গত কদিন হলো নিয়মিত দেখা হচ্ছে ইকথিয়ান্ডার আর গুট্টিয়ারার। শহরের বাইরে, সৈকতে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রাখা পোশাক পরে পাহাড়ের কাছে চলে আসে ইকথিয়ান্ডার। গুট্টিয়ারা তার একটু পরই হাজির হয়। দুজন সৈকতে পাশাপাশি হাঁটে, আলাপ করে মগ্ন হয়ে।
নতুন এই বন্ধুর সত্যিকার পরিচয় জানে না এখনও গুট্টিয়ারা। তার কৌতূহল হয় না এমন নয়, কিন্তু এব্যাপারে কোন কথাই সে জিজ্ঞেস করে না ইকথিয়ান্ডারকে। নিজের কথা ইকথিয়ান্ডার বলেও খুব কমই। গুট্টিয়ারা শুধু এটুকু জানে যে ইকথিয়ান্ডার এক ডাক্তারের ছেলে। ডাক্তার সম্বন্ধে খুব একটা ভাল ধারণা পোষণ করে না। গুট্টিয়ারা। ও আলাপ করে দেখেছে ইকথিয়ান্ডারের জ্ঞান অনেক। ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। অনেক ব্যাপারে সে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি জানে একথা সত্য, কিন্তু কোন কোন ব্যাপারে তার জ্ঞান পাঁচ বছরের শিশুর সমানও নয়। তবে বোকা ন ইকথিয়ান্ডার। রসিকতা বোধের কোন অভাবও নেই তার। যেকারণে কথা বলে মজা পায় গুট্টিয়ারা।
সাগরের কোলে সৈকতে বসে অসীম বিস্তারিত সুনীল পানির বিস্তৃতি দেখে ওরা দুজন পাশাপাশি। ওদের পায়ের কাছে প্রণতি জানায় সাগরের ঢেউ। গুট্টিয়ারার সঙ্গে কথা বলতে ইকথিয়ান্ডারেরও খুব ভাল লাগে। কেন কে জানে, বুক ভরে ওঠে আনন্দে।
এক সময় সন্ধে নেমে আসে। গুট্টিয়ারা মিষ্টি করে বলে, এবার তাহলে উঠতে হয়!
ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না ইকথিয়ান্ডারের। ইচ্ছে করে বুকের মাঝে ছোট্ট একটা ঝিনুকের মতো করে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু বিদায় দিতে হয়। শহরের কিনারা পর্যন্ত গুট্টিয়ারাকে এগিয়ে দেয় সে, তারপর ফিরে চলে সাগরের দিকে। পোশাক লুকিয়ে ফিরে যায় বাড়িতে।
মুক্তো ভালবাসে গুট্টিয়ারা, কাজেই মনের আনন্দে মুক্তো খুঁজে বেড়াতে শুরু করেছে ইকথিয়ান্ডার। সাগর-তলে সে বাছাই করা মুক্তোর একটা টিলা গড়ে তুলেছে একথা বললে বাড়াবাড়ি বলা হবে না! মুক্তোর এই স্কুপের দাম কত তা জানে না ইকথিয়ান্ডার। দামের কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে। সে ভাবে গুট্টিয়ারার কথা। ইকথিয়ান্ডার জানেও না যে কখন সে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোকে পরিণত হয়েছে। জানা তার জন্যে জরুরী বলেও কখনও বোধ হয় না। হৃদয়টা গুট্টিয়ারাকে দিয়ে নিশ্চিন্তে আছে ও। গুট্টিয়ারার কথা ভাবলেই মন ভরে ওঠে প্রশান্তিতে।
মাঝে মাঝে অবশ্য তার দুঃখও হয় গুট্টিয়ারার জনে!। বেচারি কত কষ্টই না পায় শহরের ভেতর ওই ধুলো-বালি আর ধোয়াভরা কুৎসিত পরিবেশে। কি জঘন্য হৈ-চৈ আর ভিড় ওখানে। দারুন হতো যদি গুট্টিয়ারা সাগরের প্রশান্তিময় নিরব পরিবেশে এসে থাকতে পারত। গুট্টিয়ারাকে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাত এই আজব জগৎটা। কিন্তু তা কি সব?
না।
ও নিজে পারবে না ডাঙায় থাকতে আর গুট্টিয়ারা পারবে না পানির তলায় বসবাস করতে।
বুঝতে পারছে ইকথিয়ান্ডার। বারবার নিয়ম ভঙ্গ করছে সে। যতটা সময় ডাঙায় থাকতে বলেছেন বাবা তার বেশি সময় সে থেকে যাচ্ছে ডাঙায়। ফলাফল ঘটতে শুরু করেছে। আবার ফিরে এসেছে পাঁজরের সেই ব্যথাটা। ওটা এখন প্রায়ই ওকে কষ্ট দিচ্ছে। কখনও কখনও ব্যথাটা অসহ্য হয়ে ওঠে। তোয়াক্কা করে না ইকথিয়ান্ডার, যতক্ষণ গুট্টিয়ারা বিদায় না নেয় ততক্ষণ সে-ও ওঠে না কিছুতেই।
মাঝে মাঝে তার মাথায় একটা চিন্তা দোলা দেয়, অজানা অনুভূতি কষ্ট দেয় হৃদয়টাকে কি কথা বলে গুট্টিয়ারা ওই সুদর্শন যুবকের সঙ্গে? জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। গুট্টিয়ারা যদি কিছু মনে করে!
একদিন গুট্টিয়ারা বলল, আগামী কাল আমি আসতে পারব না। কেন? জিজ্ঞেস করল ইকথিয়ান্ডার।
কাজ আছে।
কি কাজ?
জবাবে হাসল গুট্টিয়ারা। বলল, অত কৌতূহল ভাল নয় কিন্তু। আর একটা কথা, আজ আমাকে তোমার এগিয়ে দিতে হবে না।
একটু পরই আজ বিদায় নিল গুট্টিয়ারা। সাগরে ডুব দিল ইকথিয়ান্ডার, সারারাত মন খারাপ করে শুয়ে থাকল শ্যাওলা ধরা পিচ্ছিল পাথরের ওপর। ভোর হতে ফিরে চলল বাড়ির পথে।
ফেরার পথে একটা নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখে থামতে হলো ওঁকে। একদল জলে মাছ ধরতে এসেছে নৌকো নিয়ে। নতুন নিয়মে ডলফিন ধরছে তারা।
ডলফিন যেই পানির ওপর ভেসে উঠছে, অমনি বন্দুক নিয়ে গুলি করছে তারা। বিরাট একটা ডলফিন গুলির আঘাতে লাফিয়ে উঠেই অদৃশ্য হলো সাগরের তলে। চারপাশে সাগরের পানি ছিটকে গেল।
ভয়ে, আতঙ্কে অস্ফুট স্বরে শুধু বলতে পারল ইকথিয়ান্ডার, লিডিং!
আহত ডলফিন মরে ভেসে উঠবে সে আশায় পানিতে নেমে পড়েছে এক জেলে! মরা ডলফিনকে টেনে নৌকোর পাশে নিয়ে আসবে।
ডলফিনটা মরেনি। জেলের কাছ থেকে একশো মিটার দূরে ভেসে উঠেছে। দম নিয়ে আবার সাগরে ডুব দিল ডলফিন। তাকে ধরার জন্যে সাঁতার কেটে এগোল জেলে। ডলফিন দম নিতে আবার ভেসে উঠতেই হাতের নাগালে ওটাকে পেয়ে গেল সে, খপ করে পাখনা চেপে ধরে নৌকোর দিকে ঠেলে নিয়ে আসতে লাগল।
ডলফিনের বিপদ বুঝতে পেরে ডুব-সাঁতার দিয়ে এগোল ইকথিয়ান্ডার। জেলেকে কাছে পেতেই দাঁত বসিয়ে দিল তার পায়ে। জেলে ভাবল তাকে হাঙরে ধরেছে। হাতে একটা ছুরি আছে তার। ওটা দিয়ে ইকথিয়ান্ডারের ঘাড়ে গায়ের জোরে আঘাত করল সে। আজকে ইকথিয়ান্ডারের পরনে সেই বর্ম নেই। ঘাড়ে প্রচণ্ড চোট পেল ইকথিয়ান্ডার। সে পা ছেড়ে দিতেই জানের ভয়ে ডলফিনটাকে ছেড়ে নৌকোর দিকে সাঁতরে চলল জেলে।
ডলফিনটাকে নিয়ে সাগর-তলের এক গুহায় এসে ঢুকল ইকথিয়ান্ডার। এই গুহার ওপরের অংশে বাতাস আছে। ফাটল দিয়ে আছে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। ডলফিনের শ্বাস নিতে কোন কষ্ট হবে না। সেজন্যেই এখানে ওটাকে নিয়ে এসেছে ও ডলফিনের গুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখল ইকথিয়ান্ডার, গুরুতর কোন আঘাত নয়। চামড়া কেটে চর্বিতে ঢুকে বসে আছে বুলেট। আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে গুলিটা বের করে ফেলল সে, তারপর ডলফিনের পিঠ চাপড়ে সাহস দিয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই। ভাল হয়ে যাবি কদিনেই।
লেজ নাড়তে নাড়তে ফিরে চলল ডলফিন। আর ইকথিয়ান্ডার ফিরল বাড়িতে।
তার কাঁধের জখমটা দেখে ভয় পেয়ে গেল ক্রিস্টো। উদ্বিগ্ন স্বরে, জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার?
ডলফিনকে বাঁচাতে গিয়ে চোট লেগেছে বলল ইকথিয়ান্ডার।
কথাটা ক্রিস্টোর বিশ্বাস হলো না। ক্ষতটায় ব্যান্ডেজ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, আমাকে ছাই নিশ্চই সেই শহরে গিয়েছিলে, তাই না?
উত্তরে হাসল ইকথিয়ান্ডার, মুখে জবাব দিল না। ক্রিস্টো আবার বলল, কাঁধের কাছে তোমার আঁশটা একটু তোলা তো দেখি, জখমটা ভাল মতো দেখতে পাচ্ছি না।
. ঘাড়ের ক্ষত দেখার জন্যে আঁশ নিজেই সরাল ক্রিস্টো। পর মুহূর্তে আঁতকে উঠল। ইকথিয়ান্ডারের কাঁধে একটা লাল ক্ষতচিহ্ন! ভয়ঙ্কর আঘাত। আবার শিউরে উঠল ক্রিস্টো। ক্ষতচিহ্নে আঙুল বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে ওরা দাঁড় দিয়ে মেরেছে?
মাথা নাড়ল ইকথিয়ান্ডার। না। এই দাগটা জন্ম থেকেই আছে আমার।
জন্ম থেকেই?
তা-ই তো জানি।
নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেল ইকথিয়ান্ডার। একা একা ভাবনার জাল বুনে চলল ক্রিস্টো। অনেকক্ষণ পর সিদ্ধান্তে এলো সে। রওনা হলো বুয়েন্স আয়ার্সের পথে।
*
দোকানের কাউন্টারে বসে আছে গুট্টিয়ারা। তাকে দেখেই দেরি না করে প্রশ্ন ছুঁড়ল ক্রিস্টো। গুট্টি, তোমার বাবা বাসায়?
ঐ তো, ঐ ঘরে।
বালথাযার মুক্তো পালিশ করা ঘরে আছে। সেখানে এসে ঢুকল ক্রিস্টো। মনোযোগ দিয়ে মুক্তো পালিশ করছে। মেজাজ চড়া। মুখ তুলে ভাইকে দেখে বলল, জুরিতা কিন্তু আমাদের ওপরে ক্ষেপে গেছে। এখনও আমরা কেউ দানোর কোন খোঁজ বের করতে পারলাম না। এবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। আর আর মেয়েকে নিয়েও হয়েছে এক জ্বালা। কি যে করে, কখন কোথায় যায়, স্রষ্টা জানেন। জুরিতার কথা ওর এক কান দিয়ে ঢোকে আর আরেক কান দিয়ে বের হয়। পাত্তাই দিচ্ছে না। এখনও বিয়ের কথা বললেই বলছে, না, বিয়ে করলে পেদরো জুরিতাকে করধনা। পেদরো জুরিতাও বাঘের বাচ্চা। বলেছে গুট্টি রাজি না হলে জোর করে বিয়ে করবে। তাতে কি
আর এমন খারাপ হবে? কয়েকদিন মন খারাপ থাকবে গুট্টিয়ারার, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
বালথাযারের কথা মন দিয়ে শুনল ক্রিস্টো, তারপর কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়ে দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল পেদরো জুরিতা। ঢুকেই ভেতরের পরিবেশের আঁচ পেয়ে গেল লোকটা। বলে উঠল, এই যে, দুভাইকে তাহলে একসঙ্গে পেয়েছি। দেখছি! আর কতদিন আমাকে জ্বালাবে, ক্রিস্টো? শুধু টাকা খেলেই। হবে? কাজ দেখাতে হবে না?
জবাবে অমায়িক বিনীত হাসল ক্রিস্টো। বলল, সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর ঐ দানো তো সাধারণ কোন মাছ নয়, জাল পাতলেই ধরা পড়ে যাবে। ওকে সেদিন ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিলাম এখানে। কিন্তু আপনি তখন ছিলেন না। এখানে থেকে পালায় ও। সেই থেকে আর
এদিকে পা বাড়াবার নামও নিচ্ছে না।
বিরক্ত পেদরো জুরিতা নিচু স্বরে বলল, অত কথায় আমার কাজ নেই। দুটো কাজ আমি এই সপ্তাহে করতে চাই। এক, সাগর-দানোকে। ধরা, দুই, গুট্টিয়ারাকে বিয়ে করা। ডাক্তার সাহেব কি আন্দেজ থেকে ফিরেছেন, ক্রিস্টো?
ফেরেননি এখনও। যেকোনদিন ফিরবেন।
ঠিক আছে। বেশ কয়েকজন লোক বেছেছি আমি আমার কাজটা করিয়ে নেয়ার জন্যে। তাদের দিয়েই কাজ সারা যাবে। দরজাটা শুধু খুলে দেবে তুমি, তারপর যা করার ওরাই করবে। বালথাযারের দিকে তাকাল সে। বালথাযার, বিয়ের ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে কালকে কথা বলব। মনে রেখো, কাল এব্যাপারে আমাদের শেষ কথা হবে।
এরপর কোন বাধাই মানব না আমি।
কথা শেষ করে কারও বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না পেদরো জুরিতা, গটগট করে হেঁটে চলে গেল দোকান ছেড়ে। তার আগে গুট্টিয়ারাকে কি যেন বলল গুট্টিয়ারার জবাব দুই ভাইয়েরই কানে এসেছে।
না! না!
ভাইয়ের দিকে চেয়ে হতাশ ভাবে একবার মাথা নাড়ল বালথাযার।