সিলভার চলে যেতেই আমাদের দিকে চোখ পড়ল ক্যাপ্টেনের। একমাত্র আব্রাহাম গ্রে ছাড়া কেউই নিজেদের জায়গায় নেই, সবাই চলে এসেছে কথা শুনতে। রেগে আগুন হয়ে গেলেন শ্মলেট।
যার যার নিজের জায়গায় যান! কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। মিস্টার ট্রেলনী, ডাক্তার লিভসী, আপনাদের কর্তব্যজ্ঞান দেখে অবাক হচ্ছি আমি। আপনারা নাকি যোদ্ধা ছিলেন? এই ডিসিপ্লিন নিয়ে! আপনাদের দল যে হারেনি এটাই আশ্চর্য! হাত তুলে গ্রে-কে ডাকলেন। গ্রে কাছে আসতেই বললেন, তোমার কথা ডায়েরীতে লিখে রাখছি আমি। দায়িত্বশীল নাবিকের মতোই কাজ করেছো তুমি। তোমার প্রমোশনের ব্যবস্থা আমি নিজে করব। যাও, পাহারায় যাও।
লজ্জিতভাবে মাফ চাইলেন ডাক্তারচাচা আর জমিদার ট্রেলনী। দ্রুত চলে গেলেন যার যার নিজের জায়গায়। অন্যেরাও চলে গেল।
আমি যেতে যেতে শুনলাম, বিড়বিড় করছেন ক্যাপ্টেন, ভীষণ কড়া কথা বলেছি। সিলভারকে। ও সহ্য করবে না কিছুতেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হানা দেবে দুর্গে, জানা কথা। সংখ্যায়ও বেশি। অবশ্য আমরা দুর্গের ভেতর থাকছি। তবুও…এই, এই জিম, সবাইকে ডাক তো এখানে…
আবার সবাইকে কেন ডাকছেন ক্যাপ্টেন, ঠিক বুঝলাম না, কিন্তু আদেশ পালন করলাম। সবাই এসে জড়ো হলে বললেন, যুদ্ধ আসন্ন। কিন্তু খাওয়াই হয়নি এখনও। আগে কিছু খেয়ে নেয়া যাক। তারপর নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। ওরা আসবেই…
দুর্গের ভেতরে এসে ঢুকলাম সবাই। খাবার তৈরি করে পরিবেশনের ভারটা পড়ল আমার ওপর।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল সবাই। গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললেন ক্যাপ্টেন, ডাক্তার লিভসী, দুর্গের দরজা পাহারা দেবেন আপনি। আড়ালে থাকবেন, যেন কিছুতেই ডাকাতেরা আপনাকে দেখে না ফেলে। হান্টার, পুবের ভার নেবে তুমি। জয়েস, তুমি থাকবে পশ্চিমে। মিস্টার ট্রেলনী, আপনার নিশানা সবচেয়ে ভাল। গ্রে-ও ভালোই যুদ্ধ করতে পারবে, বুঝে নিয়েছি আমি। আপনারা দুজনে সামলাবেন উত্তর দিকটা। বিপদ ওদিকেই বেশি। জিম, তুমি কেবল খালি হয়ে যাওয়া বন্দুকে গুলি ভরবে। তোমাকে আমিও সাহায্য করব। বুঝেছেন আপনারা।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল সবাই।
ঠান্ডা কেটে গেছে। প্রচন্ড গরম পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। গাছপালার মাথার ওপর উঠে এসেছে সূর্য। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বালি। দুর্গের কাঠের রজন গলতে শুরু করেছে রোদ পড়ে। জ্যাকেট খুলে ফেলেছি আগেই। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিলাম।
যার যার জায়গায় পাহারায় নিযুক্ত হল যোদ্ধারা। বন্দুক আর গোলা বারুদ জড়ো করে গুলি ভরতে লাগলাম। আমাকে সাহায্য করছেন ক্যাপ্টেন। একেকটা বন্দুকে গুলি ভরা হতেই নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিলাম একেকজন যোদ্ধার হাতে।
কেটে গেল এক ঘন্টা।
কথা রাখল সিলভার। ঠিক একঘন্টা পর গর্জে উঠল কামান। আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই নিজের জায়গায় থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল জয়েস, ক্যাপ্টেন, ডাকাতদের দেখামাত্রই গুলি করব?
অবশ্যই!
কিন্তু গুলি করার মত কাউকেই দেখা গেল না।
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। সবাই সতর্ক আমরা। কেটে যাচ্ছে সময়। হঠাৎই গুলি করে বসল জয়েস। সঙ্গে সঙ্গেই বনের ওদিক থেকে পর পর কয়েকবার গর্জে উঠল বন্দুক। তারপরই শুরু হল একটানা গুলিবর্ষণ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ, সব দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে গুলি। বিধছে কাঠের দেয়ালে। কিন্তু একটা গুলিও কাঠ ভেদ করে দুর্গে ঢুকতে পারছে না। আধ মিনিট পরে হঠাৎই আবার থেমে গেল গুলির আওয়াজ।
কাউকে লাগাতে পেরেছ? জয়েসকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
মনে হয় না!
আপনার ওদিকে কজনকে দেখেছেন, ডাক্তারসাহেব?
তিনটে বন্দুক গর্জেছে।
আপনার? ট্রেলনীকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
সাতটা হবে, ঠিক বলতে পারছি না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পূব আর পশ্চিম থেকে মাত্র একটা গুলি এসেছে। ক্যাপ্টেনের অনুমানই ঠিক। উত্তর থেকেই আসবে আসলে আক্রমণ। অন্য তিন দিকে দুয়েকজন করে রয়েছে শুধু আমাদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে।
আবার সব চুপচাপ। তারপর হঠাৎই শোনা গেল একটা হুল্লোড়। উত্তরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দুর্গের দিকে ছুটে আসছে একদল ডাকাত। ছুটতে ছুটতেই গুলি চালাচ্ছে।
সমানে গুলি চালাচ্ছেন ট্রেলনী আর গ্রে। ফোকরে চোখ রেখে দেখলাম, তিনজন ডাকাত পড়ে গেল। কতটা আহত হয়েছে, দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না, তবে মরেনি কেউই। কারণ, নিজেদের টেনে হিচড়ে নিয়ে আবার গাছপালার আড়ালে চলে গেল তিনজনেই।
মুহুর্মুহু গুলিবৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বেড়ার কাছে চলে এল ডাকাতেরা। ফোকরের ভেতর দিয়ে পুরো একশো আশি ডিগ্রী ঘোরানো যায় না বন্দুকের নল। কাজেই নলের মুখ আর এখন ডাকাতদের দিকে নিশানা করতে পারছে না। সোজা ধেয়ে এল ওরা বেড়ার কাছে। নেতা জোব অ্যান্ডারসন।
এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোকরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে থাকা হান্টারের বন্দুকের নল ধরে ফেলল এক ডাকাত, জোরে ঝাকুনি দিয়েই পিছনে ধাক্কা মারল। চোয়ালে বন্দুকের বাটের প্রচন্ড গুঁতো খেয়ে পেছনে উল্টে পড়ল হান্টার। জ্ঞান হারিয়েছে। ফোকর গলিয়ে বন্দুক বের করে নিল ডাকাতটা।
ওদিকে বেড়া ডিঙোতে শুরু করেছে কয়েকজন ডাকাত। ধপ করে লাফিয়ে নেমে খোলা ছুরি হাতে ডাক্তারচাচাকে আক্রমণ করল একজন।
বদলে গেছে পরিস্থিতি। আমাদের কায়দা করে ফেলেছে ডাকাতেরা। চিৎকার, হুল্লোড়, পিস্তল-বন্দুকের আওয়াজ ছাপিয়ে একটা আর্তস্বর শোনা গেল। একটা ছুরি নিয়ে ছুটে গেলাম শব্দ লক্ষ্য করে।
ফাঁকা জায়গায় ছুরি হাতে লড়ছেন ডাক্তারচাচা। আক্রমণকারী দস্যুর গালের একদিকে ছুরির আঘাতে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি কাছে যাবার আগেই আবার ছুরি চালালেন ডাক্তারচাচা। ফেরাতে গিয়ে বাহুতে আঘাত খেল লোকটা। বুঝে গেল, ডাক্তারচাচার সঙ্গে পেরে উঠবে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল, তারপর ঘুরেই ছুটল ঢাল বেয়ে। তাড়া করে ধেয়ে গেলেন ডাক্তারচাচা।
দুর্গের পেছনে যান সবাই, ক্যাপ্টেনের উত্তেজিত আদেশ শুনতে পেলাম।
ডাক্তারচাচার পেছনে ছুটতে গিয়েও থমকে গেলাম। মোড় নিয়ে ঘুরে ছুটলাম দুর্গের পেছনে। কিন্তু কয়েক গজ এগিয়েই একেবারে অ্যান্ডারসনের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ছুরিটা বাগিয়ে ধরে আমার দিকে তেড়ে এল অ্যান্ডারসন। ছুরির আঘাত বাঁচাতে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এলাম। কিন্তু কিসে যেন পা বেধে গিয়ে পড়ে গেলাম উল্টে। ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করল আমার দেহ। এতে ভালোই হল। আমাকে ছেড়ে গ্রে-কে আক্রমণ করল সে।
ছুরি খেলায় অ্যান্ডারসনের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ গ্রে। সহজভাবে অ্যান্ডারসনের আঘাত প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অ্যান্ডারসনের হাত আর গাল বেয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল।
ওদিকে একজোট হয়ে ডাকাতদের আক্রমণ করেছেন ডাক্তারচাচা, জমিদার আর জয়েস। দুর্গের পেছনে সবাই। বেড়ার ধারে মাটিতে বসে দেখছি। অল্পক্ষণেই পিছু হাঁটতে আরম্ভ করল ডাকাতেরা। এদিকে অ্যান্ডারসনকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে গ্রে।
উঠে পড়লাম। ছুরিটা পড়ে গেছে হাত থেকে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ডাক্তারচাচার কাছে ছুটলাম। তেমন কিছুই করতে পারব না জানি, কিন্তু তবু যদি কিছু সাহায্য করতে পারি? কিন্তু তার দরকার হল না। রণে ভঙ্গ দিয়ে বেড়ার দিকে ছুটেছে ডাকাতেরা। ইতিমধ্যেই বেড়া ডিঙোতে শুরু করেছে অ্যান্ডারসন। আর পাঁচ সেকেন্ড পর একজন জ্যান্ত ডাকাতও রইল না বেড়ার এপাশে।
ডাকাতরা পালিয়ে যেতেই লোকজন কতটা কি ক্ষতি হয়েছে জানা গেল। বেড়ার কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এখনও হান্টার। জয়েসের কাছে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন জমিদারচাচা। এগিয়ে গেলাম। ডাক্তারচাচা বসে পড়ে জয়েসকে একবার পরীক্ষা করলেন। তারপর হতাশভাবে মাথা নাড়লেন এদিক-ওদিক, সব সাহায্যের বাইরে চেলে গেছে!
স্তব্ধ হয়ে গেলেন জমিদার ট্রেলনী। চব্বিশ ঘন্টাও পেরোয়নি, এরই মাঝে দুজন বিশ্বস্ত অনুচরকে হারালেন চিরকালের মত।
সামান্য আহত হয়েছেন ক্যাপ্টেন। গুলি খেয়েছেন কাঁধের কাছে। তেমন কিছু না। ডাক্তারচাচা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। তিনিও আহত হয়েছেন। ছুরির আঘাত। হান্টারেরও জ্ঞান ফেরানো হল। আমার কব্জি থেকেও রক্ত ঝরছে, এতক্ষণ পরে খেয়াল করলাম।
কজন ডাকাত মারা পড়েছে, গুনলাম এবার। বেড়ার ভেতরে আর বাইরে পড়ে থাকতে দেখলাম পাঁচটা লাশ।