আক্রমণটা হঠাৎ করেই এলো। খালাসীদের দলপতির নির্দেশে একযোগে পেদরো জুরিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেশ কয়েকজন খালাসী। তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, কিন্তু সংখ্যায় তারা অনেক। পেদো জুরিতাকে ঘায়েল করা তাদের জন্যে সহজ হলো না। দুজন খালাসী তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। তাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে পিছনে হটল পেদরো, রেলিঙে জোরে ধাক্কা দিল পিঠ দিয়ে। খালাসী দুজন আর্তনাদ করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বড় গেল ডোকর ওপর। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল পেদরো, সামনে বাড়ল দুহাতে ঘুসি মারতে মারতে।
আক্রমণটা এতই আকস্মিক যে কোমরে হাত দিয়ে হোলস্টার থেকে যে রিভলভার বের করবে সেই সময়টুকুওঁ পাচ্ছে না, পেরেরা। মাস্তুলের দিকে পিছু হটছে সে ঘুসি ছুঁড়তে ছুঁড়তে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল আড়কাঠে, মাস্তুলের ওপর উঠতে চেষ্টা করছে।
এক খালাসী তার পা চেপে ধরল। রাখতে পারল না ধরে। মাথায় পেদরোর প্রচণ্ড লাথি খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ডেকে। মাস্তুলে চড়ছে পেদরো, খালাসীদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। একেবারে ওপরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। গালাগাল করছে খালাসীদের। রিভলভার বের করে শাসাল।
কুত্তার বাচ্চারা! এক পা সামনে বেড়েছিস তো গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।
উদ্যত অস্ত্রটা দেখে একটু দমে গেল খালাসীরা। নাগালের বাইরে পেদরো আস্ফালন করছে। দ্রুত আলোচনা চলল খালাসীদের ভেতর, কি করা যায় এই পরিস্থিতিতে।
একটু পরই খালাসীদের দলপতির গলা পাওয়া গেল। ক্যাপ্টেনের কেবিনে বন্দুক আছে। চলো, দরজা ভেঙে ওটা নিয়ে আসি।
দলপতির কথায় চমকে গেল পেদরো। বড়লোক হবার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় অস্থির লাগল তার। বড়লোক হওয়া তো দূরের কথা, এখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি। বাঁচার সম্ভাবনা কতটা সেটা ভেবে দেখতে হবে।
হতাশ পেদরো সাগরের দিকে তাকাল। চোখ আটকে গেল তার সাগরে। যা দেখছে তা নিজেও বিশ্বাস করতে পারল না। ছোট একটা সাবমেরিন তীব্র গতিতে জেলিফিশ জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে!
প্রার্থনা শুরু করল পেদরো, সাবমেরিনটা যাতে পানির নিচে ডুব দিয়ে অন্যদিকে না যায়। দেখতে পেল একজন লোক সাবমেরিনের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মাঝে আশা জাগল পেদক্টের, লোকগুলো নিশ্চই তাকে দেখতে পাচ্ছে। ওরা জানে কী ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে সে।
প্রাণপণে চিৎকার করল পেদরো, বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে এরা খুন করে ফেলল!
সাবমেরিনের লোকজন বোধহয় তাকে দেখতে পেয়েছে। আওয়াজও শুনে থাকবে হয়তো। সাবমেরিনটা দ্রুত ছুটে আসছে জাহাজের দিকে।
এদিকে ডেকের ওপর বিশৃক্ষলা দেখা দিয়েছে। ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজা ভেঙে বন্দুক নিয়ে এসেছে খালাসীরা, কিন্তু সাবমেরিনটা দেখে তারাও চমকিত হয়ে থমকে দাঁড়াল। ওটা সামরিক সাবমেরিন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের কপালে খারাবি আছে। পেরোকে হত্যার প্রচেষ্টায় তাদের না কঠিন শাস্তি হয়ে যায়!
মনে সাহস ফিরে পেল পেদরো জুরিতা। উল্লসিত হয়ে উঠল। কিন্তু সেই উল্লাস অতি অল্প সময় স্থায়ী হলো। সাবমেরিনের ডেকে এসে দাঁড়িয়েছে বালথাযার আর ক্রিস্টো। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকা এবং তীক্ষ্ণ নাক তাঁর। চেহারায় ব্যক্তিত্ত্বের ছটা।
চিৎকার করলেন ভদ্রলোক, ক্যাপ্টেন পেদরো জুরিতা, ইকথিয়ান্ডারকে এক্ষুণি আমাদের হাতে তুলে দিন, তা নাহলে আপনার জাহাজ আমি ডুবিয়ে দেব। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। দেরি করলে নিজের সর্বনাশ করবেন।
বিশ্বাসঘাতক! বালথাযার আর ক্রিস্টোর দিকে চেয়ে মনে মনে বলল পেদরো। বুঝতে পারছে জাহাজডুবি হয়ে ভিখারি হবার চেয়ে ইকথিয়ান্ডারকে খোয়ানো অনেক ভাল। মাস্তুল থেকে নামতে শুরু করে চেঁচাল সে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। এক্ষুণি ইকথিয়ান্ডারকে নিয়ে আসছি।
খালাসীদের বুঝতে বাকি নেই এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ পালিয়ে যাওয়া। ঝটপট কয়েকটা নৌকো নামিয়ে ফেলল তারা সাগরে। কারও কারও সেটুকু তরও সইল না, লাফ দিয়ে সাগরে পড়ে সাঁতরে এগিয়ে চলল তীরের দিকে। যে যার প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে তার কেবিনে এসে ঢুকল পেদরো, সিন্দুক খুলে মুক্তোগুলো বের করে শার্টের পকের্টে রাখল, তারপর গেল গুট্টিয়ারার কেবিনে। গুট্টিয়ারাকে বের করে ডেকের ওপর নিয়ে এলো। সাবমেরিনের দিকে চেয়ে বলল, ইকথিয়ান্ডার অসুস্থ বোধ করছে। সে তার কেবিনে আছে।
একটা নৌকো পানিতে নামাল পেদরো। গুট্টিয়ারাকে নৌকোয় তুলে নৌকো ভাসিয়ে দিল। নিজে বসে আছে দাড়ীর আসনে। খুবই অগভীর পানিতে নৌকো সরিয়ে নিয়েছে চতুর পেদরো। এখন আর তাকে সাবমেরিন নিয়ে অনুসরণ করার কোন উপায় নেই।
সাবমেরিনের ডেকে বালথাযারকে দেখতে পেয়েছে গুট্টিয়ারা। চিৎকার করল মেয়েটা: বাবা, ইকথিয়ান্ডার জাহাজে আছে…ওকে তোমরা উদ্ধার…
তাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিল না পলাতক পেদরো, রুমাল দিয়ে স্ত্রীর মুখ বেঁধে ফেলল। হাত দুটো বাঁধল কোমর থেকে বেল্ট খুলে।
তার আচরণ লক্ষ করেছেন সালভাদর। তিনি চিৎকার করে বললেন, ওই মহিলাকে আপনি ছেড়ে দিন, পেদরো।
এ আমার স্ত্রী, জবাবে বলল পেদরো। আমাদের ব্যাপারে আপনি নাক গলাবেন না। দাঁড় টানার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত তীরের দিকে চলেছে নৌকো অগভীর পানি পাড়ি দিয়ে।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে এরকম আচরণ করার কোন অধিকার নেই আপনার, বললেন সালভাদর। নৌকো থামান, নইলে কিন্তু আমি গুলি করব।
রিভলভার তাক করে গুলি করলেন সালভাদর। নৌকোর গায়ে বিঁধল বুলেট।
সঙ্গে সঙ্গে গুট্টিয়ারাকে সামনে ঠেলে নিজে তার আড়াল নিল পেদরো। কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, গুলি করবেন বুঝি? করুন দেখি!
পেদরোর হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করছে গুট্টিয়ারা, পারছে না। পশু? রিভলভার নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন ডাক্তার।
নৌকোটাকে ধরবার জন্যে সাগরে নামল বালথাযার, সাঁতার দিয়ে নৌকোর গতির সঙ্গে পারল না। বারকয়েক দাঁড় টানতেই তীরে পৌঁছে গেল নৌকো! গুট্টিয়ারাকে জোর করে ধরে নামাল পেদরো, চলে গেল সৈকতের পাথরের স্তৃপগুলোর আড়ালে।
পেদরোকে ধরা যাবে না বুঝে জেলিফিশ জাহাজে এসে উঠল বালথাযার। ডেকে উঠে নোঙরের শেকল ছেড়ে খুঁজতে শুরু করল জাহাজ। কেবিন, ডেক, নিচের তলা-সবখানে খুঁজল। কোথাও ইকথিয়ান্ডারকে দেখতে পেল না। চিৎকার করে সালভাদরকে বলল, ইকথিয়ান্ডার জাহাজে নেই।
কিন্তু এখানেই তার থাকার কথা, আপত্তি জানাল ক্রিস্টো। গুট্টিয়ারা বলে গেছে ও জাহাজে আছে।
হঠাৎ পানিতে চোখ পড়তে ক্রিস্টো দেখল পানির ওপর এক জায়গায় একটা মাস্তুলের ডগা উঁচু হয়ে আছে। দেখে মনে হয় কিছুদিন আগে এখানে জাহাজডুবি হয়েছে। এমন হতে পারে যে ইকথিয়ান্ডার ওই ডুবে যাওয়া জাহাজে লুকিয়ে আছে। পেদরো হয়তো নিজেই তাকে ওখানে পাঠিয়েছে ধনরত্ন আহরণের জন্যে।
সাবমেরিনের রেলিং ধরে চিন্তিত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার সালভাদর। তিনি বললেন, ওখানে ইকথিয়ান্ডার নেই, ক্রিস্টো। পেদরোর সঙ্গে লড়াইতে আমরা জিতলাম, কিন্তু ইকথিয়ান্ডারকে ফিরে পেলাম না।