৭১.
পূর্বনির্ধারিত দিন এল। যথাসময়ে জাফ্রাট জাহাজের সঙ্গে দেখা হলো আমাদের।
একসময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত তিমি শিকারী জাতি ডাচ আর জার্মানরা এখন তিমি শিকার প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে কালেভদ্রে এখন চোখে পড়ে তাদের জাহাজ।
দেখা করার জন্যে খুব আগ্রহ প্রকাশ পেল জাংফ্রাউয়ের! অনেক আগেই নৌকো নামিয়ে দিল তারা, স্টার্নের পরিবর্তে ক্যাপটেন এসে দাঁড়াল বোতে।
ওর হাতে ওটা কি? জার্মানটার ধরা একটা দোদুল্যমান বস্তুর দিকে নির্দেশ করল স্টারবাক। অসম্ভব! এ যে দেখছি একটা ল্যাম্প-ফীডার!
না, মি. স্টারবাক, বলল স্টাব, ওটা একটা কফির পাত্র। ওটার পাশে যে আরেকটা পাত্র দেখছেন, তাতে রয়েছে গরম পানি। জার্মান ক্যাপটেন আসছে আমাদের সবাইকে কফি খাওয়াতে।
আমি আপনার সঙ্গে একমত, মি. স্টারবাক, বলল ফ্লাস্ক, আসলেই ওটা একটা ল্যাম্প-ফীডার আর পাশেরটা তেলের টিন। জাহাজটার তেল ফুরিয়ে গেছে, তাই আমাদের কাছে চাইতে আসছে।
স্টারবাক ভুল বলেনি। তিমি শিকারে বেরিয়ে তেল ফুরিয়ে যাওয়া সত্যিই একটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এমন ঘটনাও ঘটে অনেক সময়। ক্যাপটেন ডেরিক ভী ডিয়ার তেল চাইতেই আসছে।
পেকোডের ডেকে আসতেই তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল ক্যাপটেন আহাব, হাতের টিনটার দিকে তাকিয়েও দেখল না। কিন্তু ভাঙা ভাঙা ভাষায় জার্মানটা বলল যে সাদা কোন তিমিকে সে দেখেনি কোথাও। তারপর জানাল, তাদের শেষ তেলের ফোটাটাও গত রাতে শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং তিমি শিকারীদের ভাষায় জাহাজটা এখন পরিষ্কার। তবে জাহাজটার জাংফ্রাই অর্থাৎ কুমারী নামটা সার্থক হয়েছে।
তেল নিয়ে চলে গেল ডেরিক। কিন্তু জাহাজের পাশে যেতেই তিমি দেখা গেল দুই জাহাজের মাস্ট-হেড থেকেই। তেলের ব্যাপারে জার্মানটা এতই উদ্বিগ্ন। হয়েছিল যে জাহাজে না উঠেই পিছু নিল তিমির।
তিমিগুলো ভেসেছে বাতাসের অনুকূলে। সবসুদ্ধ আটটা। শিগগিরই বিপদ টের পেয়ে এগোতে লাগল সামনে।
দলটার বেশ খানিকটা পেছনে পড়ে রয়েছে প্রকাণ্ড এক মদ্দা তিমি। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ওটা এই দলেরই নাকি নিঃসঙ্গ। তিমিটার রঙ হলুদ, যেন জসি হয়েছে। তার ফোয়ারাও উঠছে থেমে, খুব ধীরে।
তোমাদের কারও কাছে বেদনানাশক আছে? বলল স্টাব, বেচারির পেট ব্যথা হয়েছে। যে-পেটের আয়তন আধ একর, তার ব্যথাটা কেমন হবে একবার ভাব। আর ওই যে, তিমিকে তোমরা কখনও এমন হাই তুলতে দেখেছ?
তিমিটার ডানপাশের পাখনাটা নেই। হয়তো কোন লড়াইয়ে হারিয়েছে, কিংবা জন্ম থেকেই এমন।
একটু অপেক্ষা করো, বুড়ো, তোমার আহত হাতের জন্যে একটা স্লিংয়ের, ব্যবস্থা করছি, হোয়েল-লাইন নির্দেশ করে নিষ্ঠুরভাবে বলল ফ্লাস্ক।
দেখো, সে আবার তোমাকেই না স্লিং পরিয়ে দেয়, বলল স্টারবাক। তাড়াতাড়ি এগোও, নাহলে জার্মানরা তিমিটাকে ধরে ফেলবে।
দলের মধ্যে এই তিমিটাই সবচেয়ে বড়, রয়েছেও সবার পেছনে, তাই সবগুলো নৌকো ওটাকেই তাড়া করেছে। ডেরিকের নৌকোই সবার আগে। ব্যবধান যদিও দ্রুত কমে আসছে, পেকোডের নাবিকদের আশঙ্কা, জার্মানটা না আগেই হারপুন ছোড়ে। ওদিকে প্রথম হারপুন ছোড়ার ব্যাপারে ডেরিক নিশ্চিত, তাই মাঝেসাঝে অন্য নৌকোগুলোকে সে উপহাস করছে ল্যাম্প-ফীডার দুলিয়ে।
অভদ্র, অকৃতজ্ঞ কুকুর কোথাকার! বলল স্টারবাক, এমন এক জিনিস দেখিয়ে বিদ্রুপ করছে, যেটা আমিই ভরে দিয়েছি পাঁচ মিনিট আগে!–তারপর ফিসফিসিয়ে উঠল নাবিকদের উদ্দেশে জোরে! আরও জোরে!
শোনো সবাই, স্টাব বলল তার নাবিকদের উদ্দেশে, আমি রাগ করি, তবে রাগে অন্ধ হওয়া আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু আজ ওই অকৃতজ্ঞ শয়তানকে চিবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। এমন একটা লোকের কাছে তোমরা হার মানতে চাও? ব্র্যাণ্ডি পছন্দ করো তোমরা? সবচেয়ে জোরে যে দাঁড় বাইতে পারবে, তার জন্যে রইল পুরো এক বোতল ব্র্যাণ্ডি!
ওহ! কী ফেনা তুলছে ব্যাটা! লাফাতে লাফাতে বলল ফ্লাস্ক–আর কুঁজটা দেখেছ? বুড়োর গায়ে একশো ব্যারেলের কম তেল হবে না। ওই অমূল্য সম্পদকে হেলায় হারাতে চাও তোমরা? কমপক্ষে ওটার মূল্য তিন হাজার ডলার ব্যাঙ্ক!একটা আস্ত ব্যাঙ্ক! ব্যাঙ্ক অভ ইংল্যাণ্ড! হাত চালাও সবাই!
মেটদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে পেকোডের তিন নৌকোকে নাবিকেরা এনে ফেলল জার্মানটার প্রায় কাছাকাছি। তবু ডেরিকের সঙ্গে তারা পেরে উঠত না, যদি না তার এক নাবিক হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত। ডোবার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে ডেরিক যখন ব্যস্ত, স্টারবাক, স্টাব আর ফ্লাস্কের নৌকো এসে পড়ল তার পাশে।
তিমিটা তখনও এগিয়ে চলেছে একই গতিতে, একইভাবে তার ফোয়ারা উঠছে থেমে থেমে। মাথার ওপর থেকে সাবধানী চিৎকার ছাড়ল সামুদ্রিক একটা পাখি, কিন্তু তিমিটার সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই।
পেকোডের নৌকো পাশে এসে পড়েছে দেখে উঠে দাঁড়াল ডেরিকের হারপুনার। কিন্তু সে হাত তোলার আগেই লাফিয়ে উঠল কুইকেগ, ট্যাসটেগো আর ডাগগু। প্রায় একইসঙ্গে তিনটে হারপুন ছুটে গিয়ে বিদ্ধ হলো তিমির শরীরে। প্রচণ্ড টানে নৌকোগুলো লাফিয়ে সামনে এগোতেই ধাক্কা খেয়ে পানিতে ছিটকে পড়ল ডেরিক আর তার হতভম্ব হারপুনার।
ভয় পেয়ো না, ননীর পুতুলেরা, ছুটতে ছুটতেই চেঁচাল স্টাব, তোমাদের উদ্ধার করা হবে–আসার সময় কয়েকটা হাঙর দেখে এসেছি–ওরা আবার বিপদে পড়া ভ্রমণকারীদের খুব সাহায্য করে!
হোয়েল-লাইন যেভাবে যেতে শুরু করেছিল, তাতে তিন হারপুনার ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল লাইনে শেষমেশ কুলাবে কিনা ভেবে কিন্তু খানিকট গিয়েই থেমে গেল তিমিটা, যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
তিমির সঙ্গে তিন নৌকোও নিশ্চল হয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনটে লাইন কাপতে শুরু করতেই স্টারবাক বলল, লক্ষ রাখো সবাই! তিমিটা নড়ছে, ওই যে উঠছে!
হারপুন বিদ্ধ হতেই তিমির রক্তপাত শুরু হয়, কিন্তু দানব এই প্রাণীর শরীরে এতই রক্ত থাকে যে অনবরত রক্তক্ষয় সত্ত্বেও কাহিল হতে অনেক সময় লাগে। কাছে গিয়ে বর্শা ছুঁড়তে লাগল সবাই। যন্ত্রণায় রক্তের মাঝে ওল্টাতে লাগল তিমিটা, হঠাৎ চোখে পড়ল তার পাজরের কাছে ফ্যাকাসে একটা ফোলা জায়গা।
চমৎকার জায়গা, বলল ফ্লাস্ক, একটা পুঁতো দিই!
থামো, বলল স্টারবাক, তার আর প্রয়োজন হবে না।
কিন্তু ততক্ষণে ছুটে গেছে ফ্লাস্কের বর্শা। ফোয়ারার মত রক্ত বেরতে লাগল ক্ষতস্থান থেকে। একপাশে ধীরে ধীরে কাৎ হয়ে গেল তিমিটা, অসহায়ভাবে নড়তে লাগল পাখনা। ওটাই ছিল তার মারণাঘাত।
জাহাজের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নাবিকেরা লক্ষ করল, তিমিটা রে যেতে চাইছে। স্টারবাকের নির্দেশে রশি বাঁধা হলো বিভিন্ন দিক থে নৌকো তিনটে কাজ করতে লাগল বয়া হিসেবে।
এই তিমিটাকে কাটার পর ক্ষতস্থানটার কাছে পাওয়া গিয়েছি: মরচে ধর একটা আস্ত হারপুন। কিন্তু এরকম হারপুন তিমির শরীরে প্রায়ই পাওয়া যায়। পাঁজরের কাছে জায়গাটা ফুলে ওঠার পেছনে নিশ্চয় অন্য কারণ ছিল। অবাক ব্যাপার হলো, তিমিটার ভেতরে পাওয়া গিয়েছিল পাথরের একটা বা। এই বর্শা ছুঁড়েছিল কে? কখন? সম্ভবত এই বর্শা ছুঁড়েছিল কোন নর্থ-ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান আমেরিকা আবিষ্কারেরও আগে।
জাহাজ এলে তিমিটাকে তার পাশে বাধা হলো শেকল দিয়ে। কিন্তু খানিক পরেই সেটা ডুবু ডুবু হলো তিমির টানে। তাড়াহুড়ো করে শেকল কেটে রক্ষা করা হলো পেকোডকে। জাহাজ ভারসাম্য ফিরে পেলেও ডুবে গেল তিমিটা।
হাড় খুব ভারী এবং বেতো না হলে স্পার্ম তিমি সাধারণত ডোবে না। রাইট তিমির তুলনায় স্পার্ম তিমির ডোবার সম্ভাবনা বিশ ভাগের এক ভাগ। রাইট তিমির শরীরে হাড়ের পরিমাণ অনেক বেশি। কখনও কখনও শুধু তার হোয়েলবোনের ওজন হয় এক টনেরও বেশি। ডোবার পর অবশ্য আবার ভেসে ওঠে তিমি, তবে সেটা হয় গ্যাসের কারণে। গ্যাসে ফোলা তিমি পরিণত হয় এক ধরনের প্রাণী-বেলুনে। তখন বোধ হয় এক সারি যুদ্ধজাহাজের পক্ষেও তাকে ডোবানো সম্ভব নয়।
তিমিটা ডুবে যাবার পর বেশিক্ষণ হয়নি। পেকোডের মাস্ট-হেডার জানাল, জাংফ্রাউ আবার নৌকো নামাচ্ছে। এখন যে-ফোয়ারাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা ফিনব্যাকের। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সাঁতরাতে পারে বলে আজ পর্যন্ত কেউ মারতে পারেনি ফিনব্যাক তিমি। অথচ তারই পিছু নিয়ে দেখতে দেখতে দৃষ্টিপথ থেকে উধাও হয়ে গেল জাংফ্রাউয়ের চারটে নৌকো।
৭২.
জার্মান জাহাজ জাংফ্রাউ চলে যাবার কদিন পরেই এক দুপুরে তিমি দেখা গেল।
ধাওয়া করা হলো নৌকো নামিয়ে। সবার আগে স্টাব। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ট্যাটেগো একটা হারপুন লাগাতে পারল। কিন্তু তিমিটা এত জোরে ছুটতে লাগল যে হারপুন খোলে খোলে অবস্থা। ছুটন্ত তিমিকে বর্শা লাগানোও সম্ভব নয়। তাহলে উপায়?
উপায় একটা আছে। অভিজ্ঞ হোয়েলম্যানরা এই পরিস্থিতিতে যেভাবে বর্শা ছুঁড়ে তিমিকে ঘায়েল করে, তাকে বলে পিচপোলিং। ইস্পাত আর কাঠে নির্মিত বর্শাটা লম্বা হয় দশ থেকে বারো ফুট। বর্শার সঙ্গে যুক্ত থাকে ছোট একটা রশি, যেটাকে বলে ওয়ার্প (Warp)। এই ওয়ার্পের জন্যেই বর্শা ছুঁড়েও আবার ফেরৎ আনা যায়।
পিচপোলিংয়ের বর্শা হারপুনের চেয়ে লম্বা এবং হালকা। বেশি ভারী হওয়ার জন্যেই হারপুন দিয়ে পিচপোলিং হয় না।
সবসময় রসিকতা করে স্টাব, কিন্তু এখন তার মধ্যে রসিকতার চিহ্নমাত্র নেই। নৌকোর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, দৃষ্টি ধাবমান তিমিটার ওপর। তার হাত ওপরে উঠে গেল, পরমুহূর্তেই বিদ্যুদবেগে ছুটে গেল বর্শা, বিরাট এক রূপালী বাঁক নিয়ে লক্ষ্যভেদ করল। তিমিটার স্পাউট দিয়ে পানির বদলে উঠল রক্তের ফোয়ারা।
ব্যাটার ছিপি খুলে দিয়েছি! মুহূর্তে স্টাব রূপান্তরিত হলো আসল স্টাবে। বার বার বর্শা ছুঁড়তে লাগল সে, বার বার সে-বর্শা তার কাছে ফিরে এল শেকল লাগানো গ্ৰেহাউণ্ড কুকুরের মত। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল তিমিটা, ঢিল দেয়া হলো হোয়েল-লাইনে, তারপর স্টার্নে বসে, হাত মুড়ে দানবটার মৃত্যু দেখতে লাগল স্টাব।
৭৩.
হয়তো ছয় হাজার বছর কিংবা কে জানে, হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকে অতিকায় তিমিরা তাদের ফোয়ারা ছাড়তে ছাড়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাসাগরে। অথচ আজ পর্যন্ত মানুষ জানে না, কি ওঠে তার ফোয়ারা দিয়ে পানি নাকি বাষ্প। এটা সত্যিই একটা ভাবনার বিষয়।
ফুলকাঅলা প্রাণীরা তাদের ফুলকার সাহায্যে শ্বাস নিতে পারে। ফলে হেরিং বা কড মাছের পক্ষে পানির ওপরে একবারও মাথা না তুলে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু মানুষের মত ফুসফুস থাকায় তিমিকে ওপরে উঠতেই হবে। তিমি মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে পারে না, কারণ, একটা স্পার্ম তিমির মুখ থাকে পানির অন্তত আট ফুট নিচে। তার চেয়েও বড় কথা, তিমির মুখের সঙ্গে শ্বাসনালীর যোগাযোগ নেই। সে শ্বাস নেয় স্পাউট দিয়ে, যে-অঙ্গটা রয়েছে তার মাথার ওপর।
মানুষের রক্তের সঙ্গে যদি বাতাস মিশিয়ে দেয়া যায়, তাহলে শ্বাস না নিয়েও সে অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে। এজন্যেই তিমি এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় একবারও শ্বাস না নিয়ে থাকতে পারে পানির নিচে। তিমির পাঁজরের ফাঁকে ফাকে এবং মেরুদণ্ডের পাশে রয়েছে সেমাইয়ের মত অসংখ্য শিরা, যেখানে রক্তের সনজ্ঞে বাতাস মিশে থাকতে পারে।
আগেই বলেছি, তিমি শ্বাস নেয় তার স্পাউট দিয়ে। এখন যদি ধরে নিই, তার স্পাউটে সবসময়ই কিছু না কিছু পানি থাকে, তাহলেই বোঝা যাবে যে কেন তিমি গন্ধ পায় না। অবশ্য স্পার্ম তিমির কোন ঘ্রাণকোষও নেই। থাকবার প্রয়োজনটাই বা কি? সাগরের অতলে কোন গোলাপ বা ভায়োলেট ফোটে না যে গন্ধ শুঁকবে।
এছাড়া শ্বাসনালী স্পাউটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে তিমির সত্যিকারের কোন স্বরও নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে তার গুমগুম শব্দ শুনে যদি আপনি বলেন, তিমি কথা বলে তার নাক দিয়ে, তাহলে আমার বলবার কিছু নেই।
স্পাউটের ভেতরটা অবিকল গ্যাস পাইপের মত। কিন্তু এই গ্যাস পাইপকে তিমি পানির পাইপ হিসেবেও ব্যবহার করে কিনা, সেটাই হলো কথা। হয়তো বলবেন, পানি আর গ্যাসের পার্থক্য বোঝা যাবে না? পৃথিবীতে সহজ জিনিসগুলো বোঝা সহজ নয়। আমি তো দেখেছি, সহজ জিনিসের মধ্যেই থাকে যতসব জটিলতা। আপনি একেবারে স্পাউটের ওপর অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েও স্পাউট সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা করতে পারবেন না।
তিমির স্পাউট দিয়ে ঠিক কি ওঠে, তা দেখার জন্যে আজ পর্যন্ত কেউ সেখানে চোখ লাগিয়েছে বলে আমার জানা নেই। ব্যাপারটা নিরাপদও নয়। বাপ বা পানি যা-ই হোক, সেটা লেগে চোখ জ্বালা করতে পারে। একজন লোকের কথা জানি, যে স্পাউটের একেবারে কাছে গিয়েছিল। চিবুক আর বাহুর চামড়া উঠে গিয়েছিল বেচারির। তারপর থেকে হোয়েলম্যানরা স্পাউটকে বিষাক্ত ভাবে। অনেককে বলতে শুনেছি, তিমির ফোয়ারা সরাসরি চোখে লাগলে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এই কথাটা আমি বিশ্বাস করি। সুতরাং সুযোগ পেলেও স্পাউটের বেশি কাছে না যাওয়াই ভাল।
তাহলে এত আলোচনার পরেও দেখা যাচ্ছে, তিমির ফোয়ারা সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। তো, আমার অনুমান হলো, তিমির এই ফোয়ারা কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। মাথার ওপর কুয়াশার চাদোয়া সৃষ্টি করে অতিকায় প্রাণীগুলো ঘুরে বেড়ায় এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগরে।
৭৪.
অ্যান্টিলোপের নরম চোখ আর পাখির রঙিন পালকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে কবিরা। কিন্তু আমি বলতে চাই তিমির লেজ সম্বন্ধে।
বড় আকারের একটা স্পার্ম তিমির লেজের মাপ হবে কমপক্ষে পঞ্চাশ বর্গফুট। যেখানটায় লেজ সবচেয়ে সরু, সেই জায়গাটাও মানুষের কোমরের সমান মোটা। এক ইঞ্চি পুরু ফ্লুক (FLUKE) দুটো পাখির ডানার মত দুদিকে ছড়ানো।
উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার হলো, এক স্পার্ম তিমি আরেক স্পার্ম তিমির সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যবহার করে মাথা আর চোয়াল, কিন্তু মানুষের সঙ্গে প্রধানত লেজ। এই লেজ সরাসরি কোন জিনিসের ওপর নেমে এলে তা আর আস্ত থাকে না। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ বা নৌকো আসেনি, তিমির লেজের সরাসরি আঘাত সহ্য করতে পারে। তবে হোয়েলবোটে আঘাত সাধারণত পাশ থেকে পড়ে পিছলে যায়। ফলে বড়জোর কারও পাজর ভাঙে কিংবা খুলে যায় দুএকটা তক্তা।
তিমির লেজ আর হাতির শুঁড়–দুটোই খুব স্পর্শকাতর অঙ্গ। কিন্তু তাই বলে অঙ্গ দুটো কখনোই তুলনীয় হতে পারে না। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান হাতিটাও তিমির কাছে একটা টেরিয়ার কুকুর মাত্র। তিমির লেজের কাছে হাতির শুড় শাপলার ডাটা। হাতির শুড়ের সবচেয়ে কঠিন আঘাত তিমির লেজের তুলনায় হাতপাখার বাড়ি। স্পার্ম তিমির লেজের প্রচণ্ড আঘাতে দাঁড় নাবিক, এমনকি আস্ত নৌকো পর্যন্ত উড়ে চলে যায় জাদুকরের হাতের বলের মত।
তিমির রাজকীয় লেজ একটা দেখবার মত জিনিস। এক ভোরে দাঁড়িয়ে আছি পেকোডের মাস্ট-হেডে। চারদিক স্তব্ধ। আকাশ আর সাগরে সূর্য কেবল লাগিয়েছে লাল ছোপ হঠাৎ দেখি, তিমির বিরাট এক দল পুবদিকে যেতে যেতে তাদের লেজগুলো তুলে ধরল ওপরে। মনে হলো, সবচেয়ে শক্তিমান প্রাণী যেন তাদের ভক্তি নিংড়ে দিচ্ছে ঈশ্বরের উদ্দেশে। রাজা জুবার বর্ণনাতেও পাওয়া যায়, সেকালের জঙ্গী মেজাজের হাতিরা নাকি শুড় ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকত ভোরের স্তব্ধ নীরবতায়।
৭৫.
সরু, লম্বা মালাক্কা প্রণালী বার্মা থেকে দক্ষিণ-পুবে এগিয়ে গড়ে তুলেছে এশিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের দেশগুলো। লাইন ধরে চলে গেছে সুমাত্রা, জাভা, বালি আর তৈমুর। অন্য সব ছোট ছোট দ্বীপের সঙ্গে মিলে এই দ্বীপগুলো এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়াকে যুক্ত করেছে, সেইসঙ্গে প্রাচ্যের দ্বীপপুঞ্জকে পৃথক করেছে ভারত মহাসাগর থেকে। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটা স্যালি-পোর্ট, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মালাক্কা আর সুন্দা প্রণালী। চীনগামী জলযানগুলো প্রধানত সুন্দা প্রণালী দিয়েই চীন সাগরে আসে।
পেকোড এখন এগিয়ে চলেছে সেই প্রণালীগুলোর দিকেই। জাভা সাগরে পড়ে আহাব এগোতে চায় উত্তরে, সেখানে স্পার্ম তিমির কয়েকটা ক্ষেত্র দেখে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ হয়ে জাপানের উপকূলে। যে-ঋতুতে জাপানে প্রচুর তিমি আসে, সে-সময়টা পার করে দিয়ে মবি ডিকের মুখোমুখি হবার জন্যে সে আবার উপস্থিত হবে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তে।
কিন্তু জাহাজ প্রণালীতে পড়তেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। বিরাট একটা বৃত্ত রচনা করে ফোয়ারা তুলছে দলে দলে তিমি। তৎক্ষণাৎ নৌকো নামানো হলো পেকোড থেকে। কিন্তু ধাওয়া করার পর মাত্র একটা তিমি মারা পড়ল ফ্লাস্কের হাতে। কুইকেগ একটাকে হারপুনে গেঁথেছিল, কিন্তু সেটা খুলে গেল অনেকখানি দৌড়ে। তিমি শিকারে একটা প্রবাদ আছে–যত বেশি তিমি তত কম শিকার। সেটাই আজ সত্যি হলো।
৭৬.
গত অধ্যায়ে বলেছি তিমির বিশাল এক দলের কথা। তবে বিশ বা পঞ্চাশটা তিমির ছোট ছোট দলও দেখা যায় অনেক সময়। এরকম দলকে বলে স্কুল। স্কুল দেখা যায় প্রধানত দুই ধরনের। কোনটায় থাকে শুধুই মাদি তিমি, আবার কোনটায় সমস্ত মাদিকে পরিচালনা করে একটা মাত্র মদ্দা।
লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, কোথাও কোন বিপদের আশঙ্কা টের পাবার সঙ্গে সঙ্গে মদ্দাটা চলে যাচ্ছে দলের পেছনে, যেন এগোতে চায় সবাইকে আগলে নিয়ে। মদ্দা এই তিমি একজন বিলাসী ভদ্রলোক, পৃথিবীর জলরাশিগুলো হারেম সঙ্গে নিয়ে প্রদক্ষিণ করে বেড়ায় সে।
হারেমের ওপর থাকে তার তীক্ষ্ণ চোখ। অন্য কোথাও থেকে কোন মদ্দা এসে তার কোন রক্ষিতার কাছে ঘোরাঘুরি শুরু করলে ভয়ঙ্কর মেজাজে আক্রমণ করে সে। অনেক সময় রক্ষিতাদের মধ্যেও লড়াই বেধে যায় ভালবাসার ভাগাভাগি নিয়ে।
এই ধরনের দলকে জেলেরা যেহেতু স্কুল বলে, স্কুলের পরিচালক মদ্দাটাকে তারা বলে স্কুলমাস্টার। পরিচালকের এরকম নামকরণের পেছনে কোন বিদ্রুপ লুকিয়ে আছে কিনা, তা আমার জানা নেই।
তবে বয়স বাড়লে এই স্কুলমাস্টাররা যেমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, সেটা বুড়ো সব স্পার্ম তিমিরই নিয়তি। তখন সে একেবারেই একা, সেই নিঃসঙ্গতায় তার সঙ্গী বলতে শুধুই প্রকৃতি।
মাদি তিমিদের যেমন স্কুল আছে, তেমনি স্কুল আছে মর্দাদের। সেসব স্কুলে থাকে খুবই বদমেজাজি সব মদ্দা, জেলেরা যাদের বলে ফরটি ব্যারেল বুল। মারামারি, কামড়া-কামড়ি করে এরা কাটিয়ে দেয় জীবনের বেশ কয়েকটা বছর। তারপর বয়স একটু বাড়লে দলছুট হয়ে বেরিয়ে পড়ে হারেমের সন্ধানে।
মাদি আর মর্দাদের স্কুলের মধ্যে একটা চরিত্রগত পার্থক্য আছে। আপনি যদি কোন ফরটি ব্যারেল বুলকে আঘাত করেন, বাকি সবাই ছেড়ে চলে যাবে তাকে। কিন্তু কোন মাদিকে আঘাত করলে স্কুলের আর সব মাদি চলে আসবে তার কাছাকাছি, ঘিরে ধরবে, এমনকি প্রয়োজনে আহত হবে নিজেরাই।
৭৭.
তিমি শিকারে এমন. প্রায়ই ঘটে, কোন তিমিকে আহত করল এক জাহাজ আর মারল আরেক জাহাজ। ধরা যাক, সারাদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধাওয়া করে কোন জাহাজ একটা তিমিকে ধরে বেঁধে রাখল পাশে। কিন্তু রাতে ঝড়ে খুলে গেল তিমিটা, এবং পরে আসা একটা জাহাজ আরাম করে সেটাকে ধরে নিল। প্রশ্ন হচ্ছে, তিমিটা আসলে কার পাওয়া উচিত। এই ব্যাপারটা নিয়ে জাহাজে জাহাজে চূড়ান্ত বিরোধের সূত্রপাত হয়। বিরোধ ক্রমে আরও বাড়বে, যদি না পুরো ব্যাপারটাকে একটা আইনের আওতায় আনা যায়।
যত দূর জানি, তিমি সংক্রান্ত আইন পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত একবারই পাস হয়েছে। ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে, হল্যাণ্ডে। এরপর আর কোন দেশ লিখিত আইন পাস না করলেও আমেরিকান তিমি শিকারীরা নিজস্ব আইনের আওতায় চলে। কিন্তু তাদের আইনের ধারা এতই কম যে অনায়াসেই একটা পেন্সের ওপর খোদাই করে রেখে দেয়া যাবে পকেটে।
ধারা ১, বাধা মাছ প্রথম যে-জাহাজ তাকে ধরবে, সে-ই পাবে।
ধারা ২ খুলে যাওয়া মাছ পরে যে-কেউ শিকার করতে পারবে!
৭৮.
সন্দা প্রণালীতে তিমির সেই বিশাল দল দেখার এক কি দুসপ্তাহ পরের কথা। পেকোড এগোচ্ছে, হঠাৎ সবার নাকে এসে ঝাপটা মারল বাজে একটা গন্ধ।
বাজি ধরতে পারি, বলল স্টাব, সেদিন আমাদের দেখা কোন তিমিকে মেরে এগিয়ে আসছে একটা জাহাজ।
খানিক পরেই জাহাজ দেখা গেল দূরে। কাছাকাছি হতে পাশে বাধা একটা তিমি চোখে পড়ল, তিমি শিকারীরা এ-ধরনের তিমিকে বলে ব্লাস্টেড তিমি। স্বাভাবিকভাবে মারা গিয়ে পানিতে ভাসমান তিমিকে ব্লাস্টেড তিমি বলে। জাহাজ আরও কাছে আসতে পতাকা দেখে বোঝা গেল, জাহাজটা ফ্রান্সের, আর তিমি একটা নয় দুটো। দ্বিতীয়:তিমিটা প্রথমটার চেয়েও গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটা একেবারে শুকনো, যেন মারা গেছে বদহজমে। এই জাতীয় তিমির তেলও খুবই কম পাওয়া যায়।
দুটো জাহাজ একদম পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। স্টাব বলল, এই ফরাসীগুলোকে আমি খুব ভাল করে চিনি। এরা এক অদ্ভুত চিজ! কখনও নৌকো নামায় ব্রেকারকে স্পার্ম তিমির ফোয়ারা মনে করে, কখনও বন্দর ছাড়ার সময়েই জাহাজে তোলে বাক্স বাক্স চর্বির মোমবাতি। কারণ, শিকারে যা চর্বি পাওয়া যাবে তা দিয়ে যদি ক্যাপটেনের সলতে না ভেজে! প্রথম তিমিটার তেল যেরকম হবে, সেটা জেলখানায়, এমনকি ফাঁসির আসামীর সেলে জ্বালাবারও যোগ্য নয়। দ্বিতীয় তিমিটারও একই অবস্থা। তবে এটায় রয়েছে তেলের চেয়ে অনেক মূল্যবান এক পদার্থ–অ্যামবারগ্রিস। আমাদের বুড়ো সেই পদার্থের কথা ভেবেছে বলে মনে হয় না। আমি একবার চেষ্টা করে দেখব, ওটা সংগ্রহ করা যায় কিনা। রওনা দিল সে কোয়ার্টার-ডেকের দিকে।
জাহাজটার হেড বোর্ডে গিলটি করা অক্ষরে বড় বড় করে লেখা রয়েছেসুতো দ্য রোজ অর্থাৎ রোজ-বাটন বা রোজ-বাড়।
কাঠের গোলাপ কুঁড়ি, অ্যাঁ? নাকে হাত দিল স্টাব, বেশ, বেশ। তবে এই গোলাপের গন্ধটা যেন কেমন!
ডেকের লোকদের সঙ্গে কথোপকথন এড়াবার জন্যে স্টারবোর্ডে চলে এল স্টাব, ব্লাস্টেড তিমিটার কাছে। হাত তখনও নাক থেকে সরেনি, বলল, কে আছ! গোলাপ কুঁড়িদের কেউ ইংরেজীতে কথা বলতে পারে?
হ্যাঁ, বুলওয়ার্কের কাছ থেকে এগিয়ে এল গেঞ্জি পরা এক লোক। এই লোকটাই রোজ-বাডের চীফ মেট।
বেশ। তাহলে বলুন, সাদা তিমিটাকে আপনারা দেখেছেন?
কী তিমি?
সাদা তিমি–একটা স্পার্ম তিমি–আপনারা ওটা দেখেছেন?
জীবনেও শুনিনি এরকম তিমির কথা।
খুব ভাল কাজ করেছেন। একটু অপেক্ষা করুন দয়া করে, আমি মিনিটখানেকের মধ্যেই আসছি।
সংবাদের জন্যে কোয়ার্টার-ডেকের রেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আহাব। দুহাত সিঙ্গার মত গোল করে মুখের সামনে ধরে স্টাব বলল, না, স্যার, না! আহাব ফিরে গেল কেবিনে, স্টাব ফিরল ফরাসীটার কাছে।
সে তখন নাক কাপড়ে ঢেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তিমিটার পাশে, হাতে বড়সড় একটা কাটিং-স্পেড।
নাকে কি হয়েছে আপনার? বলল স্টাব। ভেঙে গেছে?
ভেঙে গেলে তো বেঁচেই যেতাম, কিংবা আমার যদি কোন নাকই না থাকত! গজগজ করতে লাগল হাতের কাজের ওপর বিরঙ ফরাসীটা। কিন্তু আপনি আবার নাক ধরে আছেন কেন?
সে আর বলবেন না! মোমের নাক, ধরে না থেকে উপায় নেই। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, তাই না? চারপাশে কেমন একটা বাগান বাগান গন্ধ। আমাদের এক গুচ্ছ ফুল দেবেন?
আপনি এখানে ঠিক কি চান বলুন তো? রেগে গেল গেঞ্জি।
আহা! রাগবেন না, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন–ঠাণ্ডা হয়েছে? হ্যাঁ, মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা। কাজ করার সময় তিমিগুলোকে বরফে ঢেকে নিলেই পারেন না, থাক, আর রসিকতা নয়। আচ্ছা, মি. রোজ-বাড, এই ধরনের তিমিতে যে তেল হয় না, সেটা আপনাদের জানা নেই? সবসুদ্ধ এক জিল (Gill আড়াই আউন্স) তেলও তো পাবেন না।
সে আমার খুব ভালভাবেই জানা আছে। কিন্তু ক্যাপটেন বিশ্বাস করে না। এটাই তার প্রথম তিমি শিকার অভিযান। একটু চেষ্টা করে দেখুন না, আপনার কথা বিশ্বাস করতেও পারে। আর যদি কোনরকমে বিশ্বাস করে, আমিও এই যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাই!
আপনাকে রক্ষা করতে আমি যে-কোন কাজে রাজি, মাই ডিয়ার, বলে স্টার চলে এল ডেকে। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য। লাল ক্যাপ পরা নাবিকেরা ভারী ভারী ট্যাকল এনে জমা করছে তিমি দুটোকে কাটার জন্যে। তবে কাজ তারা যতটা না করছে, তার চেয়ে কথা বলছে বেশি, আর সেসব কথাতে রসিকতার ছোঁয়ামাত্র নেই। নাক যথাসম্ভব উঁচিয়ে রেখেছে তারা, আর কাজ ফেলে মাঝেসাঝেই মাস্টহেডের কাছে ছুটে যাচ্ছে তাজা বাতাসে শ্বাস নিতে। কেউ কেউ ভাবছে তাদের প্লেগ হতে পারে, তাই একটু পরপরই দড়ি শুকছে আলকাতরায় চুবিয়ে। অন্যেরা গন্ধের হাত থেকে বাচার জন্য ঘনঘন পাইপ টানছে, যেন ঘ্রাণ কোষগুলো সবসময় ভরে থাকে তামাকের গন্ধে।
অদ্ভুত দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে মনে মনে একটা পরিকল্পনা খাড়া করল স্টাব। চীফ মেটের সঙ্গে খানিক আলাপেই সে বুঝতে পারল, ভ্যামবারগ্রিস সম্বন্ধে কিছুই জানে না লোকটা। ঠিক হলো, চীফ মেট দোভাষী হবার ভান করে, তিমিগুলোর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে, যা খুশি বলবে ক্যাপটেনকে। সুতরাং সাজিয়ে কথা বলার দায় স্টাবের নেই, সেও বলবে মুখে যা আসবে তা-ই।
কেবিন থেকে ক্যাপটেন বেরিয়ে আসতেই স্টাবের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল গেঞ্জি। দোভাষীর ভূমিকা নিতেও দেরি হলো না।
তাহলে প্রথমে আমি কি বলব? জানতে চাইল সে।
বলুন, তাকাল স্টাব ক্যাপটেনের দিকে, তাকে দেখে আমার বাচ্চাদের মত মনে হচ্ছে।
মঁসিয়ে, উনি বলছেন, ক্যাপটেনের দিকে ফিরে গেঞ্জি বলল ফরাসী ভাষায়, গতকাল তাঁদের দেখা হয়েছিল এক জাহাজের সঙ্গে, যেটার ক্যাপটেন, চীফ মেট আর ছয় জন নাবিক মারা গেছে অদ্ভুত এক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। জুরটা নাকি হয়েছিল তাদের জাহাজের পাশে বেঁধে রাখা এক ব্লাস্টেড তিমি থেকে।
গল্পটা শোনার জন্যে কৌতুহলী হয়ে উঠল ক্যাপটেন।
এবার কি বলব? চীফ মেট ফিরল স্টাবের দিকে।
বলুন, আমার প্রথম কথাটায় তিনি যখন কিছু মনে করেননি, তখন আমি নিশ্চিত যে হোয়েল-শিপের ক্যাপটেন হবার উপযুক্ত উনি নন। তাই আমি তাঁকে একটা বেবুন বলে ঘোষণা করছি।
মঁসিয়ে, উনি ঘোষণা করছেন, শুকনো তিমি ব্লাস্টেড তিমির চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। সুতরাং প্রাণের যদি কোন মায়া আমাদের থেকে থাকে, তাহলে এই মুহূর্তে মাছ দুটোকে খুলে দেয়া উচিত।
সঙ্গে সঙ্গে নাবিকদের আদেশ দিল ক্যাপটেন তিমি দুটোর শেকল খুলে দেয়ার জন্যে।
এবার? ক্যাপটেন ফিরে আসতে জানতে চাইল গেঞ্জি।
এবার একটু ভাবতে দিন। হ্যাঁ, এবার বলতে পারেন যে আমি তাকে ঠকিয়েছি, বোধ হয় (মুখটা অন্য পাশে ঘুরিয়ে) আরেকজনকেও।
মঁসিয়ে, উনি বলছেন যে আমাদের কাজে লাগতে পেরে উনি খুশি হয়েছেন।
এ-কথা শুনে ক্যাপটেন জানাল, সে আর মেট তার কাছে কৃতজ্ঞ। শেষে বুর্দো পানের জন্যে সে দাওয়াত দিল স্টাবকে।
ক্যাপটেন তাঁর সঙ্গে এক গ্লাস ওয়াইন খেতে বলছেন আপনাকে, জানাল দোভাষী।
ক্যাপটেনকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তাকে বলুন, যেসব মানুষকে আমি ঠকাই, তাদের সঙ্গে ওয়াইন খাওয়া আমার নীতিবিরুদ্ধ। আসলে তাকে বলুন যে এবার আমাকে যেতে হবে।
মঁসিয়ে, নীতিগতভাবে উনি মদ খান না। তবে আপনি যদি জীবনে আর একটা দিনও মদ খেতে চান, উনি বলছেন, কালবিলম্ব না করে এই স্থান আপনার ত্যাগ করা উচিত।
দেখতে দেখতে দূরে চলে গেল রোজ-বাড। পেকোডের আড়াল ব্যবহার করে নৌকো নিয়ে শুকনো তিমিটার কাছে এসে পৌঁছুল স্টাব। ধারাল বোট-স্পেড দিয়ে তিমিটার পাশের পাখনার সামান্য পেছনে কাটল সে। উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইল নাবিকেরা, যেন এখনই বেরিয়ে আসবে গুপ্তধন।
বেশ কিছুক্ষণ কাটাকাটির পর যখন কেবল হতাশ হতে শুরু করেছে স্টাব, ঠিক তখনই দুর্গন্ধকে ছাপিয়ে ভেসে এল একটা মিষ্টি গন্ধ।
পেয়েছি, পেয়েছি! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে তিমির শরীরের কাটা জায়গা দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল স্টাব।
পুরানো পনিরের মত মুঠো পরিমাণ জিনিস উঠে এল তার হাতে। নরম, হলুদ আর ছাইয়ের মাঝামাঝি রঙের এই জিনিসটাকেই বলে অ্যামবারগ্রিস। যেকোন ড্রাগিস্ট এর একেক আউন্স কিনবে এক স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে। ছয় মুঠো অ্যামবারগ্রিস তুলল স্টাব, খানিকটা নষ্ট হয়ে গেল সাগরের পানিতে। তবু হয়তো আরও কিছুটা তোলা যেত, কিন্তু আহাব তাকে আদেশ দিল তক্ষুণি পেকোডে ফিরে আসার জন্যে। আদেশ মানতে বাধ্য হলো স্টাব। কারণ, বদমেজাজী আহাবের পক্ষে তাকে ফেলে চলে যাওয়াটাও তেমন বিচিত্র কিছু নয়।
৭৯.
অ্যামবারগ্রিস একটা অদ্ভুত জিনিস। এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ন্যানটাকেটে জন্মগ্রহণকারী ক্যাপটেন কফিনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল হাউস অভ কমন্সের বারে। কারণ, তখন এমনকি তার অনেক দিন পরেও মানুষ অম্বর আর অ্যামবারগ্রিস নিয়ে ধাধায় পড়ত। অ্যামবারগ্রিস বলতে ফরাসী ভাষায় যদিও ধূসর অম্বর বোঝায়, আসলে জিনিস দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। অম্বর সাগর উপকূল ছাড়াও পাওয়া যায়, কিন্তু অ্যামবারগ্রিস সাগর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। অম্বর একটা শক্ত, স্বচ্ছ, ভঙ্গুর, গন্ধহীন জিনিস, যেটা ব্যবহৃত হয়। পাইপের মাউথপিস, পুঁতি আর অলঙ্কার তৈরির কাজে। কিন্তু অ্যামবারগ্রিস নরম, সুগন্ধী, মোমের মত একটা জিনিস, যা দিয়ে প্রধানত তৈরি হয় পারফিউম, প্যাসটিল, দামী মোমবাতি, হেয়ার-পাউডার আর পমেড। তুর্কীরা এটা ব্যবহার করে রান্নায়। কোন কোন মদ ব্যবসায়ী সুগন্ধের জন্যে এর কয়েক ফোটা মেশায় ক্ল্যারেটের সঙ্গে।
কেউ কি কল্পনা করতে পারবে, অভিজাত নারী-পুরুষ যে-সুগন্ধী মেখে তপ্ত হয়, সেটা পাওয়া যায় রোগা তিমির ভেতরে! এই অ্যামবারগ্রিসের কারণেই তিমির বদহজম হয়। আর সেই অসুখ সারে কিভাবে, বলা কঠিন।
বলতে ভুলে গেছি, অ্যামবারগ্রিসের মধ্যে স্টাব পেয়েছিল গোল গোল, হাড়ের মত শক্ত জিনিস। প্রথমটায় সে ভেবেছিল, ওগুলো বোধহয় নাবিকদের ট্রাউজার্সের বোতাম। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওগুলো আসলে স্কুইডের হাড়। খেয়ে হজম করতে পারেনি তিমিটা।
৮০.
ফরাসী জাহাজ রোজ-বাডের সঙ্গে দেখা হবার অল্প কদিন পরেই পেকোডের নাবিকদের জীবনে ঘটল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
হোয়েল-শিপে তিমিকে ধাওয়া করার সময় সবাই নৌকোয় চলে যায় না। দেখাশোনার জন্যে কিছু কিছু লোক তখনও থেকে যায় জাহাজে, যাদের বলে শিপ-কিপার। এরাও নাবিকদের মতই শক্ত-সমর্থ। এমনি একজন শিপ-কিপার হলো নিগ্রো ছেলে পিপিন, যাকে সবাই পিপ বলে ডাকে।
কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে একটা বছর যেন তিনশো পঁয়ষট্টিটা চৌঠা জুলাই আর নববর্ষের দিনে ভরা। এই যে এখন লিখব, ছেলেটা ছিল চমৎকার, পড়ে যেন আবার হাসবেন না। কালোরও রয়েছে চমৎকারিত্ব। রাজাদের ক্যাবিনেটে চকচকে আবলুস কখনও দেখেছেন? যাক গে, কাহিনীতে ফিরে আসি।
অ্যামবারগ্রিস সংগ্রহ করতে গিয়ে স্টাবের নৌকোর এক নাবিকের হাত মচকে গিয়েছিল। ফলে সাময়িকভাবে তার স্থলাভিষিক্ত হলো পিপ।
প্রথম বার তিমিকে ধাওয়া করতে গিয়ে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়লেও মোটামুটি কাজ চালিয়ে গেল পিপ। ব্যাপারটা লক্ষ করে তাকে সাহস জোগাল স্টাব। নাবিকটা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পিপকে তার প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বার ধাওয়া করতে গিয়ে নৌকো উঠে গেল তিমির প্রায় ওপরে। হারপুন খেয়ে তিমি ঘুরে গেল পিপের ঠিক নিচ দিয়ে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে দাঁড় হাতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল পিপ, আর ঠিক তখনই তিমি ছুটতে লাগল তীব্র গতিতে। হোয়েল-লাইন পেঁচিয়ে গেল পিপের শরীরে।
বোতে দাঁড়িয়ে ছিল ট্যাসটেগো। কাপুরুষ ভেবে পিপকে সে সহ্যই করতে পারত না। তাই কোমর থেকে ছুরি বের করে, লাইনে ঠেকিয়েও ঘুরল সে স্টাবের দিকে, কাটব? ওদিকে পিপের রক্তশূন্য মুখ বলছে–ঈশ্বরের দোহাই, কিছু একটা করো তোমরা! মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেল পুরো ঘটনাটা।
কাটো! গর্জে উঠল স্টাব। ফলে তিমিটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও রক্ষা পেল পিপ।
একটু সুস্থ হতেই পিপকে অভিশাপ দিতে লাগল নাবিকরা। তাদের উত্তেজনা প্রশমিত হলে নিজস্ব স্টাইলে হাসিমুখে পিপকে অভিশাপ দিল স্টাব। তারপর শুরু হলো উপদেশের পালা, যার মোদ্দা কথা–কোন অবস্থাতেই নৌকো থেকে। লাফিয়ে পড়া চলবে না। কিন্তু তিমি শিকারে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যখন নৌকোয় বসে থাকার চেয়ে লাফিয়ে পড়াটাই অনেক বেশি নিরাপদ। স্টাবের উপদেশ শেষ হলো এরকম আদেশের মধ্যে দিয়ে, নৌকোয় বসে থাকবে। যদি লাফ দাও, সত্যি বলছি, আমি তোমাকে তুলে নেব না। তোমার মত ছেলের জন্যে তিমি হারানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পিপ, আলাবামায় একটা তিমি তোমার চেয়ে ত্রিশ গুণ দামে বিক্রি হবে। কথাটা মনে রেখো, এবং লাফ দিয়ো না। কথাগুলো বলে পরোক্ষভাবে স্টাব বোঝাতে চাইল, সঙ্গীকে ভালবাসলেও মানুষ একটা টাকা উৎপাদনকারী প্রাণী। মানুষের এই ঝোকের কাছে অনেক সময় সদাশয়তা হার মানে।
কিন্তু আমাদের সবার ভবিষ্যতের ভার তো ঈশ্বরের হাতে। আবার পানিতে ঝাপিয়ে পড়ল পিপ। ঘটনা প্রায় গত বারের মতই ঘটল, শুধু এবারে সে হোয়েললাইনে জড়িয়ে গেল না। চমৎকার দিন, মাথার ওপরে মেঘমুক্ত নীল আকাশ। পিপের আবলুস কালো মাথাটা ওঠানামা করতে লাগল লবঙ্গের মত। তিমির টানে তীরহীন সাগরে ছেলেটাকে ফেলে, মিনিট তিনেকের মধ্যে এক মাইল সামনে চলে গেল স্টাবের নৌকো।
শান্ত আবহাওয়ায় ভোলা সাগরে সাঁতরানো কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু চারপাশের অন্তহীন একাকিত্ব যেন বুকে চেপে বসতে চায়।
স্টাব কি তাহলে নিগ্রো ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়েছিল নিয়তির হাতে? না। অন্তত তা সে চায়নি। সে ভেবেছিল, বাকি দুটো নৌকো নিশ্চয় পিপকে তুলে নেবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম।
পাশেই তিমি দেখে সেই নৌকো দুটোও শুরু করল ধাওয়া। ফলে আরও বেড়ে গেল ছেলেটার একাকিত্ব। পরে নেহাৎ ভাগ্যক্রমে তাকে উদ্ধার করে পেকোড। কিন্তু উদ্ধার পাবার পর থেকে হারিয়ে গেছে তার যাবতীয় উচ্ছলতা, এখন সে শুধু তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। সবাই বলে, পিপ নাকি পাগল হয়ে গেছে।
শেষ কথা, স্টাবকে অযথা নিষ্ঠুর ভাববেন না। তিমি শিকারে এরকম ঘটনা অহরহই ঘটে।