এই উদ্ভট বাগান আর বিদঘুটে পরিবেশে শেষ পর্যন্ত নিজেকে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হলো না ক্রিস্টোর। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে বোধ করলেও শিগগিরই কাটিয়ে উঠল তা। বাগানের জম্ভ-জানোয়ার, পাখি আর সরীসৃপ যা আছে সবই আসলে পোষ মানা। কয়েকটা জানোয়ারের সঙ্গে তো রীতিমতো খাতির হয়ে গেল ক্রিস্টোর। কুগারের মতো দেখতে যে কুকুরগুলো ক্রিস্টোর আত্মার পানি শুকিয়ে দিয়েছিল সেগুলো এখন ক্রিস্টোর গায়ের কাছ ঘুরঘুর করে, সুযোগ পেলে গা চেটে কৃতজ্ঞতা জানায়। লামাগুলো ক্রিস্টোর হাত থেকে খেতে আনন্দ পায়। টিয়া পাখির দল উড়ে এসে ক্রিস্টোর কাধে বসে।
বাগান পরিচর্যায় আছে বারোজন নিগ্রো। তারা প্রত্যেকেই জিমের মতোই নির্বাক। কখনোই তাদের কোন কথা বলতে শোনেনি ক্রিস্টো। এমনকি নিজেদের মধ্যেও তারা কথা বলে না। চুপচাপ নিজেদের কাজ করে যায় তারা। অবশ্য কাজের চাপ এততাই যে কথা বলার মতো। সময় বের করাও প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। সবার সর্দার জিম। সে-ই সবার কাজ ভাগ করে দেয়। কে কি করল, কিভাবে করল সেই নজরদারিত্বের দায়িত্ব জিমের।
ক্রিস্টোকে এই জিমেরই সহকারীর পূদ দেয়া হলো। কাজ ওর বেশি নয়। এখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও চমৎকার। কোন অসুবিধে নেই কোথাও, সুন্দর ভাবে কেটে যাচ্ছে জীবন। কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে মাঝে মাঝেই খোঁচায়। আচ্ছা, নিগ্রো লোকগুলো কথা বলে না কেন? ক্রিস্টোর মনে বিশ্বাস, জন্মেছে যে ডাক্তার সালভাদর ওদের জিভ কেটে নিয়েছেন। বিশ্বাসটা ওর মনে এততাই প্রভাব ফেলেছে যে ডাক্তার সালভাদর ডেকে পাঠালেই ওর বুকের ভেতরটা ধরা পড়া চড়ুই পাখির বুকের মতো কাঁপতে শুরু করে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ভাবে, এইবার বুবি জিভটা গেল। তবে ক্রিস্টোর ভাগ্যে তেমন মর্মান্তিক কিছু ঘটল না। দিনের পর দিন যখন তার জিভ কাটা হলো না তখন আস্তে আস্তে তার ভয়টা কমে গেল।
একদিন ক্রিস্টো দেখে একটা জলপাই গাছের নিচে সেঁটে ঘুম দিয়েছে জিম। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। এই তো সুযোগ। পা টিপে টিপে কাছে চলে গেল ক্রিস্টো। দেখতে হবে এই সুযোগে, জিমের জিভ আছে কি নেই। আশ্চর্য হতে হলো ওকে : জিমের জিভ যথাস্থানে। সগৌরবে অবস্থান করছে।
এই দেখে ক্রিস্টোর মাথা থেকে বিরাট একটা দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেল।
ডাক্তার সালভাদর একেবারে ঘড়ির কাটা ধরে চলেন। সকাল সাতটা থেকে নটা পর্যন্ত তার রুগী দেখার সময়। নটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত তাঁর অস্ত্রোপচারের সময়। এরপর তিনি চলে যান নিজের বাড়িতে। সেখানে তিনি একা একা ল্যাবোরেটরিতে কাজ করেন। নানা পরীক্ষা তিনি করে থাকেন। কোন কোন পরীক্ষায় দরকার পড়ে জীবজন্তু। সেগুলোর ওপর অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রপচার বা অঙ্গ পুনস্থাপনের পর দীর্ঘ সময় নিয়ে রুগীকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। তিনি সন্তুষ্ট হলে তবেই সেই জন্তুকে বাগানে পাঠান।
ঘর পরিষ্কার করার সুযোগে ক্রিস্টো একবার। ল্যাবরেটরির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেছে, বিস্ময়ে চোখ দুটো আরেকটু হলে গর্ত থেকে খুলে আসত তার। টেস্ট টিউবের কোন অভাব নেই ঘরে। সেগুলোতে নানা তরল। সেই তরলে চুবিয়ে রাখা হয়েছে হরেক প্রাণীর অঙ্গ। সেগুলো প্রত্যেকটিই জীবন্ত, সজীর, নড়ে চড়ে। কোন অঙ্গ যদি স্পন্দিত না হয় তাহলে ডাক্তার আবার সেই অঙ্গে প্রাণের সঞ্চালন করেন।
ঘটনা দেখে ক্রিস্টোর চক্ষু চড়কগাছ। তার ওপর এতই আতঙ্ক ভর করল যে লাববারেটরির ধারেকাছে না গিয়ে সে বাগানের অদ্ভুত জন্তুদের মাঝে সময় কাটানোই বেশি নিরাপদ মনে করল।
ক্রিস্টোকে ডাক্তার সালভাদর বিশ্বাস করলেও তৃতীয় দেয়ালের ওপাশে যাওয়ার অধিকার তাকে দেননি। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। সে কারণেই তৃতীয় দেয়ালের ওপারে কি আছে জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে ক্রিস্টো। দুপুরে সবাই যখন বিশ্রাম নেয়, ক্রিস্টো তখন যায় ওই দেয়ালের কাছে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে রেড-ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের গলার স্বর। তাদের সঙ্গে চিকন গলায় কারা। যেন কথা বলে ভাষাটা একেবারেই অপরিচিত। কি বলে কিছু বুঝতে পারে না ক্রিস্টো। কৌতূহল বেড়ে যায় আরও।
একদিন ওর আশা পূরণ হলো। বাগানে ওকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন ডাক্তার। বললেন, একমাস হলো তুমি এখানে কাজ করছ, ক্রিস্টো। আমি তোমার কাজে খুশি হয়েছি। আমার ওদিকের বাগানের এক মালী অসুস্থ, ভাবছি তার জায়গায় তোমাকেই ওখানে পাঠাব কিনা। অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। একটা কথা মনে রেখো, আগেও বলেছি, যা কিছু দেখবে, যা কিছু শুনবে, বলতে পারবে না কাউকে। সেই কথাগুলো মনে আছে তো?
ক্রিস্টো জবাবে বলল, আপনার বোবা কর্মচারীদের সঙ্গে থেকে থেকে আমিও কথা বলা প্রায় ভুলে গেছি। কোন অসুবিধা হবে না, ডাক্তার সাহেব।
তবে তো ভালই হয়েছে, বললেন ডাক্তার। কথা না বললে সৌভাগ্যবান হওয়া যায়। প্রসঙ্গ পাল্টালেন। আচ্ছা ক্রিস্টো, আন্দেজ পাহাড়ী অঞ্চলটা কেমন চেনো তুমি?
ভাল। ওখানেই তো আমার জন্ম।
চমৎকার। আমার কিছু নতুন জন্তু-জানোয়ার দরকার। ওখানে যেতে হবে। আমার সঙ্গে তুমিওস্তাবে।…এখন যাও তাহলে, জিম তোমাকে ওদিকের বাগানের কাজ বুঝিয়ে দেবে।
দেয়ালের ওপাড়ে গিয়ে ক্রিস্টো যা দেখল তা ওর সমস্ত কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেল।
প্রকাণ্ড একটা মাঠের মধ্যে রোদের ভেতর খেলা করছে একদল উলঙ্গ শিশু। সবাই রেড ইন্ডিয়ান। তাদের সঙ্গে আছে বাদরের দল। শিশুদের সবাই ডাক্তার সালভাদরের রুগী। অনেকের দেহেই। অস্ত্রপচারের দাগ রয়েছে। সালভাদর ওদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন।
ক্রিস্টো বেশি অবাক হলো বাঁদর দেখে। এখানের বাঁদর কথা বলে। শিশুদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে ওরাও কিচির-মিচির করে প্রতিবাদের সুরে কি যেন বলে। তর্কও করে। যতই ঝগড়া করুক, একটু পরই মিটে যায় সব। মিলেমিশে মহা আনন্দে আছে সবাই। জীবনটা এখানে ওদের মস্ত একটা দীর্ঘ মজাদার খেলা।
এ বাগানটা আগের বাগানের চেয়ে আকারে ছোট। বাগানের একদিক সরাসরি নেমে গেছে সাগরে। ওই জায়গাটা পাহাড়ী। খাড়া একটা পাহাড় সমুদ্রে ওখানে নাক ডুবিয়েছে। ক্রিস্টো বুঝল, ওই পাহাড়ের ওপারেই আছে সাগ। দূর থেকেও ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জন শুনতে পাওয়া যায়।
পাহাড়টা কয়েকদিন দেখে তারপর ক্রিস্টো বুঝতে পারল ওটা আসল নয়, মানুষের নির্মিত পাহাড়। দেয়ালের কাজ দিচ্ছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে ঘন ঝোপ-ঝাড় জন্মেছে। তার ফাঁক দিয়ে ধূসর একটা দরজাও চোখে পড়ল ওর।
কৌতূহল ক্রিস্টোর একটু বেশিই। দরজার গায়ে একদিন কান পাতল সে। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কিছুই সে শুনতে পেল না। ওই ফটকের ওপারে সম্ভবত সাগর সৈকত আছে।
হঠাৎ শিশুদের উত্তেজিত চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল ও। আকাশের দিকে চেয়ে আছে সবাই। কোন এক ছেলের একটা লাল বেলুন হাত থেকে ফস্কে গেছে বোধহয়। ওটা ধীরে ধীরে হেলেদুলে উঠে যাচ্ছে আকাশের গায়ে। একটু পরই এত ওপরে উঠে গেল যে আর দেখাই গেল না।
সাধারণ একটা বেলুন। কিন্তু কেন কে জানে চিন্তিত হয়ে পড়ল ক্রিস্টো। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে শুরু করল। এদিকে যার জায়গায় ও এই বাগানে কাজে এসেছে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করল ক্রিস্টো, বলল, আমি কয়েক দিনের জন্যে আন্দেজ পর্বতে যেতে চাই। ফিরতে হয়তো কিছুদিন দেরি হতে পারে। মেয়ে আর জাতনীর কথা খুব মনে পড়ছে।
শীতল চোখে ক্রিস্টোকে দেখলেন ডাক্তার সালভাদর, তারপর আরও ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার সেই শর্তের কথা যেন মনে থাকে। মুখ একদম বন্ধ রাখবে। তোমাকে তিন দিনের ছুটি দেয়া হলো। এর মধ্যেই ফিরে আসবে। একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, তুমি। এখানে একটু দাঁড়াও। পাশের ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন হাতে একটা চামড়ার থলে নিয়ে! থলের ভেতর ঝনঝন আওয়াজ করল সোনার মোহর। থলেটা তিনি ক্রিস্টোর হাতে দিলেন। বললেন, এটা তোমার নাতনীর জন্যে। আর ভাল কাজ করেছ তুমি এ কদিন। মুখ বন্ধ রেখো। মনে কোরো এই টাকার একটা অংশ তোমার মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।