লা প্লাটা উপসাগর ছাড়িয়ে উত্তরমুখী হয়ে বয়ে চলেছে পারানা নদী। নদীর মোহনায় পানি সাঙ্তিক নোংরা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের, মনে হচ্ছে মুখবন্ধ একটা কুয়োর ভেতর আটকে গেছে সে। নদীর পানিতে আছে পারানা শহরের যত বর্জ্য পদার্থ। শহুরে নিষ্কাষণ ব্যবস্থার কারণে নদীর তলায় জমে আছে জীবজন্তুর কঙ্কাল, মানুষের মৃতদেহ, ভাঙাচোরা জিনিসপত্র আরও বহুকিছু। মাথার খুলি ফাটা একটা মৃতদেহও দেখল ইকথিয়ান্ডার। গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে একটা বড় পাথর বাধা আছে। নিঃসন্দেহে কেউ তার অপকর্ম পাথর চাপা দিয়েছে এভাবে। নদীর মোহনার এই বিশ্রী জায়গাটা যত দ্রুত সম্ভব সাঁতার কেটে পার হয়ে যেতে চাইছে ইকথিয়ান্ডার।
এক সময় পেছনে পড়ে গেল নদীর মোহনা।
নদীর পানিতে লবণের পরিমাণ কম। তাছাড়া কাদার পরিমাণও বেশি। শ্বাস নিতে খুব অসুবিধে হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। লিডিঙের কথা একবার মনে এলো ওর। তাকে সঙ্গে আনলে দৈহিক পরিশ্রম, অনেক কম হতো। কিন্তু লিডিঙেরও কষ্ট হতো এই নোঙরা পানিতে। সেই বিচারে লিডিংকে সঙ্গে না এনে ভালই হয়েছে।
আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলেছে সময়। একসময় সন্ধে হয়ে গেল, অন্ধকার নামল সাগরের বুকে। সারাদিন প্রবল উত্তেজনায় খাওয়ার কথা মনে আসেনি ইকথিয়ান্ডারের, সন্ধে নামার পর ওর মনে হলো পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি সব সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। লাল মাটি ভরা নদীর তলদেশে তাকিয়ে দেখল ও, ঝিনুক বা মাছ নেই সেখানে। ওর ধারকাছ দিয়েই অবশ্য ছুটোছুটি করছে মিষ্টি পানির কিছু মাছ। কিন্তু সাগরের মাছের তুলনায় এগুলো অনেক ধূর্ত, সহজে ধরা যাবে না। রাতে একটা পাইক মাছ ধরল ইকথিয়ান্ডার। মাছটার স্বাদ অত্যন্ত খারাপ, মাংসে কাদা-কাদা গন্ধ, তবুও কাঁটাসহ মাছটাকে খেতে বাধ্য হলো ও খিদের জ্বালায়।
নদীর পানিতে অক্টোপাস কিংবা হাঙরের আক্রমণের ভয় নেই। সাগরের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ল ওর। একবার একটা গুহার ভেতরে অনেকগুলো অক্টোপাস ওকে আটকে ফেলতে চেয়েছিল। সেবার অনেক কষ্টে ওগুলোকে যুদ্ধে হারিয়ে মুক্তি পায় সে। নদীতে হাঙর বা অক্টোপাস নেই। এখানে বিপদ আসতে পারে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। খেয়াল রাখতে হবে ঘুমের সময় স্রোত যাতে তাকে। ভাটিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। বুদ্ধি বের করল ইকথিয়ান্ডার, তারপর বড় একটা পাথর জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।
তীব্র সাদা আলোর আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল ওর। চেয়ে দেখে, একটা স্টীমার এগিয়ে আসছে উজানের দিকে, তারই আলো। বুদ্ধি খেলল ইকথিয়ান্ডারের মাথায়। এমনিতেই খুব ক্লান্ত সে এখন! এটা সামনে একটা বিরাট সুযোগ। হেলায় হারানোর কোন মানে হয় না। স্টীমারের তলায় চলে এলো ইকথিয়ান্ডার, তলা আঁকড়ে ধরে ওটার। সঙ্গে চলল পারানা শহরের দিকে। পারানায় তাকে যেতেই হবে। যেতে হবে ডলোরেসে। ওখানে পেদরোর বাড়িতে গুট্টিয়ারা, আছে!
শহরের জেটিতে স্টীমার থামার পর ডুব সাঁতার কেটে একটা নির্জন জায়গায় চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। গগলস আর গ্লাভস খুলে ফেলল, নদীর কূলে বালির তলায় লুকিয়ে রাখল ওগুলো। রোদে শুকিয়ে নিল পরনের পোশাক। কোঁচকানো পোশাক দেখে তাকে মনে হলো চির ভবঘুরে এক নিঃসঙ্গ আগন্তুক।
অলসেন আগেই পথের হদিস রে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী নদীর ডান তীর ধরে হাঁটছে ইকথিয়ান্ডার; মাঝে মাঝে জেলেদের জিজ্ঞেস করে আরও নিশ্চিত হয়ে নিল, কোথায় পেদরোর ডলোরেসের বাড়ি।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপ। কাঠফাটা গরমে এখন রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে ইকথিয়ান্ডার। কাপড় ছেড়ে একবার নদীতে ডুব দিয়ে খানিক গা জুড়িয়ে নিল। পথ চলছে একটানা।
বিকেলে তার দেখা হলো এক বুড়ো চাষীর সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বুড়ো বলল, মাঠের মাঝ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা ধরে চলে যাও। ব্রিজ পার হয়ে টিলা পর্যন্ত গেলেই দেখা পাবে গোঁফওয়ালী ডলোরসের।
সেটাই নাকি পেদরোর বাড়ি?
তা ঠিক। ওই বাড়ির কত্রীর নাম ডলোরেস। মহিলার ঠোঁটের ওপর গোঁফ আছে বলে সবাই তাকে এক নামে ডাকে গুঁফো ডলোরেস। সে-ই পেদরো জুরিতার মা। বুড়োর ধারণা হয়েছে ইকথিয়ান্ডার ওই বাড়িতে মজুরি খাটতে যাচ্ছে, কাজেই শুভাকাক্ষী হিসেবে সে সাবধান করে দিয়ে বলল, ওখানে ভুলেও মজুর খাটতে যেয়ো না। ওই গুঁফো ডলোরেস আস্ত একটা ডাইনী। এত খাটা। খাটাবে যে স্রেফ মারা পড়বে। শুনছি পেদরো জুরিতা নাকি তরুণী এক মেয়েকে বিয়েও করেছে। শাশুড়ির অত্যাচারে সে বেচারি এখন টিকতে পারলে হয়। ইকথিয়ান্ডারকে আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে আরও বহু কিছু বলে গেল বুড়ো।
বাড়ির হদিস আবার জেনে নিয়ে একসময় পথে নামল ইকথিয়ান্ডার। পথ আর সামনে শেষ হয় না। গমের খেত, ভুট্টার খেত শেষ হতেই শুরু হলো দীর্ঘ ঘাসের প্রেয়ারি। অসংখ্য গরু ঘোড়া আর ভেড়া চরছে সেখানে। পায়ে হাঁটা পথটা মাঠের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে।
ভ্যাপসা গরমে কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। জলাশয় পেলে আরেকবার ডুব দিয়ে শরীরটা একটু জুড়িয়ে নিত। পাঁজরের সেই তীব্র ব্যথাটা ফিরে এসেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বোঝার ওপর শাকের আঁটি, খিদেও লেগেছে খুব।
রাস্তার দুধারে পাথরের দেয়াল। ভেতরে ফলের বাগান। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে পীচ আর পাকা কমলালেবু। কিন্তু এ তো সাগর তল নয়, এখানে সবই কারও না কারও সম্পত্তি। এখানে সবকিছুই অধিকারের আওতাধীন, বেড়া দিয়ে ঘেরা। পাহারা দেয়া। আকাশের পাখিগুলোরই যেন শুধু মালিক নেই কেউ। পথ জুড়ে কিচিরমিচির করছে অনেক পাখি।
ইকথিয়ান্ডারের খেয়াল নেই, তার দিকে এগিয়ে আসছে উর্দিপরা। একটা মোটা লোক। বেশ চুপি সাড়ে অসছে সে। কোমরে ঝুলছে : রিভলভার। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। কাছে চলে এলো।
ইকথিয়ান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করল ডলোরেসের বাড়ি কোনদিকে।
জবাবে খেকিয়ে উঠল লোকটা। তাতে তোর কি, আঁ? কোথেকে আসা হয়েছে, শুনি?
বুয়েন্স আয়ার্স। ডলোরেসে একজনের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে।
হাত বাড়া সামনে, নির্দেশের সুরে বলল মোটকু।
দ্বিধার কোন কারণ নেই, কাজেই কথাটা শুনে লোকটার বাজে ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও হাত বাড়াল ইকথিয়ান্ডার। দেরি না করে সেই বাড়ানো হাতে পরিয়ে দেয়া হলো হাতকড়া। ইকথিয়ান্ডারের পাজরে একটা গুঁতো মারল মোটকু। এইবার ঠিক ঠিক ধরেছি, বাপু। চল, তোকে ডলোরেসে পৌঁছে দিচ্ছি।
হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার। আমাকে হাতকড়া পরালেন কেন?
আবার খেঁকিয়ে উঠল মোটকু। অত কথায় তোর কাজ কি? একদম চুপ। সামনে বাড়ু।
ইকথিয়ান্ডার জানে না, পাশের গ্রামে এক বাড়িতে গতকাল ডাকাত পড়েছিল। তারা খুনজখমও করে গেছে। তাঁদেরই খুঁজছে পুলিশ। কোঁচকানো ধূলিমলিন পোশাকে ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে সন্দেহজনক লাগছে সেটাও ওর খেয়ালে নেই। এখনও জানে না ডাকাত সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের লোক।
ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে থানায় চলল পুলিশ। সেখান থেকে তাকে জেলে পাঠানো হবে। এতক্ষণে বিষয়টি কিছু কিছু আঁচ করতে পারছে ইকথিয়ান্ডার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, প্রথম সুযোগেই পালাতে হবে তাকে।
ইকথিয়ান্ডারের পেছন পেছন হাঁটছে মোটা পুলিশ, আয়েস করে একটা চুরুট ধরাল। সাফল্যের আনন্দে আত্মমগ্ন। হাঁটতে হাঁটতে ডলোরেসের বাড়ির কাছে দিঘির পাশে চলে এসেছে ওরা। দিঘির ওপর দিয়ে ব্রিজ। সেই ব্রিজ পার হয়ে যেতে হবে। ব্রিজে উঠেই রেলিং টপকে পানির ভেতর ঝাঁপ দিল ইকথিয়ান্ডার।
মোটা পুলিশ ভাবতেও পারেনি ইকথিয়ান্ডার এরকম একটা কাজ করতে পারে। আর ইকথিয়ান্ডারও ভাবতে পারেনি মোটা পুলিশ এমন কীর্তি করবে। মোটা পুলিশও ওর পিছু নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বসেছে দিঘির ভেতর। তার মনে হয়েছে অপরাধী বোধহয় পানিতে ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। বিরাট বিপদে আছে বেচারী অপরাধী। এমনিতেই বিরাট দিঘি, তারওপর লোকটার হাতে হাতকড়া আছে। ওই হাতকড়া সহ লোকটা মারা গেলে কৈফিয়ত দিতে দিতে তার জীবন যাবে। ইকথিয়ান্ডারের পিছু পিছু ডুব সাঁতার দিয়ে তাকে ধরে ফেলল পুলিশ, তার চুলগুলো হাতের মুঠোয় পেয়ে ধরে ফেলল। কতক্ষণ থাকবে সে পানির নিচে? একটু পরই দম ফুরিয়ে যাওয়ায় তাকে ভেসে উঠতে হলো। মুক্তি পেয়ে কয়েক মিটার দূরে সরে পানির ওপর যখজাগাল ইকথিয়ান্ডার। তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলা মোটা পুলিশ, ডুবে মরবি তো! শীঘ্রি উঠে আয়!
ইকথিয়ান্ডারের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। চিৎকার করে উঠল ও, বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি…
ও কথা শেষ করেই পানির তলে ডুব দিল ও।
মোটা পুলিশও নাছোড়বান্দা ধরনের। কাজে বোঝা গেল সে বেশ করিৎকর্মাও বটে। লোকজন এবং নৌকো জোগাড় করে এনে পানিতে হুক ফেলে ইকথিয়ান্ডারকে খুঁজতে শুরু করল সে। যেখানেই ওরা খোঁজে, সেখান থেকেই সরে যায় ইকথিয়ান্ডার। এ যেন মজার এক খেলা। কিন্তু একটু পরই খেলাটা আর মজার থাকল না। বারবার পানির তলায় লুক নামানো-ওঠানো করায় পানিতে কাদার পরিমাণ বেড়ে গেল। অস্বচ্ছ পানিতে দেখতে অসুবিধে হতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডারের। শ্বাসকষ্টও বাড়ছে। কানকোতে কাদা ঢুকে গেছে। কড়কড় করছে সেগুলো। তীরের কাছে গিয়ে সাবধানে একবার মাথা জাগাল ও। দেখতে পেল পালানোর সুযোগ তার পানির ওপরে তৈরি করাই আছে। এতক্ষণ খুঁজে ইকথিয়ান্ডারকে না পেয়ে তাকে মৃত ধরে নিয়েছিল সবাই। এতক্ষণ পর ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেয়ে নির্ঘাত ভূত বলে ধরে নিল তারা। আসামী ভূত! ভূত আসামী! কখন কার ঘাড় মটকায় রাগে…
আঁ…আঁ করে আর্তনাদ করে উঠল এক পুলিশ। আরেকজন নৌকোর ওপর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। যে দুজন তীরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা যিশুর নাম নিতে নিতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল, ঠক ঠক করে কাপছে। নাছোড়বান্দা সেই মোটা পুলিশকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, এতক্ষণে বোধহয় মেইল ট্রেইনের মতো দ্রুত ছুটে মাইল খানেক পেরিয়ে গেছে।
এতটা সুযোগ পাওয়া যাবে সেটা ইকথিয়ান্ডার ভাবতেও পারেনি। এদের কাণ্ড দেখে এখন ওর মনে পড়ল, স্প্যানিশরা খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। নিশ্চই ওরা ভেবেছে প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে ভয়ঙ্কর জেদী আসামী ভূত। দুষ্ট বুদ্ধির অভাব নেই ইকথিয়ান্ডারের। উর মনে হলো এদের আরও একটু ভয় দেখানো যাক। দুই পুলিশ এখন জড়াজড়ি করে যিশুর নাম নিচ্ছে আর ঠকঠক করে কঁপিছে। দাত-মুখ খিচিয়ে চেহারা বিকৃত করে চিৎকার আর গর্জনের পাশাপাশি তীরের দিকে এগোতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডাঁর। মুঠোকর হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে রেখেছে। এতক্ষণ দুই পুলিশ ঠকঠক করে কাপছিল। এবার সেই কাঁপাকাঁপিও থেমে গেল। প্রচণ্ড গরমেও জমাট বরফের মতো স্থির হয়ে গেল ওরা। শুধু চোখ দুটো ইকথিয়ান্ডারের গগলসের মতো বড় হয়ে উঠল।