রাত প্রায় শেষ। একটু পরই ভোর হবে। গ্রীষ্মের ভেজা বাতাসে ম্যাগনোলিয়া, টিউবরোজ আর মিনোনেট ফুলের সুবাস। হাওয়া নেই আজকে, কাজেই গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। চারদিক নিস্তব্ধ। বাগানের বালির পথ ধরে হাঁটছে ইকথিয়ান্ডার। ওর কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ছোরা। এক হাতে চশমা আরেক হাতে ব্যাঙের পায়ের মতো গ্লাভূস। ইকথিয়ান্ডারের পায়ের তলায় পিষে ভেঙে যাচ্ছে বালিতে পড়ে থাকা অসংখ্য ছোট শখ, শামুক আর গুগলি। দুপাশে রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড়গুলোকে কালো দেখাচ্ছে। বাতাস না থাকায় নিথর, মনে হচ্ছে অপেক্ষা করছে একটা কিছু ঘটবে। বাগানের জলাধার থেকে হালকা কুয়াশার মতো বাষ্প উঠছে। গাছের সারির মধ্যে দিয়ে চলেছে এখন ইকথিয়ান্ডার। দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। চোপে আসা অবাধ্য গাছের ডালগুলো। ভোরের শিশির জমেছে ইকথিয়ান্ডারের চুলে আর মুখে। বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা, স্ফটিকের মতো দেখাচ্ছে।
বাগানের একটা রাস্তা ঢালু হয়ে ডান দিক দিয়ে নেমে গেছে। পাথরে তৈরি একটা চাতালে এসে দাঁড়াল ইকথিয়ান্ডার, গগলস আর গ্লাভস পরে নিয়ে বড় করে দম ছাড়ল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পানির মাঝে। শীতল প্রশান্তিময় অনুভূতিতে ভরে গেল ওর সমস্ত দেহ। পানির ঠাণ্ডা স্পর্শ কানাকোয় লাগতেই নিয়মিত ছন্দে ওগুলো ওঠা-নামা শুরু করল স্বয়ংক্রিয় ভাবে। ওই এক মুহূর্তে মানুষ ইকথিয়ান্ডার রূপান্তরিত হলো সামুদ্রিক মাছে।
গ্লাভস্ পরা হাতের গুণে খুব কম সময়েই ও নেমে গেল পানির অনেক গভীরে। পুকুরের পাথরের দেয়ালে বসানো আঙটা ধরে ও এগিয়ে চলল পানি ভর্তি সুড়ঙ্গের দিকে। বাগানের পুকুরটা সাগরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু, কাজেই পুকুরের পানি সর্বক্ষণ সাগরে গিয়ে পড়ছে। সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল ইকথিয়ান্ডার। চিত হয়ে আছে। দুহাত বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা।
সুড়ঙ্গটা শেষ হতেই উপুড় হয়ে সামনের দিকটা দেখল ইকথিয়ান্ডার। সামনে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। সামনে দিকে হাত বাড়িয়ে লোহার শিক ছুঁলো ও। লোহার তৈরি দরজাটায় ঝুলছে একটা মজবুত তালা। চাবি দিয়ে তালাটা খুলে বাইরে খোলা সমুদ্রে বেরিয়ে এলো ও। নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল পেছনে লোহার দরজা।
সামনে এখন খোল সাগর। তবে অন্ধকার কাটেনি এখনও। পানির রং কালো কালির মতো। মাঝে মাঝে নকটিসির সৃষ্টি নীলচে আলোর কণা দেখা দিতে আঁধারে। জেলিফিশের গোলাপী আভাও চোখে পড়ছে কখনও কখনও। ভোর হতে আর বাকি নেই। পানিতে আলো পড়লেই রাতে আলো জ্বালা প্রাণীগুলো নিভিয়ে দেবে নিজেদের আলো। কানকো দিয়ে শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। মনে হচ্ছে সুই দিয়ে কেউ ঘন ঘন খোঁচা মারছে কানকোয়। তার মানে হচ্ছে অন্তরীপ পেরিয়ে শহুরে আবর্জনায় ভর্তি একটা স্রোতের মাঝে চলে এসেছে ও। কাদা আর বালিও অসুবিধে সৃষ্টি করছে। এখানে একটা নদী সাগরে এসে পড়েছে। সেকারণেই এই কাদা-বালি আর আবর্জনা। পানিতে ছোট ছোট ঘূর্ণিও আছে। তাছাড়া নদী কাছাকাছি হওয়ায় পানিতে লবণের পরিমাণ কম। লবণাক্ত পানি ছাড়া ইকথিয়ান্ডার ভাল করে শ্বাস নিতে পারে বিশেষ ভাবে সৃষ্টি তার কানকোগুলো মিষ্টি পানির উপযোগী নয় মোটেই। নদীর মাছ অত কাদা-বালি আর মিষ্টি পানিতে কি করে বেচে থাকে ভেবে অবাক লাগে ইকথিয়ান্ডারের।
সামান্য ওপরে উঠে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিল ও। একটু পরই আবার নামতে শুরু করল। এখানে পানি একদম পরিষ্কার। শীতল একটা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল ও। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে স্রোতটা পারানা নদীর মোহনা পর্যন্ত। এরপর স্রোতটা বেঁকে গেছে পুব দিকে। ওই স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দূর হতে দূরান্তরে।
মাঝে মধ্যে চোখ বুজে থাকছে ইকথিয়ান্ডার। বিপদের কোন ভয় নেই। চারদিক এখনও প্রায় অন্ধকার। সমুদ্রের আতঙ্ক যেসব প্রাণী, লারা এখনও ঘুম থেকে জাগেনি। সূর্য ওঠার আগে আরাম করে ভেসে থাকতে খুব ভাল লাগে ওর। দেহ ভরে যায় প্রশান্তিতে। কত অনুভূতি যে হয়। শরীরের সূক্ষ্ম যন্ত্র বলে দেয় পানির তাপ বাড়ছে কি কমছে। স্রোত দিক বদলাচ্ছে কিনা। হাজারো কম শব্দের জগৎ সমুদ্র। ইকথিয়াল্ডারের তীক্ষ্ণ কান সব শব্দই আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। এই মাত্র জাহাজের নোঙর তোলার আওয়াজ হলো। ঝন ঝন ঝন! কয়েক কিলোমিটার দূরে কয়েকটা মাছ ধরা জাহাজ তাদের নোঙর তুলছে।
সকাল প্রায় হয়ে এলো। ধকধক আওয়াজ করে চালু হলো একটা জাহাজের এঞ্জিন। ওটা ব্রিটিশ জাহাজ হাবোক্সের আওয়াজ, জানে ইকথিয়ান্ডার। বিরাট এই জাহাজটা ইংল্যান্ডের লিভারপুল আর আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের মধ্যে নিয়মিত চলাচল করে। সমুদ্রের নোনা পানিতে শব্দের গতি সেকেন্ডে মাত্র পনেরো মিটার, কিন্তু চল্লিশ কিলোমিটার দূরের হারোক্স জাহাজের এপ্রিনের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ইকথিয়ান্ডার, যেন সামান্য দূরেই আছে জাহাজটা। ভোরের ধূসর আলোয় দূর থেকে চমৎকার মায়াময় লাগছে জাহাজটাকে দেখতে। যেন একটা আস্ত শহর, আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের বুকে। ওই জাহাজটাকে আরও সুন্দর লাগে কাছ থেকে দেখতে। তাই, জাহাজ দেখতে ইকথিয়ান্ডারকে যেতে হয় আরও বহুদূর, গভীর সমুদ্রে। ওই জাহাজ যখন বুয়েন্স আয়ার্সে পৌঁছোয় তখন সকালের আলো ফুটে যায়। জাহাজের আলোও নিভে যায় তখন। জাহাজটা আসছে। প্রপেলারের আওয়াজ, এঞ্জিনের ধকধক আর পানির আলোড়নের শব্দে সমুদ্রের ঘুমন্ত প্রাণীদের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে হারোক্স জাহাজ। ইতিমধ্যেই ডলফিনরা জেগে গেছে। ছোট্ট একটা ঢেউয়ের বাড়িতে সচেতন হয়ে উঠল ইকথিয়ান্ডার। বুঝতে পারছে ডলফিনরা খেলার জন্যে জাহাজের দিকে রওনা হয়ে গেছে। অলসতা কাটিয়ে উঠে ইকথিয়ান্ডারও সাঁতরাতে শুরু করল।
পানির ওপর মাথা তুলে চারদিকে একবার তাকাল। আশেপাশে কোন জাহাজ বা নৌকো নেই। মাথার সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে গেল বুনো হাঁস আর গাঙচিলের দল। এতই নিচ দিয়ে উড়ছে যে মাঝে মাঝে পানি স্পর্শ করছে ওদের পাখা, থেকে থেকে পানি ঝরছে ডানা থেকে। গাঙচিলের ডাক একেবারে বাচ্চাদের কান্নার মতো। বিরাট প্রশস্ত ডানা মেলে, বাতাসে হুসহুস আওয়াজ তুলে মাথার ওপর দিয়ে। উড়ে গেল একটা অ্যালবাট্রস। লা-পাটা উপসাগরের দিকে চলেছে। ডানার বিস্তার চার মিটারের কম হবে না। ইকথিয়ান্ডারের আফসোস হলো, মনে হলো যদি ওরও অমন ডানা থাকত তাহলে কি ভালই না–হতো! নিমেষে উড়ে চলে যেত দূরদূরান্তে।
পাহাড়ের দিকে সরে যাচেছ অন্ধকার, আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠছে আকাশ। পুব দিগন্তে সূর্যের আভাস দেখা দিল। এখন সমুদ্রের ঢেউগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোলাপী আভা বুকে মেখে উড়ে যাচ্ছে গাঙচিলের দল।
সমুদ্রের সুনীল বিস্তারে নানা রকম নক্সার খেলা শুরু হয়ে গেছে। অপূর্ব! বাতাসের বাড়িতে ক্রমেই বাড়ছে বিচিত্র সব নক্সা, যেন সূর্যালোকের তুলি দিয়ে গভীর মনোযোগে আঁকছেন স্বয়ং ঈশ্বর।
মাছ-ধরা কয়েকটা জাহাজ এগিয়ে আসছে ইকথিয়ান্ডারের দিকে। ডাক্তার সালভাদরের নিষেধ আছে যেন সে মানুষের সামনে না যায়। ডুব সাঁতার দিয়ে পুবদিকে উন্মুক্ত সাগরের দিকে চলল ও। সাগরের পানি এই গভীরতায় কেমন যেন ছায়া ছায়া। নীলাভ পানিতে সাঁতার কাটছে অজস্র রংবেরঙের মাছ। কোনটা ডোরাকাটা, কোনটা বুটিদার, কোনটা লাল, হলুদ, কালো, বাদামী, সবুজ-হরেক রঙা। যেন প্রজাপতি, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে আপন আনন্দে।
পানির ওপরে গুড়-গুড় একটা একটানা আওয়াজ হচ্ছে। পানিতে লম্বাটে একটা ছায়া পড়ল। সমুদ্রের ওপর দিয়ে কোন যুদ্ধ বিমান যাচ্ছে।–একবার একটা সী-প্লেনের ডানায় উঠে বসেছিল ইকথিয়ান্ডার। মারাত্মক দুর্ঘটনা হতে পারত। প্লেনটা হঠাৎ করেই উড়তে শুরু করল সংক্ষিপ্ত দৌড় শেষে। প্রায় তিরিশ ফুট ওপর থেকে হাত ফস্কে সাগরে পড়ে গিয়েছিল ইকথিয়ান্ডার। উচ্চতা আরও বেশি হলে হয়তো মারাই যেত।
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। সাগরের ওপরে উঠে এলো ইকথিয়ান্ডার। সূর্যটা মাথার ওপর আগুন ঝরাচ্ছে। চিকচিক করছে সমুদ্রের পানি, আগের মতো আর স্বচ্ছ নেই, তলায় কি আছে দেখা : যাচ্ছে না আলোর প্রতিফলনের কারণে। এছাড়া বাতাসও ছেড়েছে। সমুদ্রে ঢেউ উঠছে। সেটাও তলার কিছু দেখা না যাওয়ার একটা কারণ। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে বসল ইকথিয়ান্ডার, নেমে গেল ঢেউ মিলিয়ে যেতেই। খেলাটা বেশ পছন্দ করে সে।
উড়ক্কু মাছের দল ঢেউয়ের মাথায় উঠে দল বেঁধে লাফ দিচ্ছে, কয়েকশো গজ উড়ে গিয়ে আরেকটা ঢেউয়ের ভেতর ডুব দিচ্ছে। পুব থেকে পশ্চিমে উড়ে চলেছে দ্রুতগামী ফ্রিগেট পাখির ঝাঁক, দুপুরের বিশ্রামের জায়গায় চলেছে ব্যস্ত হয়ে। হঠাৎ করেই একটা পাখি ছোঁ মারল সাগরের বুকে, পানির তলায় গিয়ে পর মুহূর্তে উঠে এলো আবার। ওটার বাঁকা ঠোঁটের ফাঁকে চকচক করছে একটা রুপোলি মাছ। পাখিটার দুপুরের খাবার জোগাড় হয়ে গেছে।
আকাশে কয়েকটা অ্যালবাট্রসও উড়ছে। ইকথিয়ান্ডার বুঝতে পারল সাগরে একটা বড় ধরনের ঝড় আসন্ন। ঝড় অ্যালব্যাট্রসের খুব পছন্দ। বিদ্যুত্বহী মেঘের দিকে চলেছে তারা মহা উৎসাহে। ছোট জাহাজ আর নৌকোগুলোর আচরণ ঠিক ওদের উল্টো। চট জলদি করে। তীরের দিকে ছুটছে ওগুলো। ঝড় আঘাত হানলে মারাত্মক বিপদ হবে জলযানগুলোর।
সমুদ্রের পানি স্বজেটে হয়ে গেছে। সূর্য হেলে পড়েছে, আকাশে গোধূলির রং লাগছে। খিদে পেয়েছে ইকথিয়ান্ডারের। সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ লুকানোর আগেই ওকে তীরে ফিরতে হবে। দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করল ও।
সূর্যের আলো দেখে দিক ঠিক করে সাঁতরে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। সাগব্র উপকূলবর্তী পানি অপেক্ষাকৃত কম ঘন হয়, কিন্তু তাতে লবণ আর অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। এসব জায়গায় শ্বাস নিতে সুবিধে হয় ইকথিয়ান্ডারের। একবার জিভে সামান্য পানি ছোঁয়াল ও। দক্ষ নাবিকরাও এভাবেই বুঝে নেয় পরিচিত তীরের কাছে সে এসেছে কিনা।
পানিতে ডুবন্ত পাহাড়গুলোকে এখন চিনতে পারছে ও? ওগুলোর মাঝে ছোট ছোট মালভূমি আছে। ওসব পার হয়ে একটা পাথরের প্রাচীরের কাছে চলে এলো ও। পানির নিচে বিপদের সম্ভাবনা দেখলে এখানেই সে আশ্রয় নেয়। ঝড় যত প্রলয়ঙ্করীই হোক, এখানে পানি সবসময় থাকে শান্ত।
মাছরাও জানে এ জায়গা নিরাপদ। অসংখ্য মাছ এসে জুটেছে এখানে। ক্ষণিকের জন্যে তারা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আসছে একটু পরই। ঝড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে সরবে না ওরা।
সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাথরের তলায় রয়েছে অসংখ্য ঝিনুক-খাবারের অফুরন্ত ভাণ্ডার। ওখানে চলে এলো ইকথিয়ান্ডার। ওখানেই সে বিশ্রাম নেয়, খাওয়াটাও সারে। একের পর এক ঝিনুকের খোলা ছাড়িয়ে ভেতরের রসাল শাঁসগুলো মুখ ফেলছে ও, ঠোঁট ফাঁক করে বের করে দিচ্ছে শাঁসের সঙ্গে ঢোকা নোনা পানি। সামান্য নোনা পানি যে তার পেটে চলে যায় না তা নয়। কিন্তু ওটুকু অসুবিধে ইকথিয়ান্ডারের শরীরে সয়ে গেছে। বমির ভাব হয় না।
পেট ভরতেই চিত হয়ে শুয়ে থাকল ইকথিয়ান্ডার। ওর চারপাশে সামুদ্রিক উদ্ভিদের ছড়াছড়ি, যেন অদক্ষ কোন মালির হাতে তৈরি অগোছাল বাগান। বেশির ভাগ গাছই আগার, মেক্সিকান কাউলেরপ আর নরম গোলাপী অ্যালজি। আজকে উদ্ভিদগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে। পানির রং গোলাপী হয়ে আসছে। সাগরের নিচ থেকেও প্রচণ্ড ঝড়ের আওয়াজ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই গুড়-গুড় কড়াৎ শব্দে মেঘ ডাকছে, বাজ পড়ছে।
বিরাট ডানা মেলে একটা অ্যালবাট্রস উড়ে চলেছে। সাগরের পানিতে তার ছায়া পড়েছে। ক্রমেই সরে যাচ্ছে ছায়াটা। খুব নিচু দিয়ে উড়ছে। ওটার কমলা রঙের পা ইকথিয়ান্ডারের হাতের নাগালের মধ্যে। খপ করে পাখিটার পা দুটো চেপে ধরল ও। ধপাস করে : পানিতে পড়ল পাখিটা, পর মুহূর্তেই ওপরে ওঠার জন্যে সর্বশক্তিতে ডানা ঝাঁপটাতে শুরু করল। ওটার প্রবল টানের কারণে পানির ওপর উঠে আসছে ইকথিয়ান্ডার। অ্যালব্যাট্রসের বুকের নরম অংশের ছোঁয়া পেল ও। আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেলেই লাল ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে আহত করে দেবে পাখিটা। পানির ওপর উঠে আসার আগের মুহূর্তে পাখিটার পা ছেড়ে দিল ও। দেখতে দেখতে পুবদিকের পাহাড় পেরিয়ে অদৃশ্য হলো পাখিটা।
ইতিমধ্যে ঝড়ের প্রকোপ কমে গেছে। একটু পরই সম্পূর্ণ থেমে গেল। দূরে শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে এদিকের সাগরে।
খাওয়া এবং বিশ্রাম, দুটোই হয়ে গেছে ইকথিয়ান্ডারের, এবার পানির ওপর দেহের অর্ধেকটা তুলে আনল ও। আকাশ এখনও মেঘে কালে কাঁদছে প্রকৃতি ঝরঝর করে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলোতে ছোট ছোট ফোটা তৈরি করছে বৃষ্টির পানি। একেকটা ঢেউ পাহাড়ের মতো উঁচু, বেশ কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে নিঃশেষে বিপুল জলরাশির সঙ্গে।
সাধারণ মানুষ ঝড়-বৃষ্টি অপছন্দ করলেও ইকথিয়ান্ডারের প্রকৃতির লীলা দেখতে খুব ভাল লাগে। কখনও সে ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, আবার কখনও নেমে যায় ঢেউয়ের নিচে। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করতে তার ভাল লাগে। তবে এ খেলা বিপজ্জনক। একবার একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে মাথায় মারাত্মক চোট পেয়েছিল ও, জ্ঞান ছিল না। তলিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ হলে মারাই যেত, কিন্তু খানিক পর পানির তলায় জ্ঞান ফিরে পেতে ইকথিয়ান্ডারের অসুবিধে হয়নি। আঘাত সামলে সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
একসময় থেমে গেল বৃষ্টি। অনিঃশেষিত মেঘের দল হাওয়ায় ভরা দিয়ে চলে গেল পুব আকাশের এক কোণে। উত্তর গোলার্ধের উষ্ণ অঞ্চল থেকে ভেসে এলো গরম বায়ু। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিল আকাশের নীল। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের ঢেউয়ের ওপর, ওদের নিয়ে আলোছায়ার খেলায় মেতে উঠল। একটু আগের সেই সাগর আর নেই, এখন ধূসর রং বদলে গিয়ে নীল রং ধরেছে। বিপুল জলরাশি। রোদের কারণে মাঝে মাঝে পানির রং সবুজও
দেখাচ্ছে।
সূর্যের আলোয় সাগর, আকাশ আর দূরের পাহাড়শ্রেণী ভিন্ন রূপ ধরেছে।
সাগরের ভেজা সুশীতল বাতাস বুক ভরে টেনে নিল ইকথিয়ান্ডার। মাঝে মাঝে কানকো দিয়েও শ্বাসের কাজ চালাচ্ছে। ইকথিয়ান্ডার জানে, ঝড়-বাদলে-বজ্রপাতে বদলে যায় প্রকৃতি, এক হয়ে মিশে যায় সাগর আর আকাশ, পানির ওপরে আর নিচে দুজায়গাতেই বেড়ে যায় নিষ্কলুষ অক্সিজেনের পরিমাণ। সাগরে প্রাণের স্পন্দন বেড়ে যায়। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসে মাছের ঝাঁক। তারপর একসময় ঢেউ শান্ত হয়। তখন বের হয় জেলিফিশ, চিংড়ি, পর্পিতা, স্টেনোফোরা, সেস্টাস আর ভেনেরিসের মতো দুর্বল প্রাণীগুলো।
সামান্য দূরে ইকথিয়ান্ডারের বন্ধু কে পাল ডলফিন খেলা জুড়ে দিয়েছে নিজেদের মাঝে। একজন আরেকজনকে তাড়া করছে। লাফ দিচ্ছে আকাশে। ভাল লাগল ইকথিয়ান্ডারের, হাসিমুখে ওদের খেলায় সামিল হলো সে। একটু পরই খেলায় মেতে উঠল। ওদের সঙ্গেই সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে, তাড়া করছে হয়তো কাউকে। ওর মনে হয় এই আকাশ এই বাতাস এই ডলফিনের দল যেন শুধু ওর জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে।
একটু পরই সন্ধে নামবে। সূর্য পশ্চিমে অনেক দূর হেলে পড়েছে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই ইকথিয়ান্ডারের। আগে আকাশ কালো হোক, হাজারো নক্ষত্র তাদের উপস্থিতি জাহির করুক, তখন ডলফিন বন্ধুদের সঙ্গে খেলা সাঙ্গ করে বাড়িতে ফিরবে সে, তার আগে নয়। এখন সে ঢেউয়ের মাথায় উঠে হুটোপুটি খেলবে।
প্রতিটা ঝড়ের পরই দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটে। করুণ সেই দৃশ্য। ঝড়ের ঢেউয়ের ধাক্কায় অসংখ্য জেলিফিশ, কাঁকড়া, তারামাছ আছড়ে পড়ে তীরের বেলাভূমিতে। কখনও কখনও ডলফিনও রক্ষা পায় না। যারা সৈকতে গিয়ে পড়ে তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। তবে সময় মতো সাহায্য করলে তাদের বাঁচানো সম্ভব। ইকথিয়ান্ডার একবার সৈকতের দিকে চেয়ে দেখল কোন প্রাণীর তার সাহায্যের দরকার আছে কিনা। তীরের কাছে এখনও ফুসছে সাগর। বড় বড় ঢেউ বেলাভূমিতে আঘাত হানছে।
ঝড়ের পর সাধারণত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়ায় ইকথিয়ান্ডার, যেসব প্রাণীদের বাঁচানো সম্ভব সেগুলোকে সাগরে নিয়ে ছেড়ে দেয়। ওরা যখন জীবনীশক্তি ফিরে পেয়ে আপন ভুবনে ফেরে, বুকটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ইকথিয়ান্ডারের। ওর হাতের ভেতর মাছগুলো যখন হাঁপাতে থাকে, তখন ও সান্ত্বনা দেয়, আর একটু ধৈর্য ধরো, আমি তোমাকে ঠিক ঠিক বাঁচাব, দেখো!
অন্য সময় হলে হয়তো ইকথিয়ান্ডার মাছগুলো খেয়েই ফেলত। কিন্তু এখন তা ও কখনোই করবে না। ও তো এখন রক্ষক এবং বন্ধু। রক্ষক হয়ে সে ভক্ষক হবে কি করে?
সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ডুবে গেছে পুব আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে। মেঘের গায়ে লেগেছে সোনালী-লাল-গোলাপী আর ধূসর রং। নিচের সাগরে তাদের প্রতিফলন হচ্ছে। সাগর এখনও কিছুটা অশান্ত। মাঝে মাঝে ওপরে সাঁতরে আবার কখনও কখনও ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে চলেছে ইকথিয়ান্ডার। আঁধার ঘনিয়েছে। এখন এমন এক সময় যখন সমুদ্রের জীব একে অপরের ওপর হামলা করে না। যেসব হিংস্র প্রাণী দিনে জাগে তারা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার রাতে যারা জাগে তারা এখনও শিকারে বের হয়নি। এসময়টা নিশ্চিন্তে ডুব সাঁতার দিয়ে মজা করার উপযুক্ত সময়।
সাগরের স্রোত চেনে ইকথিয়ান্ডার। ও জানে উত্তর থেকে আসা স্রোতটা একটু ওপর দিয়ে বয়ে যায়। দক্ষিণের শীতলতা ওই স্রোতকে শীতল করতে পারে না, উষ্ণ স্রোত হয়ে ওটা বয়ে যায়।
উল্টো আরেকটা স্রোত আছে সমুদ্রের আরও গভীরে। ওটা সুশীতল দক্ষিণ থেকে চলেছে উত্তরের উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। তীরের দিকে যেতে চাইলে এই ভিন্নমুখী স্রোতগুলোকেই কাজে লাগায় ইকথিয়ান্ডার, তাতে ওর পরিশ্রম অনেক কমে যায়।
আজকে উত্তরের স্রোত ধরে বহুদূর চলে গেল ইকথিয়ান্ডার। এবার। উষ্ণ স্রোতে গা এলিয়ে দিল। এই স্রোত ওঁকে নিয়ে যাবে বাড়ির কাছের সেই সুড়ঙ্গের মুখে। একবার এরকম ভাবে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ইকথিয়ান্ডার। সেবার অনেক দূরে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্রোতটা। আজকে ইকথিয়ান্ডার তাই জেগেই থাকল।
হাজার কোটি তারায় ভরা আকাশের মতোই সাগরেও জ্বলছে যেন। নক্ষত্রের দল। তারা নয়, সাগরের বুকে নিজেদের পিচ্চি দেহ নিয়ে আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্ৰ নকটিলুসি। অগভীর পানিতে আলো জ্বেলেছে তারা মাছেরা। কাছেই ইকথিয়ান্ডার একটা জেলিফিশ দেখতে পেল। গভীর পানিতে দেখা দিতে শুরু করেছে হিংস্ৰ নিশাচর মাংসাশী প্রাণীরা। শিকারের পেছনে ছুটছে তারা। ওদের দেহের আলোও জ্বলছে নিভছে।
পানির নিচে যেন সূর্য-চাঁদের কোন অভাব নেই। কোমল আলো জ্বলছে নিভছে সর্বক্ষণ। তাতে নানা ধরঙের বৈচিত্র্য। তুলনা করে দেখল ইকথিয়ান্ডার, আকাশের চেয়ে সাগরের গভীরতার রূপ অনেক অনেক বেশি সুন্দর।
বন্দরের কাছ থেকে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ। ইকথিয়ান্ডারের বুঝতে দেরি হলো না, হারোক্স জাহাজ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
আজ বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের। রাত এখন প্রায় শেষ। কখন এত সময় পেরিয়ে গেছে সমুদ্রের রূপ দেখতে দেখতে ও জানে না। একটু পরই পুবাকাশে সূর্য উঠবে ফের। কখন মনের ভুলে একদিন একরাত সাগরের কাটিয়ে দিয়েছে সে। ডাক্তার সালভাদর নিশ্চই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। দেখা হলেই বকাবকি করবেন।
সুড়ঙ্গের দিকে চলল এবার ইকথিয়ান্ডার। একটু পরই চলে এলো গন্তব্যে। শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দরজা খুলে ঢুকল ঘন অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে। একটু পরই ভেসে উঠল, শ্বাস নিল ওপরের বাতাসে। ফুলের মিষ্টি সুবাস ওকে মুহূর্তের জন্যে আনমনা করে দিল।
ঘরে ফিরে গ্লাস্ আর গগলস্ খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। ডাক্তারের নির্দেশ তা-ই।
বড় ক্লান্তু ও। সারাশরীরে ভর করেছে পরিশ্রান্তি। একটু পরই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ইকথিয়ান্ডার।