উত্তেজিত কথাবার্তায় সকালে ঘুম ভাঙল আমার। কে একজন বলে উঠল, একি! এ যে সিলভার!
খোঁড়া ডাকাতটার নাম কানে যাওয়ামাত্র ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে এলাম আঙিনায়। বেড়ার ফোকরে চোখ ঠেকিয়ে দেখছে আমার সঙ্গীরা সবাই। আমিও এগিয়ে গিয়ে একটা ফোকরে চোখ রাখলাম।
বেড়ার বাইরে, গাছপালার সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। একজন সিলভার, তার হাতে একটা সাদা পতাকা। দোলাচ্ছে সেটা।
হিমেল সকাল। আর খানিকক্ষণ পরই যে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে আবহাওয়া এখন সেটা ভাবাই যায় না। আকাশ উজ্জ্বল, নির্মেঘ। সূর্যের সোনালী আলো সবে গাছের ডগা ছুঁয়েছে। আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে বনভূমি।
চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন, কেন এসেছ?
শান্তি চাই আমরা, সিলভারের কণ্ঠ শোনা গেল। সন্ধি করতে এসেছি!
ব্যাটাদের কোন চাল! আস্তে করে বললেন ক্যাপ্টেন। ডাক্তারচাচাকে বললেন, বন্দুকে গুলি ভরে নিন। আপনি সামনের দিকটায় খেয়াল রাখুন। মিস্টার ট্রেলনী, আপনি দেখুন উত্তরটায়। জিম, তুমি চোখ রাখ পুবদিকে, গ্রে পশ্চিমে। জয়েস, হান্টার, তোমরা আমাদের বন্দুকে গুলি ভরে দেবার জন্যে তৈরি থাক। সাবধান! চেঁচিয়ে আবার সিলভারকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই শুভবুদ্ধি কেন হল হঠাৎ?
খামোকা রক্তারক্তি বারবিকিউর পছন্দ না! জবাব দিল এবার সিলভারের সঙ্গী।
তাই নাকি? বড় মজার কথা তো! কবে থেকে সাধু হল খোঁড়াটা?
দয়া করে ভুল বুঝবেন না, ক্যাপ্টেন! সিলভার বলল, সত্যিই কিছু কথা বলতে চাই আমি। দুদলে একটা বোঝাপড়া হওয়া ভাল। কিন্তু দূর থেকে চিৎকার করে কিভাবে সব বলি?
ভাবলেন ক্যাপ্টেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, কাছে এসো। কিন্তু সাবধান, ছয়টা বন্দুকের নল চেয়ে আছে তোমাদের দিকে।
বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল দুই ডাকাত। ক্ৰাচটা বেড়া ডিঙিয়ে এপাশে ছুঁড়ে ফেলল সিলভার। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে উঁচু বেড়াটা ডিঙিয়ে চলে এল এপাশে। অন্য ডাকাতটাও বেড়া ডিঙিয়ে এসে নামল আঙিনায়। প্রবেশপথটা অন্যপাশে। এতটা ঘুরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করল না ওদের কেউ।
পাহারার কথা ভুলে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে ক্যাপ্টেনের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সিলভারের পরনে এখন বাবুর্চির পোশাক নেই। তার বদলে দামি পোশাক পরেছে। তামার বোতাম বসানো মোটা নীল কাপড়ের তৈরি কোটের ঝুল হাঁটু পর্যন্ত নেমেছে। চমৎকার লেস লাগানো হ্যাটটা মাথার পেছন দিকে হেলানো।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন। কি বলবে, বলে ফেল চট করে।
বসতে বলবেন না? সিলভারের গলায় অনুযোগ।
ইচ্ছে করলে বালির ওপর বসতে পার। তোমার মত ডাকাতের ওই-ই উপযুক্ত জায়গা, নিস্পৃহ ক্যাপ্টেনের গলা।
অঅ!
ভেবেছিলাম বসবে না, কিন্তু ঠান্ডা বালির ওপরই সঙ্গীকে নিয়ে বসে পড়ল সিলভার। চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, চমৎকার জায়গা। আমার ওপর চোখ পড়তেই হাসল, আরে, জিম, তুমি এখানে!
কিছু বলার থাকলে বলে ফেল! কর্কশ গলায় বললেন ক্যাপ্টেন।
সরাসরি ক্যাপ্টেনের চোখের দিকে চাইল সিলভার। ক্যাপ্টেন, ফ্রিন্টের সমস্ত ধনরত্ন আমার চাই। আর আপনারা নিশ্চয় বেঁচে নিরাপদে দেশে ফিরে যাওয়াটাই সবদিক থেকে বিবেচ্য মনে করবেন। একটা ম্যাপ আছে আপনাদের কাছে, না?
থাকলে?
ওটা দিতে হবে আমাকে।
বাজে বকছ, পকেট থেকে পাইপ বের করলেন ক্যাপ্টেন। ধীরেসুস্থে তামাক পুরে ধরালেন। নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এটা তোমাকে দেবার জন্যে এত কষ্ট করে ট্রেজার আইল্যান্ডে আসেননি মিস্টার ট্রেলনী। পারলে অবশ্য ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে দেখতে পার, কিন্তু সফল হবে না। সেটা তুমি ঠিকই বোঝ, নইলে এখানে মিন মিন করতে আসতে না।
চুপচাপ কি ভাবল সিলভার। হাসল। বলল, আপনাকে দেখে আমারও পাইপ ধরাতে ইচ্ছে করছে।
কোন কথা বললেন না ক্যাপ্টেন। সিলভারকে পকেটে হাত দিতে দেখেও নীরব রইলেন। পকেট থেকে পাইপ আর তামাক বের করে ধরাল সিলভার। নীরবে দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পাইপ টেনে চলল। মজার দৃশ্য!
আগে কথা বলল সিলভারই, ক্যাপ্টেন, এভাবে জেদাজেদি করে কারোই কোন লাভ হবে না। আমার প্রস্তাব দেখুন পছন্দ হয় কিনা। আপনারা সমস্ত ধনরত্ন আমাকে দিয়ে দেবেন। কথা দিচ্ছি, আপনাদের নিরাপদ কোন জায়গায় পৌঁছে দেব হিসপানিওলায় করে। যদি এটা পছন্দ না হয়, অন্য উপায়ও আছে। প্রয়োজনীয় সমস্ত মালপত্র আমরা দুদলের মধ্যে ভাগ করে নেব। তারপর গুপ্তধন নিয়ে চলে যাব আমরা। আপনারা দ্বীপেই থেকে যাবেন। কথা দিচ্ছি এবারেও, পথে প্রথম যে জাহাজটাকে দেখব, আপনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পাঠাব।
পোড়া তামাকটুকু ফেলে দিলেন ক্যাপ্টেন। পাইপের মাথার দিকটা ঠুকলেন বাঁ হাতের চেটোয়। মুখ না তুলেই সিলভারকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলার আছে তোমার?
না।
তাহলে আমার প্রস্তাব শোন এবার। পুরো নিরস্ত্র হয়ে একজন একজন করে দুর্গে আসবে তোমরা। লোহার হাতকড়া পরিয়ে বিচারের জন্যে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাব তোমাদের। আর যদি তাতে রাজি না হও, তোমাদের শেষ লোকটাকে খুন না করা পর্যন্ত আমি, ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার স্মলেট, এই দ্বীপ ছেড়ে নড়ছি না। কোন ভরসায় শর্ত রাখতে এসেছ? তোমাদের আছে কি? ম্যাপ নেই, গুপ্তধন পাচ্ছ না। জাহাজ আছে, কিন্তু ক্যাপ্টেনের অভাবে দ্বীপ ছেড়ে দশটা মাইলও যেতে পারবে না। মারা পড়বে। ভাল যোদ্ধা, সেটাই বা বলি কি করে? পাঁচ পাঁচজনে একটি মাত্র লোক আব্রাহাম গ্রে-কে আটকাতে পারনি। শোন সিলভার, এরপরের বার যদি আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে আস, কোনরকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই কপাল ফুটো করে দেব। বোঝা গেছে? নাউ, গেট আউট।
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সিলভারের চেহারা। হাসি হাসি ভাবটা অদৃশ্য হয়ে গেছে আগেই। দুচোখে আগুনের ঝলক। জোরে জোরে বালিতে পাইপ বুকে জ্বলন্ত তামাকটুকু ঝেড়ে ফেলল সে। পকেটে রেখে দিল আবার পাইপ। পায়ের কাছে পড়ে থাকা ক্ৰাচটা তুলে নিয়ে ওটাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর থুক করে বালিতে থুথু ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আর এক ঘন্টার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করছেন আপনারা। যাদের ভাগ্য ভাল, আমার হাতে ধরা পড়ার আগেই মারা যাবে! ক্রাচে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সিলভার। সঙ্গীকে নিয়ে এগিয়ে গেল বেড়ার কাছে।
পেছন থেকে ওকে ভয়ঙ্কর এক দানবের মত মনে হল আমার।