একটা পাইন গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে সে। বনমানুষ না ভালুক, বোঝার উপায় নেই। মাথার লালচে, জট পাকানো লম্বা লম্বা চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। হাতে পায়ে বড় বড় নখ। ছাগলের ছালে ঢেকে রেখেছে শরীর। চামড়ার রঙ সাদা।
কি করব আমি এখন? একদিকে ডাকাতের দল, অন্যদিকে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে শ্বেতাঙ্গ বনমানুষটা। সামনে পাহাড়। কোন্ দিকে যাই?
লাফিয়ে উঠে পাহাড়ের দিকেই ছুটলাম। জান তো বাঁচাই, তারপর পথ খুঁজে নিয়ে জাহাজে ফেরার ব্যবস্থা করব।
কিন্তু আমি কয়েক পা যেতে না যেতেই ছুটে এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল বনমানুষ। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি মানুষ।
থমকে গেলাম। এই বন মানুষটা তাহলে ইংরেজ!
কে তুমি?
আমি বেন গান। হতভাগ্য এক ইংরেজ নাবিক। গত তিনটে বছর ধরে পড়ে আছি এই দ্বীপে, একা।
জাহাজডুবি হয়েছিল বুঝি?
না। আমাকে দ্বীপান্তর দিয়ে গেছে ওরা।
এধরনের ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা আমি শুনেছি, জলদস্যুদের মাঝে এই প্রথা প্রচলিত। দলের কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি হিসেবে একটা নির্জন দ্বীপে নির্বাসন দিয়ে যায় ডাকাতেরা। একটা বন্দুক, কিছু গুলি আর সামান্য খাবারও দিয়ে যায়। কিন্তু এতে আর কদিন চলে? খাবার আর গুলি ফুরিয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না খেয়ে মারা যায়। নির্বাসিত লোকটি।
তিন বছর ধরে ঝিনুক, ছাগলের মাংস আর বুনো ফলমূল খেয়ে বেঁচে আছি আমি, আবার বলল বেন গান। কিন্তু ইংরেজদের সত্যিকারের যে খাবার..ইসস, মেট, কতদিন চোখে দেখিনি। কতদিন পনিরের জন্যে মনটা আইডাই করেছে, কতদিন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি টেবিলে পনিরের স্তুপ, কিন্তু ঘুম ভেঙে যে-কে সেই। সেই আঁশটে ঝিনুক…এসব খাওয়া যায় সব সময়? শুধু বাঁচার তাগিদে গিলেছি।
আমি জাহাজে ফিরতে পারলে পেট পুরে পনির খাওয়াব তোমাকে, বললাম।
ফিরতে পারলে মানে? রোমশ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে চাইল বেন গান।
পথ হারিয়েছি।
কোন ভয় নেই। পুরো দ্বীপটা আমার চেনা। জঙ্গলের প্রতিটা গাছ, পাহাড়ের গুহা, খানাখন্দ, ঝর্না, সব চিনি আমি। কোথায় তোমার জাহাজ?
স্কেলিটন আইল্যান্ডের ওদিকে।
তাহলে তো কাছেই। চল আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু আরও ব্যাপার আছে… দ্বিধা করলাম। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, জলদস্যুরা আছে আশপাশে।
জলদস্যু! এই দ্বীপে আবার জলদস্যু!
হ্যাঁ, লঙ জন সিলভার ওদের সর্দার।
সেই একপেয়ে বদমাশটা না তো?
ঠিকই ধরেছ, সে-ই। কিন্তু তুমি চেন ওকে?
চিনব না মানে? ফ্লিন্টের দলেই তো ছিলাম আমি। সে-ই তো নির্বাসন দিয়েছে আমাকে এখানে। আমার আরও কাছে এল বেন গান। মুখটা একটু নামিয়ে বলল, কিন্তু সর্দার তো ছিল ফ্লিন্ট! সিলভার হয় কি করে?
ফ্লিন্ট নাকি মারা গেছে। বেশি মদ খেত…
মরবেই! কিন্তু খুশি হতে পারলাম না এ কথা শুনে। ফাঁসিতে ঝুলে মরা উচিত ছিল ব্যাটার। কি লাভ হল শুধু শুধু মানুষ খুন করে? টাকা জমালি ঠিকই, কিন্তু ভোগ করতে পারলি? আমাকে নির্বাসন দিয়েছিস, এদিকে তোর টাকার সন্ধান পেয়ে বসে আছি আমি…
টাকা?
হ্যাঁ, ফ্লিন্টের ধনরত্ন তো সব এই দ্বীপেই লুকানো… আচমকা থেমে গেল বেন গান। সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল আমার দিকে, কিন্তু তোমাকে এসব বলা উচিত হচ্ছে না, সিলভারের দলের লোক তুমি।
না না, আমি সিলভারের দলের নই, তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ওদের ভয়েই তো পালাচ্ছিলাম। এই তো, কিছুক্ষণ আগেই দুজন লোককে খুন করেছে সিলভার আর তার লোকেরা আমাদের গুপ্তধনের সন্ধানে আসার ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানালাম বেন গানকে।
চুপ করে সব শুনল বেন গান। আমার কথা শেষ হলে বলল, বুঝেছি, তোমাকে বলা যায়। ফ্লিন্টের জাহাজের নাম ছিল ওয়ালরাস। ওটাতে করেই সমস্ত জমানো ধনরত্ন নিয়ে এই দ্বীপে এসে হাজির হয় একদিন সে। জাহাজ নোঙর করে একটা মাত্র বোট নামানোর আদেশ দেয় ফ্লিন্ট। নৌকা নামানো হল। সেই নৌকায় নেয়া হল তার সমস্ত ধনরত্ন। তারপর ছয়জন বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা ভাসাল সে। ধনরত্নগুলো নিয়ে ঢুকে গেল ওরা জঙ্গলে। কয়েক ঘন্টা পরেই নৌকা নিয়ে ফিরে এল ফ্লিন্ট, একা। আমাদের জানাল, ছজন অনুচর নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছে। ধনরত্নগুলো কোথায়, কি করেছে সে, কিছু বলল না। আমরাও সাহস করে কিছু আর জিজ্ঞেস করলাম না। হ্যাঁ, ওয়ালরাসের মেট ছিল কিন্তু বিলি বোনস…ওই যার কথা বললে আর কি, তোমাদের সরাইতে গিয়ে উঠেছিল যে… থামল একটু বেন গান। তারপর সামনে ঝুকে আমার হাত দুটো চেপে ধরল, এক কাজ কর না, মেট, আমাকে তোমাদের জাহাজে নিয়ে চল। মিস্টার ট্রেলনীকে বুঝিয়ে বল সব। ধনরত্নের হদিস আমি দেব, বিনিময়ে আমাকে ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেবেন ট্রেলনী, পুলিশকে কিছু বলবেন না, আর এক হাজার পাউন্ড দেবেন। বলবে?
অবশ্যই বলব, চল।
বুনো ছাগলের মতই নিঃশব্দ দ্রুত পদক্ষেপে গাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটল বেন গান। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে ঘাম ছুটে গেল আমার।
বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসব, এই সময় শোনা গেল কামানের গোলার আওয়াজ। তারপরেই কয়েকবার গর্জন করে উঠল বন্দুক।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বেন গান। তার পাশে এসে দাঁড়ালাম আমিও। গাছের ফাঁক দিয়ে সামনে তাকালাম। কামানের গোলাটা কোন দিকে গেল দেখার চেষ্টা করতেই চোখে পড়ল ওটা।
বড় জোর সিকি মাইল দূরে একটা গাছের মগডালে উড়ছে একটা ফ্ল্যাগ, ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা।