বাকের পরিবারের সবাই খুব ভাল, চমৎকার ব্যবহার। বাড়িটাও সুন্দর। সামনের দরজায় পেতলের হাতল। বসার ঘরে খাট-পালঙ্ক নেই, অথচ শহরের অনেক বৈঠকখানায় অমনটা দেখেছি আমি। ইটের তৈরি বিশাল ফায়ারপ্লেস। ম্যাপিসের ঠিক মাঝখানে একটা আজব ধরনের ঘড়ি। ঘড়িটার নিচের অংশে কাচের ওপর একটা শহরের ছবি আঁকা। তার মধ্যিখানে সূর্যের মত গোল ফাঁকা অংশ। সেখান দিয়ে পেন্ডুলামের দোলা দেখা যায়। তবে সবচেয়ে মজার জিনিস ওটার বাজনা। দেড়শবার না বেজে ক্লান্ত হয় না।
ঘড়ির দুপাশে দুটো টিয়া পাখি। চকমাটি জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। বেশ রংচঙে। একটা টিয়ার সামনে বেড়াল, আরেকটার সামনে কুকুর রাখা। দুটোই চিনেমাটির। কামরার মাঝখানে একটা টেবিল। তার ওপর চিনেমাটির আপেল কমলা আঙুর থরে থরে সাজান। ওগুলো দেখতে আসলের চেয়েও সুন্দর। কেবল দুএক জায়গায় চটা উঠে যাওয়ায় নকল বলে চেনা যায়।
টেবিলের ওপর চমৎকার অয়েক্লথ পাতা। তাতে ডানা মেলা লাল-নীল ঈগলের ছবি। ছবির চারদিকে রঙিন বর্ডার। অয়েলক্লথটা ফিলাডেলফিয়া থেকে আনা, জানাল ওরা। টেবিলের চার কোণে থাক থাক বই। ওগুলোর ভেতর একটা আবার বিরাট আকারের পারিবারিক বাইবেল, ছবিতে ভর্তি।
দেয়ালে ছবির গ্যালারি। বেশির ভাগই ওঅশিংটন, লাফায়েত এ ধরনের নামকরা লোকেদের। যুদ্ধের ছবিও আছে কয়েকটা। রঙিন পেন্সিলে আঁকা ছবি দেখলাম। ওগুলোকে নাকি ক্রেয়ন বলে, ওরা জানাল।
এগুলো আমার এক বোনের আঁকা, বলল বাক। ওর নাম এমেলিন। ওর বয়স যখন পনের, তখনকার আঁকা। মারা গেছে সে।
এতদিন আমি যেসব ছবি দেখেছি, তার সাথে এগুলোর মিল নেই। সাধারণত যা দেখা যায় তার চেয়ে একটু বেশি কালো। একটা ছবি আমার কাছে ভারি অদ্ভুত ঠেকল। ছবিটা অসম্পূর্ণ। লম্বা সাদা গাউন পরা এক যুবতী, ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে লাফিয়ে পড়ার জন্যে। চুল পিঠ বেয়ে নেমেছে। চাঁদের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। দুচোখে অশ্রুর ধারা। হাত বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। এছাড়াও আরও চারটে হাত আঁকা ছবিতে। তার এক জোড়া সামনে প্রসারিত, বাকি দুহাত চাঁদের দিকে তোলা। ছবিটা শেষ করার আগেই মারা যায় এমেলিন। ওর ইচ্ছে ছিল সবচেয়ে সুন্দর হাত দুটো রেখে বাকিগুলো মুছে দেবে। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত।
বাকের বাবা, কর্নেল গ্র্যানজারফোর্ড খাঁটি ভদ্রলোক। অমায়িক। লম্বা, ছিপছিপে গড়ন। তামাটে রং। মুখে একগাছা দাড়ির চিহ্ন নেই, রোজ সকালে ক্ষৌরি করা চাই। পাতলা ঠোঁট। বাঁশির মত খাড়া নাক। ঘন ভ্রু, আর এক জোড়া গভীর কালো চোখ। তাকালেই মনে হয় যেন অন্তস্তল পর্যন্ত সব দেখে নিচ্ছেন। উঁচু, চওড়া কপাল। ধবধবে সাদা বাবরি চুল। তার মত অমন দীর্ঘ, সরু হাত আমি আর কখনও দেখিনি। রোজ সকালে ধোয়া শার্ট আর সাদা স্যুট পরেন। এত সাদা যে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রোববারে পরেন একটা নীল টেইল কোট। তাতে পেতলের বোতাম লাগান। যেখানেই যান, মেহগনি কাঠের একখানা ছড়ি থাকে তার হাতে। সেটার বাট রুপো দিয়ে বাঁধানো। কখনও জোরে কথা বলেন না। অত্যন্ত দয়ালু। দেখামাত্র এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে মনে ধরেছিল আমার।
সবার বড় বব। তারপর টম। দুজনেই সুপুরুষ। চওড়া কাঁধ। দীর্ঘকালো চুল। আর ঠিক বাপের মত গভীর কালো চোখ। ওরাও, বৃদ্ধের মতই, সাদা স্যুট আর চওড়া শোলার টুপি পরে।
ওই দুজনের পরেই জিম শার্লট। পঁচিশ বছর বয়েস। দীর্ঘকায়। চমৎকার ব্যক্তিত্ব। দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে, ঠিক তার বাবার মত।
মিস সোফিয়ার স্বভাব আবার একদম এর উল্টো। ঘুঘুর মত শান্ত আর মিষ্টি। বয়েস মাত্র কুড়ি। এদের প্রত্যেকেরই একজন করে খাসচাকর আছে। নিগ্রো।
এরা ছাড়াও আরও তিন ভাই ছিল ওদের। খুন হয়েছে তারা। আর এমেলিনের কথা তো আগেই বলেছি। গ্র্যানজারফোর্ডরা বেশ কয়েকটা খামারের মালিক। নিগ্রো চাকর একশোর ওপর। প্রায়ই দূর-দূরান্ত থেকে ঘোড়ায় চড়ে অনেক লোক আসে এদের বাসায়। পাঁচ-ছদিন থাকে। খুব আমোদ-ফুর্তি হয় তখন।
এদের সমকক্ষ আর একটি মাত্র বংশ ছিল ওই এলাকায়। ওরাই হচ্ছে শেফার্ডসন পরিবার। এই দুই পরিবারের মধ্যে আবার শত্রুতা ছিল। একদিন তার নমুনা দেখলাম আমি।
বাক আর আমি জঙ্গলে শিকারে গেছি, হঠাৎ ঘোড়র পায়ের আওয়াজ পেলাম।
জলদি! শিগগির ঝোপের আড়ালে লুকোও, বলল বাক।
তা-ই করলাম আমরা। একটু বাদে দেখলাম, সুদর্শন এক যুবক ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। সৈনিকের মত দেখাচ্ছে তাকে। জিনের সামনে বন্দুক ঝোলান। ওকে আগেও দেখেছি আমি—হারনি শেফার্ডসন। চোখের পলকে বাকের গুলিতে হারনির টুপি উড়ে গেল। হারনি ঘোড়া ছুটিয়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে আসতেই চম্পট দিলাম আমরা। বাককে নিশানা করে দুবার গুলি ছুড়ল সে, কিন্তু লাগাতে পারল না। তারপর, হয়ত টুপিটা উদ্ধার করতেই, যেদিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকে চলে গেল হারনি। আমরাও বাসায় ফিরে এলাম।
সব শুনে বৃদ্ধের চোখ জ্বলে উঠল- আমার মনে হল আনন্দেই হল অমনটা-তারপর মুখের পেশিতে ঢিল পড়ল, স্নিগ্ধ হয়ে এল চেহারা। ঠিকই করেছ, বললেন তিনি। তবে এরকম পেছন থেকে গুলি ছোড়া আমি পছন্দ করি না। তুমি রাস্তায় উঠে এলে না কেন, বাবা?
ওরাও তো বরাবর পেছন থেকেই হামলা করে, বাবা।
বাকের গল্প শোনার সময়ে মিস শার্লটের চোখজোড়া জ্বলে উঠল। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল ওদের বড় দুভাই। মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ক্রুদ্ধ হয়েছে তারা। কিন্তু মিস সোফিয়ার মুখ প্রথমে মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল; তারপর যেই শুনল হারনির কিছু হয়নি, স্বাভাবিক হয়ে এল চেহারা।
পরে এক সময় বাককে জিজ্ঞেস করলাম আমি, বাক, তুমি কি ওকে খুন করতে চেয়েছিলে?
আলবত।
তোমার কোন ক্ষতি করেছে সে?
না।
তবে?
এ আমাদের পারিবারিক বিবাদ।
পারিবারিক বিবাদ? সে আবার কী জিনিস?
পারিবারিক বিবাদ এইভাবে হয়, বাক বলল, মনে কর, দুজন লোকের ঝগড়া। একজন আরেকজনকে মেরে ফেলল। তখন নিহত লোকের ভাই বদলা নিল, খুন করল সেই লোককে। এরপর এল আর ভাইয়েরা। এদিকে যেমন এল, ওদিকেও তেমনি এসে একে অপরকে মারতে লাগল। তারপর এল তাদের চাচাত ভাইয়েরা। এভাবেই সবাই খতম হয়ে যায়, এবং শত্রুতাও শেষ হয়। তবে ব্যাপারটা খুবই ঢিমেতালে এগোয়, সময় লাগে প্রচুর।
তোমাদের ঝগড়া কী নিয়ে, জমি?
ঠিক জানি না। বাবা হয়ত জানে। তা প্রায় তিরিশ বছরের লড়াই; কী থেকে এর সূত্রপাত, আজ আর কারো মনে নেই বোধহয়।
পরের রোববার গির্জায় গেলাম আমরা। শেফার্ডসনদের দেখলাম সেখানে। দুপক্ষই বন্দুক নিয়েছে সঙ্গে। দুহাঁটুর মাঝখানে, কিংবা কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছে, যাতে দরকারমত হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। খুব সাদামাঠাভাবে ভ্রাতৃপ্রেমের ওপর বক্তৃতা দিল পাদ্রি। একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। তবে ওরা সবাই বলল, ভালই হয়েছে বক্তৃতাটা। ফেরার পথেও ইনিয়ে-বিনিয়ে সেই একই কথা বিশ্বাস, সৎকাজ, ভাগ্যের লিখন, যার মাথামুণ্ডু বুঝি না আমি বলল ওরা। আমার মনে হল জীবনে এ পর্যন্ত যে কটা বিরক্তিকর রোববার কাটিয়েছি, এটা তার একটা।
লাঞ্চের পর ঝিমুতে লাগল সবাই। রোদ-ছাওয়া ঘাসে টানটান হয়ে ঘুমুচ্ছে বাক আর একটা কুকুর। কেমন যেন বিষন্ন পরিবেশ। আমিও ঠিক করলাম একটু গড়িয়ে নেব। দোতলায় যেতেই মিস সোফিয়া তার ঘর থেকে ডাকল আমায়।
জর্জ, আমি ঘরে ঢুকতেই বলল সে, চার্চে আমার বাইবেলটা ফেলে এসেছি। তুই এনে দেনা, ভাই। কাউকে বলিস না যেন, কেমন!
কথা দিলাম মিস সোফিয়াকে, কাউকে বলব না। নিশ্চয়ই এর ভেতর কোন কিন্তু আছে, গির্জায় যাবার পথে মনে হল আমার। নইলে সামান্য একটা বাইবেরে জন্যে অমন ঘেমে উঠবে কেন মেয়েটা। বাইকেলটা হাতে নিতেই ওটার ভেতর থেকে একটা কাগজ টুপ করে মাটিতে পড়ল। তার ওপর পেন্সিলে লেখা: আড়াইটে। বাইবেলটা ভাল করে দেখলাম উলটে-পালটে, কিন্তু আর কিছুই পেলাম না। লেখাটার কিছুই বুঝলাম না আমি। কাগজটা আবার বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম।
বাসায় ফিরে দেখলাম আমার জন্যে দরজায় অপেক্ষা করছে মিস সোফিয়া। আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। কাগজটা বের করে পড়ল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই খুব ভাল।
লক্ষ্য করলাম, খুশিতে তার মুখ লালচে দেখাচ্ছে। দুচোখে তারার উজ্জ্বলতা। নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। মিস সোফিয়ার অদ্ভুত ব্যবহারের কথা ঘূর্ণির মত পাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার নিগ্রো চাকর পেছন পেছন আসছে। বাড়িটা চোখের আড়াল হতেই দৌড়ে এল সে।
মাস্টার জর্জ, ও বলল, চলেন আপনাকে জংলী তরমুজের ক্ষেত দেখিয়ে আনি।
ওর কথায় একটু বিস্মিত হলাম, এর আগেও একদিন আমাকে এই প্রস্তাব দিয়েছে ও। অথচ জংলী তরমুজ খায় না লোকে। তবু, কৌতুহল দমন করতে না পেরে, গেলাম ওর সঙ্গে।
প্রায় মাইলটাক দূরে আমাকে নিয়ে গেল সে। বেশির ভাগ জায়গাই জলা, থিকথিকে কাদা। অবশেষে ছোট্ট একটা দ্বীপে এসে উঠলাম আমরা। শুকনো, খটখটে। চারদিকে ঘন ঝোপ আর আঙুর লতায় ভরা।
যান, মালিক, দেখে আসুন গিয়ে, জ্যাক বলল।
কথা শেষ করে চলে গেল সে। আমি ঝোপের ভেতর ঢুকলাম। খানিক যেতেই একটা ফাঁকা জায়গায় পৌছুলাম। জায়গাটা আয়তনে একটা কামরার সমান। আঙুর লতায় ঢাকা পড়েছে চারপাশ। একটা লোক ঘুমিয়ে আছে সেখানে। আরে, একি! চমকে উঠলাম। লোকটা আর কেউ নয়, আমার বন্ধু জিম। ঠেলা দিয়ে জাগালাম ওকে। আমাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল জিম।
কী হয়েছিল তোমার? জিজ্ঞেস করলাম।
সে-রাতে তোমার ঠিক পেছনেই ছিলাম, শুরু করল জিম। তোমার ডাক শুনেছি, কিন্তু উত্তর দিতে সাহস পাইনি। কারণ তাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। চোট পাওয়ায় তোমার সাথে তাল মিলিয়ে সাঁতরাতে পারিনি। তাই যখন দেখলাম, তুমি ওই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে, আমি পাশেই জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রইলাম। পরদিন খুব সকালে কয়েকজন নিগ্রোর সাথে দেখা হয়। তারাই আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। চারদিকে পানি, কুকুর আমার গন্ধ পাবে না। রোজ রাতে ওরাই আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসে। তুমি কেমন আছ না আছ, জানায়।
জ্যাককে বললেই পারতে আরও আগেই আমাকে এখানে নিয়ে আসতো।
একটু গুছিয়ে নিতে চাইছিলাম আরকি। এখন আর আমাদের কোন অসুবিধে নেই, হাক। হাঁড়িপাতিল কিনেছি। ভেলাটাও মেরামতের…
কোন ভেলা, জিম? ওর কথার মাঝে বাধা দিলাম।
আমাদেরটা!
কিন্তু সেতো চুরমার হয়ে গেছে?
না। কেবল একপাশে একটু ভেঙেছিল।
ওটা পেলে কী ভাবে?
পাড়ে ডাল-পালায় বেঁধে আটকে ছিল। এই খামারের নিগ্রোরা দেখতে পেয়ে একটা ঝাউ-ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে।
উফ! জিম! দারুণ!