রাত প্রায় একটার দিকে দ্বীপের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ভেলা। যদি কোন নৌকো আমাদের খোঁজে এসে পড়ে, ডিঙি নিয়ে ইলিনয়ের দিকে পাড়ি জমাব আমরা। কপাল ভালই বলতে হবে, কোন নৌকো এল না।
পুব-আকাশে ভোরের আলো ফোটামাত্রই একটা বাঁকের মাথায় বাধলাম ভেলাটা। কটনউড ঝোপ থেকে ডালপালা কেটে এনে এমনভাবে ঢেকে দিলাম যে দেখে মনে হবে কোন গুহা আছে ওখানে। বাঁকের মাথায় চর; তাতে কটনউডের সারি, নিড়ানি মইয়ের দাঁতের মত ঘন।
নদীর ওপাশে মিসৌরি, তীর ঘেঁষে আকাশ ছুঁয়েছে পাহাড়, আর এপাশে, ইলিনয়ের দিকে, বড় বড় গাছের সারি। ঠিক ওই জায়গাতেই স্রোতধারা মিসৌরির তীর ঘেঁষে চলে গেছে। ফলে, হঠাৎ কেউ আমাদের দেখতে পাবে এমন ভয় নেই। সারাদিন ঝোপের ভেতর শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। সামনে দিয়ে গয়না নৌকো, স্টিমার যাচ্ছে উজান ঠেলে।
আঁধার নামার পর আশ্রয় ছেড়ে বেরুলাম। তক্তা দিয়ে ভেলার ওপর একটা ছই বানাল জিম, যাতে রোদ-বৃষ্টিতে ঠাই নিতে পারি। তারপর এক ফুট উঁচু একটা পাটাতন তৈরি করা হল। এখন আর স্টিমারের ঢেউতে ভিজবে না জিনিসপত্র। ছইয়ের ঠিক মাঝখানে কাদামাটি দিয়ে একটা চুলোমত তৈরি করলাম। এবার ঠাণ্ডা কিংবা স্যাঁতস্যাতে দিনে ওর ভেতর আগুন জ্বালানো যাবে। ঘেরা থাকায় চোখে পড়বে না কারো। বাড়তি একটা হালও তৈরি করা হল, জোড়ারটা ভেঙে বা নষ্ট হয়ে গেলে কাজে লাগবে। সবশেষে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখার জন্যে আংটার মত করে একটা লাঠি গেঁথে দিলাম। রাতে যখন কোন স্টিমার আসবে, তখন বাতি না দেখালে হুঁড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে পারে। অবশ্য উজানে যে স্টিমারগুলো যাবে, তাদের বাতি দেখানোর দরকার হবে না।
দ্বিতীয় রাতে সাত-আট ঘণ্টা চললাম, বেশির ভাগ সময় গা ভাসিয়ে দিলাম স্রোতের অনুকূলে। মাছ ধরলাম, গল্পগুজব করলাম। মাঝেমধ্যে ঘুম তাড়াতে সাঁতারও কাটলাম খানিক। অধিকাংশ সময় কাটল তারা দেখে। চমৎকার আবহাওয়া। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটল না সেইরাতে—এমনকি পরের দুরাতেও না। প্রতি রাতেই কোন না কোন শহর অতিক্রম করলাম আমরা। পঞ্চম রাতে পেরিয়ে এলাম সেন্ট লুইস। আলো ঝলমলে শহর। সেন্ট পিটসবার্গে শুনেছিলাম, সেন্ট লুইসে নাকি বিশ-তিরিশ হাজার লোকের বাস। কিন্তু এবার চোখে দেখার আগে পর্যন্ত বিশ্বাস করিনি সেকথা। এখন অবশ্য প্রাণের সাড়া নেই শহরে, সবাই যেন ঘুমিয়ে আছে পরম নিশ্চিন্তে।
এখন প্রায় প্রতি রাতেই ডিঙি নিয়ে তীরে যাচ্ছি আমি। গ্রামের দোকান থেকে খাবার জিনিস কিনে আনি। আর মওকামত কোন মুরগি-টুরগি পেলে ধরে নিয়ে আসি চুপি চুপি। বাবা সব সময়েই বলত, মোরগ-মুরগি পেলেই তার একটা নিয়ে নেবে। কারণ তুমি না-নিলেও, অনন্য নেবে সেটা।
ভোর হবার আগেই ঢুকে পড়ি কোন শস্য-ক্ষেতে। রোজই কিছু না কিছু ধার করতে লাগলাম সেখান থেকে। বাবা বলত, যদি কোনদিন ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে থাকে, তবে এরকম ধার করায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু ওই বিধবা বলত, এটাও এক ধরনের চুরি। ভদ্রলোক একাজ করবে না। জিম বলল, ওর মতে দুজনের কথাই ঠিক। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে আমাদের তালিকা থেকে দুতিনটে জিনিস বাদ দেয়া, এবং মনে করা সেগুলো আমরা ধার করব না। সেক্ষেত্রে, অন্যগুলো ধরি করলে দোষ হবে না। অতএব আলাপ-আলোচনা করে আমরা ঠিক করলাম, বুনো নাশপাতি আর পিসিমন, এই দুটো জিনিস বাদ দেব তালিকা থেকে। এ দুটো বাদ যাওয়ায় মনে মনে খুশিই হলাম আমি। বুনো নাশপাতি খেতে বিচ্ছিরি, আর পিসিমন অন্তত আরো দুতিন মাসের আগে পাকবে না।
পঞ্চম রাতেই ঝড়ে পড়লাম আমরা। দুপুর রাতের পর মুষলধারে নামল বৃষ্টি। থেকে থেকে আকাশটা চিরে দিচ্ছে বিজলিচমক। বাজ পড়ার শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। ছইয়ের ভেতর আশ্রয় নিলাম আমরা, ভেলাটাকে ইচ্ছেমত চলতে ছেড়ে দিলাম। বিজলির আলোয় দেখলাম নদীর দুপাশে উঁচু পাড়। অদূরেই কাত হয়ে পড়ে আছে একটা স্টিমার। ডুবে যাচ্ছে ওটা। আমাদের ভেলাটা সেদিকেই ভেসে যাচ্ছে। এই নির্জন নদীতে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখে অন্য যেকোন বাচ্চা ছেলের যে অনুভূতি হবে, আমারও তা-ই হল। ওতে উঠে ঘুরেফিরে দেখতে ইচ্ছে জাগল।
চল, জিম, জাহাজে গিয়ে উঠি, বললাম। জিমের তাতে ঘোরতর আপত্তি। বোকামি কোরো না, বলল ও, পাহারাদার থাকতে পারে।
পাহারাদার না তোমার মাথা, বললাম। কিস্যু নেই ওর ভেতর। এই দুর্যোগের রাতে কে আসবে জান খোয়াতে। তাছাড়া, আমাদের নেয়ার মত কোন জিনিস মিলেও যেতে পারে।
নিমরাজি হল জিম। বলল, ওখানে গিয়ে বিশেষ কথা বলব না আমরা। আর যাও-বা বলব, খুব আস্তে। জাহাজের সামনের দিকে একটা কপিকল ছিল। কপিকলটার সাথে বাধলাম ভেলাটা।
ডেকটা বেশ উঁচুতে। নিঃশব্দে দেয়াল বেয়ে পেছনের দিকে অন্ধকারে নামলাম আমরা। পা দিয়ে পথ অনুমান করে বসার ঘরের দিকে এমনভাবে এগোলাম, যদি কোন লোক হাতড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তাকে যেন ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে পারি। আমাদের এ সিদ্ধান্তের কারণ, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। একটু পরেই একটা পোর্টহোলের কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা, ওটা বেয়ে উঠলাম। পরক্ষণে এসে পড়লাম ক্যাপ্টেনের ঘরের দরজার সামনে। ভেতরে বাতি জ্বলছে। হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে এল দূর থেকে।
ফিসফিস করে জানাল জিম, অসুস্থ বোধ করছে সে। আমাকে ফিরে যেতে বলল ও। ফিরে যাব, এমন সময় একটা কাতর গলা শুনতে পেলাম: দোহাই লাগে, এটা কোরো না তোমরা! কসম কেটে বলছি, এবার আর কাউকে কিছু বলব না আমি।
মিথ্যে বলে লাভ হবে না, জিম টার্নার। আরেকটা মোটা কর্কশ গলা শোনা গেল। এর আগেও এমন করেছ তুমি। সকলের চেয়ে বেশি ভাগ চেয়েছ, পেয়েওছ। কারণ, না-দিলে হুমকি দিয়েছ, সব ফাঁস করে দেবে। তোমার মত এরকম হারামি আর বেঈমান এই তল্লাটে আর একটাও নেই।
ইতিমধ্যে ভেলায় ফিরে গেছে জিম। দারুণ কৌতূহল বোধ করলাম আমি। টম সয়্যার এক্ষেত্রে পিছপা হত না, বললাম মনে মনে, আমিও হব না।
হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের সরু প্যাসেজ বেয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের অন্ধকারের দিকে। একটা স্টেটরুম থেকে ক্ষীণ আলোর ছটা এসে পড়েছে বাইরে। ওই আলোয় দেখলাম, একটা লোক হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চিত হয়ে পড়ে আছে মেঝেয়। দুজন লোক ওর পাশে দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে একটা টিমটিমে লণ্ঠন, অপরজনের হাতে পিস্তল। বন্দির দিকে পিস্তলটা উচিয়ে আছে সে। দেই শেষ করে। শালা একটা আস্ত শয়তান, বলল লোকটা।
না…না, মের না। দোহাই ঈশ্বরের, চেঁচিয়ে উঠল বন্দি।
ওর অনুনয় শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল অপর দুজন। পিস্তলটা সরাও, বিল, বলল লণ্ঠনধারী, এমনিতেই ভিরমি খেয়েছে ব্যাটা। আর ভয় দেখাতে হবে না।
ওকে মেরে ফেলাই উচিত, প্যাকার্ড, বলল বিল। বুড়ো হ্যাটফিল্ডকে মেরেছে ও। কাজেই এটা ওর পাওনা।
লণ্ঠনটা পেরেকে ঝুলিয়ে আমি যেখানে বসে আছি, সেদিকে ইশারায় বিলকে আসতে বলল প্যাকার্ড। চিংড়িমাছের মত তিড়িং করে দু গজ পিছিয়ে এলাম আমি। কিন্তু সুবিধে হল না, স্টিমারটা ভীষণ রকমের কাত হয়ে আছে। ওরা যাতে আমার গায়ের ওপর এসে না-পড়ে সেজন্যে বসার ঘরের ভেতর দিয়ে চট করে বেরিয়ে এলাম। ঘেমে নেয়ে উঠেছি, শীত-শীত করছে। অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলাম। আলকাতরার মত অন্ধকার। ডেকরেলিংয়ের ওপর উঠে ফিসফিস করে ডাকলাম জিমকে। আমার কনুইয়ের কাছ থেকে কো কো করে উত্তর নিল ও।
জলদি কর, জিম, বললাম। ওখানে একদল খুনি রয়েছে। এদের নৌকোটা খুঁজে ভাসিয়ে দিতে হবে, নইলে ওদের একজন ভীষণ বিপদে পড়বে। আর ভাসিয়ে দিতে পারলে সব কটাই বিপাকে পড়বে। নাও, তাড়াতাড়ি কর। আমি পেছনের দিকটায় খুঁজছি। তুমি সামনেটা দেখ…
হায় হায়, ভেলা কই গেল, আঁতকে উঠল জিম। আরে, ওটা দেখছি দড়ি ছিড়ে চলে গেছে। এখন কী হবে!