ক্যাপ্টেনকে তার কেবিন থেকে বেরুতে দেখেই স্যার বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল শ্যানডন। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, গ্যারী! তুমি…!
সবাই দেখল লম্বা জুলপি দিয়ে এতদিন ঢাকা ছিল ওর মুখ। আজ জুলপি কেটে ফেলায় তার মুখে গাম্ভীর্যময় একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। দেখলে মনে হয় যেন গ্যারীর জন্মই হয়েছে শুধু হুকুম দেবার জন্যে। হতভম্ব নাবিকেরা বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই চেঁচিয়ে উঠল, থ্রী চিয়ার্স ফর ক্যাপ্টেন।
ডেকে এসে ক্যাপ্টেন সবাইকে ডাকবার জন্যে শ্যানডনকে নির্দেশ দিলেন। ডাক শুনে সবাই এসে পড়ল ডেকে। ক্যাপ্টেন কি বলেন তা শোনার জন্যে সকলে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
ভাল করে একনজর সবাইকে দেখে নিয়ে ক্যাপ্টেন আস্তে আস্তে শুরু করলেন, আমি একজন ইংরেজ সন্তান। আমি দেশের পতাকা এমন জায়গায় উড়িয়ে আসতে চাই যেখানে এর আগে আর কারও পদার্পণ ঘটেনি। সুমেরুতে আমি ইংরেজ পতাকা ওড়াতে চাই। টাকার জন্যে কোন চিন্তা নেই। প্রয়োজনমত খরচ করব আমি। এ কাজ শুধু টাকা দিয়ে হয় না। চাই দৃঢ় মনোবল ও দেশপ্রেম। আমি আপনাদের অনেক টাকা দেব। আমরা এখন আছি বাহাত্তর ডিগ্রিতে। প্রতি ডিগ্রি উত্তরে এগুনর জন্য আপনারা সবাই এক হাজার পাউন্ড করে পুরস্কার পাবেন। মনে রাখবেন, আমিই ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস।
ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস!
ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের নাম শোনেন এমন ইংরেজ কমই আছে। বিশেষ করে নাবিকদের কাছে তিনি এক বিস্ময়। অজেয়কে জয় করার উন্মাদনায় একবার পেয়ে বসলে কারুরই সাধ্য নেই তাকে ফিরিয়ে আনে। তার সঙ্গে অভিযানে যেতে হবে শুনলেই নাবিকেরা শিউরে ওঠে। পৈতৃক সূত্রে প্রচুর ধন-দৌলতের মালিক এই জন হ্যাটেরাস। হ্যাটেরাসের বাবা ছিলেন মদের ব্যবসায়ী। মৃত্যুকালে তিনি ছেলের জন্যে রেখে যান নগদ ষাট লক্ষ পাউন্ড আর অগাধ সম্পত্তি। অসম সাহসী হ্যাটেরাস অসংখ্য অ্যাডভেঞ্চারে প্রচুর টাকা খুইয়েছেন, অথচ আবিষ্কারের নেশাটা এখনও আগের মতই তরতাজা রয়েছে।
হ্যাটেরাসের জীবনে একটাই দুঃখ-অজানা অজ্ঞাত দেশ আবিষ্কারে ইংরেজরা অনেক পিছনে পড়ে আছে। আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন কলম্বাস, একজন ইহুদী। ভাস্কোডাগামা ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেছেন-তিনি জাতে পর্তুগীজ। চীনও আবিষ্কার করেছেন পর্তুগীজ ফার্নান্ডো ডি আনড্রাডা। কানাডা আবিষ্কার করেছেন ফরাসী জ্যাকুইস কার্টার। কিন্তু সেই তুলনায় ইংরেজদের তেমন কোন দুঃসাহসিক আবিষ্কার নেই। তারা কেবল কলোনি করেছে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ভারতবর্ষে। এতে সুনামের চাইতে দুর্নামই হয়েছে বেশি। ইরেজদের এই কলঙ্ক যে করেই হোক ঘুচাতে হবে। তাই তিনি এমন জায়গা আবিষ্কার করতে চান যা দেখে সারা দুনিয়ার সব লোকের তাক লেগে যাবে।
ইংরেজদের কলঙ্ক ঘুচাতে হ্যাটেরাস দক্ষিণ সাগরে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে বাফিন উপসাগরে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা ১৮৪৬ সালের কথা। জাহাজের নাম ছিল হ্যালিফ্যাক্স। ওই অভিযানে হ্যাটেরাসের পাগলামো চরমে পৌঁছেছিল। নাবিকদের যে কি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল তা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হ্যাটেরাসকে তাই নাবিকদের এত ভয়। তার সঙ্গে অভিযানের কথা ভুলেও কেউ মুখে আনে না। তবুও টাকার লোভ দেখিয়ে ফেয়ারওয়েল জাহাজে বেশ কজন দুঃসাহী নাবিক নিয়ে আবার ১৮৫০ সালে উত্তরে রওনা হয়েছিলেন তিনি। বরফ সমুদ্রে ধ্বংস হল ফেয়ারওয়েল জাহাজ। নাবিকদের একজনও বাঁচেনি। শুধুমাত্র হ্যাটেরাস বরফের উপর দুশো মাইল পায়ে হেঁটে, কোনমতে প্রাণে বেঁচে যান। পরে ভাগ্যগুণে এক তিমি-শিকারির জাহাজে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন।
সেই থেকেই হ্যাটেরাসকে নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনার আর শেষ নেই। তিনি কি মানুষ না আর কিছু বদ্ধ উন্মাদ, নাকি খ্যাপা ক্যাপ্টেন?
ফেয়ারওয়েল অভিযানের পর তাঁর সম্পর্কে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল নাবিকদের মাঝে। তাই অঢেল টাকার লোভ দেখিয়েও আর কোন সঙ্গী জোগাড় করতে পারলেন না তার পরবর্তী অভিযানের জন্য। তাই দুবছর ছদ্মবেশে লিভারপুলে থাকলেন। মিশলেন নাবিকদের সঙ্গে। রিচার্ড শ্যানডনকে মনে ধরল তার। বেনামী চিঠি লিখে শ্যানডনকে দিয়ে তৈরি করালেন ফরওয়ার্ড। আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন; প্রয়োজন না পড়লে, চরম সঙ্কট না এলে, নিজেকে প্রকাশ করবেন না। শুরু হল ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসের নতুন অভিযান। জাহাজে ক্যাপ্টেন থেকেও ছিল না। বিনা ক্যাপ্টেনেই এগিয়ে চলছিল জাহাজ।