ইকথিয়ান্ডারের হাতকড়া কেটে দিয়েছে পেদরো জুরিতা, দিয়েছে নতুন পোশাক আর জুতো। সবই অবশ্য নিজের স্বার্থে। বালির নিচে কোনো গ্লাভস আর গগলসও উদ্ধার করে আনা হয়েছে। খাতির করা হলেও ইকথিয়ান্ডার আসলে একজন বন্দি। সেটা বুঝতে একটু দেরি হলো ওর। ডেকে উঠতেই কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান ডুবুরি ওকে ঘিরে ধরে জোর করে জাহাজের খোলে ফেরত পাঠাল।
রসদ নেবার জন্যে জাহাজ একবার থামল বুয়েন্স আয়ার্স বন্দরে, তারপর রওনা দিল রিও ডি জেনিরো শহরের দিকে। বন্দরে জাহাজ যখন থেমেছে তখন খাণিক সময় করে নিয়ে বালথাযারের দোকানে গিয়েছিল পেদরো নিজের পিঠ নিজে চাপড়াতে। নিজের মুখে গর্ব করে বালথাযারকে নিজেরই সাফল্যের কথা বলে এসেছে সে, নইলে বালথাষার কিছুই জানতে পেত না।
পেদরো জুরিতা তার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার পুব তীর ধরে মুক্তো সংগ্রহ করতে করতে এগিয়ে যাবে ওরা, একসময় হাজির হবে ক্যারিবিয়ানে।
সঙ্গে করে গুট্টিয়ারাকেও নিয়েছে সে। বাগানের সেই ঘটনার পর থেকে মোটেও গুট্টিয়ারাকে বিশ্বাস করতে পারছে না পেদরো। মেয়েটাকে আপাতত শান্ত করতে মিথ্যে বলেছিল সে। বলেছিল ইকথিয়ান্ডারকে সে লা-প্লাটা উপসাগরে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মিথ্যেটা ধোপে টেকেনি। জাহাজের খোলের ভেতর থেকে গোঙানি আর চিৎকার শুনে বুঝে গেছে গুট্টিয়ারা, এই জাহাজেই আছে ইকথিয়ান্ডার। কিন্তু তার কিছু করার নেই। নিরুপায় সে। বাইরে থেকে তার কেবিনের তালা বন্ধ করে দিয়ে গেছে তার স্বামী। অনেকবার দরজা ধাক্কিয়ে হতাশ হয়ে সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে গুট্টিয়ারা। কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি, নিষেধ আছে।
ইকথিয়ান্ডারের চিঙ্কার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু বাড়ছে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে ইন্ডিয়ান এক সহযোগীকে নিয়ে জাহাজের খোলে নেমে আসতে বাধ্য হলো পেদরো জুরি। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হয়েছেটা কি? এত চেঁচাচ্ছ কেন?
আমার দম শেষ হয়ে যাচ্ছে, বলল ইকথিয়ান্ডার হাঁফাতে হাঁফাতে। মরে যাব। পানি ছাড়া মরে যাব মনে হচ্ছে। আমাকে সাগরে ছেড়ে দাও।
ডেকের ওপর চলে এলো অস্থির পেদোরা জুরিতা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সত্যি যদি সাগর-দানো মারা যায় তাহলে তার এত স্বপ্নের কি হবে? কোনমতেই ইকথিয়ান্ডারকে মরতে দেয়া যায় না।
সিদ্ধান্ত নিয়ে খালাসীদের মাধ্যমে একটা সমাধান করে ফেলল সে সমস্যার। একটা পিপেয় সাগরের পানি ভরে সেটা পাঠিয়ে দিল জাহাজের খোলে। দরকার হলে ইকথিয়ান্ডার বড় পিপেটায় ডুব দিয়ে দম নিতে পারবে।
ইকথিয়ান্ডারকে বলল, তুমি এটাতে একটু গোসল-টোসল সেরে নাও। সকাল হলে তোমাকে সাগরে নামানো হবে।
পিপের মধ্যে ঢুকে দম নিল ইকথিয়ান্ডার, সারা শরীর ভেজাতে শুরু করল। ইন্ডিয়ান খালাসীরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, অবাক হয়ে দেখছে তার কাণ্ড। ওরা শুনেছে, এই মানুষটাই নাকি আসলে সাগরের সেই ভয়ানক দানো।
এই, এখানে ভিড় কিসের! যাও, ডেকে যাও সবাই, খেঁকিয়ে উঠে খালাসীদের তাড়া লাগাল পেদরো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে বাধ্য হলো লোকগুলো।
এদিকে পানিতে ডুব দিয়েও শান্তি নেই ইকথিয়ান্ডারের। পিপে যত বড়ই হোক, হাত-পা না গুটিয়ে পানির নিচে ডুবে থাকা যাচ্ছে না। তাছাড়া পিপের গন্ধটাও অসহ্য লাগছে। এই পিপেতে থাকত নোনা মাংস। সেকারণে পানি থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। তবু কিছুই না থাকার চেয়ে সাগরের পানি ভর্তি এই পিপেটা থাকায় আপাতত প্রাণে বাচল ইকথিয়ান্ডার। জেলিফিশ জাহাজ উত্তর দিকে চলেছে। দক্ষিণ-পুর্ব থেকে পালে এসে লেগেছে সাগরের ঝিরঝিরে লবণাক্ত বায়ু।
ভোরের একটু আগে কেবিনে ফিরল পেদরো জুরিতা। সে ভেবেছিল তার বউ এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেবিনে ঢুকে দেখল একটা টেবিলে বসে আছে গুট্টিয়ারা, হাত দুটো চিন্তা করার ভঙ্গিতে মাথার দুপাশে ছাদ থেকে ঝুলন্ত লণ্ঠনের আলোয় গুট্টিয়ারার মুখটা ফ্যাকাশে লাগছে দেখতে, কেমন যেন দিশেহারা।
তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ, চাপা স্বরে অভিযোগ করল গুট্টিয়ারা।
না গুট্টি, পাখি পড়াল পেঁদরো। মিথ্যে গোপনের নানা কৌশল তার জন্মসূত্রে পাওয়া। প্রয়োগ করল বদগুণটা। বাঁকা হেসে বলল, আমি তো ওকে ছেড়েই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এই জাহাজে আছো জানার পর সে কিছুতেই যেতে রাজি নয় আর।
মিথ্যে কথা! মিথ্যেবাদী! তুমি একটা পশু! তোমার মুখ দেখতেও ঘৃণা হয়! টেবিল ছাড়ল গুট্টিয়ারা, চরকির মতো পাক খেল। হাতে দেয়ালের খাজে আটকানো ক্ষুরধার একটা ছোরা। সোজো পেদরোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গুট্টিয়ারা।
আচ্ছা! ছোটখাট একটা গর্জন ছাড়ল পেদরো। সহজেই গুট্টিয়ারার ছছারাসহ হাতটা ধরে ফেলল সে। জোরে মোচড় দিতেই হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল ছোরাটা লাথি মেরে হারাটা কেবিনের বাইরে বের করে দিল পেরে ভেতরটা রাগে জ্বলে গেলেও মুখে টেনে আনল ভদ্রতার হাসি। বলল, তুমি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। মাথা ঠাণ্ডা করো। এক গ্লাস পানি খেয়ে নাও, ভাল লাগবে।
কথা শেষ করে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। বাইরে থেকে কেবিনের তালা মেরে দিয়ে চলে গেল ওপরের ডেকে। যে মেয়ে তাকে আক্রমণ করার সাহস দেখাতে পারে তারই জাহাজে, সে মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমানোর মতো নির্বুদ্ধিতা করার তুলনায় অনেক চালাক লোক সে।
অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে পেনরো জুরিতার আদেশ। দুজন রেড ইন্ডিয়ান খালাসী ইকথিয়ারকে জাহাজের ডেকে নিয়ে এলো। দুর্বল হয়ে পড়েছে ইকথিয়ান্ডাব, তবু পালানোর সুযোগ আছে কিনা চোখ বুলিয়ে দেখে নিল একবার। খালাশিরা তাকে ছেড়ে দিতেই রেলিঙের দিকে দৌড় দিল। প্রাণপণে ছুটছে। রেলিং টপকে লাফ দেবে, তার আগেই ঝড়ের বেগে ওর পেছনে পৌঁছে গেল পেদরো জুরি, গায়ের জোরে ঘুসি বসিয়ে দিল মাথায়। ওই এক আঘাতেই জ্ঞান হারাল দুর্বল ইকথিয়ান্ডার, কাত হয়ে পড়ে গেল ডেকের ওপর।
উপদেশ দেবার সুরে বিড়বিড় করল পেদরো জুরিতা, এত তাড়াহুড়ো ঠিক নয়। ধীরেসুস্থে কাজ করো।
লোহার শেকল ঝনঝন শব্দ করছে। সরু এবং দীর্ঘ একটা শেকল নিয়ে আসা হয়েছে ডেকের ওপর। সেটার এক মাথা ইকথিয়ান্ডারের কোমরে জড়ানো হলো। তালা আটকে দেয়া হলো শেকলে টাইট করে।
এবার ওর মাথায় পানি ঢাললা, নির্দেশ দিল পেদরো।
একটু পর জ্ঞান ফিরল ইকথিয়ান্ডারের। কোমরে বাঁধা শেকলের দিকে অবাক হয়ে তাকাল ও। চোখ স্থির হলো পেদেরো জুরির ওপর।
যাতে পালাতে না পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা, জানাল পেদরো। এখন তোমাকে সাগরে নামানো হবে। বড় বড় মুক্তোভরা ঝিনুক তুলে আনবে তুমি আমাদের জন্যে। মুক্তো যত বড় হবে ততই বেশিক্ষণ তোমাকে সাগরে থাকতে দেব। মুক্তো যত পাওয়া গেলে তোমার কপালে পিপেয় গোসলের বেশি কিছু জুটবে না। বুঝতে পেরেছ কথা?
বিনা প্রতিবাদে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিল ইকথিয়ান্ডার। সাগরে নামল শেকল সহ। একটু চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল তার পক্ষে এই শেকল ছিঁড়ে মুক্ত হওয়া অসম্ভব। এবার কাজে মন দিল ও, কোমরের থলেতে মুক্তোভরা ঝিনুক ভরতে শুরু করল। কোমরে ব্যথা লাগছে ভারী শেকলের কারণে। তবুও ভাল। জাহাজের ওপরের ওই পিপের তুলনায় এখানে অনেক ভাল আছে সে।
সূর্য মাঝ আকাশে ওঠার আগে পর্যন্ত একটানা কাজ করল ও, তারপর ডাক দেয়ার জন্যে শেকলে টান দিল। থলেটা ততক্ষণে পেটমোটা লোকের মতো ফুলে উঠেছে।
জেলিফিশ জাহাজের খালাসীরা টেনে তুলল অসাধারণ ডুবুরিকে। প্রত্যেকেই কৌতূহলী। জানতে চায় ইকথিয়ান্ডার কেমন মুক্তো সংগ্রহ করছে।
এমনিতে ঝিনুক থেকে মুক্তো বের করার আগে ঝিনুকটাকে চার পাঁচদিন শুকনোয় রেখে পচিয়ে নেয়া হয়, যাতে মুক্তো বের করা সহজ হয়। কিন্তু ইকথিয়ান্ডার কি তুলেছে সেটা দেখার কৌতূহল এত তীব্র সবার যে দেরি করতে রাজি নয় কেউ। ছুরি দিয়ে ঝিনুকের মুখ খুলতে শুরু করল ওরা।
সব খোলা শেষে দেখা গেল এক ডুবে ইকথিয়ান্ডার যা তুলে এনেছে তার পরিমাণ রীতিমতো অবিশ্বাস্য। গোটা বিশেক মুক্তো একেবারে তুলনাহীন। ওগুলোর যে কোন একটা বিক্রি করে জেলিফিশের মতো জাহাজ কেনা যাবে। সামনে এখন বিপুল ঐশ্বর্য পাওয়ার পথ খুলে গেছে পেদরো জুরিতার।
কিন্তু সম্পদের সঙ্গে সঙ্গেই বিপদের ভয়ও বাড়ে। খেয়াল করল পেদরো, তার খালাসীরা চোখে নগ্ন লোভ নিয়ে মুক্তোগুলো দেখছে। ব্যাপারটা তার পছন্দ হলো না। মুক্তোগুলো ঝটপট সরিয়ে ফেলল সে। একটু পর ইকথিয়ান্ডারকে বলল, দারুণ ডুবুরি তুমি, ইকথিয়ান্ডার। ভাল কাজ দেখিয়েছ। পুরস্কার হিসেরে তোমার জন্যে একটা টিনের চৌবাচ্চার ব্যবস্থা করব ভাবছি। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, শেকল আমি কিছুতেই খুলব না। খুললেই তুমি তোমার কাঁকড়া বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা শুরু করে দেবে। নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা করে হাসল পেদরো।
পেদরোর সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিল না ইকথিয়ান্ডারের, কিন্তু যেহেতু ও পেদরোর হাতেই বন্দি, কাজেই সুবিধে অসুবিধের কথা তাকেই বলতে হয়। বাধ্য হয়ে ইকথিয়ান্ডার বলল, পিপের চেয়ে চৌবাচ্চা ভাল। কিন্তু পানিটা ঘনঘন বদলাতে হবে, নইলে আমি দম নিতে পারব না।
বদলাতে হবে কতক্ষণ পরপর?
আধঘণ্টা।
আরে বাপু, এ তো বসতে দিলে শুতে চায়! কাজ এখনও ঠিক। মতো শুরুই হয়নি তার আগেই এত দাবি কিসের!
অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় মাছ। পানি না বদলালে পানির অক্সিজেন কমে যাবে আমি শ্বাস নিতে থাকলে। একসময় আর দমই নিতে পারব না।
অত কথা বুঝি না। জানো তোমার চৌবাচ্চায় একটু পর পর পানি ভরতে কত খরচ পড়বে?
সেক্ষেত্রে আমি বলব, আমাকে সাগরে ছেড়ে দেয়া উচিত। ইকথিয়ান্ডারের চোখ ঘুরে এলো নীল সাগরের গা ছুঁয়ে।
লক্ষ করল পেদরো। হেসে উঠে বলল, বলো কী!
ছেড়ে দিন আমাকে, বলল ইকথিয়ান্ডার। পালাব না, কথা দিচ্ছি। আপনাকে আমি অনেক অনেক মুক্তো এনে দেব। গুট্টিয়ারা মুক্তো ভালবাসত দেখে ওর জন্যে মুক্তোর একটা স্তূপ করেছিলাম। ওই সমস্ত তূপ আপনাকে এনে দেব। ছেড়ে দিন আমাকে।
হা-হা করে হাসল পেরো, তারপর হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল, গুট্টিয়ারাকে তুমি এখনও ভালবাসো নাকি?
হ্যাঁ, বাসি।
কিন্তু সে এখন আমার স্ত্রী। সেকথা জানো?
তাতে কি! মানুষকে সবসময়েই ভালবাসা যায়।
কিন্তু সে এখন আমার মেয়েমানুষ।
কিন্তু মেয়ে হলেও তো সে মানুষ।
বিরক্ত বোধ করছে পেদরো। উভচর মানবের মনের সরলতা তাকে বিস্মিতও করছে। বুঝতে পারছে এভাবে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এসব বিষয়ের মীমাংসা হবে না। আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো পেদরো।
ছেড়ে দিলে তো আর কখনও ফিরবে না তুমি।
এবার ইকথিয়ান্ডারও বিরক্ত হলো। রেগে গিয়ে বলল, জীবনে আমি কখনও মিথ্যে কথা বলিনি।
তাহলে আমাকে বলো কোথায় আছে সেই মুক্তোর স্তূপ।
আছে সাগরের নিচে একটা গুহায়! লিডিং আর আমি ছাড়া আর কেউ চেনে না সেই গুহা,।
লিডিং! সে আবার কে? আমার পোষা ডলফিন। তাই নাকি?
ইকথিয়ান্ডারের কথাবার্তা কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে পেদরো জুরিতার। ভেবে দেখল। ইকথিয়ান্ডার মিথ্যে বলছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ব্যাপার যদি সত্যি হয়, সত্যি যদি মুক্তোর একটা তৃপ কোথাও থেকে থাকে তাহলে তা কল্পনাকেও হার মানাবে। এক নিমেষে বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোক হয়ে যাবে সে ওটা হাতাতে পারলে। আমেরিকার সেরা ধনী রস-চাইল্ড বা রকফেলার তখন তার তুলনায় রীতিমতো গরীব লোক! লাগামছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভেসে গেল পেদরোর মন।
কিন্তু ব্যবসায়ী মানুষ সে। পোক্ত বুদ্ধি। মানুষের কথা চট করে বিশ্বাস করার তুলনায় অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। মনে মনে ঠিক করল মুক্তোর তূপ কিভাবে দখল করবে। বাঁকা বুদ্ধি তার। হঠাৎ করে গুট্টিয়ারার কথা মনে পড়ল। এব্যাপারে টিয়ারা তাকে সাহায্য করতে পারবে। শুট্টি যদি অনুরোধ করে তাহলে এক্ষুণি ওই তূপের সন্ধান দিয়ে দেবে ইকথিয়ান্ডার। আরও একটু ভাবনা-চিন্তা সেরে নিয়ে সে বলল, দেখো, ইকথিয়ান্ডার, বন্দি হলেও তুমি আমার মেহমান। সেকারণে তোমার আরামের ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। সেজন্যে ভাবছি তোমার জন্যে বড় একটা লোহার খাঁচা তৈরি করাব। ঐ খাচায় করে নামিয়ে দেব তোমাকে। হাঙর, কুমির, অক্টোপাসের ভয় আর থাকবে না। তুমি আর আমি দুজনই এভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।
আমার কিন্তু বাতাসেও সময় কাটাতে হয়, জানাল ইকথিয়ান্ডার।
পেদরো এখন মস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী। কোন অসুবিধে নেই। মাঝে মাঝে খাঁচাটা তুলে আনলেই হবে।
এই নিয়মটা নিজেরই বেশ পছন্দ হলে পেদরোর। বিরাট একটা সমস্যার সমাধান তাহলে হলো। খুশি হয়ে উঠল পেদরো। এতই, যে উদার ভাবে নির্দেশ দিল, আজকে জেলিফিশ জাহাজের সবাইকে এক পাত্র করে মদ দেয়া হোক।
ইকথিয়ান্ডারকে আবার জাহাজের খোলে আটকে রাখা হলো। আশ্বাস দেয়া হলো তাকে, শীঘ্রি চৌবাচ্চা আর খাঁচা তৈরি হয়ে যাবে।
মুক্তোগুলো টুপিতে ভরে খুশি মনে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেল পেদরো। কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে মুক্তোগুলো গুট্টিয়ারাকে দেখিয়ে বলল, দেখো, তোমাকে কত ভালবাসি। সেজন্যেই তো কথা রেখেছি। এই যে, তুমি মুক্তো ভালবাসো, তাই তোমার জন্যে সেরা মুক্তোগুলো আমি নিয়ে এসেছি। এই দেখো।
মুক্তোগুলোর ওপর ঘুরে এলো গুট্টিয়ারার চোখ, স্থির হলো পেদরোর ওপর। মনে মনে বিস্মিত হলেও ওর মুখে ভাবের কোন প্রকাশ নেই। চোখ বোধহয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কারণ বিস্ময় দেখে বলল পেদরো, তুমি হবে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে ধনী মহিলা। হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মহিলা। কি চাই তোমার বলো একবার মুখ ফুটে। যা চাইবে তা-ই পাবে। তোমার জন্যে আমি এমন একটা প্রাসাদ বানাব যে দেখলেও রাজা-রাজড়াদেরও হিংসায় অন্তর জ্বলবে।
গুট্টিয়ারা কিছুই বলল না। উচ্ছাস সামলাতে না পেরে পেদরো বলেই চলল, এই মুক্তোগুলো তুমি রাখো। এগুলো আমার প্রতিশ্রুতির আগাম জামিন ইকথিয়ান্ডারকে দিয়ে তুলিয়েছি এগুলো। দুর্দান্ত ডুবুরি ও।
চোখ জোড়া এক পলকের জন্যে জ্বলে উঠল গুট্টিয়ারার। রাগ। চেপে শান্ত গলায় বলল, ঐ নোংরা ভাবে আহরিত মুক্তো আমার চাই। যাও তুমি এখান থেকে। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল পেদরো। গুট্টিয়ারার এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানে। রাগও হলো। বিব্রত বোধ করল। সেসব অনুভূতি চেপে ঠাট্টার সুরে বলল, আপনি কি চান না ইকথিয়ান্ডার মুক্তি পাক, জনাবা?
সম্বোধন এবং প্রস্তাব দুটোই অবিশ্বাস্য। গুট্টিয়ারা বলল, তারপর? আর কত মিথ্যে বলবে?
মিথ্যে বলছি না। কথা সোজা। যদি বোঝে। ইকথিয়ান্ডারের ভাগ্য এখন তোমার হাতে। সাগরের নিচে কোথায় যেন সে মুক্তোর একটা তূপ করে রেখেছে। ওগুলো সে আমার জাহাজে ভুলে দিক, তাকে আমি ছেড়ে দেব। তাকে বলে এই কাজটুকু তুমি করিয়ে দাও, মুক্তি পাবে সাগর-দানো।
নিষ্পলক চোখে পেদরোর দিকে চেয়ে থাকল গুট্টিয়ারা। বুঝতে চেষ্টা করল কুটিল কোন দুরভিসন্ধি আছে কিনা পেদরোর মনে। একটু পর বলল, তোমার কথা তো শুনলাম। এবার তাহলে আমার কথাগুলোও শুনে রাখো। মুক্তোগুলো হাতে পাবার পর আবার তুমি ইকথিয়ান্ডারকে শেকলে বেঁধে রাখবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মাথা নাড়ল। কোনও নিশ্চয়তা নেই। শুনে নাও শেষ বারের মতো, আমাকে এসব নোংরা ব্যাপারে আর জড়াতে পারবে না। চলে যাও এখন এখান–থেকে, প্লিজ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
ধুপধাপ পা ফেলে স্ত্রীর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো পেদরো। আর কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই সেটা বুঝতে তার দেরি হয়নি। নিজের কেবিনে ফিরল সে। সিন্দুকে সাবধানে ভরে রাখল মুক্তোগুলো। কেবিনের বাইরে এসে একটা চুরুট ধরাল। বিপুল ধনসম্পদের ভাবনায় মনটা তার কল্পনাবিলাসী হয়ে আছে। স্ত্রী তার যেমনই হোক, না-ই বা বাসুক ভালো, দুনিয়ার সেরা ধনী হতে চলেছে সে, এতে আর সন্দেহের তেমন কোন অবকাশ নেই। বিভোর হয়ে আছে পেদরো জুরিতা। এতই বিভোর যে লক্ষ করল না তার খালাসীরা ছোট ছোট জটলা করে নিচু স্বরে কি যেন আলাপ করছে। পরিবেশে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা।