রাস্তাটা সাগরের ধার ঘেঁষে। ওটা ধরে উন্মত্ত উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। শহর পেরোতেই সৈকতে একটা পাথরের আড়ালে চলে এলো সে, কাপড়চোপড় খুলে নেমে পড়ল সাগরে। শহরের বাতাসে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর। এখন কানকো ভরে দম নিয়ে তৃপ্তি বোধ করল। এত দ্রুত ও সাঁতার কাটছে যেমন ও কাটেনি কখনও। কিসের এক অজানা আকুতি আর তাড়া পেয়ে বসেছে ওকে।
এদিকের সাগরের সবই ওর চেনা। ওই তো দেখা যাচ্ছে টারব্যাট মাছের বাড়িটা। সামান্য দূরে ওই যে সেই নানা রঙা প্রবালের পাহাড়। ওটার ধারেকাছে ঘুরঘুর করছে লাল ফিনওয়ালা অসংখ্য খুদে মাছ, বড় মাছদের তাড়া খেলেই চট করে ঢুকে পড়বে প্রবালের খুঁজে-ফোকরে। ওই যে সেই ডুবন্ত জেলে নৌকো। ওখানে সংসার পেতেছে দুটো অক্টোপাস। ভারি ভাব দুটোতে। কিছুদিন আগেই ওদের বাচ্চা হয়েছে কয়েকটা। পাটকিলে পাথরটার নিচে আছে কাঁকড়াদের সংসার।
ওদের চেনে ইকথিয়ান্ডার। জানে ওদের সুখ-দুঃখ সাংসারিক সম্পর্ক এবং ভালবাসার খবর। ভাল একটা শিকার ধরতে পারলে ওদের যে আনন্দ হয় তা বলে বোঝানো যাবে না। আবার শত্রুর সঙ্গে লড়াই বেধে একটা দাঁড়া হারাতে হলে ওদের কষ্ট তা-ও বলার মতো নয়।
ওই যে দেখা যাচ্ছে সেই ডুবো পাথর। ওখানে আড্ডা গেড়েছে। ঝিনুকের দল। তাদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না।
ঢেউয়ের মাথায় একদল ডলফিন দেখতে পেয়ে ডাকল ইকথিয়ান্ডার, লিডিং! লিডিং!
ওদের মাঝেই লিডিং ছিল। ডাক শুনে ঝড়ের বেগে লেজ নাচিয়ে ইকথিয়ান্ডারের কাছে চলে এলো ও। তাকে জড়িয়ে ধরল। ইকথিয়ান্ডার।
চল, আমাকে নিয়ে চল। দূরে। অনেক দূরে কোথাও!
কে বলতে পারবে লিভিং ওর কথা বোঝে কিনা। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে ছুটল সে। মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে, তারপর ঢেউ ছাপিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে পানির নিচে, চলে যাচ্ছে গভীর গহীন সমুদ্রের তলায়। তাতেও যেন মন ভরছে না ইকথিয়ান্ডারের। মনে কিসের এক অশান্তি। তার মনের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। লিডিং জোরে ছুটে চলেছে, কিন্তু আজ তাতেও যেন আনন্দ পাচ্ছে না ইকথিয়ান্ডার। লিডিঙের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরও গভীর সাগবে ডুব দিল ও। শহরে সেই মেয়েকে দেখে আজ যে অনুভূতি তার হয়েছে। সেটা কিছুতেই কেন যে ভুলতে পারছে না বুঝতে পারছে না ওর মন। নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে আজ ও উদ্বেগ, প্রশ্ন আর নানা অস্পষ্ট কষ্টকর অনুভূতি জাগছে মনে। সাগরের গভীর অন্ধকারে একাকিত্ব জেঁকে বসেছে। তা-ই চায় ও। একটু একা থাকা দরকার। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। জানা দরকারী হয়ে পড়েছে আজ, কেন সে আর সব মানুষের মতো নয়। কেন সাগরে এবং ডাঙা, দুজায়গাতেই ও স্রেফ এক ক্ষণিক অতিথি আগন্তুক।
ধীরে ধীরে সাগরের গভীরে নেমে চলেছে ইকথিয়ান্ডার আস্তে আস্তে ওর দেহের ওপর বাড়ছে পানির চাপ। কষ্টকর হয়ে উঠছে শ্বাস নেয়া। সাগরের এত গভীরে মাছের সংখ্যাও কম। যাদের ও আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ওর অচেনা। নিরব এই কবরের মতো অন্ধকার স্থবির জগতে আগে আর কখনও আসেনি ও। কেমন যেন শিউরে উঠল ইকথিয়ান্ডারস্ট্রতবেগে সাঁতার কেটে ওপরে উঠতে শুরু করল।
পানির ওপরে যখন মাথা জাগাল, সূর্য তখন পাটে বসেছে। গোল একটা লাল থালার মতো। নিরুত্তাপ লাল আলো গায়ে মেখে নাচতে নাচতে ছুটছে তখন অসংখ্য ঊর্মি।
নৌকো সৈকতে ভোলার জন্যে হাঁটু পানিতে নেমেছে কয়েকজন জেলে। দূর থেকে তাদের দেখল ইকথিয়ান্ডার। পছন্দ করতে পারল না। তাদের উপস্থিতি। খামোকা চেঁচাচ্ছে লোকগুলো। কটু গন্ধওয়ালা চুরুট কুঁকছে। ওদের চেয়ে ডলফিনদের সংসর্গ অনেক আনন্দদায়ক। ওরা অনেক পরিষ্কার, অনেক মজার মজার খেলায় মেতে থাকে।
একটানা তিনদিন হলো মহাসাগরে রয়ে গেছে ইকথিয়ান্ডার। বুকের মাঝে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে ও। অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়েছে। অনেক প্রশ্নের জবাব এখনও পায়নি। অসম্পূর্ণ আত্ম অনুসন্ধান অস্থির করে তুলছে ওকে। এ এক অজানা আকুতি
ওদিকে ক্রিস্টোর মাথা খারাপ হবার জোগাড়। তিনদিন হলো কোন খবর নেই ইকথিয়ান্ডারের। গেল কই ছোকরা? কোন বিপদ হলো না তো?
তৃতীয় দিন ইকথিয়ান্ডার ফিরে আসার পর অভিযোগের সুরে বলল সে, কোথায় ছিলে? আরেকটু হলে আমার চাকরি চলে যেত। এমন, আর কক্ষনো কোরো না।
সাগরের নিচে ছিলাম, সংক্ষেপে জবাব দিল ইকথিয়ান্ডার। এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন তোমাকে দেখতে?
জীবনে এই প্রথম মিথ্যে বলল ইকথিয়ান্ডার। আরেকটু হলে মারাই পড়তাম।
যে ঘটনা সে ক্রিস্টোকে বলল তা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবে ঘটনা ঘটেছিল অনেক দিন আগে। একটা ক্যানিয়নের ধার ঘেঁষে তখন সাঁতার কাটছিল ইকথিয়ান্ডার। ক্যানিয়নের খাদে নামতেই হঠাৎ করে কানকোয় তীব্র ব্যথা অনুভব করল। মাথা ঘুরছে। পানিতে কিসের যেন কটু গন্ধ। দেখল, একটা হাঙর হাঁসফাঁস করতে করতে তার পাশ দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে অন্তহীন গহ্বরে। হাঙরটা বোধহয় ওকেই আক্রমণ করতে আসছিল। কিন্তু বিষাক্ত এই খাদের কাছে এসে নিজেই মারা পড়ছে। শেষ পর্যন্ত মারা গেল হাঙরটা। ইকথিয়ান্ডার কোন রকমে ক্রল করে সরে এলো বিষাক্ত খাদের কাছ থেকে।
অবাক হয়ে শুনছে ক্রিস্টো। ডাক্তার সালভাদরের কাছ থেকে এঘটনার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরে শুনেছিল ইকথিয়ান্ডার। সেটাও গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিল। বলল, নিশ্চই ওই খাদে কোন বিষাক্ত গ্যাস জমছে। হাইড্রোজেন সালফাইড বা অ্যানহাইড্রাইড হতে পারে। সাগরের ওপরে এলে অক্সিজেনের সংস্পর্শে ওগুলো ক্ষতি করার ক্ষমতা হারায়। কিন্তু পানির তলায় ওই খাদ থেকে যেহেতু গ্যাস বের হচ্ছে, ফলে ওখানে পরিবেশটা সাজ্জাতিক বিষাক্ত। এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল ও। বলল, খিদে পেয়েছে খুব। কিছু একটা খেতে দাও তো, ক্রিস্টো।
ইকথিয়ান্ডার মোটামুটি স্বাভাবিক আছে দেখে বিরাট স্বস্তি পেল ক্রিস্টো। নিশ্চিন্তু বোধ করত, কিন্তু করতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা গোপন করছে ইকথিয়ান্ডার। মাত্র ভেবেছে জিজ্ঞেস করবে কথাটা, তখনই দস্তানা আর গগলস পরে আবার বের হয়ে গেল, ইকথিয়ান্ডার, থামানো গেল না তাকে।