জাহাজে উঠতেই এগিয়ে এসে আমাদের সালাম জানাল মেট অ্যারো। চামড়ার রঙ তামাটে, চোখ ট্যারা, কানে ইয়ারিং। কোন এক সময় নৌবাহিনীতে ছিল হয়ত। ট্রেলনীর সঙ্গে তার সদ্ভাব, সহজেই বোঝা যায়।
অ্যারোর সঙ্গে কথা বলছেন ট্রেলনী, এই সময় কয়েকজন নাবিকের পেছনে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন হিসপানিওলার ক্যাপ্টেন। রুক্ষ কিন্তু ধারাল চেহারা। সারাক্ষণই যেন রেগে আছেন। ভদ্রতার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না ক্যাপ্টেন, এসেই শুরু করলেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে, মিস্টার ট্রেলনী।
ও, ক্যাপ্টেন স্মলেট? ভুরু কুঁচকে গেছে জমিদারের, কি কথা?
সোজাসুজিই বলছি। এই জাহাজের লোকজনদের মোটেই ভাল লাগছে না আমার।
জাহাজটাও নিশ্চয় ভাল লাগছে না আপনার? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল রেগে গেছেন ট্রেলনী।
জাহাজটা সত্যিই ভাল কি মন্দ, জানি না এখনও। না চালিয়ে কোন মন্তব্য করব না।
জাহাজ পছন্দ নয়, নাবিকেরা ভাল নয়, তাহলে নিশ্চয় হিসপানিওলার মালিককেও আপনার সুবিধের মনে হচ্ছে না?
তর্কবিতর্ক খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে, বুঝে, হাত তুলে থামালেন দুজনকে ডাক্তারচাচা, আরে কি শুরু করলেন আপনারা? ক্যাপ্টেনের পক্ষ নিয়ে বললেন তিনি, ক্যাপ্টেন স্মলেট একটা কথা বলেছেন, সেটা সত্যি কি মিথ্যে না জেনে খামোকা তর্ক বাধাচ্ছ কেন, স্কয়ার? জাহাজের ভার যখন তার ওপর, ভালমন্দ সব বিষয়েই কথা বলার অধিকারও আছে। হ্যাঁ ক্যাপ্টেন, বলুন, কেন আপনার পছন্দ নয়?
চাকরি দেবার সময় আমাকে বলা হয়েছে, একটা গোপন মিশনে চলেছে হিসপানিওলা। কিন্তু জাহাজে উঠে দেখি, ওমা, নাবিকেরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে। কেন, কোথায় যাচ্ছে জাহাজ, সব জানে! এটা কেমন ধরনের কথা, স্যার?
ভুল বলেননি আপনি, ক্যাপ্টেনের স্বপক্ষে রায় দিয়ে বললেন ডাক্তারচাচা।
আরও কথা আছে। নাবিকেরা বলাবলি করছে, গুপ্তধনের সন্ধানে যাচ্ছে এই জাহাজ। নাবিকদের মুখে কথা ছড়ায় বেশি। কোথায় কোন্ ডাকাতের দল শুনবে কথাটা, ব্যস, পিছু নেবে…বেঁচে আর ফিরে আসতে হবে না। আপনিই বলুন, জেনেশুনে কে মরতে যায়?
আপনার এই অভিযোগও ফেলনা নয়, বললেন ডাক্তারচাচা। কিন্তু নাবিকদের পছন্দ করছেন না কেন?
দেখুন, স্যার, শুনেছি আপনি ডাক্তার। রোগীর চেহারা দেখেই ভেতরের অনেক কিছু আঁচ করতে পারেন। আমি নাবিক, সারাজীবন নাবিকদের মাঝে কাটিয়েছি। চোখ দেখে ওদের চরিত্র অন্তত কিছুটা বুঝব না, ভাবলেন কি করে? কথাটা যখন উঠেই পড়ল, তো বলি, এই জাহাজ সামলানোর দায়িত্ব আমার। নাবিকদের ভারও থাকবে আমারই ওপর। কাজেই নাবিক জোগাড়ের ভারটাও আমার ওপর দিলেই ভাল করতেন।
আপনার কথায় যুক্তি আছে, বললেন ডাক্তারচাচা। কিন্তু কাকে কাকে পছন্দ হয় আপনার, বলুন তো? মেট অ্যারোকে কেমন মনে হয় আপনার?
নাবিক হিসেবে খারাপ না। তবে তার স্বভাব অফিসারের মত নয়। মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে বসে মদ খায়…
মদ খেলে কি হল! আপনি খান না? খেঁকিয়ে উঠলেন ট্রেলনী।
খাই, কর্কশ হয়ে উঠেছে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ, কিন্তু আমার বক্তব্য সেটা নয়। আমি বোঝাতে চাইছি, মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া জাহাজের অফিসারদের জন্যে বেমানান।
পরিষ্কার করে বলুন তো, ক্যাপ্টেন, কি বলতে চান আপনি? প্রশ্ন করলেন ডাক্তারচাচা।
সত্যিই এই অভিযানে যাবার ইচ্ছে আপনাদের আছে?
নিশ্চয়! বললেন জমিদার। তার রাগ কমেনি, নইলে এত খরচাপাতি কিসের জন্যে?
বেশ। তাহলে বলছি, যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু এই মুহূর্ত থেকে আমার আদেশেই সব কিছু চলবে হিসপানিওলায়। কান্ডটা দেখুন তো! নিচে সুন্দর স্টোররূম থাকতে জাহাজের সামনে এনে জমা করেছে সব গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র! ওগুলো সরাব আমি ওখান থেকে। তাছাড়া যে চারজন লোককে ওই গোলাবারুদের পাহারায় রাখা হয়েছে, তাদের কোন দরকার নেই। ওরা থাকবে নিজের নিজের কোয়ার্টারে।
ঠিক আছে, মেনে নিলাম, বললেন ট্রেলনী। আর কিছু বলবেন?
বলব। হিসপানিওলা কোথায়, কেন সব জানাজানি হয়ে গেছে…
ঠিকই বলেছেন আপনি, ক্যাপ্টেন, সায় দিলেন ডাক্তারচাচা।
নিজের কানে শুনেছি আমি, আপনাদের কাছে দ্বীপের ম্যাপ আছে। সেই ম্যাপে চিহ্নিত করা আছে কোথায় গুপ্তধন মিলবে। দ্বীপটার অবস্থানও জানি, মানে শুনেছি… গড়গড় করে অবস্থানটা সঠিক আউড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন।
আশ্চর্য তো! বললেন জমিদার, আমি এ কথা কাউকে জানাইনি!
অথচ হিসপানিওলার নাবিকদের কারও অজানা নেই! থমথমে গম্ভীর ক্যাপ্টেনের মুখ।
কে বলল তাহলে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার আমার একবার ডাক্তারচাচার মুখের দিকে তাকালেন জমিদার।
বেশি কথা বলি না আমি, তুমি জানো, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ডাক্তারচাচা। আর জিমও বেঁফাস কথা বলার ছেলে নয়।
কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন জমিদার, কিন্তু তার আগেই বলে ফেললেন ক্যাপ্টেন, কার কাছে আছে ম্যাপটা জানি না, জানতে চাইও না। কিন্তু দেখবেন, খুইয়ে না বসেন ওটা।
গুপ্তধন…ম্যাপ…গোলাবারুদ, ক্যাপ্টেন, আপনি কি বিদ্রোহের আশঙ্কা করছেন? জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তারচাচা।
এ-ব্যাপারে খোলাখুলি এখুনি কিছু বলতে পারব না, মাপ করবেন। আমার সন্দেহ হয়েছিল, জানালাম, পরে যেন দোষ না দিতে পারেন আমাকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন আমি, জাহাজের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাই আমার। আমাকে পুরো স্বাধীনতা আর জাহাজের শাসন ক্ষমতা দিতে হবে। নইলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই মুহূর্তে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না আমার।
একবার জমিদারের দিকে তাকালেন ডাক্তারচাচা, তারপর ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ক্যাপ্টেন স্মলেট, আপনার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না আর।
আপনি বুদ্ধিমান শুনেছি, বললেন কাপ্টেন। ঠিকই শুনেছি।
ডাক্তার যখন বলছে, বললেন জমিদার। আমার বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়।
বড় বড় কথা বলে ফেললাম, মাপ করবেন আমাকে, মিস্টার ট্রেলনী, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন। আমাকে আমার মত কাজ করতে দিন, কথা দিচ্ছি, কোন ফাঁকি কিংবা অবহেলা পাবেন না। আর একটাও কথা না বলে ঘুরে চলে গেলেন স্মলেট।
দুজন খাটি লোক পেয়েছ হে তুমি, জমিদার, বললেন ডাক্তারচাচা। একটি ওই জন সিলভার, আরেকটি এই ক্যাপ্টেন।
এটার চাইতে সিলভার অনেক ভাল, মুখ গোমড়াই রয়েছে জমিদারের। এই ব্যাটা তো ব্যবহারই জানে না। ইংরেজের বাচ্চা অমন হতে দেখিনি কখনও!
হয়েছে, হয়েছে, শান্ত হও, বললেন ডাক্তারচাচা।
জাহাজের সব ব্যবস্থা আবার ঢেলে সাজানো শুরু হল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু তদারক করছেন ক্যাপ্টেন, তাঁকে সাহায্য করছে মেট অ্যারো।
জোর কাজ চলছে, এই সময় একটা নৌকায় করে কয়েকজন লোক এল। হিসপানিওলার চাকুরেই ওরা, সর্বশেষ আগমন। তাদের মধ্যে সিলভারও আছে।
একটা পা নেই, কিন্তু ঝোলানো দড়ি বেয়ে বানরের মত ক্ষিপ্রতায় ডেকে উঠে এল সিলভার। উঠেই প্রশ্ন করল, একি? কি হচ্ছে?
গোলাবারুদ সরাচ্ছি, বলল একজন নাবিক।
কেন? দেরি হয়ে যাবে যে তাহলে? আজকের জোয়ার ধরতে পারব না!
এই, তোমার এত মাতব্বরী কেন? ধমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন, রান্নাঘরে যাও! খাওয়ার ব্যবস্থা করগে…যত্তোসব… গজ গজ করে উঠলেন তিনি।
মাপ করবেন, স্যার, এই যে যাচ্ছি… তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের উদ্দেশে চলে গেল সিলভার।
মনে হচ্ছে কথা একটু বেশি বলে, মন্তব্য করলেন ডাক্তারচাচা। তবে লোক ভাল..ব্যবহারেই বোঝা যায়।
হবে হয়ত! বললেন স্মলেট। কথাবার্তা শুনতে একটু বেশিই এগিয়েছিলাম, ক্যাপ্টেনের নজরে পড়ে গেলাম। খেঁকিয়ে উঠলেন, এই, এই ছেলে, তুমি এখানে কি করছ? যাও, রান্নাঘরে যাও। বাবুর্চিকে সাহায্য করগে।
তিলমাত্র বিলম্ব না করে রওনা হলাম। পেছনে ক্যাপ্টেনের গজগজ শোনা গেল, কোন সুপারিশ, পেয়ারের লোকটোক চলবে না আমার জাহাজে। কাজ করতে হবে…
স্কয়ার ট্রেলনীর সঙ্গে সেই মুহূর্তে একমত হলাম আমি। অসহ্য লোক ক্যাপ্টেন স্মলেট। তাঁর প্রতি গভীর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল আমার মন।