বাড়িতে পাওয়া গেল না ডাক্তার লিভসীকে। চাকরাণী জানাল, বিকেলে বেরিয়ে গেছেন ডাক্তার। হল-এ গেছেন। রাতের খাওয়াটা জমিদার বন্ধু ট্রেলনীর ওখানেই সারবেন।
সেখানেই যাব, বললেন ডানস।
রাস্তা বেশি না। চাঁদের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথের দুপাশে সারি সারি গাছ, পাতা ঝরে গেছে। চাঁদের আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে নিষ্প্রাণ গাছগুলোকে। সবকিছুতেই যেন জলদস্যুর ছোঁয়া লেগে আছে।
এক বিরাট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন ডানস। হাত তুলে পেছনের সবাইকে থামার ইঙ্গিত করলেন। তারপর নামলেন ঘোড়া থেকে। আমরাও নামলাম সবাই।
বেল টিপে ডাকতেই দরজা খুলে দিল বেয়ারা। পথ দেখিয়ে ট্রেনীর লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল আমাদের। ঘরে ঘরে সারি সারি আলমারি, সবগুলোতে বই ঠাসা। প্রতিটি আলমারির ওপরে রাখা আছে বিখ্যাত সব লোকের একটি করে আবক্ষ মূর্তি। ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে আছেন ডাক্তার লিভসী আর স্কয়ার ট্রেলনী। দুজনেরই হাতে পাইপ।
এত কাছে থেকে এর আগে কখনও ট্রেলনীকে দেখিনি আমি। অনুমান করলাম, ছফুটের বেশি হবে উচ্চতা, সেই অনুপাতে স্বাস্থ্য। চেহারায় সপ্রতিভ ভাব, কিন্তু চামড়া রুক্ষ। কপালে বয়েসের বলিরেখা। কুচকুচে কালো ভুরু দেখলেই মেজাজের আঁচ পাওয়া যায়, তবে বদমেজাজী নয়। চোখের তারায় আবেগ আর উত্তেজনার মিশ্রণ। শুনেছি, দুর্গম অঞ্চলে ঘোরার সাংঘাতিক বাতিক আছে এই জমিদারের।
আরে ডানস যে! খুশি খুশি গলায় আপ্যায়ন করলেন ট্রেলনী, এসো, এসো। তারপর, কি মনে করে?
আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন ডাক্তার লিভসী। জিম, তুমি এত রাতে! ব্যাপার কি?
অল্প কথায় সব গুছিয়ে বললেন ডানস কিটস। শুনতে শুনতে ট্রেলনী, ডাক্তার চাচা, দুজনেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ট্রেলনী তো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চুল খামচাতে লাগলেন। খুলে এল তার মাথার পরচুলাটা। বেরিয়ে পড়ল ছোট করে ছাটা চুল। চেহারাটাই পাল্টে গেল নিমেষে।
কিটসের কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন ট্রেলনী, কানা বদমাশটাকে মেরে একটা দারুণ কাজ করেছ তুমি, কিটস!
হাত বাড়ালেন ডাক্তার চাচা, প্যাকেটটা দাও, জিম।
এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা তুলে দিলাম তার হাতে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ডাক্তারচাচা। ভেবেছি, দেয়া মাত্র খুলে দেখবেন ভেতরে কি আছে, কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে প্যাকেটটা পকেটে রেখে দিলেন তিনি। জমিদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ট্রেলনী, খাওয়াটা সেরে নেয়া যাক। ডানসের আবার ডিউটি আছে, তাকে আটকে রাখা ঠিক হবে না। আমাকে দেখিয়ে বললেন, আর এই ছেলেটারও নিশ্চয় পেট জ্বলছে…
আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাওয়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, ঘন্টা বাজিয়ে ভৃত্যকে ডাকলেন জমিদার।
সবার জন্যেই খাবার এল। আস্ত একটা পায়রার মাংস এল আমার জন্যে। দারুণ খিদে পেয়েছে, গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।
খাওয়া শেষ হল। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডানস কিটস। ফায়ারপ্লেসের পাশে গিয়ে আবার আরাম করে বসলেন ডাক্তারচাচা। পাশে গিয়ে বসলেন ট্রেলনী। আমিও গিয়ে বসলাম তাদের পাশে।
প্যাকেটটা খুলে দেখা যাক এবার, বললেন ট্রেলনী।
মৃদু হাসলেন ডাক্তারচাচা। অত অধৈর্য হচ্ছ কেন? তা আগে বল তো, ফ্লিন্ট সম্পর্কে কি জানো।
ফ্লিন্ট? গম্ভীর হয়ে গেলেন ট্রেলনী, আমি যার নাম শুনেছি সে একজন দুর্দান্ত জলদস্যু। ভয়ঙ্কর খুনী। ওর তুলনায় ব্ল্যাক বিয়ার্ডও নিতান্তই শিশু। স্পেনীয় সাগরে তো নাবিকেরা ওর নাম শুনলেই মূৰ্ছা যায়। আমি কিন্তু মনে মনে গর্বই অনুভব করেছি ফ্লিন্টের জন্যে। ইংরেজ তো। ওকে দেখিনি কখনও, কিন্তু ত্রিনিদাদে ওর জাহাজ দেখেছি, তা-ও দূর থেকে। আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল, একটা কাপুরুষ। ফ্লিন্টের জাহাজের ফ্ল্যাগ দেখেই সোজা ছুটল। পোর্ট অভ স্পেনে। যাওয়ার আগে আর পেছন ফিরে তাকাল না।
আমিও শুনেছি তার নাম, বললেন ডাক্তারচাচা। আচ্ছা, তার কি খুব টাকাকড়ি ছিল?
তো সারাজীবন ডাকাতি করেছে কেন? কিসের জন্যে অত জাহাজকে তাড়া করে বেড়িয়েছে? এত খুনখারাবিই বা কিসের জন্যে? উত্তেজিত মনে হচ্ছে জমিদারকে।
তোমার সঙ্গে কথা বলাই এক ঝকমারী! সারাক্ষণ মাথাটা গরম! আরে বাবা, ডাকাতি করে তো ডাকাতরা পয়সার জন্যেই, সে-কি জানি না? আসলে আমি জানতে চাইছি, জমানো টাকা-পয়সা, ধনরত্ন কেমন ছিল ফ্লিন্টের?
প্রচুর! ঘোষণা করলেন জমিদার। দুহাত ছড়িয়ে বললেন, এই এত্ত…
কে জানে এতে ফ্লিন্টের জমানো রত্নের সন্ধানই আছে কিনা! পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন ডাক্তারচাচা। তার পায়ের কাছেই রাখা ডাক্তারী-ব্যাগটা। সেটা খুলে একটা কাঁচি বার করলেন, দেখি খুলে! কাপড়ের প্যাকেটের ভেতর থেকে দুটো জিনিস বের হলঃ একটা ডায়েরী, আর সিল-করা একটা খাম।
এটাই পড়ি আগে, ডায়েরীটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা। পাতা ওল্টালেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ডাক্তারচাচার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। প্রথম পৃষ্ঠায় কতকগুলো হিজিবিজি আঁকা আর কিছু অদ্ভুত শব্দ—ক্যাপ্টেনের হাতে উল্কিতে যেমন লেখা ছিলঃ বিলি বোনস হিজ ফ্যান্সী, মিস্টার ডব্লিউ বোনস, মেট, নো মোর রাম, অফ পাম কী হি গট ইট ইত্যাদি। এছাড়াও আরও কিছু ছোটখাটো শব্দ আছে, যেগুলোর অর্থ উদ্ধার করা রীতিমত কঠিন। একটা শব্দে-পিঠে ছুরির আঘাত জাতীয় কি যেন বোঝাচ্ছে!
তেমন কিছু নেই, পাতা উল্টে গেলেন ডাক্তার চাচা।
পরের দশ-বারোটা পাতা অদ্ভুত লেখায় ভরা। এক পাতায় একটা লাইনের প্রান্তে একটা তারিখ রয়েছে, অন্যপ্রান্তে টাকার অংক—সাধারণ হিসেবের খাতায় যেমন থাকে। তারিখটা ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন, টাকা ৭০ পাউন্ড-কার কাছে যেন পাওনা। নিচে লেখাঃ কারাক্কাস থেকে সামান্য দূরে। একটা অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমাও দেয়া আছে—৬২.১৭২০ ৯.২৪০।
এরপরের কয়েকটা পৃষ্ঠায় শুধুই টাকার হিসেব। ক্রমেই বেড়েছে যোগফল। শেষ যোগফলটার তলায় লেখাঃ বোনস, তার সঞ্চয়।
মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বললেন ডাক্তারচাচা।
কিন্তু না বোঝার কিছু তো নেই, বললেন ট্রেলনী, কিছু জাহাজের নাম আছে, এগুলো ডুবিয়েছে দস্যুরা। টাকার অঙ্কগুলো বোনসের বখরার হিসেব। কারাকাস থেকে সামান্য দূরে নিশ্চয় কোন জাহাজ আক্রমণ করেছিল ওরা! ঈশ্বর নাবিকদের আত্মাকে শান্তি দিন…
ঠিকই বলেছেন, সায় দিলেন ডাক্তারচাচা। দেখেছেন, টাকার অঙ্ক ক্রমেই বেড়েছে!
এর পরের একটা পাতা বাদে পুরো ডায়েরীটাই ফাঁকা। ওই একটা পাতায় একটা তালিকা। তাতে ফরাসী, ইংরেজি আর স্পেনীয় মুদ্রার পারস্পরিক মূল্যায়ন করা।
দারুণ হিসেবী ছিল তো বোনস, মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। ঠকেনি নিশ্চয় কখনও। ডায়েরীটা আবার পকেটে রেখে দিলেন তিনি।
খামটা খোল এবার, বললেন জমিদার।
সিলমোহর করা খামের ভেতর থেকে বেরোল একটা দ্বীপের মানচিত্র। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, পাহাড়, খাড়ি, উপসাগর ইত্যাদি পরিষ্কার দেখানো আছে। নমাইল দৈর্ঘ্য আর পাঁচ মাইল প্রস্থের মোটাসোটা ড্রাগন-আকৃতির এই দ্বীপ। সাগর থেকে উঠে গিয়ে দ্বীপে মিশেছে একটা পাহাড়—দুপাশে দুটো চমৎকার নেচারাল পোর্ট। পাহাড়টার নাম দেখা যাচ্ছে ম্যাপে দি স্পাই-গ্লাস। ম্যাপের তিন জায়গায় লাল কালিতে ক্রস চিহ্ন দেয়া আছে। দুটো চিহ্ন দ্বীপের উত্তর অংশে, তৃতীয়টা রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। এই চিহ্নটার নিচে কালো কালিতে ছোট কিন্তু পরিষ্কার অক্ষরে লেখাঃ ধনরত্নের স্তুপ এখানে। লেখাটা ক্যাপ্টেন বোনসের হাতের নয়।
ম্যাপের উল্টো পিঠে একই হাতের লেখা আছেঃ টল ট্রি, স্পাইগ্লাস শোল্ডার, উত্তরে উত্তর-পূর্বের উত্তরে এক জায়গায়। স্কেলিটন আইল্যান্ড পূর্বে দক্ষিণ-পূর্বের পূর্বে। দশ ফুট। রূপার বাট উত্তরের গুপ্তস্থানে। পূর্বে ঢিবি ধরে এগিয়ে দক্ষিণে ষাট ফুট গেলে সামনে পড়বে। বালি পাহাড়ে, বাহু দুটো সহজেই পাওয়া যাবে, উত্তর বিন্দুতে উত্তর অন্তরীপের প্রবেশ পথে…
—জে. এফ.
হুমম! উফুল্ল হয়ে উঠেছেন জমিদার, এটা জন ফ্লিন্টের গুপ্তধনের ঠিকানা, ঠিকই অনুমান করেছি। ডাক্তারচাচার দিকে ফিরে বললেন, ডাক্তার, আগামীকালই ব্রিস্টল রওনা হচ্ছি আমি। দিন দশেকের মধ্যেই সেরা জাহাজ আর সেরা নাবিক জোগাড় করে ফেলতে পারব। আমি খবর পাঠালেই আপনি আর জিম চলে যাবেন ব্রিস্টলে। তারপর বেরিয়ে পড়ব আমরা ট্রেজার আইল্যান্ডের উদ্দেশে। আপনি জাহাজের ডাক্তারের কাজ চালাবেন, জিম কেবিন বয় আর আমি হব অ্যাডমিরাল। আর হ্যাঁ, রেডরুথ, হান্টার, জয়েসকেও সঙ্গে নেব। অনুকূল বাতাস পেলে…ঠিকানা তো জানাই আছে, দ্বীপে পৌছতে বেশিদিন লাগবে না। তারপর…তারপর বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে…
কাটানো যাবে, এই তো? বললেন ডাক্তারচাচা, কিন্তু…
আবার কিন্তু কিসের? ভুরু কোঁচকালেন জমিদার।
জলদস্যুদের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? এই নকশার জন্যেই আজ বেনবো সরাইয়ে আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। নিশ্চয় তক্কে তক্কে থাকবে…ব্রিস্টল থেকে আমাদের জাহাজ নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে বেরোতে দেখলেই বুঝে নেবে সব। ভাববেন না আমরা ওদের চোখের আড়াল হতে পারব। দূরে, সাগরেই আমাদের খুন করবে ওরা। জাহাজ সুদ্ধ ডুবিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্যই নকশাটা ছিনিয়ে নেবে আমাদের কাছ থেকে…
তারমানে, এই মুহূর্ত থেকে মুখে কুলুপ এটে ফেলতে হবে আমাদের। নকশা সম্পর্কে কোন কথাই কারও কাছে উচ্চারণ করা চলবে না। আমার দিকে ফিরলেন জমিদার ট্রেলনী, জিম, বুঝতে পেরেছ তো?
মাথা ঝাকালাম।