দশদিনে জাহাজ-নাবিক জোগাড় করতে পারলেন না জমিদার ট্রেলনী, তারচেয়ে অনেক বেশি সময় লেগে গেল।
১৭…সালের ১ মার্চ, ব্রিস্টলের ওল্ড অ্যাংকর সরাইখানা থেকে ডাক্তার লিভসীর কাছে একটা চিঠি লিখলেন ট্রেলনী। চিঠিটা হলঃ
প্রিয় লিভসী,
জাহাজ কেনা হয়েছে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কেনা হয়ে গেছে। চমৎকার স্কুনার। সহজেই চালানো যায়। পরিবহণ ক্ষমতা দুশো টন। নাম, হিসপানিওলা।
জাহাজটা জোগাড় করে দিয়েছে আমার পুরানো বন্ধু, পর্যটক ব্ল্যান্ডলি। আমার জন্যে সাংঘাতিক পরিশ্রম করেছে সে। ব্রিস্টলের আরও অনেকেই সাহায্য করেছে আমাকে। তারা জেনেছে গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছি আমি।
ব্ল্যান্ডলির কথাঃ খুব কম দামে পাওয়া গেছে জাহাজটা। কিন্তু দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই। তারা বলছেঃ আসলে এটা ব্ল্যান্ডলিরই জাহাজ ছিল। আমাকে বোকা পেয়ে খুব চড়া দামে বিক্রি করেছে, বলেছে জাহাজের মালিক অন্য লোক। মধ্যস্থতার নামে খুব ঠকিয়েছে নাকি সে আমাকে। সে যাই হোক, জাহাজটাকে খারাপ বলতে পারছে না কেউ।
যতটা ভেবেছিলাম, তত সহজে নাবিক জোগাড় হয়নি। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে সিলভারকে না পেয়ে গেলে তো নাবিকই জোটাতে পারতাম না। লোকটা বুড়ো, এককালে জাহাজে চাকরি করত। এখন ব্রিস্টলে একটা সরাইখানার মালিক। আমি নাবিক খুঁজছি শুনে একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে হাজির। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, লোকটার একটা পা নেই।
লোকটার পুরো নাম লঙ জন সিলভার। অমর বীর হুকের অধীনে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছিল সে, পা খোয়ায় ওই যুদ্ধেই। নাবিক এবং যোদ্ধা ছাড়াও আরেকটা পরিচয় আছে তার, চমৎকার রাঁধুনী। যেচে পড়ে এল, হিসপানিওলার বাবুর্চির কাজটা তাকেই দিয়ে দিলাম। ডাঙায় থেকে থেকে শরীর খারাপ হয়ে গেছে নাকি তার, দূর সাগরের নোনা হাওয়ায় যদি স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, এই আশায়ই বুড়ো বয়সে জাহাজে চড়তে চাইছে সিলভার। হুট করে তাকে চাকরি দেয়ার আরও একটা কারণ আছে। আমাকে আশ্বাস দিল, হিসপানিওলার জন্যে নাবিক জোগাড় করে দিতে পারবে সে। সত্যিই, কথা রেখেছে একপেয়ে নাবিক।
দেখতে দেখতে নাবিক জোগাড় করে ফেলেছে সিলভার। যে-সে নাবিক নয়, রীতিমত কাজের লোক প্রত্যেকে। চেহারা ওদের খারাপ, অস্বীকার করছি না, কিন্তু চেহারা দেখে তো বেতন দেব না। কাঁচা লোক নই আমি, বাজিয়ে দেখে নিয়ে তবেই চাকরি দিয়েছি। অদম্য ওদের মনোবল। দরকার পড়লে লড়াই করানো যাবে ওদের দিয়ে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন নিয়োগ করেছি যাকে, সে তো একটি রত্ন। মেজাজটা অবশ্য একটু কড়া, কিন্তু ক্যাপ্টেনের মেজাজ কড়া না হলে নাবিকেরা তাকে মানবে কেন? খোঁজ পেয়ে নিজেই এসেছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু মেট অ্যারোকে আবিষ্কার করেছে সিলভার। সারেঙ লোকটার গুণ আছে, বাঁশি বাজাতে পারে।
সিলভারের কথা আরও কিছু বলে নিই। লোকটা হিসপানিওলায় ছোট চাকরি নিয়েছে বটে, কিন্তু তাকে যা-তা ভাবা ঠিক হবে না। ব্যাংকে মোটামুটি টাকা আছে তার নামে। সরাই চালাবার ভার স্ত্রীর ওপর দিয়েছে। মেয়েলোকটি ইংরেজ নয়। সিলভার অবশ্য বলেনি কিছু, কিন্তু কারও কারও ধারণা বৌয়ের দাপট সইতে না পেরেই নাকি পালিয়ে বাঁচতে চাইছে খোঁড়া বাবুর্চি। হাওয়া পরিবর্তনের কথাটা আসলে একটা বাহানা। সে যাই হোক, ওসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার কোন কারণ নেই।
ট্রেলনীর চিঠিটা আমাকেও পড়তে দিলেন ডাক্তারচাচা। জাহাজ আর নাবিক জোগাড় হয়ে গেছে জেনে দারুণ খুশি হলাম। এই খবরের আশায়ই তো আছি। কিন্তু একটা ব্যাপার মোটেই ভাল লাগল না আমার। জমিদার নিজেই বললেন, গুপ্তধন আর নকশা সম্পর্কে কাউকে কিছু বলা হবে না, অথচ তিনি নিজেই কথাটা ফাঁস করে দিয়ে বসে আছেন!
পরদিন গোধূলি বেলায় রয়াল জর্জে এসে দাঁড়াল ডাক গাড়িটা। রেডরুথ, হান্টার আর জয়েগের সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসলাম।
ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে কনকনে হাওয়া এসে ঢুকছে ভেতরে। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে চলেছি। বাড়ির কথা মায়ের কথা মনে পড়ছে বারে বারে। মনে পড়ছে আমাদের সরাই অ্যাডমিরাল বেনবোর কথা। বাবার স্মৃতিটা কেন যেন আজ বড় বেশি মনে আসছে, সেই সঙ্গে ভাবছি সরাইয়ের আশেপাশের পাহাড় আর সাগরের কথা। ক্যাপ্টেন বোনসও এসে চড়াও হচ্ছে মনের পর্দায়। নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলেছি। আর কি কোনদিন ফিরে আসতে পারব অ্যাডমিরাল বেনবোয়?
ঠিক কতক্ষণ পরে জানি না, পাজরে রেডরুথের কনুইয়ের খোঁচায় তন্ময়তা ভাঙল। বলল সে, নেমে পড়। ব্রিস্টলে এসে গেছি।
নামলাম। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসে পৌঁছলাম শহর থেকে দূরে, ডকইয়ার্ডে। সারি সারি জাহাজ নোঙর করে আছে। দেশ-বিদেশের নাবিকেরা কোলাহল করছে, গান গাইছে, কাজ করছে। নোনা হাওয়ায় মেশানো আলকাতরার গন্ধটা একেবারে অপরিচিত ঠেকল না। এই গন্ধ আগেও পেয়েছি। ক্যাপ্টেন বোনসের সিন্দুকের ভেতরে।
কানে মাকড়ি, দু-গালের জুলফি পাকিয়ে পাকিয়ে গোল-করা, রঙওঠা পোশাকপরা মাঝবয়েসী এক নাবিককে অবাক চোখে দেখছি, এই সময় সেখানে এসে দাঁড়ালেন ট্রেলনী। জমিদারকে দেখে প্রথমে তো চিনতেই পারলাম না। স্বাস্থ্য অনেক ভাল হয়েছে। পরনে নীল রঙ মোটা কাপড়ের নাবিকের পোশাক। কথা, হাসি, চলাফেরার ভঙ্গি ইত্যাদি সব কিছুতেই নাবিকদের অনুকরণ করছেন।
কেমন আছ, জিম? আমার হাত ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন জমিদার।
আমি ভাল আছি জানাতেই বললেন, কাল রাতে ডাক্তার লিভসীও এসে পৌঁছেছে। সে-ও ভাল আছে।
আমরা কবে রওনা হচ্ছি, স্যার?
আগামী কাল।