জাহাজে আমরা যে কি রাজার হালে ছিলাম তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে আপনাদের ভারাক্রান্ত করব না। এক সপ্তাহ আমরা পারাতে ছিলাম। (পেরেইরা ডা পিন্টা কোম্পানী আমাদের যন্ত্রপাতি, রসদ সব একসাথে করতে খুবই সাহায্য করে।) ছোট আরেকটা স্টীমারে করে চওড়া, শান্ত স্রোতের একটা নদী ধরে আমরা ওবিডস হয়ে উজানে গিয়ে মানাওস পৌঁছলাম।
ব্রিটিশ-ব্রাজিলিয়ান ট্রেডিং কোম্পানীর প্রতিনিধি মিস্টার শর্টম্যানের সৌজন্যে আমাদের আর স্থানীয় সরাইখানায় থাকতে হলো না। বেশ ভালই কাটল তাঁর আতিথেয়তায়। যাই হোক, অবশেষে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের দেয়া চিঠি খোলার নির্ধারিত দিন এল।
আমার সঙ্গী দুজন সম্বন্ধে এখানে কিছু বলা প্রয়োজন। বিজ্ঞানী হিসাবে প্রফেসর সামারলী পরিচয়ের অপেক্ষা রাখেন না। তবে তাকে দেখলে প্রথম দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না এই ধরনের কষ্টসাধ্য অভিযানের জন্যে তিনি যে কতখানি উপযুক্ত। লম্বা দড়ির মত শরীরে ক্লান্তি বলে কিছু নেই। ছেষট্টি বছর বয়স কিন্তু আমাদের অভিযানের নানা কষ্ট ক্লেশের মধ্যেও কেউ কখনও তাকে নালিশ করতে শোনেনি। কষ্টসহিষ্ণুতায় আমার চেয়ে কোন অংশেই কম যান না তিনি।
প্রথম থেকেই প্রফেসর সামারলীর বদ্ধমূল ধারণা যে চ্যালেঞ্জার একটা ঠগ। বৃথাই আমাদের কাকের পিছনে দৌড়ানো। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে নানান বিপদ আপদে পড়তে হবে আর শেষ পর্যন্ত কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসাই সার হবে। জাহাজে চড়ার পর থেকেই এই একই কথা বলছেন সামারলী।
কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তার অদ্ভুত নিষ্ঠা। প্রজাপতি ধরার জাল আর বন্দুক নিয়ে সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আর নানান জাতের বিচিত্র সব পোকামাকড় সংগ্রহ করে তার সময় কাটে। সন্ধ্যায় তিনি সারা দিনের শিকার সযত্নে পিন দিয়ে আটকে রাখেন। খুবই অন্যমনস্ক ভাব তার। মুখে সব সময়ে ব্রায়ার কাঠের পাইপ ঝুলছে। ক্যাম্পের জীবন নতুন কিছু নয় তার কাছে।
লর্ড জন রক্সটনের সঙ্গে সামারলীর কিছু কিছু মিল আছে; আবার অনেক গরমিলও আছে তাদের। রক্সটন বয়সে বিশ বছরের ছোট হলেও দুজনের দেহের গড়ন একই ধরনের। সব সময় খুব পরিপাটি আর ছিমছাম থাকতে ভালবাসেন জন। সাদা ড্রিলের স্যুটের সাথে তামাটে রঙের উঁচু বুট পরেন পায়ে। রোজ অন্তত একবার দাড়ি কামাবেনই তিনি।
সারা পৃথিবী সম্বন্ধে বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান রাখেন জন। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস সামারলী যতই নাক সিটকান না কেন কিছু একটা পাবই আমরা। গলার স্বর মোলায়েম হলেও তাঁর নীল চোখের পিছনে আত্মপ্রত্যয়শীল আর কঠিন একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়।
এখানকার লোকেদের মাঝে সাড়া পড়ে গেছে জনের আগমনে। এদের হিরো হচ্ছেন জন-রেড চীফ। পীরের মত মানে তাঁকে সবাই। ওঁর সম্বন্ধে আশ্চর্য আশ্চর্য অনেক গাঁথা প্রচলিত আছে এখানে, সেগুলোর কিছু কিছু সত্যিই বিস্ময়কর।
কয়েকজন লোক নিলাম আমরা। প্রথম জন এক বিশাল নিগ্রো হারকিউলিস, নাম জাম্বাে। ঘোড়ার মত খাটতে পারে লোকটা, বুদ্ধিও অনুরূপ। ওকে নিয়েছিলাম পারা থেকে, এক জাহাজ কোম্পানীর সুপারিশে। সেই জাহাজেই ভাঙা ভাঙা ইংরেজি শিখেছে সে।
মিশ্র রক্তের গোমেস আর ম্যানুয়েলকেও নেয়া হয়েছে পারা থেকেই। দুজনই দাড়িওয়ালা ভয়ঙ্কর দর্শন লোক। চিতাবাঘের মত কর্মঠ। নদী পথে লাল কাঠের একটা সাপ্লাই নিয়ে এসেছিল ওরা জঙ্গল থেকে। আমরা যেদিকটায় অভিযানে যাব সারাটা জীবন ওরা সেদিককার জঙ্গলেই কাটিয়েছে। ওদের একজন, গোমেস, চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে। রান্নাবাড়া, নৌকা চালানো, মোট বওয়া বা যে কোন কাজেই দুজনের কেউ পিছপা নয়।
এরা ছাড়াও আরও তিনজন বলিভিয়ার মোজো ইন্ডিয়ানকে নেয়া হয়েছে। আমাদের সাথে-সবার বেতনই মাসে পনেরো ডলার করে। তিন জনের মধ্যে যে সর্দার তাকে গোত্রের নাম অনুযায়ী মোজো বলে ডাকে সবাই। অন্য দুজনের একজন জোসি আর অন্যজন ফারনান্দো।
দীর্ঘ এক সপ্তাহ পরে চরম সময় উপস্থিত। ফাজেন্দা সান্তা ইগনাসিয়ার ছায়া ঘেরা একটা বৈঠকখানা। মানাওস থেকে দুমাইল ভিতরে। বাইরে সূর্যের ঝলমলে আলো। পামগাছের ছায়াও গাছগুলোর মতই নিকষ কালো। বাতাস স্থির, নানা জাতের পোকা, মৌমাছি আর মশা যেন সারগমের সুর তুলেছে।
বেতের টেবিলের চারপাশে বসেছি আমরা। খামটা টেবিলের উপর রাখা। খামের উপর প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের অসমান অক্ষরে লেখা:
দুপুর ১২টা জুলাই ১৫
লর্ড জন তাঁর ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। আর মাত্র সাত মিনিট বাকি আছে, বললেন রক্সটন, আমাদের প্রফেসর নিখুঁত কাজে বিশ্বাসী।
একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে শুকনো পাতলা হাত দিয়ে খামটা তুলে নিলেন সামারলী। সাত মিনিট পরে আর আগে কি আসে যায়? আমি ভাল করেই জানি এই লোক হাতুড়ে, ভন্ড।
কিন্ত আমাদের তার নিয়ম মেনেই চলতে হবে, বললেন জন, হঠাৎ যদি প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এসে হাজির হন এখানে, আর দেখেন আমরা তাঁর নির্দেশ এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি, সেটা কি আমাদের ছোট মনেরই পরিচয় দেবে না?
খুব ভাল কথা, তিক্তভাবে মন্তব্য করলেন সামারলী। লন্ডনে থাকতেই এটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল, এখন নিজের চোখে এলাকাটা দেখার পর গোটা ব্যাপারটা নেহাতই অসম্ভব মনে হচ্ছে। জানি না খামের মধ্যে কি আছে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু না থাকলে ফিরতি বলিভিয়া জাহাজেই ফিরে যাব আমি। একটা পাগলকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ পড়ে আছে আমার। সেসব কাজে গোটা পৃথিবী উপকৃত হবে। সাত মিনিট কি এখনও শেষ হয়নি?
হয়েছে-এখন আপনি খুলতে পারেন ওটা।
পকেট থেকে ছোট্ট একটা ছুরি বের করে খামটা কাটলেন মিস্টার সামারলী। একটা ভাঁজ করা কাগজ বেরুল খাম থেকে। সাবধানে ভাঁজ খুলে টেবিলের উপর বিছালেন সেটা। একটা সাদা কাগজ! আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়লেন সামারলী।
আর কি প্রমাণ চাও তোমরা? এইটাই তো তার স্বীকারোক্তি। নিজের অযোগ্যতা নিজেই স্বীকার করল। এখন দেশে ফিরে তার মুখোশটা খুলে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।
অদৃশ্য কালি! আমি তথ্য যোগান দিলাম।
মনে হচ্ছে না, আলোতে ধরে মন্তব্য করলেন জন। এই কাগজে কোন দিনই কিছু লেখা হয়নি এটা আমি হলপ করে বলতে পারি।
ভিতরে আসতে পারি? বারান্দা থেকে অতি অস্বাভাবিক জোরে কেউ জিজ্ঞেস করলেন।
বেঁটে আকৃতির একজন মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরে আলোর পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। সেই স্বর, আর সেই বিরাট কাঁধ! আমরা সবাই চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম—প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন! মাথায় একটা বাচ্চাঁদের রঙীন হ্যাট—তার সাথে আবার লাল ফিতে বাধা। এগিয়ে এসে বললেন তিনি, আমি দুঃখিত যে কয়েক মিনিট দেরি করে ফেলেছি পৌঁছতে। খামটা দেবার সময়ে আমি ভেবেছিলাম যে ওটা খোলার সুযোগ দেব না আপনাদের; ইচ্ছে ছিল আরও ঘণ্টাখানেক আগেই পৌঁছাব আমি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি আমার পাইলটের একটা ভুলে। প্রফেসর সামারলী আমাকে নিশ্চয়ই শাপশাপান্ত করেছেন?
আমি প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, কেন আপনি এই পথ বেছে নিলেন? আমাদের অভিযান এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। প্রতিবাদ করলেন জন।
এ কথার কোন জবাব না দিয়ে জন আর আমার সঙ্গে হাত মিলালেন চ্যালেঞ্জার। কিন্তু সামারলীর সাথে হাত না মিলিয়ে একটু ব্যঙ্গভরে কুর্নিশ করলেন। তারপর একটা বেতের চেয়ার টেনে বসলেন।
যাত্রার জন্যে সব তৈরি তো? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
আগামীকালই আমরা রওনা হতে পারি, বললাম আমি।
তবে আপনারা কালই রওনা হবেন। এখন আর ম্যাপ দেখার দরকার হবে না। আমিও যাব আপনাদের সাথে, আমার সুযোগ্য নির্দেশে আপনারা ঠিক ঠিক জায়গা মত পৌঁছে যাবেন।
জন রক্সটন এসমেরালডা নামে একটি স্টীম লঞ্চ ভাড়া নিয়েছেন আমাদের জন্যে। আমি প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে জানিয়ে দিলাম আমরা পুরোপুরি তৈরি।
খুব ভাল, আজ রাতের মধ্যেই সবাই গোছগাছ যা করার করে রাখবেন। কাল খুব ভোরেই আমরা রওনা হব।
সকালেই রওনা হলাম। অবশ্য এখানকার আবহাওয়া অনুযায়ী যে কোন সময়ে রওনা হলেই চলত। দিনের তাপমাত্রা শীতে বা গ্রীষ্মে পঁচাত্তর থেকে নব্বই ডিগ্রীর মধ্যেই ওঠানামা করে। ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত এখানে বর্ষাকাল, এই সময়ে নদীতে প্রায় চল্লিশ ফুট পানি বাড়ে। নদীর দুই পাড়ই বন্যায় ভেসে যায়। বিরাট এলাকা জুড়ে শুধু পানি থৈ থৈ করে। এখানকার স্থানীয় লোকেরা একে বলে গ্যাপো; পায়ে চলার জন্যে কষ্টসাধ্য, আবার জাহাজ চলার জন্যে অগভীর। জুন মাসে পানি নামতে শুরু করে, অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে নদীতে পানি সবচেয়ে কম থাকে। এখন এখানকার বিশাল নদী আর উপনদীর পানি অনেকটা স্বাভাবিক।
নদীর ঢাল মাইলে আট ইঞ্চির বেশি না হওয়ায় স্রোত এখানে খুবই কম, জাহাজ নিয়ে উজানে এগুনো আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সহজ হলো। দ্রুত এগিয়ে চললাম। একটানা তিনদিন চললাম উত্তর-পশ্চিমে। মোহনা থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরেও নদী এখানে যথেষ্ট চওড়া।
চার দিনের দিন আমরা আমাজনের একটা উপনদীতে ঢুকলাম। মুখের কাছে প্রায় আমাজনের মত চওড়া হলেও কিছুদূর এগুতেই দ্রুত সরু হয়ে এল নদী। আরও দুইদিন চলার পর একটা ইন্ডিয়ান গ্রামে পৌঁছলাম। এখান থেকেই প্রফেসরের নির্দেশে ফেরত পাঠানো হলো জাহাজ। ২ আগস্ট তারিখে ফেরত চলে গেল এসমেরালডা। আর সেই সাথে বাইরের পৃথিবীর সাথে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
বাঁশের ফালির কাঠামোর উপর চামড়া মুড়ে দুটো বড় আকারের সরু নৌকা তৈরি করতে আমাদের চারদিন কেটে গেল। খুবই হালকা করে বানানো হলো নৌকা যেন জলপ্রপাত বা অন্য কোন বাধা এলে দরকার মত সহজেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
আরও দুজনকে কাজে নেয়া হলো নাবিক হিসাবে—আটাকা আর ইপেটু। প্রফেসরের গত অভিযানে এরাই ছিল তার সাথে। প্রথমে ওরা ভয়ে যেতে রাজি হয়নি, কিন্তু সর্দারের কথা অমান্য করার উপায় নেই এই সমাজে। উপহার আর টাকা দিয়ে প্রফেসর সর্দারকে রাজি করিয়ে ফেলেছেন, সুতরাং বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয়েছে ওদের।
নৌকায় আমাদের সব মালপত্র বোঝাই করা হলো, আগামীকাল রওনা হব অজানার উদ্দেশে।