অন্ধের নিয়ে আসা কাগজের টুকরোটা পড়ল মা। আমি আগেই পড়ে ফেলেছি। শঙ্কিত হয়ে পড়ল মা। সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে আসছে, মায়ের মত আমিও বুঝতে পারছি। ক্যাপ্টেন নিজেই আমাকে বলেছে, তার কিছু জমানো টাকা আছে। থাকলে ওগুলো আছে ওই সিন্দুকেই। এটা নিশ্চয় অনুমান করে ফেলেছে দস্যুরা। সুতরাং ওরা আসবে। ব্লাক ডগ আর অন্ধ দস্যুর মত লোকেরা খামোকা সময় নষ্ট করতে আসেনি নিশ্চয়।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মোতাবেক এখন ডাক্তার লিভসীকে খবর দেয়া দরকার এবং তাহলে আমাকেই যেতে হবে। কিন্তু মাকে একা রেখে যাই কি করে? ঘরের নিস্তব্ধতার মাঝে দেয়াল ঘড়িটার টিক টিক বড় বেশি করে কানে বাজছে। ফায়ারপ্লেসে জ্বলন্ত গনগনে লাল কয়লাগুলো যেন জলদস্যুর ভয়ঙ্কর রক্তচক্ষু। আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। ফিসফিস করে যেন কথা বলছে কারা আমাদের চারপাশে। মেঝেতে পড়ে থাকা ক্যাপ্টেনকে যেন আবার জাগিয়ে তুলতে চাইছে অজানা অশরীরীরা। শিউরে উঠলাম। একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল শিরদাড়া বেয়ে।
খুব দ্রুত কিছু করতে হবে আমাদের। বাইরে কুয়াশাঢাকা হিমেল সন্ধ্যা নামছে। আর দেরি করলে আগামী সকালে এসে আমাদের মৃতদেহ উদ্ধার করবে গ্রামবাসীরা।
মা আর আমি পরামর্শ করে গ্রামবাসীদের খবর দেয়াই ঠিক করলাম। ঘনায়মান সন্ধ্যার কুয়াশায় ঢাকা আকাশের নিচে নেমে এলাম আমরা। মাথায় টুপি পরতে পর্যন্ত ভুলে গেছি।
সরাই থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে গ্রাম। অন্ধ ডাকাতটা এসেছিল উল্টোদিক থেকে। আশা করলাম, ওদিকেই আবার চলে গেছে সে। দ্রুত পা চালালাম। মা আর আমি, দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে আছি। যে-কোনরকম অস্বাভাবিক শব্দের জন্যে খাড়া রয়েছে কান। কিন্তু পাহাড়ের পাথুরে পাদদেশে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎছল শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
গ্রামে এসে পৌছুলাম। সন্ধ্যাবাতি জ্বালছে সবাই। দরজা-জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা হলদে-লাল আলোর মৃদু রশ্মি প্রাণের সঞ্চার করল যেন আমাদের দেহে।
গ্রামবাসীরা আমাদের কথা মন দিয়ে শুনল। কিন্তু কেউই সরাইয়ে যেতে রাজি হল না। প্রাণের ভয় সবারই আছে। আসলে আমিই ভুল করেছি। ক্যাপ্টেনের মুখে শোনা ফ্লিন্টের নাম বোকার মত বলে বসেছি গ্রামবাসীদেরকে। আমি নামটা শুনেছি ক্যাপ্টেনের কাছে, কিন্তু গ্রামের কোন কোন প্রাচীন লোক আগেই শুনেছে ওই নাম। শোনামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তারা। কেউ কেউ জানাল, দুপুরের দিকে কয়েকজন অচেনা লোককে পাহাড়ের ওদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। দুজন জেলে জানাল, কিটস হোল-এ অচেনা একটা ছোট জাহাজ দেখেছে। ওদের মতে, দলবল নিয়ে এসে পড়েছে দুর্দান্ত জলদস্যু ফ্লিন্ট।
সরাইয়ে যেতে রাজি না হলেও ডাক্তার লিভসীর বাড়িতে যেতে রাজি হল দুএকজন।
অনেক অনুনয়-বিনয়, অনুরোধ-উপরোধ করেও কাউকে অ্যাডমিরাল বেনবোয় যেতে রাজি করাতে পারল না মা। শেষে রেগেমেগেই বলল, তোমরা পুরুষ মানুষ বলে বড়াই কর আবার! ঠিক আছে, কেউ যেতে না চাও, না যাবে। আমি মেয়ে মানুষ, তবু যাব। মরতে হলে বাধা দিয়ে মরব। ডাকাতেরা সব লুটপাট করে নিয়ে গেলে ছেলেটাকে নিয়ে পথে বসতে হবে আমাকে। এতদিন ভাবতাম তোমরা আমার প্রতিবেশী, বিপদে-আপদে সাহায্য পাব। কিন্তু ভুল। ভীতু কাপুরুষদের ওপর নির্ভর করার কোন মানে হয় না। চল, জিম, আমার হাত ধরে টানল মা, চল যাই।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গ্রামবাসীরা। আমাদের এভাবে বিপদের মুখে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না ওদের, অথচ ভয়ে সঙ্গেও যেতে পারছে না। আমরা রওনা হতেই ডেকে থামাল একজন বুড়ো। গুলিভর্তি একটা পিস্তল দিল আত্মরক্ষার জন্যে। ঘোড়া দিয়েও সাহায্য করতে চাইল, কিন্তু নিল না মা। একজন যুবক গেল ডাক্তার লিভসীকে খবর দিতে।
হিম-রাতের অন্ধকারে আবার পথে নেমে এলাম মায়ের সঙ্গে। কুয়াশা ভেদ করে একটা লালচে আভা দেখা যাচ্ছে দিগন্তে। চাঁদ উঠছে৷ কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। চলার গতি দ্রুত করল মা। শিগগিরই ধূসর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে পথঘাট। কাছেপিঠে থেকে থাকলে সহজেই আমাদের দেখে ফেলবে দস্যুরা।
পথের দুইধারে ঝোপঝাড়। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে প্রতিটি ঝোপের ভিতর গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে বুঝি ডাকাতেরা। যে কোন মুহূর্তে আমাদের ওপর চড়াও হতে পারে। সরাইখানার সদর দরজাটা চোখে পড়তেই অনেকখানি সাহস ফিরে পেলাম।
ঘরে ঢুকেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিল মা। দ্রুত হেঁটে এসেছি। কনকনে ঠান্ডায়ও ঘেমে নেয়ে উঠেছে আমাদের শরীর। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। দরজার কাছেই, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দম নিলাম আমরা। তারপর গিয়ে খুঁজেপেতে মোমবাতি বার করল মা। জ্বালল। একটি মাত্র মোমের আলোয় ঘরের অন্ধকার দূর তো হলই না, চারপাশ থেকে আরও যেন চেপে ধরল। দেয়ালে কাপছে ধূসর ছায়া। হাত ধরাধরি করে নাচছে যেন অসংখ্য দস্যু।
হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল মা। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ফিসফিস করে বলল, চল, আগে ক্যাপ্টেনের ঘরে যাই। তার সিন্দুকটা খুলে দেখতে হবে। মাকে সাহসী বলেই জানতাম, কিন্তু এতটা সাহসী বুঝিনি।
দুরুদুরু বুকে গিয়ে ক্যাপ্টেনের ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। ঠেলা দিয়ে পাল্লা খুলল মা। মেঝেতে তেমনি পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। ভেতরে ঢুকেই বলল মা, জিম, দরজাজানালাগুলো বন্ধ করে দে। কে জানে আমাদের ওপর ওরা নজর রাখছে কিনা!
শেষ জানালাটা বন্ধ করে সবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এমনি সময় ঢং ঢং করে উঠল ঘড়ি। চমকে চোখ তুলে চাইলাম। ছটা বাজে। ফিসফিস করে বললাম, আর মাত্র চার ঘন্টা সময় আছে, মা!
সঙ্গে আনা মোমের আগুনে লণ্ঠন ধরিয়ে ফেলেছে মা ইতিমধ্যেই। আমাকে বলল, চাবিটা বার কর। ক্যাপ্টেনের পকেটেই আছে হয়ত।
অন্য সময় হলে কি করতাম জানি না, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় নির্দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে লাশের পাশে বসে পড়লাম আমি। ক্যাপ্টেনের কোটের পকেটে হাত ঢোকালাম। সবকটা পকেট হাতড়ে একে একে বের করে আনলাম কিছু খুচরো পয়সা, একটা আঙটি, সুতোর বান্ডিল, বড় সুঁচ, এক টুকরো তামার তার, একটা ছোট কম্পাস, আর একবাক্স দেশলাই। কিন্তু কোন চাবি নেই।
কি যেন ভাবল মা। তারপর বলল, ওর গলার কাছে দেখ তো।
আছে। মা কি করে অনুমান করল জানি না, তবে আছে চাবিটা। গলায় সুতো দিয়ে ঝোলানো, লকেটের মত করে। সুতো ছিড়ে চাবিটা খুলে নিলাম। এগিয়ে গেলাম সিন্দুকের দিকে। কতদিন কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছি এই সিন্দুকটার দিকে। আজ দেখতে পাব কি আছে ভেতরে।
আমার পাশে এসে দাঁড়াল মা। হাত বাড়াল। চাবিটা আমার কাছে দে।
তালায় তেল দেয়া আছে। চাবি ঢুকিয়ে একবার মোচড় দিতেই খুলে গেল। আস্তে করে ডালা তুলে উঁচু করে ধরল মা।
পুরানো তামাক আর আলকাতরার তীব্র গন্ধ সিন্দুকের ভেতর। উপরের দিকে কিছু কাপড় চোপড় ভাঁজ করে রাখা। দামি জিনিস, অব্যবহৃত। কাপড়গুলো বের করে আনল মা। নিচে নানারকম জিনিসঃ একটা কোয়াড্র্যান্ট, একটা টিনের প্যানিকিন, তামাক, পিস্তলের চমৎকার দুটো খাপ, একটা রূপার বাঁট, পুরানো একটা স্প্যানিশ ঘড়ি, দুটো কম্পাস, গোটা পাঁচেক সুদৃশ্য ঝিনুকের খোলা এবং আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। অবাক হলাম। এসব সাধারণ জিনিসই তার কাছে এত মূল্যবান ছিল!
আরও নিচে পাওয়া গেল নৌকার পালের খানিকটা। নোনাপানির দাগ জায়গায় জায়গায়। বিরক্ত হয়ে টান মেরে কাপড়টা তুলে ফেলে দিল মা। বেরিয়ে পড়ল আসল জিনিস।
অয়েলক্লথে মোড়া একটা প্যাকেট। আর একটা ক্যানভাসের ব্যাগ। ব্যাগটা নাড়াতেই ভেতরে ধাতব শব্দ উঠল। সেই প্রথম দিনে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়া মোহরের আওয়াজ কেমন, মনে আছে। ব্যাগের ভেতরের শব্দ তাই অচেনা লাগল না।
আমার মুখের দিকে তাকাল মা। ইচ্ছে করলে সবই নিতে পারি আমরা। কিন্তু চোর তো নই। তাই ক্যাপ্টেনের কাছে আমাদের যা পাওনা হয়েছে তার বেশি একটা মুদ্রাও নেব না। যা তো বাবা, একটা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে আয়।
ব্যাগ খুলে মোহর বার করল মা। গুনে গুনে আমার হাতে দিতে লাগল। ব্যাপারটা এত সহজ নয়, বেশ সময়সাপেক্ষ। কারণ, মোহরগুলো বিভিন্ন দেশের। সঠিক মূল্য নির্ণয় করা কঠিন।
অর্ধেক কাজ এগিয়েছে, হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলাম। চেপে ধরলাম মার হাত। কুয়াশাঢাকা রাতের স্তব্ধ বাতাসে ক্ষীণ আওয়াজটাও ঠিকই এসে কানে পৌঁছেছে আমার। তুষার-ঢাকা রাস্তায় লাঠির ঠকঠক আওয়াজ। এগিয়ে আসছে ক্রমেই। মা-ও শুনতে পেয়েছে শব্দটা। স্তব্ধ হয়ে রইলাম দুজনেই।
সরাইয়ের দরজায় লাঠি ঠোকার আওয়াজ হল। ঘনঘন ধাক্কা দেয়া হল দরজায়। কিন্তু ছিটকিনি তোলা থাকায় দরজা খুলতে পারল না। খিস্তির আওয়াজ কানে এল। তারপর আবার ঠকঠক শব্দ। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে শব্দটা। শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল একেবারে।
মা, বললাম। এভাবে গুনে নিতে গেলে হয়ত আর যাওয়াই হবে না আমাদের। চল সব নিয়ে যাই। বেশ বুঝতে পারছি, একা এসেছিল অন্ধ। দরজা খুলতে ব্যর্থ হয়ে চলে গেছে। কিন্তু ফিরে আসবে শিগগিরই। দলবল নিয়ে দরজা ভাঙার জন্যে তৈরি হয়ে।
কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না মা। তার পাওনা থেকে এক পয়সা বেশি নেবে না। বলল, সাতটা বাজেনি এখনও। সুতরাং সময় আছে হাতে। আবার শুনতে শুরু করল।
মৃদু শিসের শব্দ কানে এল এই সময়। পাহাড়ের ওদিক থেকেই যেন এল শব্দটা।
আমারও কাজ শেষ, কান পেতে শিসের শব্দটা শুনে বলল মা।
চারপেনি করে আমারও কিছু পাওনা হয়েছে ক্যাপ্টেনের কাছে, অয়েলক্লথে মোড়ানো ছোট প্যাকেটটা তুলে নিতে নিতে বললাম। কাজেই আমি এটা নিচ্ছি। কি ভেবে নিষেধ করল না মা।
সঙ্গে করে আনা মোমটা শেষ হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে অনুমানে অন্ধকারেই চললাম আমরা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম কয়েক সেকেন্ড। সন্দেহজনক যে কোন শব্দের জন্যে কান খাড়া রাখলাম। নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলল মা। বাইরে বেরিয়ে এলাম আবার।
অনেকটা ওপরে উঠেছে চাঁদ। দ্রুত সরে যাচ্ছে কুয়াশা। ইতিমধ্যেই অনেকখানি হালকা হয়ে এসেছে। হলদে-ধূসর জ্যোৎস্নায় নাওয়া পথঘাট। তুষার ঢাকা পাথরের পাহাড়টা বেয়ে যেন তরল সোনার বান নেমেছে। অপরূপ এই রূপ উপভোগ করার মত সময় কিংবা মানিসক অবস্থা কোনটাই এখন নেই আমাদের। পিচ্ছিল পথ ধরে দ্রুত ছুটছি। গ্রাম আর সরাইয়ের মাঝের অর্ধেক পথ পেরিয়েছি, এমনি সময় কানে এল বুট পরা পায়ের শব্দ। কয়েক জোড়া। পেছনে ফিরে তাকালাম। ছোট্ট একটা আলো দুলছে। লণ্ঠন নিশ্চয়।
হাঁপিয়ে উঠেছে মা, আর পারছে না। আমার দিকে মোহরের থলেটা বাড়িয়ে ধরে বলল, তুই পালা, বাবা! আমি আর পারছি না!
সাংঘাতিক রাগ হল গ্রামবাসীদের ওপর। জীবিত থাকতে ওদের কম সাহায্য করেনি বাবা। অথচ এই বিপদে আমাদের দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়াল ওরা! মাকেও দোষী সাব্যস্ত করলাম মনে মনে। এত দুঃসাহসের কি প্রয়োজন ছিল? আর সাহস করে সরাইয়ে যখন গিয়েছেই, টাকা-পয়সা আর মুদ্রাগুলো নিয়ে ঝটপট কেটে পড়লেই হয়ে যেত। এত সততা দেখাতে গেল কেন?
মা আর হাঁটতে পারছে না। কিন্তু তাকে ফেলে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে আমিও মরব, কিন্তু মাকে রেখে যেতে পারব না কিছুতেই। একহাতে থলেটা ধরে অন্য হাতে মার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। ভর রাখতে বললাম আমার কাঁধে। তারপর কোন রকমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পৌঁছলাম ছোট ব্রিজটার কাছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমিও। সেই বিকেল থেকে কম পরিশ্রম তো করিনি। তারওপর প্রচন্ড উত্তেজনা। ঠান্ডা তো আছেই।
তুষারের ওপরই বসে পড়ল মা।