পরদিন সকালে নাস্তার পর পাই গ্লাস সরাইয়ে যেতে বললেন আমাকে ট্রেলনী। জন সিলভারকে দেবার জন্যে একটা চিঠি দিলেন আমার হাতে। সরাইয়ের ঠিকানাটা বুঝিয়ে বললেনঃ ডকের ধার ধরে যেতে যেতে সাগরের পাড়েই একটা ছোট্ট বাড়ি, দেয়ালে মস্ত দূরবীনের ছবি আঁকা, ওটাই স্পাই গ্লাস সরাইখানা।
বেরিয়ে পড়লাম। উত্তেজনা আর আনন্দে মশগুল। আরও জাহাজ, আরও নাবিক, নতুন জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছি, এই তো আমি চাই। কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড় ডকে। তাদের পাশ কাটিয়ে, মালপত্রের স্তুপ এড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম সরাইটার সামনে। ঠিকই বলেছেন জমিদার, সহজেই পাওয়া গেল স্পাই গ্লাস সরাইখানা।
সরাইয়ের বাইরের জায়গাটুকু সুন্দর ছিমছাম। নতুন আঁকা সাইনবোর্ড। জানালায় টকটকে লাল পর্দা। ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
এক কামরার একটা বাড়ির মাঝখানে দেয়াল তুলে দুভাগ, অর্থাৎ দুটো ঘর করা হয়েছে। মেঝে পাকা নয়, চমৎকার করে বালি বিছানো। মালিকের আজব কিন্তু চমৎকার রুচির পরিচয় পাওয়া যায় এতে। তামাকের ধোয়ায় আচ্ছন্ন ঘরের খদ্দেররা বেশির ভাগই নাবিক। জোরে জোরে কথা বলছে ওরা, এভাবেই হয়ত কথা বলতে অভ্যস্ত নাবিকেরা।
দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এইসময় ওপাশের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু সে কে বুঝতে অসুবিধে হল না। বাঁ পা-টা উরুর কাছ থেকে কাটা, বগলে ক্ৰাচ। প্রায় নিঃশব্দে আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে হাঁটে লোকটা। একটা পা-যে নেই, তাতে যেন কোন অসুবিধেই হচ্ছে না তার। লম্বা বলিষ্ঠ দেহ। প্রকান্ড মুখটা ফ্যাকাসে, হয়ত বয়সের ভারেই, কিন্তু হাসি লেগেই আছে মুখে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। টেবিলগুলোর পাশ দিয়ে চলছে ফিরছে লোকটা, প্রতিটি টেবিলের পাশে থেমে কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে, কারও কারও পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে আন্তরিক ভঙ্গিতে।
নাহ্, যা সন্দেহ করেছিলাম তা নয়। লোকটা একপেয়ে ঠিকই, নাবিকও ছিল এককালে, কিন্তু সে ক্যাপ্টেন বোনসের সেই ভয়ঙ্কর লোক নয়। আমার দুঃস্বপ্নে দেখা দানব নয় সে। এই হাসিখুশি চমৎকার লোকটা আর যাই হোক, জলদস্যু হতে পারে না। সিলভারের ব্যবহার দেখে তাই মনে হচ্ছে আমার।
এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে ডাকলাম, মিস্টার সিলভার, স্যার?
ফিরে চাইল লোকটা। মিস্টার ট্রেলনী দিয়েছেন, চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে বললাম।
চিঠিটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সিলভার, তুমি কে, খোকা? তারপর হঠাৎই যেন অনুমান করে নিয়ে বলল, ওহহো বুঝেছি, তুমি সেই। মানে কেবিনবয়। ভাল, খুশি হলাম তোমাকে দেখে। বিশাল এক থাবা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
হঠাৎই ওপাশের ঘর থেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল একটা লোক। আমাকে দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখে ফুটল বিস্ময়, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশে।
সিলভারের থাবা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, আরে, ওই তো! ব্ল্যাক ডগ!
কে? কি নাম বললে? আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে চেয়েছে সিলভার।
ছুটে গেলাম দুই ঘরের মাঝের দরজার কাছে। পলকের জন্যে চোখে পড়ল বেরিয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাক ডগ। ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সিলভার। ডগের পেছনটা দেখতে পেয়েছে সে। আরে, আমার পয়সা না দিয়েই চলে যাচ্ছে! হ্যারি, এই হ্যারি, জলদি ধর ব্যাটাকে!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দরজার কাছে বসা একজন লোক।
হাঁ করে আছ কেন, জলদি যাও! তাড়া লাগাল সিলভার।
আমার দিকে ফিরে বলল, কি নাম যেন বললে?
ব্ল্যাক ডগ! জলদুস্য!
আমার সরাইয়ে ডাকাত! ব্যাটার সাহস তো কম নয়! এই বেন, আরেকজন লোককে ডেকে আদেশ দিল সিলভার। তুমিও যাও। যে করেই হোক ধরে নিয়ে এস ব্যাটাকে। জলদস্যু! বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব! আমাকে চেনে না! ঘরের ভেতরের দিকে একটা টেবিলে বসা লোকের দিকে চেয়ে হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল সে, এই, এই মরগান, তোমার পাশেই তো বসেছিল ও! এসো, এদিকে এসো!
হতচকিত হয়ে পড়ল মরগান। উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে এল সিলভারের কাছে। পোশাক-পরিচ্ছদে মনে হচ্ছে নাবিক। মাথার চুল পেকে গেছে, মেহগনি রঙের, চামড়ায় ঢাকা মুখ। হাতের তামাকের ডেলাটা গোল করতে করতে কাঁচুমাচু মুখে এসে দাঁড়াল সিলভারের সামনে।
ওই ব্ল্যাক ডগ না কি নাম বলল…ওর সঙ্গে পরিচয় আছে?
জ্বী, না!
তবে যে বড় গল্প করছিলে তখন?
মদের টেবিলে যে-কোন অপরিচিত নাবিক পরিচিত হয়ে যায়, আপনিও তো জানেন। সত্যি বলছি, আমি ওকে দেখিনি এর আগে।
এবং বেঁচে গেলে এই জন্যেই। এরপর থেকে যদি দেখি ওই ধরনের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করছ, ঝেটিয়ে বার করব আমার সরাই থেকে! তা কি বলছিল তোমাকে? সাগর… জাহাজ… ক্যাপ্টেন, এমনি সব শব্দ কানে আসছিল?
এসব নিয়েই তো আলোচনা করে নাবিকেরা…
হু, যাও। বসোগে…
ধীরে ধীরে গিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়ল মরগান। সিলভারের দিকে চোখ তুলে চাইতে সাহস হচ্ছে না। তামাকের ডেলাটা গোল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল সিলভার, মরগান লোক খুব ভাল, কিন্তু হদ্দ বোকারাম।
দরজার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল সিলভার, তারপর আমার দিকে চেয়ে আপনমনেই মাথা নাড়ল, ব্ল্যাক…ব্ল্যাক ডগ…দেখেছি আগেও লোকটাকে…আচ্ছা, ওর সঙ্গে একটা অন্ধ লোককে দেখেছ কখনও? বিচ্ছিরি চেহারা?
নিশ্চয়ই! উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আমি, ওই ব্যাটাও ডাকাত ছিল। নাম, পিউ।
হ্যা হ্যাঁ, পিউ, সায় দিয়ে বলল সিলভার। দুই হারামজাদাই আমার দোকানে হরদম আসে যায়, ইদানীং অবশ্য কানাটাকে দেখি না!..ইসস, আগে যদি জানতাম…
পিউ তো মারা গেছে। ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে গিয়েছিল…
এই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল হ্যারি আর বেন। তাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল সিলভার।
ওকে…ধরতে পারলাম না… ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে হ্যারি, ব্যাটা এক্কেবারে গায়েব হয়ে গেছে…
তোমাদের দুই গাধাকে দিয়ে কোনদিন কোন কাজ হয়েছে? খেঁকিয়ে উঠল সিলভার। ইসস, এখন আমি কি জবাব দেব মিস্টার ট্রেলনীর কাছে! আমার সরাইয়ে ডাকাতদের আড্ডা, যদি শোনেন তিনি আমাকে কি আর চাকরিতে রাখবেন! আর আমিই বা কি করি যুদ্ধে গিয়ে তো একটা পা খোয়ালাম… পা থাকলে, আরে গাধারা, তোমাদের মত গায়ের জোর থাকলে, ওই হারামখোর আমার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচে?
যাক যা হবার, হয়েছে, অভয় দিলাম। আমি সব কথা বুঝিয়ে বলব মিস্টার ট্রেলনীকে। আপনার কোন দোষ নেই, দেখতেই তো পেলাম। তাছাড়া সরাইয়ে কত লোক আসে যায়, কি করে বুঝবেন কে ডাকাত আর কে সাধু?
বুদ্ধিমান ছেলে! হাসিতে ভরে গেছে সিলভারের মুখ। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, তোমার সম্পর্কে যা শুনেছি, দেখছি মিথ্যে নয়। এসো, এক গেলাস রাম খাও… হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেল কথাটা তার। আরে তাই তো, ডাকাতটা যে আমার তিন গেলাস মদের দাম না দিয়েই চলে গেল…যাকগে, এসো, যা হবার হয়েছে… আপ্যায়ন করে নিয়ে আমাকে একটা চেয়ারে বসাল সিলভার।
রাম নয়, চা নিলাম আমি। ইতিমধ্যে ট্রেলনীর চিঠিটা পড়ে ফেলেছে সিলভার। ট্রেলনীর সঙ্গে তাকে দেখা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমার পাশে বসে বলল সিলভার, একটা কথা কি জানো, বুড়ো আর বাচ্চাদের মাঝে খাতির হতে সময় লাগে না। বুঝতে পারছি, তোমার সঙ্গে আমার বনিবনা ভালই হবে। তাছাড়া দুজনের কাজও প্রায় একই ধরনের। তুমি কেবিনয়, আমি বাবুর্চি… বক বক করেই চলল সিলভার।
আমার চা খাওয়া শেষ হলে উঠে দাঁড়ালাম। সিলভারও উঠল। সরাই থেকে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে।
ডকের পথটা ধরে চলতে চলতে আমার সঙ্গে আলাপ আরও জমে উঠল সিলভারের। চমৎকার গল্প বলতে পারে সে, অল্পক্ষণেই বুঝে গেলাম। জাহাজ নাবিক। সাগর সম্পর্কে জ্ঞানও তার অপরিসীম। চলার পথে যে কটা জাহাজ দেখলাম, সবকটার গঠন, কোন্ জাতের কোন দেশের জাহাজ ওগুলো, কি মাল বহন করে, কোন কোন্ সাগর পথে যাতায়াত, ইত্যাদি সব বলল আমাকে। এরই ফাঁকে ফাঁকে নাবিকদের সম্পর্কেও ছোটখাটো গল্প শোনাল। খুশি হয়ে উঠলাম। সিলভারকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি, জাহাজে সময় আমার ভালই কাটবে।
ডকের ধারেই একটা সরাইয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তারচাচা আর ট্রেলনী। আমাদের দেরি দেখে লাঞ্চ শুরু করে দিয়েছেন।
কেন দেরি হল, সব বুঝিয়ে বলল সিলভার। প্রচুর উৎসাহের সঙ্গেই ব্ল্যাক ডগকে ধাওয়া করার ঘটনা বর্ণনা করল। মাঝে মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আমার দিকে তাকাচ্ছে, সায় দিচ্ছি আমি।
ব্ল্যাক ডগ ধরা না পড়ায় আফসোস করলেন ডাক্তারচাচা আর ট্রেলনী, কিন্তু ঠিকই বুঝলেন, সিলভারেরও কিছু করার ছিল না। সে তো সঙ্গে সঙ্গেই লোক পাঠিয়েছে। ডাকাতটাকে ওরা ধরতে না পারলে খোঁড়া মানুষটার কি করার আছে?
আজ বিকেল চারটেয়, কাজের কথায় এলেন ট্রেলনী। আবার বলছি, বিকেল চারটেয় নাবিকদের হিসপানিওলায় গিয়ে তৈরি থাকতে বলবে।
জী, আচ্ছা, ঘাড় কাত করল সিলভার।
তাহলে যাও এখন। সিলভারের চলার পথের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন ডাক্তারচাচা। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্, লোকটার ওপর কোন সন্দেহ হচ্ছে না আমার।
সন্দেহ মানে? ওর মত চমৎকার লোক হয় নাকি! বললেন ট্রেলনী। তা আর দেরি কেন? খাওয়া তো হল, চল যাই তোমাকে দেখাই জাহাজটা।
হ্যাঁ, চল যাই, আমাকে দেখিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা। জিম আসবে সঙ্গে? ও-ও তো দেখেনি জাহাজটা।
নিশ্চয়! আসবে না মানে, একশোবার আসবে! চল জিম, তুমিও চল।