেলার। কিন্তু এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আপনি বরং ইকথিয়ান্ডারের মুক্তির চেষ্টাই করুন। তাতে আমার উপকার হবে বেশি। আমার স্বাস্থ্য আছে, শক্তি আছে, বন্ধু-বান্ধবেরও অভাব নেই। আমার মুক্তির জন্যে অনেকেই চেষ্টা করবে। কিন্তু ইকথিয়ান্ডারকে বাঁচাতে হবে, নইলে নিজের বিবেকের কাছে চিরদিন আমি অপরাধী হয়ে থাকব।
বেশ, আপনার কথা মতই কাজ করতে আমি চেষ্টা করছি।
জেলার সাহেব সেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ইকথিয়ান্ডারের পালাবার সব ব্যবস্থাই পাকা করে ফেলেছেন জেলার সাহেব। যাবার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করতে এলেন সালভাদর। পার্থিব ব্যাপারগুলো এখন কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে ইকথিয়ান্ডার। আইনের জালে সালভাদর আর সে নিজেও যে জড়িয়ে পড়েছে এ কথাটা অস্পষ্টভাবে হলেও সহজাত বোধশক্তি দিয়ে সে বুঝতে পেরেছে। এ কথাও সে জানতে পেরেছে যে তার পলায়নের সুব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবাকে রেখে কি করে সে পালাবে?
সালভাদর যখন তাকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে বেশ কিছুদিনের জন্যে, ইকথিয়ান্ডার। এখানে থাকা তোমার পক্ষে বিপজ্জনক। তাই তোমাকে চলে যেতেই হবে। না হলে…
বাকি কথাটা সালভাদর আর বলতে পারলেন না। বলবার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। আকুল কণ্ঠে ইকথিয়ান্ডার বলে উঠল, কিন্তু তোমার কি হবে, বাবা?
বিষণ্ণভাবে সালভাদর বললেন, আদালতের বিচারে অবশ্যই আমার জেল হবে। দুবছর কিংবা তারও বেশি সময় আমাকে জেলে থাকতে হবে। কিন্তু আমি যতদিন জেলে থাকব ততদিন তোমাকে থাকতে হবে কোন নিরাপদ জায়গায়, এবং এখান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের তুয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের একটা ছোট দ্বীপে চলে যেতে হবে তোমাকে। সেখানে পৌঁছানো তোমার পক্ষে খুব সহজ হবে না। কিন্তু এই লা-প্লটা উপসাগরে থাকলে তোমার সমূহ বিপদ। তার তুলনায় তুয়ামতু দ্বীপে যাওয়ার পথকষ্ট স্বীকার করাই তোমার জন্যে ভাল।
গন্তব্য পথটা ইকথিয়ান্ডারকে ভালমতো বুঝিয়ে দিলেন সালভাদর। পানামা খাল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়া যায়। কিন্তু খালের লক-গেটগুলোয় ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সেদিক দিয়ে
যাওয়াই ভাল। হর্ণ অন্তরীপ ঘুরে কিংবা ম্যাগেলান প্রণালী ঘুরে যাওয়াই বেশি নিরাপদ। আবার ওই দুই পথের মধ্যে হর্ণ-অন্তরীপ ঘুরে যাওয়ার নিরাপত্তা আরও বেশি, কেননা সেদিকে সামুদ্রিক খাদ্য ও পানীয়ের অভাব হবে না ইকথিয়ান্ডারের।
পথের নিশানাটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরেকবার বুঝিয়ে দিয়ে সালভাদর বললেন, হর্ণ-অন্তরীপ থেকে তুয়াম দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার পথটা খুঁজে পাওয়া পানামা খাল থেকে যাওয়ার চেয়েও কঠিন হবে। তবে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ থেকে নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আমি একটা বিশেষ যন্ত্র বানিয়েছি। সেটা তুমি সঙ্গে রাখবে। আর একটা কথা, তুমি লিডিংকেও সঙ্গে নেবে। যন্ত্রটা সেই বইবে…
ইকথিয়ান্ডার বলল, হ্যাঁ, ওর কথা ভেবে আমার মন কেমন যেন করছে।
সালভাদর একটু হেসে বললেন, কার জন্যে কারও মন কেমন করছে সেটা বলা মুস্কিল। যাই হোক, ওকে তুমি সঙ্গে নেবে। তুয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে তোমাকে খুঁজে নিতে হবে একটা নির্জন প্রবালদ্বীপ। দেখবে একটা উঁচু মাস্তুলের ওপরে দিকচিহ্ন হিসেবে টাঙানো রয়েছে একটা মাছ! হ্যাঁ, ওই দ্বীপটায় পৌঁছতে তোমার দুতিন মাস লেগে গেলেও চিন্তার কিছু নেই…।
ইকথিয়ান্ডার প্রশ্ন করল, কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার কি হবে? কি পাব সেখানে?
সালভাদর বললেন, সেখানে গিয়ে তুমি পাবে বন্ধু, পাবে তাদের ভালবাসা। সেখানে থাকেন আমার পুরানো বন্ধু ফরাসী- বৈজ্ঞানিক আরমান্দ ভিলবুয়া বিখ্যাত মহাসাগর-বিজ্ঞানী তিনি। আমার এই চিঠিটা তাঁকে তুমি দেবে। তিনি হবেন তোমার পিতৃতুল্য অভিভাবক। তাঁর মত বিজ্ঞানীর সঙ্গে তুমি যদি থাকতে পারো, মহাসাগরের আরও বহু কিছুই তুমি জানতে পারবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তুমি যদি তার সঙ্গে কাজ করতে পারো তাহলে মহাসাগর-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তোমরা এমন কিছু দিয়ে যেতে পারবে যার ফলে যুগান্তর ঘটবে, সচকিত হয়ে উঠবে সারা পৃথিবী। তোমার নাম যুক্ত হয়ে থাকবে আরমান্দ ভিলবুয়ার নামের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে থেকে বিজ্ঞানের সেবা করবে তুমি আর সেই সঙ্গে করবে সমগ্র মানবজাতির সেবা। এতে আমারও তৃপ্তি হবে। বুঝব আমার সৃষ্টি কাজে লেগেছে। সেক্ষেত্রে আমার স্থির বিশ্বাস আরমন্দ ভিলবুয়ার পরিবারে একটা নিশ্চিত আশ্রয় আর শান্তির সন্ধানও তুমি পাবে।
এদেশে থাকলে তোমাকে খাটানো হবে মূখ আর অর্থলোলুপ মানুষের হীন স্বার্থ চরিতার্থে! হ্যাঁ, আরও একটা কথা। আজ রাত্রেই হয়তো ছাড়া পাবে তুমি। জলের নিচের টানেল দিয়ে সোজা গিয়ে উঠবে আমাদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে সেই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের যন্ত্রটা আর অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু নেবার সব নিয়ে লিডিংকে সঙ্গে করে হর্ণ-অন্তরীপের দিকে রওনা দেবে ভোর হওয়ার আগেই!…তাহলে বিদায়, ইকথিয়ান্ডার। না, বিদায় নয়, আসি, ইকথিয়ান্ডার।
জীবনে এই প্রথমবার ইকথিয়ান্ডারকে আবেগের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন সালভাদর। তারপর তার পিঠ চাপড়ে হেসে বললেন, তুমি তো চমৎকার ছেলে! তোমার আবার ভাবনা কি! তাই না?