ডাক্তার লোকটার বয়েস হয়েছে, বুড়োই বলা যায়। হাসিখুশি ভাব, দয়ালু চেহারা।
স্যার, আমি বললাম, আমার ভাইয়ের পায়ে গুলি লেগেছে। ঘুমের ঘোরে তার বন্দুকে লাথি মেরেছিল সে। গতকাল বিকেলে শিকারে গিয়েছিলাম আমরা। রাত নামায় বাসায় আর ফিরিনি। সঙ্গে ভেলা ছিল, সেখানেই আশ্রয় নিই। ভাই ওখানেই আছে।
বুড়ো আমার কথা বিশ্বাস করল কি-না বুঝলাম না, তবে ব্যাগহাতে উঠে দাঁড়াল। কোথায় গেলে ভেলাটা পাওয়া যাবে আমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। যাবার আগে বলল, যাও, খোকা, বাসায় গিয়ে মা-বাবাকে খবর দাও।
উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে বাসায় আর গেলাম না আমি। একটা কাঠের গাদার ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ইচ্ছে, খানিক ঘুমিয়ে নেব। যখন ঘুম ভাঙল, সূর্য পুবের আকাশের অনেকটা পথ অতিক্রম করেছে। দৌড়ে ডাক্তারের বাসায় গেলাম, কিন্তু পেলাম না তাকে। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। দ্বীপে ফিরে যাব বলে নদীর দিকে ছুটলাম। মোড় ঘুরতেই সাইলাস খালুর ভূঁড়িতে গুতো
খেল আমার মাথা।
টম, ধমকে উঠল খালু, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
সিডের সাথে। ওই নিগ্রোটাকে ধরতে বেরিয়েছিলাম।
ওদিকে তোদের খালা চিন্তায় মরছে।
পাহারাদারদের পেছনেই ছিলাম আমরা। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর ওদের হারিয়ে ফেলি। তখন ভাবলাম নদীর উজানে দেখে আসি গিয়ে। তো ঘুরে-ঘুরে পায়ে ব্যথা ধরে গেল অথচ কারো পাত্তা পেলাম না। শেষে হার মেনে নদীর তীরেই শুয়ে পড়ি। মাত্র ঘুম থেকে উঠে আমি এদিকে আসছি, আর সিড পোস্ট অফিসের দিকে গেছে, বাড়ির কোন খবর এল কি-না জানতে।
খালুর সাথে পোস্ট অফিসে গেলাম। জানা কথা, সিডকে পাব না সেখানে। খালুর হাতে একটা চিঠি দিল পোস্ট মাস্টার। চিঠিটা পকেটে রেখে আমাকে বাসায় যেতে বলল খালু।
আমাকে দেখে স্যালিখালা ভীষণ খুশি হল। তবে বাসায় প্রচুর লোক থাকায় তার সাথে বিশেষ কথা হল না আমার। ওদের খাবারের জোগাড়েই ব্যস্ত রইল সে।
পরে তাকে একা পেয়ে সাইলাসখালুকে যা বলেছিলাম তা-ই বললাম আবার। নাহ, তোরা ছেলেমানুষই রয়ে গেলি, স্নেহের সুরে বলল খালা।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। এখনও বাড়ি ফেরেনি টম। ওর খবর জানার জন্যে ছটফট করছি আমি। খালার চোখেও উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠেছে। শেষে এক সময় অধৈর্য হয়ে বলল, সিড গেল কোথায়?
আমিও দেখলাম এই সুযোগ। আমি শহরে গিয়ে দেখে আসি? বললাম।
না, তোকে আর যেতে হবে না। চুপ করে বসে থাক। রাতের খাওয়ার আয় এলে তোর খালুই যাবে।
খাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসল কিন্তু সিড লাপাত্তা। ওর খোঁজে খালু শহরে গেল। একটু বাদে শুকনো মুখে ফিরে এল। তুমি দেখে নিও, স্যালি, কাল সকালে ও ঠিক ফিরে আসবে, খালাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল খালু। চল, শোবে চল।
আমার এখন ঘুমানোর মত মনের অবস্থা না, খালা বলল। ওর জন্যে জেগে বসে থাকব।
খালাকে শুভরাত্রি জানালাম আমি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল খালা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হল আমার। আমাদের জন্যেই আজ তার এত বিপত্তি!
টম, বাবা আমার খালা বলল, আজ রাতে আর বাইরে যাসনে, বাপ! আমার মাথা খা, বল যাবি না।
বাইরে যাবার ইচ্ছে থাকলেও খালার কথায় বাতিল করে দিলাম সেটা। সারা রাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম। কে জানে টম আর জিম কেমন আছে এখন? পা টিপে টিপে দুবার বারান্দায় এসে দেখলাম বসার ঘরের বাতি জ্বলছে। জানালার কাছে ঠায় বসে আছে খালা। পুবের আকাশ কচি লেবু পাতার রং হতেই বিছানা ছাড়লাম আমি। নিচে এসে দেখলাম খালা তখনও ওখানে বসে। মোমবাতি জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছে। হাতের তালুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে খালা।
আহা, বেচারি স্যালিখালা!