পরদিন খুব ভোরে উঠলাম বিছানা থেকে উঠেই চলে এলাম ডেকে। রাতের বেলা অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে হিসপানিওলা, দ্বীপের দক্ষিণ-পুবে নিচু তীরের প্রায় আধ মাইলের মধ্যে এসে পড়েছে।
ভালমতই চোখে পড়ছে এখন দ্বীপটা। বেশির ভাগই ধূসর জঙ্গলে ছাওয়া। নিচু জমিতে ইতস্তত ছড়ানো বালিয়াড়ির হলদে রঙ কিংবা বনের মাথা ছাড়ানো তালজাতীয় বড় বড় গাছের জন্যে এই ধূসরতা কোথাও কোথাও ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু সেটা খুব বেশি জায়গায় নয়। কেমন যেন হতাশা জাগায় মনে এই রঙ। পাথুরে পাহাড় চূড়া বিশাল গাছেরও মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে উঠে গেছে। সবচেয়ে উঁচু পাহাড় স্পাই গ্লাস, সিলভার ঠিকই বলেছে, সাগর-সমতল থেকে হাজার চারেক ফুট উঁচু। মস্ত ছুরি দিয়ে কুচ করে কেটে নিয়েছে যেন কেউ খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়টার চূড়া।
তীরে আঘাত খেয়ে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছে বড় বড় ঢেউ। দুলে দুলে উঠছে হিসপানিওলা। জাহাজের এখানে-ওখানে যেখানেই কাঠের জোড়ায় সামান্যতম ফাঁক আছে, কিংবা নড়বড়ে হয়ে গেছে পেরেকের গাঁথুনি, সেখানেই বিচিত্র ক্যাচকোচ শব্দ উঠছে প্রচন্ড দুলুনিতে। ছলাৎ-ছল ছলস করে ঝাপটা মারছে ঢেউ জাহাজের কাঠের খোলসে। সব মিলিয়ে একটা আজব আর্তনাদ ছড়াচ্ছে। দুলুনির চোটে মাথা ঘুরছে আমার। ডেকের রেলিঙ চেপে ধরে কোন মতে সামলে রেখেছি নিজেকে। দুরন্ত ঢেউয়ে এমন দুলুনিতে এই প্রথম পড়েছি তো, কেমন যেন অসহ্য ঠেকছে। তার ওপর খালি পেট, নাড়িভুড়িসুদ্ধ যেন বেরিয়ে আসবে এমনি মোচড় মারছে পেট।
কিন্তু তবু ডেক ছেড়ে যেতে মন চাইল না। সূর্য উঠেছে সবে। সোনালি হয়ে উঠেছে বনের শিশির ঢাকা গাছপালার মাথায় পাতার চাঁদোয়া। পাখপাখালির কলকাকলি এত দূর থেকেও শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তবু কেন যেন বনের বিষণ্ণ ভাবটা কাটছে না। পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণি আর ফেনার সৃষ্টি করেছে লোনা পানি। কে জানে, হয়ত এই দৃশ্যই আমার মনে জলদস্যদের চিন্তার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, আর এই জন্যেই প্রকৃতির এমন চোখ জুড়ানো রূপও বিস্বাদ ঠেকছে আমার চোখে।
হিসপানিওলায় নতুন আরেক দিন শুরু হয়েছে। সামনে প্রচুর কাজ। বাতাসের চিহ্নমাত্র নেই। মাইল তিন-চার ঘুরে খাঁড়ি ধরে গিয়ে স্কেলিটন আইল্যান্ডে নোঙর ফেলবে জাহাজ, কিন্তু তার আগেই নৌকাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নামাতে হবে।
ক্রমেই ওপরে উঠছে সূর্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রচন্ড গরম। এই সকালেই দর দর করে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে আমার কপাল বেয়ে।
নাবিকেরা পরিষ্কার করল নৌকাগুলো। পুলিতে আটকানো দড়িতে বেঁধে নিচে নামাল। কয়েকজন নাবিক গিয়ে উঠল কয়েকটা নৌকায়। আমাকে নৌকায় ওঠার আহ্বান জানাল একজন। এগিয়ে গেলাম। আমি নৌকায় নামতে না নামতেই কোথায় যেন কি একটু ভুল হল, গালাগাল দিয়ে উঠল অ্যান্ডারসন নামে এক নাবিক।
লক্ষণ খারাপ। এতদিন সবাই একটা বিশেষ নিয়মে বাঁধা ছিল, কিন্তু দ্বীপে পৌঁছতে না পৌঁছতেই কেমন যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে নাবিকেরা। অথচ জাহাজের গায়ে এখনও নৌকাগুলো বাঁধাই আছে। হালের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে জন সিলভার। বাবুর্চির কাজ নয় এটা, কিন্তু দ্বীপটা সিলভারের চেনা বলে তাকেই পথ দেখাতে আদেশ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সিলভার।
খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে জাহাজ। নিচে নৌকায় থেকেই শুনতে পেলাম সিলভারের গলা, ভাটায় টান পড়েছে। এখন তো যাচ্ছে, কিন্তু আগে কিছুতেই এখান দিয়ে ঢুকত না জাহাজ। কোদাল দিয়ে কেটে গভীর করা হয়েছে এই পথ।
ম্যাপে দুটো প্রাকৃতিক বন্দর দেখানো আছে। একটা বন্দরের কাছে নিয়ে আসা হল জাহাজ। জায়গাটার এক দিকে দ্বীপের মূল ভূখন্ড, অন্যদিকে স্কেলিটন আইল্যান্ড। দুটোই এখান থেকে সমান দূরে। কাচের মত স্বচ্ছ এখানে পানি, তলাটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। চমৎকার বালি বিছানো।
নোঙর নামানোর আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। শেকলের বিচ্ছিরি কিচকিচ শব্দে কাছের গাছপালার শাখা থেকে উড়াল দিল ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। ওগুলোর চিৎকারে শেকলের শব্দ ঢেকে গেল। নোঙর নামানো শেষ হতেই আবার একে একে গিয়ে গাছে বসে পড়ল। থেমে গেল কোলাহল।
পানির কিনারে নেমে এসেছে গাছপালা। জোয়ারের পানি কতটা উঠে, সীমানা মেপে দিয়েছে যেন। অসংখ্য সরু সরু খাল ঢুকে গেছে বনের ভেতরে।
ম্যাপে দেখানো আছে, বনের ভেতরে এদিকেই কোথাও দুর্গ আছে একটা, কিন্তু গাছপালার জন্যে চোখে পড়ছে না। কেমন যেন একটা আদিম ছাপ রয়েছে এখানকার গাছপালা পাহাড় জঙ্গল সাগরে। ম্যাপটা না থাকলে ঠিক মনে করতাম, এই এলাকায় এই প্রথম মানুষের পা পড়ল।
বাতাস একেবারেই বন্ধ। কোলাহলমুখর প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বেলাভূমিতে কিংবা পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়া ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কেমন একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে, পাতা আর গাছের গুড়ি পচলে যেমন হয়।
শুধু নোঙরের ওপর ভরসা করা গেল না। তীরের একটা বড়সড় গাছের কাছে নৌকা নিয়ে গেল অ্যান্ডারসন। কাছির এক মাথা শক্ত করে গাছের সঙ্গে বেঁধে অন্য মাথা বেঁধে দেয়া হল জাহাজের ডেক সংলগ্ন একটা মোটা খুঁটিতে। জোয়ার এলে যেন ভেসে যেতে না পারে জাহাজ এর জন্যেই এই ব্যবস্থা।
জাহাজে ফিরে এলাম আবার। ডেকের রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছেন ডাক্তারচাচা, মুখচোখ বিকৃত। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, গুপ্তধন কি আছে আছে ঈশ্বরই জানে, কিন্তু এখানে রোগ ছড়াবার উপকরণ আছে প্রচুর!
নাবিকদের ব্যবহার ক্রমেই আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে। যে-কোন সামান্য ব্যাপারেও মেজাজ দেখাচ্ছে ওরা। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মানতে চাইছে না কেউ। বিদ্রোহের চাপা আগুন জ্বলছে ভেতরে ভেতরে। যে কোন মুহূর্তে দাউ দাউ করে বেরিয়ে আসবে লকলকে শিখা।
দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লঙ জন। এখুনি যাতে কেউ কিছু না করে বসে এই জন্যে বোঝাচ্ছে নাবিকদের। রান্নাঘরের কাজ বাদ দিয়ে ক্রাচ বগলে চরকির মত পাক খাচ্ছে সারা ডেকে। চূড়ান্ত ভদ্রতা দেখাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার সহযোগিতার অন্ত নেই।
সকাল তো গেছেই, দুপুরও গেল প্রচন্ড চাপা উত্তেজনার মাঝে। এল বিকেল। প্রকট হয়ে উঠল কেমন এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা। আমাদের চেয়েও যেন বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে জন সিলভার।
কেবিনে আমাদের সভা বসল। আমাদের মানে, আমি, ডাক্তারচাচা, জমিদার ট্রেলনী, ক্যাপ্টেন স্মলেট, হান্টার, জয়েস আর রেডরুথ এই সাতজন।
কি করা যায়, জমিদারের এই প্রশ্নের জবাবে বললেন ক্যাপ্টেন, আপাতত কিছু করার নেই। নাবিকদের যে-কোন খারাপ ব্যবহার এখন সহ্য করতে হবে মুখ বুজে। এমনিতেই খেপে আছে ওরা, বারুদে আগুনের ফুলিঙ্গ ছোঁয়ানো যাবে না কিছুতেই। যেকোন মুহূর্তে যা খুশি করে বসতে পারে ওরা এখন। বিদ্রোহ দমন করতে পারে এমন একটা লোকই আছে এখন জাহাজে।
কে সে? জিজ্ঞেস করলেন জমিদার।
লঙ জন সিলভার। ওই একপেয়ে লোকটাই শুধু দমন করে রাখতে পারবে নাবিকদের।
কিন্তু হঠাৎ এমন পাগল হয়ে উঠল কেন ওরা?
ওরা ভাবছে, সারাটা দ্বীপে ছড়িয়ে আছে শুধু সোনা আর সোনা। আসলে দ্বীপে নেমে যেতে চাইছে ওরা। কার আগে কে ধনরত্ন কুড়িয়ে নেবে এই ভাবনা। ওদেরকে এখন নামতে দেয়াই উচিত। সবাই নামবে না অবশ্যি। কিন্তু যারা নামবে তারা খালি হাতে ফিরে এলেই সবার মাথা ঠান্ডা হবে। কোন ছুতো দেখিয়ে ওদের দ্বীপে নামার নির্দেশ দিই, কি বলেন, স্যার?
জমিদার আর ডাক্তারচাচার দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেনের কথাই মেনে নেয়া হল। আমাদের সাতজনকেই একটা করে গুলিভরা পিস্তল দিলেন ক্যাপ্টেন। মীটিঙ শেষ হল।
ডেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন না, খানিকক্ষণ খামোকই ঘুরলেন সারা ডেকে! নাবিকদের বোঝাতে চাইলেন, প্রচন্ড গরমে অস্বস্তি বোধ করছেন। তারপর একজন নাবিককে ডেকে বললেন অন্যদেরকে ডেকে নিয়ে আসতে। এল সবাই। কারও মুখ গোমড়া, কেউ বা গজ গজ করছে।
বললেন ক্যাপ্টেন, সাংঘাতিক গরম পড়েছে আজ! জাহাজে তো টিকতেই পারছি। এক কাজ কর, দ্বীপে নেমে বেড়িয়ে এস খানিকক্ষণ। গাছপালার ছায়ায় অনেক ঠান্ডা। শোনো, সূর্য ডোবার আধঘন্টা আগে ব্লাঙ্ক ফায়ার করব আমি। শব্দ শুনলেই কিন্তু চলে আসবে আবার। কি, যাবে?
সমস্বরে প্রচন্ড চিৎকার করে উঠল নাবিকেরা, আনন্দে। নিমেষে বিরক্তিভাব দূর হয়ে গেল ওদের চেহারা থেকে। পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে উনিশজন লোকের সম্মিলিত জোরালো চিৎকার। আবার গাছের ছায়া ঢাকা ডাল ছেড়ে আকাশে উঠে গেল পাখির দল। পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে আর চেঁচাচ্ছে ওরা।
কেউ কেউ গিয়ে রেলিঙ টপকেছে, নৌকায় নামবে। ধমকে তাদের ফেরাল সিলভার। সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে ফিরে এলেন বুদ্ধিমান ক্যাপ্টেন। নাবিকদের দলপতি সিলভার, এটা তিনি জেনেও না জানার ভান করছেন যতটা সম্ভব। সবাই যেতে চাইছে দ্বীপে, কিন্তু বারণ করল সিলভার। ঠিক হল, সিলভারসহ তেরোজন যাবে, বাকি ছজন থেকে যাবে জাহাজে। রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে সবই দেখলাম, শুনলাম আমি।
দুর্বুদ্ধিটা মাথায় ঢুকল এই সময়ই। সিলভার তো যাচ্ছে, আমিও যাই না কেন সঙ্গে? আড়ালে লুকিয়ে ওরা কি বলাবলি করে শুনব? আশা করছি সিলভার আমাকে সঙ্গে নেবে।
এগিয়ে গিয়ে সিলভারকে জানালাম আমার ইচ্ছে। সানন্দেই রাজি হল সে।
একে একে নৌকায় নেমে গেলাম সবাই। সিলভারের নৌকায় উঠলাম আমি। মরা মানুষের সিন্দুকটায়… সমস্বরে গান ধরল ডাকাতেরা, দাঁড় বাইতে লাগল সমান তালে। আমাদের নৌকাটা তীরের ঘাট ছুঁতে না ছুঁতেই লাফিয়ে নেমে পড়লাম। নৌকা থেকে চেঁচিয়ে উঠল সিলভার। কিন্তু তার সমস্ত সাবধান বাণীকে আগ্রাহ্য করে ছুটে ঢুকে পড়লাম ঘন গাছপালার অরণ্যে।