লোকগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মাকে নিয়ে নেমে ব্রিজের তলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। কৌতূহল দমন করতে না পেরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে চলে এসেছি সরাইয়ের কাছে। গা-ঢাকা দিয়ে বসেছি একটা ঝোপের ভেতরে। মুখটা বের করে রেখেছি শুধু। সরাইয়ের দরজাটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছি। সাত আটজন লোক দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে সরাইয়ের দিকে। একটা লোককে দুদিক থেকে ধরে নিয়ে এগোচ্ছে দুজন লোক। মাঝের লোকটা অন্ধ দস্যু।
দরজার কাছে এসেই আদেশ দিল অন্ধ, তার কণ্ঠ পরিষ্কার শুনতে পেলাম। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল কর্কশ কণ্ঠ, ভেঙে ফেল দরজা!
তিনজন লোক এগিয়ে গেল। হাত রাখতেই খুলে গেল ভেজানো পাল্লা। কথা শুনেই বোঝা গেল, বিস্মিত হয়েছে ওরা।
জলদি, জলদি ঢোক ভেতরে! গর্জে উঠল অন্ধ। হারামজাদা বিল পালিয়েছে হয়ত!
দুজন সহকারীর সঙ্গে বাইরে রয়ে গেল অন্ধ। অন্যেরা সবাই ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে, বিল মরে গেছেরে!
গাল দিয়ে উঠল অন্ধ। মরেছে, কাজ কমেছে হাঁদারামের দল! ওর শরীর তল্লাশি কর! সিন্দুকটা বের করে নিয়ে আয়! জলদি! তর সইছে না আর ডাকাতটার।
প্রচন্ড হাঁকডাক শুরু করেছে ডাকাতেরা। বাড়ির ভেতরে জিনিসপত্র হেঁচড়ানো আর ভাঙার আওয়াজ উঠছে। দাপাদাপি শোনা যাচ্ছে সিঁড়িতে। এক ঝটকায় খুলে ফেলল কেউ ক্যাপ্টেনের ঘরের জানালার একটা পাল্লা। শার্শির কাচ ভাঙল ঝনঝন শব্দে। খোলা জানালায় একটা লোকের কাঁধ-মাথা দেখা গেল। অন্ধকে ডেকে বলল সে, পিউ, সিন্দুকটা খোলা। তছনছ হয়ে আছে ভেতরের জিনিসপত্র।
ওটা আছে কিনা দেখ, গাধা কোথাকার! রাগে ফুসছে অন্ধ।
মোহরগুলো আছে।
টাকার কথা বলছি না, শুয়োর কোথাকার! নকশাটা আছে কিনা দেখ!
আধ মিনিট নীরবতার পর আবার জবাব দিল লোকটা, না নেই।
দেখ, বিলের শরীরে কোথাও আছে কিনা!
আবার নীরবতা। তারপর আবার জবাব এল, নেই!
হুহ! বুঝতে পেরেছি, ওই হারামজাদা ছেলেটার কাজ! ইসস, কেন যে চোখ দুটো তখন গেলে দিইনি! চেঁচিয়ে বলল পিউ, একটু আগে যখন এসেছিলাম, দরজা বন্ধ ছিল। দেখ কোথায় ব্যাটা। খোঁজ খোঁজ, খুঁজে বের কর!
তুমুল কান্ড শুরু হল সরাইয়ের ভেতরে। বুটপরা ভারি পায়ের ধুপধাপ, আসবাবপত্র ছুঁড়ে ফেলার শব্দ, দরজায় লাথি মারার আওয়াজ উঠছে। কয়েক মিনিট চলল এই অবস্থা। তারপর একজন লোক উঁকি দিল সরাইয়ের দরজায়। পিউকে জানাল, আমাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ এই সময় হুইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল। গ্রামের ওদিক থেকে এসেছে শব্দটা।
পুলিশ! চেঁচিয়ে উঠল অন্ধের পাশে দাঁড়ানো একজন। এই তোরা সব বেরিয়ে আয়… ডার্ক, কোথায় তোরা? পুলিশ আসছে!
পালাবি কেন, ভীতুর ডিম কোথাকার! ধমকে উঠল পিউ। আফসোস করল, ইসস, আজ যদি আমার চোখ থাকত!
সরাইয়ের ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল ডাকাতেরা। সরাইয়ের আশেপাশের ঝোপঝাড়ে আমাদের খোঁজার নির্দেশ দিল অন্ধ। পুলিশ আসছে তাই দ্বিধা করল দস্যুরা। আবার ভীতু কাপুরুষ বলে গাল দিল অন্ধ।
লক্ষ-কোটি টাকা তোদের হাতের নাগালে, বোঝানোর চেষ্টা করেছে পিউ। এই সুযোগ ছেড়ে দিবি? দেখ দেখ, জলদি খুঁজে দেখ ছোঁড়াটা কোথায়। নকশাটা বের করতেই হবে।
নকশা-ফকশার দরকার নেই, পিউ, বলল এক ডাকাত। মোহরগুলো পেয়েছি, এতেই চলবে।
খামোকা চিল্লাচিল্লি করে লাভ নেই, প্রথমজনের সমর্থনে বলল আরেক ডাকাত। চল কেটে পড়ি।
ভয়ঙ্কর খেপে গেল অন্ধ। চেঁচিয়ে গাল দিতে শুরু করল। কিন্তু এতেও কোন কাজ হচ্ছে না দেখে এলোপাতাড়ি বাড়ি মারতে লাগল লাঠি ঘুরিয়ে। দপাদপ কয়েক ঘা খেল লাঠির আওতায় দাঁড়ানো ডাকাতেরা! ভয়ংকর দাঁত খিচিয়ে পিউকে গালাগাল দিয়ে উঠল ওরা। সরে গেল লাঠির আওতার বাইরে।
ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল এই সময়। গ্রামের ওদিকে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে নেমে আসছে একাধিক ঘোড়া। পিস্তলের আওয়াজ হল সরাইয়ের পেছনের পাহাড়ে। মনে হল, আলোর ঝলকও দেখতে পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করল ডাকাতেরা কিটস হোলের দিকে। বুঝলাম, পিস্তলের শব্দ করে কেউ ওদের পালাবার ইঙ্গিত করেছে।
অন্ধকে ফেলে রেখেই পালিয়েছে ডাকাতেরা। এইবার নিজের বিপদ বুঝতে পারল পিউ। লাঠি ঠুকে ঠুকে পথ খুঁজে নিয়ে ছোটার চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারছে না। বার বার হোঁচট খাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে ডাকল, ওরে ভাইয়েরা, আমাকে ফেলে যাসনে! আমাকে নিয়ে যা, ভাই, নিয়ে যা…।
কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। আবার ছুটতে শুরু করল পিউ। ভুল করে গ্রামের পথে ছুটছে।
ঠিক এই মুহূর্তে উল্টো দিকের পাহাড়ের ওদিক থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন অশ্বারোহী। চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি ওদের। ঢাল বেয়ে নেমে আসছে দ্রুত।
ছুটছে পিউ। হঠাৎ তুষারে পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। অশ্বারোহীরাও এসে পড়েছে। পথের ওপর পড়ে যাওয়া মানুষটাকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল সামনের ঘোড়সওয়ার। আকাশ ফাটানো আর্তনাদ করে উঠল অন্ধ। তাকে মাড়িয়ে চলে গেল সবকটা ঘোড়া। চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম, নড়ছে পিউয়ের দেহটা। কাত হল, তারপর চিৎ হয়ে গেল আস্তে আস্তে। আর নড়ল না।
অশ্বারোহীরা আরও কাছে এসে যেতেই লাফিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। সামনের আরোহী একজন অফিসার, মিস্টার ডানস কিটস। গ্রাম থেকে যে যুবকটি গিয়েছিল ডাক্তার লিভসীকে খবর দিতে, সে-ও আছে সঙ্গে। পাহাড়ের ওদিকে সাগরে সন্দেহজনক জাহাজের কথা দুপুরেই কানে গিয়েছে কিটসের। তদন্ত করতে আসছিলেন। পথে গ্রামের যুবকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
পিউ মরে গেছে। চোখের সামনে সবুজ আচ্ছাদন খসে পড়েছে। আকাশের দিকে চেয়ে আছে যেন কালো কোটর দুটো। বীভৎস!
আমাকে দেখে থামলেন ডানস কিটস। যুবকটাও থামল। দুএক কথা জিজ্ঞেস করে, একজন পুলিশকে আমার কাছে রেখে দলবল নিয়ে ডাকাতরা যেদিকে গেছে, সেদিকে ধাওয়া করলেন কিটস। পরে ফিরে এসে তিনি জানিয়েছেন, ছোট পালতোলা জাহাজটা নিয়ে পালিয়েছে ডাকাতেরা। ধরতে পারেননি কাউকে।
পুলিশ এবং যুবকের সহযোগিতায় মাকে নিয়ে এলাম সরাইখানায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ব্রিজের তলায়। খানিকটা রাম ঢেলে দিলাম তার মুখে। গরম সেঁক ইত্যাদি দিয়ে গা গরম করে জ্ঞান ফেরানো হল।
মার জ্ঞান ফিরলে আমি ঘরদোরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তাকানো যায় না। ডাকাতেরা জিনিসপত্র কিছুই আর আস্ত রাখেনি। ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেছে সবকিছু। দেয়ালের ঘড়িগুলো পর্যন্ত খুলে নিয়ে আছড়ে ভেঙেছে।
ইতিমধ্যে কিটসও ফিরে এসেছেন। তাঁর আর উপস্থিত অন্যান্য লোকদের সব খুলে বললাম। বিকেলে অন্ধ পিউয়ের প্রথম সরাইয়ে আগমন থেকে ডাকাতেরা পালানো পর্যন্ত সব কথা।
কিটস বললেন, কিন্তু মোহরগুলো তো পেয়ে গেছে, আর কিসের খোঁজ করছিল ওরা?
হঠাৎই প্যাকেটটার কথা মনে পড়ে গেল আমার। জামার ভেতরের পকেটে রেখেছি। ওটা বের করে এনে বললাম, হয়ত এটার খোঁজ করছিল। অন্ধকে বার বার ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের নকশার কথা বলতে শুনেছি।
দেখি? হাত বাড়ালেন মিস্টার ডানস।
আমি ভাবছিলাম মিস্টার লিভসীর কাছে জমা দেব এটা…
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বললেন কিটস, ওঁকেই দিও। উনিই আগে খুলে দেখবেন, কি আছে ভেতরে। কি যেন ভাবলেন ডানস, তাহলে চল যাই, ডাক্তার সাহেবের ওখানে। দেরি না করে আজই জমা দিয়ে দেয়া উচিত। নিশ্চয় মূল্যবান কিছু আছে প্যাকেটে, নইলে ওটার জন্যে এমন পাগল হয়ে উঠত না অন্ধ।
কিটসকে ধন্যবাদ দিলাম।
একজন লোককে নির্দেশ দিলেন কিটস, ডগার, তোমার ঘোড়াটা ভাল। ছেলেটাকে তোমার সঙ্গেই নাও।
মায়ের কাছে একজন লোককে রেখে সে-রাতেই ডাক্তার লিভসীর বাড়ির পথে রওনা দিলাম আমরা।