দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ডাকাতটা, মরগানের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে। বাইরে থেকেই ভয়ে ভয়ে চাইল সিলভারের দিকে।
ডাকাতটার দিকে একবার চোখ তুলে চেয়েই আবার ফোকরে চোখ রাখলাম। বাইরে ডাকাতেরা কি করছে দেখছি। আঙিনার এক জায়গায় আগুন ধরিয়েছে ওরা, গোল হয়ে ঘিরে বসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দূত পাঠিয়েছে। যে ছুরিটা নিয়ে আমাকে তেড়ে এসেছিল মরগান, ওটা এখনও হাতে আছে ওর। বাব বার বালিতে গাঁথছে, বের করছে। উত্তেজিত চেহারা। চাঁদের আলোয় বাইরের জঙ্গলকে কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।
এসো, ঢুকে পড়, দরজায় দাঁড়ানো ডাকাতটাকে ডাকল সিলভার। দূতকে খেয়ে ফেলি না আমি।
একবার হাস্যকরভাবে অঙ্গভঙ্গি করল লোকটা, দারুণ ভয় পাচ্ছে সিলভারের কথায়। একটু যেন ভরসা পেল, ঢুকেই পড়ল। আস্তে করে ডান হাতটা বাড়াল। মুঠোয় আছে কিছু।
কি ওটা? আমাকে বলল সিলভার। এই জিম, নাও তো দেখি।
এগিয়ে গিয়ে নিলাম। একটা কাগজের ছোট টুকরো। সিলভারের কাছে নিয়ে এসে দিলাম।
মশালের আলোয় জিনিসটা দেখল সিলভার। আমিও দেখলাম। একি?
হুমম, ঠিকই অনুমান করেছিলাম, বলল সিলভার। আমাকে ব্ল্যাক স্পট দিয়েছে! আরে, বাইবেলের পাতা ছিড়ে লিখেছে দেখছি!
হ্যাঁ, সায় দিয়ে বলল দূত।
কোন ব্যাটা ডাকাত আবার বাইবেল সঙ্গে রাখে?
ডিক।
ব্যাটা হাঁদারাম! বাইবেলটা পড়তে বলগে ওকে, মরার আগে প্রার্থনা করে নিক।
উল্টো দিকেও লেখা আছে, বলল দূত।
কাগজের টুকরোর উল্টো পিঠে হাতে লেখা কথাগুলো পড়ল সিলভার। হাসি ফুটল মুখে, বা-বা-বা! আমাকে পদচ্যুত করেছে! মাথামোটা গাধারা এছাড়া আর কি-ইবা করবে! চমৎকার জিনিস নিয়ে এসেছ হে তুমি, জর্জ!
তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে, সিলভার। ব্ল্যাক স্পট তো পেলেই, বলল জর্জ। দেখে নিয়েছে সে, সিলভারের হাতে ছুরি নেই।
তোমাদের ব্ল্যাক স্পটের কোন দামই নেই আমার কাছে, গম্ভীর হয়ে গেছে সিলভার।
আছে, এখন আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তোমাকে ব্ল্যাক স্পট দেবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই অভিযানটা তুমিই ভন্ডুল করেছ, এক নাম্বার। শত্রুদেরকে দুর্গ থেকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছ, দুই নম্বর ওদের আক্রমণ করতে চাও না, কেন কে জানে! এই হল তিন নাম্বার। আর চার নাম্বার হল, এই বিচ্ছু ছেলেটাকে বাঁচাতে চাইছ। কেন?
আর কিছু বলার আছে তোমার?
তোমাকে ব্ল্যাক স্পট দিতে এইই যথেষ্ট।
ঠিক আছে, চারটে কারণেরই উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছি। অভিযান আমি পন্ড করিনি, করেছ তোমরা। আমার কথামত চলনি, চললে আজ এই অবস্থায় পড়তে না। শত্রুদেরকে কেন ছেড়ে দিয়েছি, জিজ্ঞেস করছ? তোমরা তো মারামারি করে কেউ মাথা ফাটিয়েছ, কেউ শরীরের ওপর অত্যাচার করে রোগ বাধিয়েছ, ওই ডাক্তার লিভসী কি তোমাদের ওষুধ দেননি? সকালে দয়া করে তোমাদের না দেখলে এতক্ষণে দুনিয়ায় থাকতে কিনা, সন্দেহ। আর ক্যাপ্টেন স্মলেটকে ছাড়া দেশে ফিরবে কি করে শুনি? এখন এই বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে পড়েছ। একে মেরে ফেললে কি লাভ হবে? বরং এ বেঁচে থাকলেই আমাদের লাভ। ও আমাদের পক্ষে দুচার কথা বললেও বলতে পারে। কে জানে, দয়া করে আমাদের ছেড়েও দিতে পারেন স্কোয়্যার ট্রেলনী, কাঠের দুর্গে গম গম করছে সিলভারের ভরাট কণ্ঠস্বর। একটানা কথা বলে থেমে দম নিল খোঁড়া দস্যু। তারপর কোমরের বেল্টের খোপ থেকে অয়েল ক্লথে মোড়ানো একটা ছোট প্যাকেট বের করল। এই প্যাকেট আমার অতি পরিচিত। নাও, দেখ, বলে প্যাকেট খুলে হলদেটে ম্যাপটা বের করল সে। এগিয়ে এসে ওটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল জর্জ। একবার দেখেই চেঁচিয়ে ডাকল সঙ্গীদের।
কে কার আগে ঢুকবে, ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে এসে ঢুকল ডাকাতগুলো। বেড়াল যেমন ইঁদুরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তেমনি ওরাও ম্যাপটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। একজনের হাত থেকে আরেকজন ছিনিয়ে নিচ্ছে, গালমন্দ করছে, হি হি করে হাসছে, একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে লোকগুলো।
হ্যাঁ, এক্কেবারে আসলটা! বলল মরগান। ওই তো, জে. এফ. লেখা রয়েছে!
কিন্তু ধনরত্ন পেলেই বা লাভ কি! হঠাৎই যেন ম্যাপের ওপর থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে জর্জ, ওগুলো নিয়ে দেশে ফিরব কি করে? জাহাজ কই?
তাই তো! মুখ তুলল মরগান।
এবার কিন্তু আর আমাকে দোষ দিতে পারবে না, বলল সিলভার। ধনরত্ন চেয়েছিলে তোমরা, সন্ধান দিয়েছি আমি। কি করে, কাকে নিয়ে দেশে ফিরবে, আমি কিছু জানি না।
প্লীজ, সিলভার! বারবিকিউ! মরগান ছাড়া অন্য সবাই হাতজোড় করতে লাগল, তুমিই আমাদের ক্যাপ্টেন! এভাবে আমাদের ঠেলে দিও না!
গুড গুড! হাসল সিলভার। এই তো লক্ষ্মী হয়ে উঠেছে ছেলেরা! তোমাদের মত হিংসুটে নই আমি, তাই বেঁচে গেলে। তাহলে জর্জ, মরগান, এই ব্ল্যাক স্পট ছিড়ে ফেলতে পারি?
আলবৎ! অবশ্যই পার! সমস্বরে বলে উঠল সবাই, মরগান ছাড়া। আমতা আমতা করছে সে।
মাঝে থেকে খামোকা বাইবেলের পাতা ছিড়লাম, ডিকের কণ্ঠে আক্ষেপ। আচ্ছা বারবিকিউ, যদি বাইবেলটায় চুমু খাই এখন, পাপ কাটবে?
তার জন্যে ঈশ্বরের কাছে মাফ চাইতে হবে তোমাকে।
সে রাতে আমার আর সিলভারের পাহারায় রইল জর্জ। খোলাখুলিই সঙ্গীদের জানিয়ে দিল সে, কেউ আমার বা সিলভারের কোন ক্ষতি করতে চাইলে খুন করে ফেলবে।
কাজেই নিরাপদেই কেটে গেল বাকি রাতটুকু।
সকালে আমার ঘুম ভাঙল ডাক্তারচাচার ডাকাডাকিতে। আমি ডাক্তার এসেছি হে, দুর্গবাসীরা, ওঠ, ওঠ, উঠে পড়। আন্তরিকতায় ভরা তার কণ্ঠস্বর।
উঠে গিয়ে ডাক্তারচাচাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসছে সিলভার। এক ছুটে বেরিয়ে এলাম। বাইরে কুয়াশা কাটেনি এখনও। ঘোলাটে আলো পুবে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গলের মাথায় কুয়াশা জট পাকিয়ে আছে যেন, তারই ভেতর থেকে ভেসে আসছে ভোরের পাখিদের কলরব।
আরে জিম যে! উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ডাক্তারচাচা আমাকে দেখে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে লাগলাম। তাদেরকে না জানিয়ে বেরিয়ে গিয়ে নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তার মাঝে রেখেছিলাম, সেজন্যে লজ্জা লাগছে এখন।
ঠিক আছে, পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে, বললেন ডাক্তারচাচা। আগে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে নিই।
দুর্গের ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তারচাচা। এক নজর চোখ বোলালেন, বাহ্, সেরে উঠেছে মনে হচ্ছে সবাই! এই তো চাই! এমন রোগী না হলে ডাক্তারী করে সুখ আছে? জর্জের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই জর্জ, মুখটা শুকনো কেন? লিভারের ওষুধ খেয়েছিলে ঠিকমত?
জী, খেয়েছিলাম।
তাহলে মুখ অত শুকনো কেন?
সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে তো, তাই, বলল ডিক।
কিন্তু তোমার কিছু যেন হয়েছে? ভয় পাচ্ছ যেন? এস তো, জিভটা দেখি।
কিছু হয়নি ওর, ডাক্তারসাহেব, বলল মরগান। বাইবেলের পাতা ছিড়েছিল, এখন পাপের ভয়েই বেচারা আধমরা।
ভুরু কোঁচকালেন ডাক্তারচাচা। সংক্ষেপে ব্যাপারটা ব্যক্ত করল জর্জ। ডিকের মুখের দিকে চাইলেন ডাক্তারচাচা তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। একে একে হাসিটা সংক্রমিত হল সবার মাঝেই, সিলভার ছাড়া। চিন্তিত ভাবটা কাটছে না ওর চেহারা থেকে।
আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গেল সিলভার। ফিসফিস করে বলল, ওদের বিশ্বাস করতে মানা কর ডাক্তারকে। ব্যাটাদের এক বিন্দু বিশ্বাস করি না আমি!
সবার সঙ্গে কথা শেষ হলে আমার দিকে ফিরলেন ডাক্তারচাচা। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেতেই চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললাম।
দুর্গ থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম আমরা। ডাকাতেরা যাতে কিছু সন্দেহ করতে না পারে এমন ভঙ্গিতে। আমি দুর্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গত রাতে ফিরে আসা পর্যন্ত সব কথাই বললাম তাকে। সবশেষে একটু আগে সিলভারের হুঁশিয়ারির কথাও জানালাম। চিন্তিত চোখে দুর্গের দিকে ফিরে চাইলেন ডাক্তারচাচা। আমিও চাইলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেছে সিলভার। কাঁধের তোতাটাকে দানা খাওয়াচ্ছে।
ঘুরে দ্রুত হেঁটে বনের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ডাক্তারচাচা। আমি চললাম দুর্গের দিকে।