বেলুন থেকে নামার পর কি কি জিনিস আছে তার একটা হিসেব তৈরি করতে বসল সবাই মিলে। পরনের জামা-কাপড় ছাড়া বিশেষ কিছুই নেই কারও। গিডিয়ন স্পিলেটের নোট বই আর ঘড়িটা ছাড়া সব ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বেলুন থেকে। এক কথায় ব্যবহার করার মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিছুই নেই ওদের কাছে।
থাকার জায়গা ঠিক হয়ে গেছে। আর আগুন যখন জ্বলছে তা জিইয়ে রাখার ব্যবস্থাও করা যাবে। পাহাড়ের খাঁজে আছে পায়রা আর তার ডিম! পানির ধারে ঝিনুক। খুঁজলে জঙ্গলে ফলমূলও পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টি পানির হ্রদও আছে। কাজেই প্রাণ ধারণের ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা নেই এই মুহুর্তে।
ঠিক হলো, ঘুরে দেখবে ওরা আশ-পাশের পাহাড়, জঙ্গল, দ্বীপ। পায়রার ডিম আর ঝিনুক দিয়ে নাস্তা হলো সেদিন। পাহাড়ের খাজ থেকে খানিকটা নুন জোগাড় করে এনেছিল হার্বার্ট। কাজেই জমল খাওয়াটা। এবার আগুনটাকে জিইয়ে রাখার বন্দোবস্ত হয়ে গেলেই অভিযানে বেরোনো যায়।
পকেট থেকে চেক কাটা বড় রুমালটা বের করল পেনক্র্যাফট। তারপর শক্ত করে ওটাকে পাকিয়ে নিয়ে এক মাথায় আগুন ধরাল। আগুন ধরে উঠলে ফু দিতেই শিখা নিভে গিয়ে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকল রুমালের আগুন। বহুক্ষণ লাগবে পুরো রুমালটা পুড়ে শেষ হতে! পানি আর হাওয়ার হাত থেকে ওটাকে রক্ষা করার জন্যে চিমনির ভেতরের একটা কোটরে রুমালটা লুকিয়ে রাখল পেনক্র্যাফট। গুহা থেকে বেরিয়ে হার্বার্টকে নিয়ে প্রথমেই জঙ্গলে ঢুকল পেনক্র্যাফট। গাছের একটা ডাল ভেঙে চলনসই একটা গদা বানিয়ে নিল সে। ছুরি নেই, কাজেই পাথরে ঘষে ডালটার একটা মাথা কিছুটা চোখা করে নিল।
জঙ্গলে মানুষ বাসের কোন চিহই পাওয়া গেল না। তবে চতুম্পদ জানোয়ারের পায়ের দাগ আছে। চুপচাপ এগিয়ে চলল দুজনে। একঘণ্টা হেঁটেও মাইল খানেক পথ অতিক্রম করতে পারল না। খাওয়ার মত ফলমূল চোখে পড়ছে না, এমন কি একটা নারকেল গাছও নেই। এ কেমনতর জায়গা! এক জায়গায় অনেকগুলো বুনো পাখির দেখা পাওয়া গেল। ছোটো আকারের এই পাখিগুলোর পালকের রঙ বিচিত্র। লম্বা লেজ ঝুলিয়ে এডালে ওডালে নেচে বেড়াচ্ছে। ঘাস থেকে একটা পালক কুড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে বলল হার্বার্ট, মনে হচ্ছে। এগুলো করোকাস জাতীয় পাখি।
খেতে ভাল তো? জানতে চাইল পেনক্র্যাফট।
ভাল মানে! এক্কেবারে বন মোরগের মত।
পা টিপে টিপে একটা নিচু ডালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দুজনে। পোকা খাওয়ার জন্যে ডালটাতে এসে জমেছে পাখিগুলো। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কাস্তে দিয়ে কোপ মারার মত করে গদা চালাল পেনক্র্যাফট। নিরীহ পাখিগুলো পালানোর চেষ্টাও করল না। টপাটপ পড়ল একটার পর একটা। পাখিগুলোকে একটার সাথে আর একটা বেঁধে মালার মত করে গলায় ঝুলিয়ে নিল দুজনে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল। টোপ থাকলে হয়তো ঘাসের ভেতর তাড়া করে খরগোস ধরে ফেলতে পারত এক আধটা। দুপুরের একটু পরে একজায়গায় নতুন ধরনের অনেকগুলো পাখি দেখা গেল। কর্কশ, তীক্ষ্ণ ওদের গলার স্বর। পাখিগুলোর ডাকে কেঁপে কেঁপে উঠছে বনভূমি। ধরতে গিয়েই টের পেল পেনক্র্যাফট, হার্বার্টের বনমোরগের মত বোকা নয় পাখিগুলো। সহজে হবে না দেখে অন্য ফন্দি বের করল সে।
সরু লতা একটার মাথায় আর একটা বেঁধে দশ-বারো ফুট লম্বা করে নিল। লতার এক মাথায় বাবলার কাটা বাঁকিয়ে বাঁধল শক্ত করে। মাটি থেকে লাল কেঁচো তুলে গেঁথে দিল কাঁটায়। গোটা ছয়েক পাখির বাসায় রেখে এল এ ধরনের হাতে বানানো বড়শি। নিজেরা লুকিয়ে রইল ঝোপের আড়ালে। পাখিগুলো উড়ে এসে বাসায় বসতেই লতার অন্য মাথা ধরে আস্তে করে ঝাঁকুনি দিল পেনক্র্যাফট। কেঁচোগুলো কিলবিলিয়ে উঠতেই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাখির দল। হ্যাঁচকা টান মারল পেনক্র্যাফট। ব্যস। বড়শিতে মাছ গাথার মত কাঁটা আটকে গেল পাখির ঠোঁটে।
ডাঙায় বড়শি ফেলে পাখি শিকার! আশ্চর্য ব্যাপার! মজা পেয়ে শিশুর মত হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল হার্বার্ট। এই অদ্ভুত বুদ্ধি বের করায় পেনক্র্যাফটের তারিফ করতে লাগল সে।
ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, বলল পেনক্র্যাফট, বহু যুগ ধরেই কায়দাটা জানে নাবিকরা।
গুহায় এসে ঢুকল ওরা! গরম গরম ঝিনুক পোড়া, ডিমের অমলেট আর পাখির কাবাব খেয়ে আরামের ঢেকুর তুলল। তারপর গোল হয়ে অগ্নিকুন্ডের ধার ঘেষে শুয়ে পড়ল। দারুণ পরিশ্রম গেছে সারাটা দিন। শুতে না শুতেই ঘুম এসে গেল চোখের পাতায়।
কিন্তু ওদের সাথে যোগ দিল না নেব। কিছু খেলও না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মনিবকে না পেয়ে খুবই মুষড়ে পড়েছে বেচারা!