গরমের জ্বালায় অতিষ্ঠ কিনো আর হুয়ানা ঝোপের ছায়ায় আশ্রয় নিল।
খুদে পাখির তুড়ুক তুড়ুক চলেফিরে বেড়াচ্ছে আশপাশে।
হ্যাট দিয়ে চোখ ঢাকল কিনো, মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মুখ ঢেকে নিল কম্বলে। তারপর দিল ঘুম।
কিন্তু হুয়ানার চোখে ঘুম নেই। মুখ ব্যথা করছে এখনও ওর, কিনোর বেমক্কা চড় খেয়ে। হুয়ানার কাটা চিবুকের চারপাশে ভনভন করছে ইয়া বড় বড় মাছি।
কয়োটিটোর ঘুম ভাঙতে, ওকে মাটিতে শোয়াল হুয়ানা। হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে বাচ্চাটা, দুচোখ ভরে দেখছে গর্বিত মা। কয়োটিটো হাসল মার দিকে চেয়ে, পাল্টা হাসল হয়না। বাচ্চার সাথে খানিক খেলা করে, তারপর পানি পান করতে দিল ও।
স্বপ্ন দেখছে কিনো। অস্থিরভাবে নড়চিড়া করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল আচমকা। লড়াইয়ের ভঙ্গিতে দুহাত খুঁড়ছে ও। হঠাৎ উঠে বসল ধড়মড় করে। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।
উৎকর্ণ হলো কিনো, কিন্তু অরণ্যের গান ছাড়া আর কোন শব্দ বাজল না কানে।
কি হলো? হুয়ানা জানতে চাইল।
চুপ!
স্বপ্ন দেখছিলে তুমি।
হয়তো তাই।
চোখের পাতা আর এক হলো না কিনোর। হুয়ানা ওকে একটা কর্নকেক দিতে, খাওয়া থামিয়ে কান খাড়া করল আবারও। ভয় হচ্ছে কিনোর। কাঁধের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চাইল সে, ছোরাটা শক্ত মুঠোয় ধরল। কয়োটিটো এসময় অস্ফুট শব্দ করে উঠতে কিনো বলল, থামাও ওকে।
কি ব্যাপার গো? হুয়ানা প্রশ্ন করল।
জানি না।
হঠাৎ, কিসের যেন নড়াচড়া দৃষ্টি কাড়ল ওর। কিনো মাথা নামিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে চাইল। লক্ষ্য করল বহু দূরে, তিনজন লোক। দুজন হাঁটছে এবং তৃতীয় লোকটা ঘোড়ার পিঠে। লোকগুলো কাকে খুঁজছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ধড়াস করে উঠল কিনোর বুকের ভেতরটা।
পায়ে হাঁটছে যে লোক দুটো, তারা গভীর মনোযোগে জমি পরখ করছে। ওদের একজন থমকে দাড়িয়ে ইশারায় কি যেন দেখাল। এরা ট্র্যাকার।
পাথুরে পাহাড়ে ভেড়ার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে পারে এই ট্র্যাকাররা। মাড়ানো, ছেড়া এক টুকরো ঘাসের ডগা, কিংবা বালিতে ক্ষীণতম চিহ্নও ওদের সতর্ক নজর এড়ায় না। শিকারী কুকুরের মত ধূর্ত ওরা। ঘোড়সওয়ার লোকটার নাক কম্বল দিয়ে ঢাকা। হাতে রাইফেল।
গাছের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিনো। শ্বাস বইছে কিনা ওর বোঝার উপায় নেই। যেখানকার ট্রাক মুছে দিয়েছিল, স্বভাবতই চোখ চলে গেল সেখানে। ঝাট দেয়ার চিহ্ন কিছু ফাঁস করে দেবে না তো ট্র্যাকারদের কাছে? এদেরকে চেনে কিনো। পোড় খাওয়া শিকারী ওরা, এখন কিনোকে শিকার করতে এসেছে।
ট্র্যাকাররা হঠাৎ কি একটা দেখে ঝুঁকে পড়ল। অশ্বারোহী স্থির বসে অপেক্ষা করছে। উত্তেজিত কুকুরের মত তর্জন করে উঠল ট্র্যাকার দুজন। ধীরে ধীরে ছোরাটা টেনে বের করে তৈরি হলো কিনো। ইতিকর্তব্য ঠিক করা হয়ে গেছে তার। ওকে ট্র্যাকাররা খুঁজে পেলে, ঘোড়সওয়ারের উদ্দেশে ঝাঁপ দেবে ও। ওই লোকটাকে ঝটপট খুন করে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিতে হবে। বাঁচার এই একটাই সুযোগ। লোকগুলো কাছিয়ে আসতে, চোয়াল শক্ত হলো কিনোর।
ঘোড়ার খুরের শব্দ হুয়ানার কানেও গেছে। বাচ্চাটা ডুকরে কেঁদে উঠল এসময়। কয়োটিটোকে শালের নিচে টেনে নিয়ে, ওকে দুধ পান করতে দিল দুয়ানা।
ট্র্যাকাররা কাছিয়ে এল। ওদের আর ঘোড়াটার পা কেবল দেখতে পাচ্ছে কিনো গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। এবারে, নোংরা পায়ের সাথে সাথে, পুরানো-জীর্ণ জামা-কাপড়ও চোখে পড়ল।
আরেকটু কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্র্যাকার দুজন। অশ্বারোহী লোকটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াটা মাথা ওপর-নিচ করে, নাক দিয়ে শ্বাস টানার খোঁৎ জাতীয় জোরাল শব্দ করল।
ট্র্যাকাররা এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে জানোয়ারটার দিকে চাইল, ওটার কান লক্ষ্য করছে। ঘোড়াটা বিচিত্র কোন সাড়া-শব্দ পায় কিনা দেখতে চাইছে ওরাI
শ্বাস চেপে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে কিনো, লড়াই করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দীর্ঘক্ষণ রাস্তার ওপর ঝুঁকে বসে রইল ট্র্যাকার দুজন। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। মাটিতে সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর ওদের, অনুগমন করছে অশ্বারোহী। অল্প একটু রাস্তা দৌড়চ্ছে ট্র্যাকাররা, থেমে দাড়িয়ে জমি পরখ করে, তারপর আবার ছুটছে।
ওরা ফিরে আসবে, জানে কিনো। কিনোর ট্র্যাক খুঁজে না পাওয়া অবধি, এভাবেই বিরতি নিয়ে খুঁটিয়ে মাটি পরীক্ষা করবে।
বনের ভেতর ফিরে এল কিনো। ট্র্যাক আড়াল করেনি ও। আসলে, এত বেশি ঝোপ মাড়িয়েছে আর পাথর নড়িয়েছে যে আড়াল করা সম্ভব হয়নি।
কিনো এতটাই ভয় পেয়েছে, ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে ওর। আসবে ওরা, যে কোন মুহূর্তে। বউ-বাচ্চাকে নিয়ে এখন যথাসম্ভব দ্রুত দৌড় দেয়া উচিত ওর। হুয়ানার কাছে নিঃসাড়ে এবং ত্বরিত ফেরত এল কিনো। ওকে আসতে দেখে, চোখ তুলে চাইল হুয়ানা।
ট্র্যাকার! বলল কিনো। এসো!
হঠাৎই আবিষ্কার করল কিনো ওর সমস্ত আশা-ভরসা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
ওদের কাছে ধরা দেব নাকি? বলল।
লাফিয়ে উঠে স্বামীর বাহুতে হাত রাখল হুয়ানা।
পাগল হলে? তোমার সাথে মুক্তা আছে, বলল। তুমি কি ভেবেছ ওরা। তোমাকে শহরে জ্যান্ত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে?
আস্তে আস্তে পকেটে একটা হাত ঢুকল কিনোর। ওরা মুক্তাটা হাতিয়ে নেবে, বলল শান্ত সুরে।
এসো, তাগাদা দেয় হুয়ানা। জলদি এসো!
কিনোকে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগাল হুয়ানা।
আমাকেও কি ওরা ছেড়ে দেবে নাকি? বলল। তোমার দুধের বাচ্চাটাকেও বাঁচতে দেবে না।
টনক নড়ল এবার কিনোর। ঠোঁট দৃঢ়বদ্ধ হলো ওর, দুচোখ ভরে উঠল রাগে আর ঘৃণায়।
চলো, বলল ও। পাহাড়ে যাব আমরা। ওখানে হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারব।
খাবারের ছোট ছোট থলেগুলো, আর পানির বোতলটা বাঁ হাতে তুলে নিল কিনো। ডান হাতে ধরা ওর ছোরাটা। হুয়ানা স্বামীকে অনুসরণ করছে। ঝোপ-ঝাড় ভেদ করে উচু পর্বতমালার উদ্দেশে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা।
কিনো এতটাই ভড়কেছে, ট্র্যাক আড়াল করার কথাও ওর মাথায় এল না। শশব্যস্তে হাঁটছে ওরা। নুড়ি পাথর ওদের পায়ের ধাক্কায় গড়াচ্ছে, গাছের পাতা গায়ে বেধে খসে পড়ছে। আকাশের পটভূমিতে, ওই তো, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা। প্রাণভয়ে ভীত জানোয়ারের মত ওদিক লক্ষ্য করে ছুটল ওরা।
এখানকার জমিতে পানি নেই। ভাঙাচোরা পাথর আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে অবিচল হেঁটে চলেছে স্বামী-স্ত্রী। এই খরমরুতে গা পুড়ে যেতে চায়।
সামনে, শীতল ছায়া বিছিয়ে যেন নিরাপত্তা দিচ্ছে পাথুরে পাহাড়সারি। যতটা দ্রুত পারে পা চালাচ্ছে কিনো। কি ঘটবে জানে তো সে।
শিকারীরা একটু পরেই ট্র্যাক খুঁজে পাবে। তারপর ওদের গুপ্তস্থানটা আবিষ্কার করবে। ঝরা পাতার আর ভাঙা পাথরের বদৌলতে ওদেরকে স্বচ্ছন্দে অনুসরণ করবে লোকগুলো। ধরে ফেলবে কিনো আর হুয়ানাকে। শহরে আর ফিরে যেতে হবে না স্বামী-স্ত্রী-বাচ্চাকে। অশ্বারোহী লোকটা এমনি এমনি রাইফেল আনেনি।
ছোট্ট পথটা খাড়া হয়ে গেছে এমুহূর্তে, পাথরগুলো আগের চাইতে বড়।
কিন্তু কিনোর পরিবার অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছে এখন ট্র্যাকারদের। একটু জিরিয়ে নিতে থামল ওরা। বিশাল এক পাথরে চড়ে দাঁড়িয়ে পেছনে দৃষ্টি রাখল কিনো। ট্র্যাকারদের পাত্তা পেল না। এমনকি দীর্ঘদেহী ঘোড়সওয়রিটিকেও দেখা যাচ্ছে না।
পাথরের ছায়ায় বসে পড়েছে হুয়ানা। মুখের কাছে বোতল ধরতে চুকচুক করে পানি খেল কায়েটিটো। পাথর থেকে নেমে পড়ে হুয়ানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিনো। ধারাল পাথরে লেগে পা কেটেকুটে গেছে হুয়ানার। ঝটপট স্কার্ট দিয়ে পা দুখানি ঢাকা দিল ও। তারপর স্বামীর দিকে পানির বোতলটা বাড়িয়ে ধরতে, সে মাথা নাড়ল। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে কিনোর, কিন্তু পানির পরিমাণ এতই অল্প, খেতে মন উঠল না।
হুয়ানা, বলল কিনো। আমি পাহাড়ে যাব, তুমি লুকিয়ে থেকো। ট্র্যাকাররা আমাকে পিছু নিয়ে পাহাড়ে যাবে। ওরা চলে গেলে, উত্তরে রওনা দেবে তুমি। আমি পরে এসে যোগ দেব।
মুহূর্তের জন্যে কিনোর দিকে অপলকে চেয়ে রইল হুয়ানা।
না, ঘোষণা করল এবার। আমরা তোমার সাথে যাব।
একা গেলে আমি তাড়াতাড়ি যেতে পারব, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল কিনো। তুমি আমার সাথে গেলে কয়েটিটোর বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
না।
যা বলছি করো, বলল কিনো। তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে।
না, আবারও বলল হুয়ানা।
হুয়ানার উদ্দেশে চেয়ে রইল কিনো। ওর মুখের চেহারায় ভীতির কিংবা দুর্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। হুয়ানার জ্বলজ্বলে চোখজোড়া কিনোর মনোবলও ফিরিয়ে দিল। আবার যখন ওরা হাঁটা ধরল, ভয়-ভীতি কোথায় পালিয়েছে।
ক্রমেই চড়াই বাইছে হুয়ানা আর কিনো। সমতল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটছে ওরা, ট্র্যাক রেখে যাচ্ছে না। কিন্তু কিনো জানে, হারিয়ে ফেললেও ট্রাক খুঁজে বের না করা পর্যন্ত থামবে না ট্র্যাকাররা। কাজেই সরাসরি পাহাড়ের উদ্দেশে যাচ্ছে না ও। প্রতিপক্ষের জন্যে কষ্টসাধ্য করে তুলতে চাইছে, খোঁজার কাজটা। প্রায়ই পাথর ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় ছাপ ফেলছে সে। তারপর আবার ফিরে এসে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উঠে যাচ্ছে হুয়ানার কাছে। রাস্তাটা যেন ফুরোবে না, উঠছে তো উঠছেই। ভারী শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে হুয়ানার আর কিনোর।
প্রবেশ করতে সূর্য হেলে পড়ল পশ্চিমে। উপত্যকাটা অন্ধকার, ছায়াময় কয়েকটা ছোটখাট ঝোপ-ঝাড়ের দেখা মিলল। পানি ফুরিয়ে গেছে। কিনোর মনে হলো, ঝোপের আশপাশে পানি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু উপত্যকাটা ওদের জন্যে বিপজ্জনক, কেননা শত্রুপক্ষও পানির খোঁজ করবে।
কিনো ঠিকই ভেবেছিল। ঝোপের জটলার কাছে একটা ডোবা। পাহাড়চূড়া থেকে বরফ গলা ঝর্ণাধারা নেমে এসে ওটার সৃষ্টি করেছে। ডোবাটার পাশে ঝোপ-ঝাড় আর লম্বা লম্বা দূর্বা ঘাস জন্মেছে। ছোট্ট, বালুময় তীরটায় অসংখ্য জন্তু-জানোয়ারের পায়ের ছাপ। এখানে পানি খেতে আসে ওরা।
পানির কাছে ওরা যখন পৌঁছল, সূর্য তখন পাহাড়ের ওপাশে ডুব মেরেছে। এখান থেকে দূরবর্তী সাগর দেখা যায়। ওরা স্বামী-স্ত্রী শারীরিক-মানসিক ধকলে ভয়ানক ক্লান্ত। হাঁটুর ওপর ধপ করে বসে পড়ে বাচ্চার মুখ ধুইয়ে দিল হুয়ানা। তারপর বোতল ভরে নিয়ে পানি খাওয়াল।
তৃষ্ণার্ত কিনো আঁজলা ভরে পানি তুলে আকণ্ঠ পান করল। তারপর সটান হলো ডোবার ধারে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। দৃষ্টি প্রসারিত করল পাহাড়ের গা বরাবর নিচের দিকে। যা দেখল তাতে জমে গেল সে। পাহাড়ের পায়ের কাছে পৌঁছে গেছে ট্র্যাকাররা। যদিও বহু দূরে এখনও ওরা। কিনোর চোখে এখনি থেকে ওদেরকে পুতুলের মত দেখাল।
হয়না ঘুরে চাইল, কিনো কি করছে দেখতে।
আর কদূর? স্বামীকে থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধাল।
সন্ধে নাগাদ এখানে পৌঁছে যাবে।
চোখ তুলে উপত্যকার দিকে তাকাল কিনো, ঝর্ণাধারা নামছে যেখান থেকে।
আরও উচুতে উঠে যেতে হবে আমাদের, বলল ও।