গুপ্তধনের সন্ধানে যাব এবার আমরা, জিম, আমি কাছে যেতেই বলল সিলভার। কিন্তু মোটেও ভাল লাগছে না আমার ব্যাপারটা। মোহর দেখামাত্রই পাগল হয়ে উঠবে জানোয়ারগুলো। এদিকে যদি যেতে না চাই, তাহলেও খেপে যাবে। আমাদের সারাক্ষণই হুঁশিয়ার থাকতে হবে, বুঝেছ?
ঘাড় নাড়লাম।
এই সময় আগুনের কাছ থেকে ডাকল একজন, নাস্তা তৈরি। এগিয়ে গিয়ে আর সবার পাশে বসে পড়লাম। বিস্কুট আর কিছু শুকনো ফল দিয়ে নাস্তা সারা হল।
ডাক্তারচাচা চলে যাবার পর থেকেই একটা কথা সারাক্ষণ খোঁচাচ্ছে আমাকে। তখনি জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ডাকাতদের হাতে দুর্গের ভার দিয়ে কোথায় চলে গেছেন ওঁরা? কেন? থাকছেন কোথায়? আবার যে ম্যাপ সম্বল করে এত দূর আসা হয়েছে, সেটাই বা হুট করে ডাকাতদের হাতে তুলে দিলেন কেন? এসব ব্যাপার একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে।
রওনা হলাম সবাই। আমাদের দলটা অদ্ভুত। আমি ছাড়া সবারই পরনে নাবিকের ময়লা পোশাক, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। সিলভারের সঙ্গে দুটো বন্দুক, পকেটে দুটো পিস্তল, কোমরে ঝোলানো ছুরি, কাঁধে ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট। সারাক্ষণই বকর বকর করছে তোতাটা, দুর্বোধ্য বুলি আওড়াচ্ছে।
বড় এক বান্ডিল দড়ি বইবার ভার পড়েছে আমার ওপর। দড়ির একটা প্রান্ত ধরে আমার পেছনে পেছনে কিছুক্ষণ হাঁটল সিলভার, যেন আমি সার্কাসের এক নাচিয়ে ভালুক। এই রসিকতায় হো হো করে হাসল ডাকাতেরা।
অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও সকলেই কিছু না কিছু জিনিস বয়ে নিচ্ছে। কারও হাতে মাটি খোড়ার জন্যে শাবল, কারও হাতে দুপুরের খাবার জন্যে রুটি-মাংসের ঝোলা, কারও হাতে মদের বোতল, কারও হাতে গোলা-বারুদ। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসও আছে কারও কারও হাতে।
সার বেঁধে গাছের ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে বনের বাইরে সাগর তীরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। নৌকা দুটো খুঁটিতে বাঁধা আছে। বনের ভেতর থেকে বেরোতেই প্রচন্ড রোদ ঝাপটা মারল চোখেমুখে।
নৌকার কাছে এগিয়ে গেলাম। দুটোকেই নড়বড়ে করে ফেলেছে ডাকাতেরা। একটা নৌকার হালের কাছটায় ভাঙা, মাঝির বসার জায়গা নেই। একটু নড়লেই পানি ওঠে। এই নৌকায় করে একটানা বেশিক্ষণ চলা অসম্ভব। কিন্তু ওগুলোতে চড়েই অ্যাংকোরেজ পর্যন্ত যাওয়া স্থির হল।
নৌকায় বসেই ম্যাপের সাঙ্কেতিক নিশানা নিয়ে আলোচনা করল সিলভার। লাল ক্রস দিয়ে চিহ্ন রাখা হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কার নয়। আর পেছনের লেখাটা সহজবোধ্য নয়। গুপ্তধনের সঙ্কেত সহজেই বোঝা যাবে, এটা আশাও করা যায় না অবশ্য।
টলট্রী বা লম্বা গাছ, পাই-গ্লাস শোল্ডার, মানে স্পাই-গ্লাসের কাঁধ, ইত্যাদির মানে তেমন বোঝা না গেলেও একটা ব্যাপার পরিষ্কার, স্পাই-গ্লাসের কোথাও একটা লম্বা গাছ আছে, সেটা প্রধান নিশানা।
আমাদের সামনেই ক্যাপ্টেন কিডের অ্যাংকোরেজ, একে ঘিরে আছে শ তিনেক ফুট উঁচু এক মালভূমি। উত্তরে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে স্পাই-গ্লাসের দক্ষিণ কাঁধ। তীরে নৌকা ভিড়িয়ে নামলাম সবাই।
মালভূমির চুড়ায় ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন, বড় গাছগুলোর উচ্চতা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে, চারাও আছে প্রচুর। এগুলোর ভেতর থেকেই বের করে নিতে হবে সব চেয়ে লম্বা গাছটা। ব্যাপারটা সহজ নয়।
নেতৃত্ব দিচ্ছে সিলভার, স্বভাবতই সঙ্কেত পড়ে নিশানা ঠিক করার ভারও তারই ওপর। হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। একটা, তারপর আরেকটা নদী পেরিয়ে, দ্বিতীয় নদীটার মোহনার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্পাই-গ্লাস পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা নদীটার দুই তীরে ঘন জঙ্গল।
বাঁয়ে মোড় নিয়ে খাড়া মালভূমির দিকে উঠতে লাগলাম। নদীর তীরের মাটি ভেজা, আঠালো। শক্ত মাটিতে শেকড় গেড়ে লতিয়ে লতিয়ে এই মাটির ওপর নেমে এসেছে নানা ধরনের লতাগুল্ম। কোনটার কাঁটা আছে কোনটার নেই। এগুলোর মধ্যে দিয়ে পথ চলতে ভারি অসুবিধে হচ্ছে। তবু একটু একটু করে এগিয়ে চললাম আমরা।
ক্রমেই আরও খাড়া হয়ে উঠছে পথ। শক্ত হয়ে আসছে মাটি, তার ওপর পাথর বিছানো। গাছপালা আর জঙ্গলের রূপও পাল্টাচ্ছে। সামনে মাঝে মাঝেই ফাঁকা। চমৎকার এখানকার প্রকৃতি। পথের পাশে সবুজ ঘাস, মাঝে মাঝে জন্মেছে নাম না জানা বুনো ফুলের গাছ। গাছে গাছে রঙিন ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি উড়ছে। ঘাস-বনের পাশে নাটমেগের ঝোপ, এদিক-ওদিক বিশাল লালচে পাইন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ফুলের সুবাস, নাটমেগের তীব্র ঝাঁঝ আর পাইনের মিষ্টি গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। প্রকৃতির মাধুর্যে, এখানে, অনেকখানি ম্লান হয়ে এসেছে যেন রোদের তীব্রতা।
প্রচন্ড হাকডাক হৈ হুল্লোড় করতে করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এগিয়ে চলেছি সবাই। সবার পেছনে সিলভার, আর তার আগে চলেছি আমি। ডাকাতেরা আমাদের বেশ অনেকখানি সামনে।
পায়ের নিচে বাড়ছে নুড়ি পাথরের সংখ্যা। সারাক্ষণই পা পড়ছে ওগুলোতে, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পাথর। পাশে পাহাড়ী নদীর মধুর কুলকুল আওয়াজ, যেন জলতরঙ্গের শব্দ।
খোঁড়া, তাই আলগা নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে চলতে স্বভাবতই কষ্ট হচ্ছে সিলভারের, আমি সাহায্য করছি তাকে মাঝেমধ্যে। নইলে পা ফসকে নিচে গড়িয়ে পড়ত সে অনেক আগেই।
মালভূমির চূড়ার কাছাকাছি এসে গেছি আমরা, এই সময় মহা চিৎকার শুরু করে দিল সব চেয়ে আগের লোকটা। কি ব্যাপার? সবাই ছুটলাম তার কাছে।
আমার ডান পাশ থেকে ছুটতে ছুটতে বলল মরগান, ব্যাটা অমন করছে কেন!
গিয়ে দাঁড়ালাম লোকটার পাশে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই আঙুল তুলে দেখাল। চাইলাম। একটা বিশাল পাইনের নিচে সবুজ লতাপাতায় জড়িয়ে পড়ে আছে একটা কঙ্কাল, হ্যাঁ মানুষেরই। অ্যাডমিরাল বেনবোয় ক্যাপ্টেন বোনসের অশুভ পদক্ষেপের পর থেকে অনেক বীভৎস মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু তবু কেন যেন ঠান্ডা ভয়ের একটা স্রোত শির শির করে নেমে গেল আমার শিড়দাড়া বেয়ে।
সাহস দেখাল জর্জ মেরি। কঙ্কালটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পায়ে ঠেলে কঙ্কালের ওপরের কিছু লতাপাতা সরাল। ন্যাকড়ার মত হেঁড়া পুরানো কাপড় জড়িয়ে লেগে আছে। হলদেটে হাড়ের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল জর্জ, তারপর মন্তব্য করল, লোকটা নাবিক ছিল। পোশাকটাও এককালে দামি ছিল।
এখানে নাবিক ছাড়া অন্য কেউ আসবে, আশাও করা যায় না! চিন্তিত শোনাল সিলভারের কণ্ঠ। কিন্তু কঙ্কালটার পড়ে থাকার ভঙ্গি একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?
তাই তো! এতক্ষণ তো খেয়াল করিনি! একেবারে সিধে হয়ে পড়ে আছে কঙ্কাল। শুধু তাই নয়, দুটো হাতই মাথার ওপর দিকে লম্বালম্বি হয়ে আছে। কিছু নির্দেশ করছে তো?
পকেট থেকে একটা কম্পাস বার করল সিলভার। কঙ্কালটার অবস্থান আর কম্পাসের কাটার দিক নির্দেশ মিলিয়ে দেখল ভাল করে। তারপর আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল, ঠিকই আন্দাজ করেছি। কঙ্কালটা আসলে একটা সঙ্কেত দিচ্ছে। হাত দুটো যেদিকে দেখাচ্ছে, নিশ্চয় সেদিকে কিছু আছে। কিন্তু ফ্লিন্টের রসিকতাটা দেখেছ? কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু দিয়ে সঙ্কেত বানাতে পারেনি! এ নিশ্চয় তার ছয় সঙ্গীর একজন! কিন্তু কোন জন? এগিয়ে গিয়ে কঙ্কালটার পাশে বসে পড়ল সিলভার।
খুলিতে শুকিয়ে লেগে আছে চামড়া, এখনও। তাতে চুলও লেগে আছে। সেই চুলগুলোই ভাল করে দেখল সিলভার। হাত দিয়ে মেপে দেখল কতখানি লম্বা কঙ্কাল। তারপর মুখ তুলে চাইল, অ্যান্ডারাইস। আমি শিওর।
ভয়ঙ্কর খুনী ছিল ও! গলা কেঁপে গেল মরগানের। ধার হিসেবে অনেক টাকা নিয়েছে আমার কাছ থেকে। কিন্তু চাইতে পারতাম না। চাইলেই ছুরি দেখাত! ভাবছে সে। ফ্লিন্টের সঙ্গে শেষবার এখানে আসার সময় আমার ছুরিটা নিয়ে এসেছিল! কোথায় ওটা?
আশেপাশে তো দেখছি না! বলল এক ডাকাত, পাখিরা নিশ্চয়ই ছুরি খায় না!
তাহলে কোথায় ওটা! সিলভারকে আগের মতই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
কঙ্কালের আশপাশ থেকে লতা সরিয়ে ভাল করে খুঁজে দেখল জর্জ। এদিক ওদিক মাথা দোলাল, নাই, কিছু নেই! একটা তামাকের বাক্স পর্যন্ত নেই! একেবারেই অস্বাভাবিক!
ফ্লিন্টের এটা কেমন ধরনের রসিকতা! বলল সিলভার। বুঝতে পারছি, ছয় সঙ্গীকেই খুন করে রেখে গেছে ব্যাটা। কিন্তু লাশের সঙ্গে এই ব্যবহার কেন?
এটা তো আর নতুন কিছু নয়, বলল মরগান, জানই তো, ভয়ানক লোকটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিত এভাবেই। আমাদের কপাল ভাল, মরে ভূত হয়ে গেছে ব্যাটা, নইলে এই দ্বীপে গুপ্তধনের জন্যে আসা…হুঁহ্! হাতের আঙুলে চুটকি বাজিয়ে বাকি কথাটুকু বুঝিয়ে দিল সে।
ফ্লিন্টকে দেখিনি, কিন্তু তার সম্বন্ধে ডাকাতদের কথাবার্তা শুনে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম। তার নিষ্ঠুরতার নিদর্শন তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
যাকগে, ওসব ভেবে আর লাভ নেই, বলল সিলভার। ফ্লিন্ট মারা গেছে, আর কোনদিন জ্বালাতে আসবে না। এখন চল, যে কাজে এসেছি, শেষ করি।
কঙ্কালের নির্দেশিত দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। আশেপাশের দৃশ্য এখনও আগের মতই সুন্দর, কিন্তু আর হৈ-চৈ করছে না ডাকাতেরা। প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে পাশাপাশি মেপে মেপে পা ফেলছে ওরা, একে অন্যের থেকে আলাদা হতে ভয় পাচ্ছে। কথা বলতেও চাইছে না পারতপক্ষে। ফ্লিন্ট শুনে ফেললে আক্রমণ করে বসতে পারে, এই ভয় যেন চেপে ধরেছে সবাইকে।