একটানা ডুব সাঁতার দিয়ে সাগরের ঘড়ির কাছে পৌঁছোল ইকথিয়ান্ডার। ক্রিস্টো তার কথা রেখেছে। দাঁড়িয়ে আছে সে একটা সাদা স্যুট নিয়ে। ওটার দিকে ইকথিয়ান্ডারের তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো পোশাকটা যেন আসলে পোশাক নয়, সাপের কুৎসিত একটা খোলস। কিন্তু কি আর করা! দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পোশাকটা পরতে শুরু করল ও। জীবনে এধরনের পোশাক খুব কমই পড়েছে ও। স্যুট পরা হতেই ক্রিস্টো ওর গলায় একটা টাই বেঁধে দিল।
ক্রিস্টো ঠিক করেছে ইকথিয়ান্ডারকে অবাক করে মুগ্ধ করে দেবে। শহরের সবচেয়ে বড় রাস্তা, আভেনি-দ্য-অ্যালাভেয়ারে নিয়ে গেল সে। নিয়ে গেল বেতিস, ভিক্টোরিয়া চক, গির্জা, মূর সভ্যতার সময় সৃষ্টি অপূর্ব সুন্দর টাউন হল আর ছায়াময় নিরব গাম্ভীর্য ভরা রাষ্ট্রপতি ভবনে।
ইকথিয়ান্ডারকে অবাক করতে গিয়ে কাজটা ভাল করেনি ক্রিস্টো। যানবাহন, লোকজন, ভীড়-ভাট্টা, হৈ-চৈ, ধুলো আর ভ্যাপসা গরমে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ইকথিয়ান্ডার। তবুও ওর চোখ যেন সর্বক্ষণ খুঁজছে কাকে। বারবার ক্রিস্টোর হাত আঁকড়ে ধরছে ও, নিচু স্বরে বলছে, ওই যে! ওই যে। ও-ই না ও?
কিন্তু ভুল দেখছে ইকথিয়ান্ডারের তৃষিত চোখ। নিজেই সামান্য পরে বুঝতে পারছে ভুলটা। হতাশ হয়ে যাচ্ছে ওর মন। আপন মনে বলছে, না, না, এ-তো সে নয়!
বুয়েন্স আয়ার্স বড় শহর। পথে-ঘাটে অসংখ্য মেয়ে। কোন এক নির্দিষ্ট মেয়েকে ঠিকানা ছাড়া খুঁজে বের করা যে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ এটা পরিশ্রান্ত হতাশ ইকথিয়ান্ডার এখনও জানে না। ইতিমধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে ওর। দম আটকে আসতে চাইছে।
ছোট একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামল ক্রিস্টো। বলল, এসো, হালকা কিছু খেয়ে নেয়া যাক। তারপর আবার খোজা যাবে।
ঘরটা মাটির তলায়, তাই বেশ ঠাণ্ডা। তবে ভেতরটা চুরুটের ধোয়া আর হট্টগোলে ভরপুর। অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরা লোকজন গিজগিজ করছে। ইকথিয়ান্ডারের দম বন্ধ হয়ে এলো। হাতে খবরের কাগজ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক জুড়েছে কয়েকজন, মাত করে রেখেছে গোটা রেস্টুরেন্ট। এতজন একসঙ্গে কথা বলছে যে কোন ভাষা সেটা বোঝাই মুশকিল। মাথার ভেতরটা কেমন যেন করতে শুরু করল ইকথিয়ান্ডারের। কান ভোঁ-ভোঁ করছে। খাওয়া স্পর্শ পর্যন্ত করল না সে। শুধু পানি খেয়ে পেট ভরাল!
ক্রিস্টোকে বলল, এত মানুষের ভিড়ে নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে বের করা তো অসম্ভব। এর চেয়ে মহাসাগরে একটা চেনা মাছ খুঁজে বের করা অনেক সহজ কাজ হবে। ভাল লাগছে না আমার তোমাদের এই শহরে। পাঁজর ব্যথা করছে। চলো, বাড়ি ফিরে যাই।
বেশ তো, বলল ক্রিস্টো। আরেকটু অপেক্ষা করো। আমার আরেক বন্ধু আছে, তার সঙ্গে দেখা সেরেই ফিরে যাব।
না, আর কারও সঙ্গে দেখা করার অবস্থা নেই আমার।
কোত্থাও যেতে হবে না। ওর বাড়ি আমাদের ফেরার পথেই পড়বে।
কষ্ট হচ্ছে ইকথিয়ান্ডারের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে। একটু পরই রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলো ওরা, দুর্বল বোধ করছে তাই ক্রিস্টোর পেছনে পা বাড়াল ইকথিয়ান্ডার।
শহর শেষ হয়ে গেল, শহরতলিতে চলে এলো ওরা। এদিকে গাছগাছালি বেশি। ফণীমনসা জন্মেছে। পীচ আর জলপাইয়ের বাগানও আছে। ক্রিস্টো কৌশলে বন্দরের দিকে চলেছে। উদ্দেশ্য তার ভাই। বালথাযারের সঙ্গে দেখা করা।
কিছুক্ষণ পর সাগর তীরে, বন্দরে চলে এলো ওরা। সাগরের ভেজা বাতাস বুক ভরে টেনে নিয়ে একটু স্বস্তি বোধ করল ইকথিয়ান্ডার। ওর ইচ্ছে হলো গায়ের কাপড় খুলে ফেলে সাগরে ঝাঁপ দেয়। ক্রিস্টো : আন্দাজ করতে পারছে ওর মনোভাব। ত্রস্ত ভাবে বলল, এই তো এসে গেছি। আর বেশি দূরে নেই ওর বাড়ি।
একটা বাড়ির অন্ধকারাচ্ছন্ন আঙিনায় প্রবেশ করল ওরা। চোখে অন্ধকার সয়ে যেতেই অবাক হলো ইকথিয়ান্ডার। এ যেন কোন দোকান নয়, সাগর-তলেরই কোন স্থান। দোকানের তাকে, আলমারিতে, শো-কেসে আর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের শঙ্খ আর ঝিনুক শামুক। ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে প্রবালের খণ্ড, তারা মাছ, শুকনো কাঁকড়া, শুটকি মাছ এবং নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী। হরেক রকমের মুক্তো ছড়িয়ে আছে কাউন্টারের কাঁচের তলায় একটা আলমারিতে রয়েছে কিছু মুক্তো। ওগুলোর রং গোলাপী। দামি জিনিস।
পরিবেশটা পরিচিত ঠেকায় ইকথিয়ান্ডারের মন কিছুটা স্বস্তি পেল। একটা পুরোনো বেতের চেয়ারে তাকে বসতে দিল ক্রিস্টো। বলল, খানিক বিশ্রাম নিয়ে নাও, ইকথিয়ান্ডার। হাঁক ছাড়ল ভেতর পানে চেয়ে। বালথাযার! গুট্টিয়ার!
পাশের ঘর থেকে কে যেন সাড়া দিল। কে, ক্রিস্টো নাকি? ভেতরে চলে এসো।
দুঘরের মাঝের দরজাটা উচ্চতায় অত্যন্ত কম। কুঁজো হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো ক্রিস্টোকে।
এঘরটাকে বলা যেতে পারে বালথাযারের গবেষণাগার; অ্যাসিড দিয়ে ধুয়ে এখানে মুক্তোর চাকচিক্য বাড়ায় সে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ক্রিস্টো। ভাইকে বলল নিচু গলায়, সব ভাল তো, বালথাযার? গুট্টিয়ারা কোথায়?
আছি ভালই, জবাবে বলল বালার। মেয়েটা গেছে পাশের বাড়িতে ইস্ত্রি আনতে। এক্ষুণি ফিরে আসবে। ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতার কি খবর?
কে জানে সে কোথায়। একটু বিরক্ত বালথাযার! কালকে তার সঙ্গে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে আমার।
কারণ কি? গুট্টিয়ারা নাকি?
আর বোলো না। মেয়েটার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে জুরিতা। গুট্টিয়ারাও আগের কথাই বলে যাচ্ছে। না, জুরিতাকে কিছুতেই বিয়ে করব না। ও বোঝে না যে পেদরোর মতো স্বামী পেলে যেকোন রেড ইন্ডিয়ান মেয়ে খুশিতে মনে মনে নাচতে শুরু করে দেবে। কিসের অভাব পেদোরা? টাকা আছে, নিজের জাহাজ আছে, ডুবুরি আছে। একটা মানুষের আর কি দরকার বলো, ক্রিস্টো? একটু থামল বালথাযার, তারপর বিরক্ত স্বরে বলল, কি জানি মনের দুঃখে পেদরো হয়তো এখন কোথাও বসে মদ গিলছে।
ওকে নিয়ে এসেছি, বালথাযার, নিচু স্বরে ভাইকে বলল ক্রিস্টো।
কোথায়? চমকে গেল বালথাযার।
ওঘরে বসে আছে।
দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিল বালথাযার কৌতূহল মেটাতে। কই? কোথায়? দেখছি না যে?
কাউন্টারের সামনে চেয়ারে বসে আছে।
কই! ওখানে তো দেখছি গুট্টিয়ারা।
দরজা খুলে তড়িঘড়ি দোকানে চলে এলো ক্রিস্টো আর বালথাযার।
ইকথিয়ান্ডার দোকানে নেই। দোকানে শুধু আছে বালথাযারের পালক মেয়ে গুট্টিয়ারা!
অপূর্ব সুন্দরী সে। চারপাশে ছড়িয়ে গেছে তার রূপের খ্যাতি। অনেকেই তাকে বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে একই জবাব দিয়েছে গুট্টিয়ারা। এখন আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।
ক্যাপ্টেন পপদরো জুরিতাও বউ করতে চায় গুট্টিয়ারাকে। বালথাযারেরও এই বিয়েতে মত আছে। একজন জাহাজ মালিকের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে পারলে সেটা বিরাট ব্যাপার। কিন্তু গুট্টিয়ারার সেই একই কথা। না।
কেমন আছো, মা? ভাতিজিকে জিজ্ঞেস করল ক্রিস্টো। ছোঁড়া গেল কোথায়? জানতে চাইল বালথাযার।
হাসল গুট্টিয়ারা। বলল, আমি ওকে লুকিয়ে রাখিনি। আমাকে দেখেই কেমন যেন চমকে মতো উঠল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। দেখে তো মনে হলো ভয় পেয়ে গেছে। তারপর বুক চেপে ধরে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।
আসল ঘটনা বুঝে ফেলল ক্রিস্টো। গুট্টিয়ারাই তাহলে ইকথিয়ান্ডারকে পাগল করা সেই অপূর্ব সুন্দরী পরী। না, আর কোন সন্দেহ নেই।