নাস্তার পর কুড়িয়ে আনা মালপত্র ঘঁটতে বসলাম আমরা। যেসব কাপড় চোপড় এনেছিলাম সেগুলো দেখলাম নেড়েচেড়ে। পুরোন একটা কম্বল দিয়ে তৈরি ওভারকোটটার লাইনিংয়ের ভেতর পেলাম আটটা ডলার। জিম বলল ওর ধারণা, যে-লোকগুলো ওই কাঠের বাড়িটায় ছিল, তারা কোথাও থেকে চুরি করেছে কোটটা। কারণ, তারা ওই টাকার খবর জানলে রেখে যেত না। আমার ধারণা ওই লোকগুলোই ওই মৃত লোকটিকে খুন করেছে। কথাটা জিমকে জানাতে ও এই ব্যাপারে আলাপ করতে রাজি হল না। বলল, মরা লোকের ব্যাপারে কথা বলা ঠিক নয়, ওতে কপালে দুঃখ আসে।
তোমার মতে এটা আমাদের দুঃখ বয়ে আনবে, বললাম, কিন্তু, জিম, পরশু যখন সাপের চামড়া ধরেছিলাম আমি, তখনও তুমি বলেছিলে সাপের চামড়া হাত দিয়ে ধরলে কপালে দুঃখ আসে। এই কি তোমার সেই দুঃখের নমুনা? এই যে এত সব জিনিস খুঁজে পেলাম আবার উপরি এল আট আটটা ডলার, এ কেমন দুঃখ! আমি চাই, জিম, এমন দুঃখ যেন হররোজ আসে আমাদের জন্যে।
তুমি দেখ, বলল জিম, খারাপ কিছু একটা হবেই।
সত্যিই হল। যেদিন আমরা কথাটা আলাপ করেছিলাম, সেদিন ছিল মঙ্গলবার। শুক্রবার রাতে খাওয়াদাওয়ার পর পাহাড়ের ওপর দিকটায় ঘাসের ওপর শুয়ে আছি আমরা। তামাক শেষ হয়ে গিয়েছে দেখে গুহার ভেতর আনতে গেলাম আমি। গিয়ে দেখি একটা বিষাক্ত সাপ। সাপটাকে মেরে কুণ্ডলী পাকিয়ে জিমের কম্বলের পায়ের কাছে রাখলাম। এমন ভাবে রাখলাম যেন জ্যান্ত মনে হয় ওটাকে। ভাবলাম, জিম দেখলে ভারি মজার ব্যাপার ঘটবে। পরে ভুলে গেলাম সাপটার কথা। রাতে শোয়ামাত্রই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল জিম। লণ্ঠনের আলোয় দেখলাম ফণা তুলে আছে মরা সাপের সঙ্গীটা, আরেকবার ছোবল দেবার জন্যে তৈরি। চোখের পলকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে সাপটাকে খতম করলাম আমি। জিম তাড়াতাড়ি জগ থেকে মদ ঢালতে শুরু করল পায়ের ওপর।
খালি পায়ে ছিল ও, সাপটা কামড় বসিয়েছে গোড়ালিতে। এ সবই ঘটল আমার বোকামিতে। আমার মনে ছিল না, একটাকে মারলে তার সাথীও এসে হাজির হয় সেখানে। জিম বলল মাথাটা কেটে বাদ দিয়ে, সাপের চামড়া ছিলে তার একটা টুকরো ভেজে দিতে। এতে নাকি ভাল হয়ে যাবে সে। সাপ দুটো নিয়ে মাথা নিচু করে বাইরে এলাম আমি, ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দূরের ঝোপে। জিমকে বললাম না আমার দোষেই হয়েছে এসব।
চারদিন চাররাত বিছানায় পড়ে রইল ও। তারপর ফোলা ভাবটা চলে গেল। সাপের চামড়া আর কখনও ছোঁব না, মনে মনে শপথ করলাম আমি।
জিম সুস্থ হয়ে ওঠার পর একদিন সকালে বললাম, বড্ড এক ঘেয়ে কাটছে দিনগুলো। উত্তেজনা দরকার। নদীর ওপারে গিয়ে দেখে আসি, কেউ কিছু বলছে। কি-না আমাদের ব্যাপারে।
যাও, রাজি হল জিম। তবে রাতে গেলেই ভাল করবে। আর বেশিক্ষণ থাকবে না। এক কাজ কর, মেয়েলোকের ছদ্মবেশে যাও। ঠিকমত অভিনয় করতে পারলে, হাক, কেউ চিনতে পারবে না তোমাকে।
প্রস্তাবটা মনে ধরল আমার। ওই পুরোনো কাপড়গুলোর ভেতর কয়েকটা গাউন ছিল, তারই একটা কেটে ছোট করে নিলাম; পাজামার ঝুল গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত এনে পরলাম সেটা। ভেতর দিকে হুঁক দিয়ে আটকে দিল জিম। তারপর মাথায় একটা বড় টুপি পরে, সেটার ফিতে বেঁধে দিলাম থুতনির নিচে। ছদ্মবেশ পরখ করে সন্তুষ্ট হল জিম। বলল, এবার দিনেও কেউ চিনতে পারবে না আমায়। বারবার ওগুলো পরে স্বচ্ছন্দ করে নিলাম নিজেকে। কিন্তু জিমের খুঁতখুঁতি গেল না। তোমার হাঁটার ধরন মেয়েদের মত না, বলল। ঈশ্বরের দোহাই, ওই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাবার অভ্যেসটা ছাড়।
রাতের অন্ধকার নামার পর ইলিনয়ের দিকে রওনা হলাম। শহরের যেদিকটায় ফেরিঘাট, তার একটু ভাটির দিকে গেলাম। তীরে ডিঙি বেঁধে পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। অদূরেই একটা কুঁড়ে ঘরে বাতি জ্বলছিল। নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। উঁকি দিলাম জানালা দিয়ে। বছর চল্লিশেকের এক মহিলা টেবিলের ওপর। বাতির ধারে বসে কী যেন বুনছিল। অচেনা চেহারা; বুঝলাম, নতুন এসেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, সৌভাগ্যই বলতে হবে। পরিচিত লোক হলে গলার স্বরে চিনে ফেলত আমাকে। নির্ভয়ে টোকা দিলাম দরজায়। ভুললে চলবে না আমি একটি মেয়ে, আপনমনে বললাম।
ভেতরে এস, দরদ মাখা গলায় বলল ভদ্রমহিলা। চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস।
চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। ছোট, উজ্জ্বল চোখজোড়া দিয়ে আমাকে ভাল করে দেখল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী, বাছা?
সারা উইলিয়ামস।
কোথায় থাক?
হুঁকারভিল। এখান থেকে সাত মাইল ভাটিতে। আমার মায়ের অসুখ, হাতে পয়সা নেই। শহরের ওপ্রান্তে আমার কাকা থাকেন। নাম, অ্যাবনার মুর। তাঁর কাছেই এসেছি। আপনি হয়ত চেনে তাঁকে।
না, চিনি না। সবে দশ দিন হল এসেছি এখানে। তোমার কাকার বাসা তো এখান থেকে বেশ দূর। আজ রাতটা বরং এখানেই থাক। নাও, টুপি খুলে আরাম কর।
না, খালা, থাকার উপায় নেই। একটু জিরিয়ে আবার রওনা হব আমি।
আমার স্বামী তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এক্ষুনি ফিরবে ও। এত রাতে একাকী যাওয়া ঠিক হবে না তোমার। এরপর মহিলা তার স্বামী এবং পরিবারের আর সবার ব্যাপারে নানান গল্প করল। আমার খুনের ঘটনাটাও বলল।
কাজটা করল কে? প্রশ্ন করলাম।
হুঁকারভিলেও সবাই বলাবলি করছে ঘটনাটা নিয়ে, অথচ কেউ-ই জানে না হাকফিনের খুনি কে।
প্রথমটায় সবাই ভেবেছিল এটা ওর বাবারই কীর্তি। তবে এখন বলছে, জিম নামের এক পলাতক নিগ্রোর কাজ এটা। যে-রাতে হাকফিন খুন হয়, সেই রাতেই পালিয়েছ ও। কেউ ওকে ধরতে পারলে তিনশ ডলার পুরস্কার পাবে।
এখনও জিমকে খুঁজছে ওরা?
নিশ্চয়ই। তিনশ ডলার কম টাকা হল। আমার মনে হয় খুব বেশি দূরে যায়নি ও। সম্বত জ্যাকসনের দ্বীপে লুকিয়ে আছে। গতকাল ওই দ্বীপ থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি আমি। আমার স্বামীকে বলেছি ব্যাপারটা। আজ রাতে সাথে আরেকজনকে নিয়ে ওখানে যাচ্ছে ও।
মহিলার কথা শুনে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম, উশখুশ করতে লাগলাম। কিছু একটা করা দরকার, তাই সূঁচে সুতো পরাতে লেগে পড়লাম। ভদ্রমহিলা লক্ষ্য করল, আমার হাত থরথর কাঁপছে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
তিনশ ডলার অনেক টাকা, বললাম, ইস! আমার মা এই টাকাগুলো পেলে খুব উপকার হত। আপনার স্বামী তো আজ রাতেই যাচ্ছেন ওখানে, তাই না?
হ্যাঁ। মাঝরাতের দিকে যাবে। সঙ্গের লোকটাকে নিয়ে শহরে গেছে ও। নৌকো জোগাড় করতে গেছে, কারো কাছে আরেকটা বন্দুক ধার পাওয়া যায় কি, সে-চেষ্টাও করে দেখবে।
এসব শুনে আমার চেহারায় একটা আতঙ্কের ছাপ ফুটে থাকবে, আরেকবার কৌতুকমাখা চোখে আমার দিকে তাকাল মহিলা। তোমার নামটা যেন কি বললে, বাছা? জিজ্ঞেস করল।
মেরি উইলিয়ামস।
প্রথমে সারা বলেছিলে না?
হ্যাঁ, খালা, বলেছিলাম। সারা মেরি উইলিয়ামস। সারা আমার ডাকনাম। কেউ কেউ আমায় সারা বলে, আবার মেরি বলেও ডাকে অনেকে।
ও, আচ্ছা, বলল মহিলা। হঠাৎ করেই একেবারে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিল সে। ইঁদুরের জ্বালায় টেকা দায় হয়ে উঠেছে এখানে। এমন উপদ্রব করে যে মনে হয় এ যেন ওদেরই রাজত্ব। এইটা নাও, আমার দিকে একটা পাথরখণ্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এরপর ইঁদুর দেখামাত্র ছুড়ে মারবে।
মারলাম, অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আমার হাতের টিপ দেখে ভদ্রমহিলা বলল, সত্যি করে বল তো বাছা, তোমার নাম কী? বিল, টম নাকি বব?
বুঝলাম, ধরা পড়ে গেছি। বেতপাতার মত কাঁপতে লাগলাম ভয়ে। দোহাই আপনার, খালা, একটা গরিব মেয়েকে নিয়ে ঠাট্টা করবেন না, অতিকষ্টে কাঁদো কাঁদো সুরে বললাম। এখানে আসায় আপনার যদি কোন অসুবিধা হয়ে থাকে তবে…
বোসো, লক্ষ্মীটি। তোমাকে সাহায্য করব আমি। আমার স্বামীও করবে। বুঝেছি, কোন কারখানা থেকে পালিয়েছ তুমি, অত্যাচার সইতে পারনি। সব খুলে বল আমাকে—এই তো লক্ষ্মী ছেলে।
বললাম, আমার মা-বাবা দুজনাই মারা গেছে বহুদিন আগে। আইন মোতাবেক এক বদমেজাজি বুড়োর কাছে কাজ শিখতে দেয়া হয়েছিল আমাকে। অসহ্য হয়ে উঠেছিল তার দুর্ব্যবহার। দুদিনের জন্যে বাইরে গেছে সে। তারই সুযোগ নিয়েছি আমি। পরনের কাপড়গুলো তার মেয়ের, চুরি করে এনেছি। আমার বিশ্বাস, আমার চাচা হয়ত আমার যত্ন নেবেন। তাই এই গশেন শহরে এসেছি আমি।
গশেন! কি বলছ তুমি? এটা তো সেন্ট পিটসবার্গ। গশেন তো দশ মাইল উজানে। কে বলল তোমাকে, এটা গশেন?
কেন, এক লোক, পথে তার সাথে দেখা হয়েছিল, সেই বলল। লোকটা বলল, যখন দেখব রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, তখন ডানের রাস্তা ধরে চলতে শুরু করব। এভাবে পাঁচ মাইল চললেই পৌঁছে যাব গশেনে।
লোকটা বোধহয় মাতাল ছিল। ভুল বলেছে।
হতে পারে। ওরকমই লাগছিল তাকে। তো আমাকে এখন উঠতে হয়। তাহলে সকাল হবার আগেই গশেনয়ে পৌঁছে যাব।
এক মিনিট দাঁড়াও। কিছু খাবার দেই তোমাকে। সময়ে কাজে লাগবে তোমার।
খাবার দিয়ে মহিলা বলল, আচ্ছা বল তো, শোয়া অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর সময় গরুর কোন্ অংশ আগে ওঠে?
পেছনের অংশ।
বেশ। ঘোড়ার?
সামনের অংশ।
গাছের কোন দিকে শ্যাওলা পড়ে?
উত্তর দিকে। বেশ! বেশ! বুঝলাম গ্রামে বাস করেছ তুমি। তা, তোমার আসল নাম কি?
জর্জ পিটার, খালা।
এই নামটা ভুলো না যেন। আবার ভুলে গিয়ে হয়ত বলবে আলেকজান্ডার। তারপর যখন ধরা পড়বে তখন বলবে যে জর্জ আলেকজান্ডার। আর ওই মেয়ে সেজে থেকে না সুবিধে হবে না। সুচে সুতো পরানোর সময় সুতো স্থিরভাবে ধরে রেখে তাতে সুঁই পরাবে না, সুঁই স্থির রেখে ফুটোতে সুতো পরাবে। মেয়েরা সেভাবেই পরায়, কিন্তু পুরুষরা উলটোটা করে। ইঁদুর বা আর কারো দিকে কিছু ছুড়ে মারার সময় হাত যতটা সম্ভব মাথার ওপর তুলে মারবে, যাতে সেটা লক্ষ্যবস্তূ থেকে অন্তত ছ-সাত ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। শক্তি সঞ্চয় করবে কাঁধের কাছ থেকে, মেয়েরা তা-ই করে। ছেলেদের মত শরীরের এক পাশে হাত রেখে কবজি বা কনুয়ের জোরে মারবে না। সুচ-সুতো পরন দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুমি আসলে ছেলে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, জর্জ। আমার নাম মিসেস জুডিথ লোফটাস। বিপদে পড়লে খবর দিয়ো। কেমন?
ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নদীর তীর ধরে উজানের দিকে পঞ্চাশ গজের মত গেলাম। তারপর উলটোপথে ফিরে এসে ডিঙি বেয়ে পৌঁছুলাম দ্বীপে। দেখলাম, ঘুমে কাদা হয়ে আছে জিম। জাগলাম ওকে, ওঠ, জিম। সময় নষ্ট কোরো না। পালাতে হবে। আমাদের ধরতে আসছে ওরা।
নিঃশব্দে মালপত্র ভেলায় তুললাম, ভয়ে দুজনেই কাঁপছি। আধ ঘণ্টা পর ভাটি বেয়ে রওনা হলাম আমরা।