পরদিন বেহেড মাতাল অবস্থায় জাজ থ্যাচারের কাছে গেল বাবা। টাকা দাবি করল, চোখ রাঙাল। কিন্তু চিড়ে ভিজল না, টাকা দিলেন না জাজ। তখন আদালতে যাবার হুমকি দিল বাবা; বলল, আইনের সাহায্যে জোর করে আদায় করবে টাকা।
আমার ব্যাপারে আদালতের শরণ নিলেন জাজ থ্যাচার আর ওই বিধবা, তাদের কাউকে যেন আমার অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু আদালতের বিচারক ভদ্রলোকটি ছিলেন নতুন, সদ্য এসেছেন। বুড়োর স্বভাব-চরিত্র জানতেন না কিছু। ফলে, আমাকে বাবার কাছছাড়া করতে রাজি হলেন না তিনি।
এতে মহা খুশি বাবা, অ্যাদ্দিন মনে শান্তি ছিল না তার। আমাকে এসে বলল, তাকে কিছু টাকা এনে না দিলে মেরে লাশ করে দেবে আমাকে। অগত্যা জাজ থ্যাচারের কাছ থেকে ধার করে তিন ডলার এনে দিলাম। টাকাটা নিয়ে দেদার মদ গিলল সে, তারপর রাত দুপুর অবধি শহরময় মাতলামি করে বেড়াল। এজন্যে তাকে এক হপ্তা গারদে পুরে রাখল ওরা। কিন্তু বাবা নির্বিকার: ছেলের হর্তাকর্তা হতে পেরে তার নাকি ফুর্তি করার শখ চেপেছিল।
হাজত থেকে বেরুবার পর তাকে মানুষ বানানোর দায়িত্ব নিলেন জাজ থ্যাচার। নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন বাবাকে। এমন ব্যবহার করলেন তার সাথে যেন ছেলেবেলার ইয়ার। মদ খেতে বারণ করলেন। এক পর্যায় কেঁদে ফেলল বাবা। বলল, এতকাল বোকার মত কাজ করেছে। এবার নতুন করে জীবন শুরু করবে, যাতে তাকে নিয়ে আর কাউকে মুখ-খাওয়া হতে না হয়। বাবার কথা শুনে জাজ থ্যাচার আর তার স্ত্রীর চোখেও পানি এল। মিসেস থ্যাচার তার হাতে চুমু খেলেন। জীবনে আর কখনও খারাপ কাজ করবে না, এই মর্মে একটা হলফনামায় সই করল বাবা।
তারপর বুড়োকে ওই বাড়িরই একটা সুন্দর কামরায় নিয়ে গেলেন ওঁরা। সেখানে তার আরামের বন্দোবস্ত করলেন। রাতে ভয়ানক তেষ্টা পেল বাবার। জানালা দিয়ে গাড়ি-বারান্দার ছাতে নামল, সেখান থেকে থাম বেয়ে নেমে গেল নিচে। পরনের নতুন কোর্তাটার বিনিময়ে একটা দশসেরি মদের পিপে কিনে আবার পিলার বেয়ে ফিরে এল ঘরে। ভোর রাতে নেশায় বুদ হয়ে আবার বেরোল বাবা। কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে হুঁড়মুড় করে গাড়ি বারান্দা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে। বাঁ-হাতের দু জায়গায় ভেঙে গেল। বরফে জমে আর একটু হলেই মারা যেত, সূর্য ওঠার পর তাকে একজন দেখতে পেয়েছিল তাই রক্ষে।
একটু বাদেই আবার চাঙা হয়ে পাগলামি শুরু করল বাবা। জাজ থ্যাচারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যে কোর্টে গেল। আমাকেই ধরার চেষ্টা করতে লাগল, কেন আমি ইশকুল ছাড়ছি না-এ-ই তার রাগ। বার দুই বাগে পেয়ে ভীষণ পেটাল আমাকে। আগে ইশকুলে যেতে ভাল লাগত না। কিন্তু মার খেয়ে রোখ চেপে গেল, রোজ যেতে লাগলাম। কোর্টের ব্যাপার-স্যাপার বড্ড শামুকের গতিতে চলে, বাবার মামলাটা শুরু করবার মত চাড় দেখা গেল না কারও। ফলে, মাঝে-মধ্যেই ধার করে দু-তিন ডলার এনে দিতে হয় তাকে। না-দিয়ে উপায় নেই, চাবুকপেটা করে আমাকে। টাকা পেয়েই মদে চুর হয় বাবা। তারপর মারমুখী হয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা শহরে। এজন্যে বারকয়েক হাজতেও গেল।
ইতিমধ্যে শীত চলে গিয়েছে, এখন বসন্ত। গাছে-গাছে নতুন পাতা; ফুল ফোটেনি, তবে ফুটি-ফুটি। একদিন আমাকে পাকড়াও করল বাবা। একটা ছোট্ট ডিঙিতে চড়ে মাইল তিনেক দূরের এক জঙ্গলে গিয়ে উঠল। জায়গাটা নদীর যে তীরে ইলিনয়, সেইদিকে। সেখানে একটা পুরোন কাঠের কেবিনে কয়েদ করে রাখল আমাকে। চারিধারে গভীর বন। পথের হদিস না-জানলে বের করতে পারবে না কেউ।
বাবার একটা বন্দুক ছিল; বোধহয় চুরি করা। ওটা দিয়েই শিকার-টিকার করে খাচ্ছি। এভাবে কাটল কিছুদিন। পরে অবস্থা এমন হল, আমাকে আটকে রেখে বাবা রোজই চলে যায় নদীর ধারে তিন মাইল দূরে যে-ফেরিগুদামটা আছে, সেখানে। খাবারের বদলে মদ কিনে আনে। তারপর মাতাল হয়ে আমাকে ধোলাই দেয়। কীভাবে খোঁজ পেল জানি না, আমাকে নিতে লোক পাঠাল বিধবা। বন্দুক হাতে বাবা তাড়া করল তাকে।
ধীরে ধীরে ওখানকার জীবন সয়ে এল আমার: কাজ-কাম নেই, গা ঢিলে দিয়ে চলা। খাও-দাও আর ফুর্তি করো। দুমাস কিংবা তারও বেশি হবে, দাখ-দ্যাখ করে। চলে গেল যেন। কাপড়চোপড় ছিড়ে-ছুটে গেছে, চিতি পড়ে গেছে ময়লায়। বিধবার ওখানে আঁটসাট জীবন কী করে যে ভাল লাগত, ভাবতেই অবাক লাগে এখন। আমার আর ফিরে যাবার ইচ্ছে নেই। গাল দেয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম, বিধবা পছন্দ করত না, আবার ঝালাই করলাম সেটা। বাবারও এতে আপত্তি হল না কোন।
বনে-বাদাড়ে সময় আমার ভালই কাটছিল, কিন্তু বাবার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। রোজই আমাকে আটকে রেখে চলে যায়। একবার তো তিনদিন ফিরল না। আমার সাংঘাতিক একলা মনে হতে লাগল নিজেকে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই ডুবে মরে গেছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, আর বুঝি বেরোতে পারব না ওখান থেকে। স্থির করলাম, যেভাবেই হোক পালাতে হবে। এর আগেও কয়েকবার ওই ঘর থেকে বেরুর চেষ্টা করেছি, পথ পাইনি। বড় জানালা নেই যার ভেতর দিয়ে একটা কুকুর গলতে পারে, আমি তো কোন ছার! চিমনি-পথে পালানোও সম্ভব নয়, খুবই সরু। দরজার পাল্লাগুলো যেন গাছের গুড়ি, ওক কাঠের তৈরি।
বাবা খুব সেয়ানা, বাইরে যাবার সময় একটা চাকুও রেখে যায় না ঘরে। এই ব্যাপারে তার কড়া খেয়াল। বেশ মনে আছে, তন্নতন্ন করে না-হলেও একশ বার খুঁজেছি। আমার সময়, ধরতে গেলে, ওই করেই কাটছিল। জোর বরাত, একটা পুরোন করাত পেয়ে গেলাম একদিন-মরচেপড়া, হাতলবিহীন। ছাতের কড়িকাঠের ভেতর লুকোন ছিল করাতটা।
তেল দিয়ে সাফ করলাম ওটা। কেবিনের শেষ মাথায়, একটা টেবিলের পেছনে দেয়ালের সাথে পেরেক দিয়ে একখানা কম্বল সাঁটা ছিল। কাঠের ফাঁক দিয়ে বাতাসের ঝাপটায় যেন মোমবাতি নিভে না যায়, সেজন্যে এই ব্যবস্থা। গুড়ি মেরে টেবিলের তলায় ঢুকলাম আমি, কম্বলের একটা পাশ তুলে করাত চালিয়ে ফাঁকটা বড় করতে লাগলাম, কোনমতে যাতে ওই ফোকর গলে বেরুন যায় ওখান থেকে। সময়সাপেক্ষ কাজ; প্রায় শেষ করে এনেছি, এমন সময় কানে এল বাবার বন্দুকের আওয়াজ।
করাতটা লুকিয়ে ফেললাম চট করে। কম্বলটা আবার আগের জায়গায় রেখে নিশ্চিত হলাম, আমার কীর্তির আলামত দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বাবা এসে ঢুকল। তিরিক্ষে মেজাজ। উকিল জানিয়েছে মামলায় তার জেতার সম্ভাবনা আছে, বলল সে, কিন্তু এসব কাজ ঢিমেতালে কীভাবে চালাতে হয়, জাজ থ্যাচার তা ভালই জানেন। তাছাড়া, আমাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে বিধবাও নাকি মামলা ঠুকতে পারে।
শেষের কথাটায় মন খুঁতখুঁত করতে লাগল আমার। কারণ, আর সবার মত জবুথুবু হয়ে সভ্য হবার ইচ্ছে আমার নেই।
আমাকে ডিঙির কাছে নিয়ে গেল বুড়ো। সেখানে এক বস্তা ময়দা, কিছু মাংস, চার গ্যালনের এক বোতল মদ আর গোলা-বারুদ ছিল। ওগুলো কেবিনে নিয়ে এলাম আমি।
রাতে খাবার পর ফের মদ গিলতে শুরু করল বাবা। আর ঘণ্টাখানেক বাদেই বদ্ধ মাতাল হয়ে যাবে বুড়ো, মনে মনে বললাম, চাবিটা চুরি করে তখনই চম্পট দেব।
এক সময় বিছানায় ঢলে পড়ল বাবা। তবে আমার কপাল খুলল না; ঘুমোয়নি গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝেতে, গোঙাচ্ছে অস্ফুট স্বরে। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল আমার, হাজার চেষ্টাতেও খুলে রাখতে পারলাম না। আমি কী করব, তা ঠিক করার আগেই ডুবে গেলাম ঘুমের অতলে। বাতিটা জ্বালানোই রইল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হঠাৎ চিৎকার শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। হিংস্র হয়ে উঠেছে বাবা, চোখজোড়া ভাটার মত জ্বলছে, ছুটোছুটি করছে ঘরময়।
সাপ! সাপ! চেঁচিয়ে উঠল সে। তাড়া করছে আমাকে! উফ, কামড়ে দিয়েছে। গালে!
কোন লোককে এতটা হিংস্র হতে আমি আর দেখিনি। এভাবেই চলল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল বাবা, হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। চারিদিক ভীষণ নিঝুম। দূর-বনে পেঁচা ডাকছে, একটা নেকড়ের ডাক ভেসে এল। গা ছমছম করে উঠল আমার।
হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল বাবা, বুনো দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে। আমার দিকে চোখ পড়তেই তেড়ে এল; হাতে ছুরি।
তোকে চিনি, চেঁচিয়ে উঠল সে, তুই আজরাইল। আমার জান কবচ করতে এসেছিস। পারবি না, আমি-ই আগে শেষ করব তোকে।
বাবা, আমি হাক, কেঁদে ফেললাম। দেখতে পাচ্ছ না তুমি, বাবা, আমি হাক।
কলজে-কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়ল বাবা। ভয়ে আমার পিলে চমকে গেল। বাবা ধেয়ে এল আমার দিকে। খপ করে পেছন থেকে চেপে ধরল কোটের কলারটা। মনে হল, এক্ষুনি বুঝি মরে যাব। বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে, বাউলি কেটে কোটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণ বাঁচালাম।
একটু বাদেই ঝিমিয়ে পড়ল বাবা, দরজায় ঠেস দিয়ে পড়ল চুপ করে।
দাঁড়া, জিরিয়ে নেই এক মিনিট, তারপর খুন করব তোকে, হুমকি দিল। ছুরিটা নিজের কাছেই রাখল। ঘুম থেকে উঠে বোঝাব মজা।
আস্তে আস্তে ঝিমুতে লাগল বাবা। আমি পা টিপে টিপে চেয়ারের ওপর উঠে বন্দুকটা পাড়লাম। পরখ করে দেখলাম টোটা ভরা কি-না। বাবার দিকে তাক করে গাজরের পিপেটার ওপাশে বসে পড়লাম। অতি ধীর লয়ে বয়ে চলল সময়।