তিনদিন পর।
পিঠার খামির তৈরি শেষ। তবে এজন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাদের। তিন তিন বার ময়দা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ধোঁয়ায় চোখ কানা হবার দশা হয়েছে। পিঠা বানানো শেষ করে চাদরটা ফালি করে ছিড়লাম আমরা। ভোর হবার আগেই পাকিয়ে চমৎকার দড়ি তৈরি করলাম একটা, তারপর পুর দেয়ার মত করে পিঠার ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম সেটা। এবার একটা পেতলের পাত্রে ঢেকে পিঠা বেক করতে লাগলাম। পনের মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল আবার।
জিমের থালে ডাইনী-পিঠাটা আমরা রাখার সময় ভুলেও সেদিকে তাকাল না ন্যাট। সেই অবসরে টিনের বাসন আর কলমরুপী চামচগুলোও দিয়ে দিলাম জিমকে। তারপর একলা হওয়ামাত্রই পিঠার ভেতর থেকে দড়িটা বের করে বিছানার খড়ের গাদার নিচে লুকিয়ে রাখল ও। একটা টিনের থালে দুর্বোধ্য কিছু আঁকিবুকি কেটে ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।
সেদিন রাতে আবার জিমের ঘরে গেলাম আমরা। সেখানে বসে কাগজে কয়েকটা কথা লিখল টম। সে ওটার নাম দিল বন্দির আর্তনাদ। এই কথাগুলো পালাবার আগমুহূর্তে দেয়ালে লিখতে হবে জিমকে, টম জানাল। কারণ সকলেই নাকি ওরকম লিখেছে। কী লিখেছে, আমাদের পড়ে শোনাল টম: সাঁইত্রিশ বহুর দুঃসহ কারাভোগের পর গৃহ-স্বজনহারা এক রাজপুরুষ এই ঘরে মারা গেছে।
আমার মনে হল, জিমের এবার পালান উচিত। টমকে বললাম সে-কথা।
আরও এক জিনিস বাকি, ও বলল।
কী?
একটা উড়োচিঠি।
সেটা আবার কী?
এর সাহায্য আসন্ন বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে দেয়া হয়। কিন্তু তলায় কারও সই থাকে না।
চিঠিটা নেহাত জরুরি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হ্যাঁ, জিদ ধরল টম। আমি লিখে দিচ্ছি। হাক, তুমি ওটা সামনের দরজার চৌকাঠের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে।
ছোট্ট একটা চিরকুট লিখল টম, টেলিগ্রামের মত:
সাবধান। বিপদ আসছে। কড়া নজর রাখুন।
-অচেনা বন্ধু।
ওই রাতেই টমের কথামত চিঠিটা রেখে এলাম আমি। জিম রক্ত দিয়ে দুটো হাড়ের ক্রুশচিহ্নের ওপর একটা মরা মানুষের খুলি আঁকল। পরের দিন রাতে সামনের দরজায় সেঁটে দিলাম ওটা। তৃতীয় রাতে পেছনের দরজায় একটা কফিনের ছবি টাঙিয়ে দিলাম।
বাড়ির সবার টনক নড়ল এবার। কোন পরিবারকে ভয়ে এমন ঘামতে দেখিনি আমি। দরজায় করে শব্দ হলেও স্যালিখালা চমকে উঠছে। কিছু পড়ল তো ওরে বাবা গেলাম বলে চেঁচাচ্ছে। অন্যেরাও, তার মত, ভয়ে অস্থির। শুয়ে-বসে কোথাও শান্তি নেই কারও।
টম বলল আরও ভয় রাতে হবে ওদের মনে। সুতরাং পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের আরেক খানা চিঠি তৈরি হয়ে গেল। তবে এ চিঠিটা ড্রপ করা একটু কষ্টকর হয়ে উঠল। প্রতি দরজাতেই একজন করে নিগ্রোকে রাতে পাহারায় বসিয়েছে খালু। টম লাইটপোস্ট বেয়ে নিচে গেল কী হচ্ছে দেখতে। পেছনের দরজায় পাহারারত নিগ্রোটা ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। তক্ষুনি ওর ঘাড়ের পেছনে চিঠিটা লটকে দিল।
ওতে লেখা:
আজ রাতে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের একদল গলাকাটা আপনাদের কাছে যে পলাতক নিগ্রো আছে, তাকে চুরি করতে আসছে। এরাই আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে, যাতে ঘরের ভেতর থাকেন আপনারা। আমিও এই দলেরই সদস্য, কিন্তু ধর্মভীরু। আমি ভাল হতে চাই। তাই ওদের মতলব ফাঁস করে দিচ্ছি। ওরা দুপুর-রাতে উত্তর দিক থেকে আসবে। ওদের কাছে নকল চাবি আছে। সেটা দিয়ে নিগ্রোটার ঘর খুলবে। ওরা আসামাত্রা আমি ভেড়ার ডাক ডেকে সতর্ক করে দেব আপনাদের। আজ আপনারা ধরতে পারবেন ওদের। এর জন্যে আমি কোন পুরস্কার আশা করি না; মানুষের ভালর জন্যে কিছু একটা করতে পারছি-এটাই আমার সান্ত্বনা।
-অচেনা বন্ধু
নাস্তা সেরে ডিঙি নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেলাম আমরা। সময়টা ভালই কাটল, ভেলাটাও দেখলাম। রাতের খাবার খেতে একটু দেরি করে বাসায় ফিরলাম। খাওয়া-দাওয়ার পরপরই আমাদের বিছানায় শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হল। কেন, কী ব্যাপার, বলল না কেউ। আমরা অর্ধেক সিড়ি পর্যন্ত উঠে সুট করে নেমে গিয়ে মাটির নিচের ভাড়ার ঘরে ঢুকলাম। সেখান থেকে পরদিন দুপুরের খাবার জোগাড় করে ফিরে এলাম আমাদের কামরায়। প্রায় সাড়ে-এগারোটার দিকে উঠলাম আমরা। টম খাওয়ার জিনিসগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে ভাড়ার থেকে মাখন জোগাড় করে আনতে বলল আমায়। কলল, জিমের ঘরেই আমার জন্যে ও অপেক্ষা করবে।
ভাঁড়ারে গেলাম আমি। এক খাবলা মাখন নিয়ে যেই ওপরে উঠেছি, অমনি স্যালিখালার সামনে পড়ে গেলাম। তাকে দেখেই টুপির নিচে লুকিয়ে ফেললাম মাখনটা।
ভাঁড়ারে গিয়েছিলি? খালা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
কেন?
এমনি, খালা।
উহুঁ, ঠিক করে বল, টম। নিশ্চয়ই কোন মতলব ঘুরছে তোর মাথায়। আমাকে হিড়হিড় করে বসার ঘরে নিয়ে এল খালা।
লোকে গিজগিজ করছে বৈঠকখানা। প্রায় জনা পনের হবে, কৃষক। তাদের সবার হাতে বন্দুক। দেখেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। ভীষণ উশখুশ করছে লোকগুলো, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একটা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। ভেতরে ভেতরে ঘেমে নেয়ে উঠলাম আমি।
চল, এখুনি যাই, ওদের একজন বলল। ওই ঘরে ঢুকে ডাকাতদের জন্যে অপেক্ষা করি গিয়ে। এখানে বসে গুলতামি মারার মানে হয় না কোন।
ঠিক বলেছ, সায় দিল আরেকজন। কখন সঙ্কেত আসবে সেই জন্যে বসে থাকতে হবে, ইয়ার্কি নাকি, আঁ!
ওদের কথাবার্তা শুনে আমার পিলে চমকে গেল, চাঁদি গরম হয়ে উঠল। টুপির নিচ থেকে মাখন গলে গলে পড়তে লাগল কপাল বেয়ে।
হায় ঈশ্বর? ছেলেটার হল কি? চোখ কপালে তুলে আঁতকে উঠল খালা। ওর ঘিলু বেরিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই চাঁদি গরম হয়ে গেছে।
সবাই দৌড়ে দেখতে এল। টুপিটা মাথা থেকে খুলে নিল খালা। অমনি তার চোখে পড়ল মাখনের বাকি অংশটুকু।
কী দস্যি ছেলে রে, বাবা! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি একেবারে, আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল খালা। বললেই হত মাখন খাবি, আমি এনে দিতাম। নে, এখন ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়। সকাল হবার আগে আর যেন না দেখি তোকে।
ছাড়া পেয়েই জিমের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম আমি। টম, আসছে ওরা, হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম। যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে। ওদের সবার হাতে বন্দুক আছে!
তোফা, বলল টম। উফ, হাক, যা একখানা মজা হবে না, কী বলব!
চল চল! এসে পড়ল বলে। জিম কোথায়?
তোমার পাশেই আছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে।
কই, চল? কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, কুঁড়ে ঘরের দরজার সামনে কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। তালাটা ধরে নাড়ল কেউ। বললাম না, অনেক আগে এসে পড়েছি আমরা। এই দেখ তালা আটকানই আছে, বলল একজন।
আরেকজনের গলা শোনা গেল, চল, ভেতরে ঢুকি। চাবি আছে আমার কাছে। তোমাদের কেউ বাইরে থেকে লাগিয়ে দেবে তালাটা। ভেতরে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকব আমরা।
ভেতরে ঢুকল ওরা, কিন্তু অন্ধকার বলে আমাদের দেখতে পেল না। নিঃশব্দে সুরঙ্গ-পথে চালাঘরে এলাম আমরা। দাঁড়িয়ে কান পাতলাম অন্ধকারের মধ্যে। বেশ কিছু পদশব্দ শোনা গেল কাছাকাছি কোথাও, তারপরেই সমস্ত কোলাহল থেমে গেল। একেবারে চুপচাপ। বেড়ালের মত বেরিয়ে এলাম আমরা, হামা দিয়ে এগিয়ে গেলাম বেড়ার দিকে। জিম আর আমি ঠিকমতই বেড়া ডিঙালাম, কিন্তু টমের প্যান্ট কাঁটাতারে ফেঁসে গেল। টানাটানি করে ও ছাড়িয়ে নিল বটে, কিন্তু, ওদের একজনের কানে আওয়াজ গেল।
কে ওখানে? একটা হেঁড়ে গলা ভেসে এল। জবাব দাও, নইলে গুলি করব। কোন সাড়া দিলাম না আমরা, যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটে চললাম।
গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম! পেছন থেকে একঝাঁক গুলি ছুটে এল আমাদের দিকে। শিস তুলে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম, নদীর দিকে যাচ্ছে, নদীর দিকে। দেখ, পালাতে পারে না যেন! কুকুর লেলিয়ে দাও।
লোকগুলো প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল, আমরা বাউলি কেটে ঝোপের ভেতর দিয়ে ছুটে চললাম। শর্টকাট রাস্তায় পৌঁছে গেলাম ডিঙির কাছে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ডিঙি বাইতে শুরু করলাম, ভীতচকিত হরিণের মত এসে পড়লাম মাঝনদীতে। তারপর ধীর গতিতে সেই দ্বীপের দিকে যাত্রা করলাম, যেখানে আমাদের ভেলাটা লুকোনো আছে। এখন আর কোন শব্দ পাচ্ছি না পাড় থেকে, বহুদূরে চলে এসেছি আমরা। চারদিকে অথৈ পানি। শান্ত। মাথার ওপর চাঁদ ডানা মেলেছে নদীতে। আরা এখন নিরাপদ।
জিম, আবার তুমি মুক্ত-স্বাধীন, ভেলায় উঠেই বললাম আমি।
সত্যি, তোমরা, তুমি আর টম, জব্বর ঋেল দেখিয়েছ, বলল জিম। একদম লা-জবাব। এর চেয়ে ভাল কোন প্ল্যান হতে পারে না।
আমরা সকলেই ভীষণ খুশি, টম টগবগিয়ে ফুটছিল। আমার পায়ে গুলি লেগেছে, গর্বের সুরে বলল ও। ওর কথায় জিম আর আমি মোটেও খুশি হতে পারলাম না।
দরদর করে রক্ত পড়ছিল পা থেকে। তাড়াতাড়ি ছইয়ের ভেতর শুইয়ে দিলাম টমকে। ডিউকের একটা পরিত্যক্ত শার্ট ছিড়ে পট্টি বেঁধে দিলাম সেটা দিয়ে।
এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট কোরো না, অসহিষ্ণু গলায় বলল টম। রওনা দাও।
জিম আর আমি দৃষ্টিবিনিময় করলাম। জিম, তুমিই বল, তোমার কী ইচ্ছে, বললাম আমি।
একটা ডাক্তার না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে নড়ছি না আমি, ঘোষণা করল জিম। আজ যদি মাস্টার টম ভাল থাকত, আর আমাদের কেউ গুলি খেত, তখন কী হত? সে-ও কি একথা বলতনা? না, যাব না আমি। দরকার হলে এখানে চল্লিশ বহুর অপেক্ষা করব।
ঠিকই ধারণা করেছিলাম, জিম দেখতে কালো হলেও ওর ভেতরটা সাদা। সেখানে কোন কালিমা নেই। এমন কিছুই বলবে সে, আমি জানতাম। ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি আমি, বললাম টমকে। আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল ও, কিন্তু কিছু করার মত শক্তি ওর ছিল না তখন।
বেশ যাও, অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল টম। তবে ডাক্তারের বাসায় গিয়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে। তারপর কষে ওর চোখ বাঁধবে, শপথ করিয়ে নেবে যেন সে কবরের মত নিশ্চুপ থাকে। একটা মোহর দেবে তার হাতে। তারপর এই গলি সেই গলি বেয়ে নানা জায়গা ঘুরে এখানে আসবে। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে তার গা, যেন চক জাতীয় কিছু না থাকে। নইলে ভেলাতে চিহ্ন দিয়ে রাখবে। পরে সেই চিহ্ন দেখে ওরা ধরে ফেলবে আমাদের।
টমকে অভয় দিলাম আমি। বললাম, ওর কথামতই কাজ করব। স্থির হল, ডাক্তারকে আসতে দেখলেই জিম জঙ্গলে লুকোবে। ডাক্তার চলে গেলে বেরিয়ে আসবে আবার।