কাজ থেকে ফিরে সবেমাত্র খেতে বসেছে অলসেন, এমন সময় তার দরজায় টোকা পড়ল। একটু বিরক্তভাবেই সে জিজ্ঞেস করল, কে?
দরজা খুলে ঘরে এসে যে ঢুকল তাকে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না অলসেন, আশ্চর্য হয়ে গেল।
গুট্টিয়ারা!
গুট্টিয়ারা? তুমি? তুমি এখানে?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অলসেন। এখনও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
গুট্টিয়ারা বলল, শুভ সন্ধ্যা, অলসেন। না, না, তোমাকে খাওয়া বন্ধ করতে হবে না। আমার কথাগুলো আমি দাঁড়িয়েই বলে যাচ্ছি, তুমি শোনো।
দরজা বন্ধ করে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল গুট্টিয়ারা। তারপর বেশ তিক্ত স্বরেই সে বলতে শুরু করল, আমার স্বামী আর শাশুড়ীর সঙ্গে আমি আর থাকতে পারছি না। হ্যাঁ, পেদারো আর তার মা বুড়ি ডলোরেসের কথাই বলছি। আমার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে পেদরো। তাই আমিও তাকে ছেড়ে এলাম। হ্যাঁ, একেবারেই ছেড়ে চলে এসেছি।
ইতিমধ্যেই অলসেনের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর এই বৃত্তান্ত শোনার পর খাবারের প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে বলল, সত্যি খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তোমার মতো ভাল মেয়ে… তোমার পা কাঁপছে, গুঠিয়ার। তুমি বসো।
সত্যি উত্তেজনায় পা কাঁপছে গুট্টিয়ারার। একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে অলসেন আবার বলল, কিন্তু তুমিই না বলেছিলে, স্রষ্টা যার সঙ্গে জীবন মিলিয়ে দিয়েছেন, মানুষের তাকে মেনে নেওয়াই উচিত? বিব্রত বোধ করছে গুট্টিয়ারা। খারাপ লাগল অলসেনের। থাক, ওসব কথা এখন থাক। কিন্তু ব্যাপার কি বলো তো? কোথায় উঠেছ? বাবার কাছে?
বাবা কিছুই জানে না। আর তাছাড়া ওখানে গেলে পেদরো আমাকে সহজেই খুঁজে বের করে ফেলবে। আবার আমাকে সে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তার বাড়িতে।
অলসেন বলল, তাহলে কোথায় উঠেছ?
উঠেছি এক বান্ধবীর বাড়িতে।
তারপর? এখন কি করবে তুমি?
আমি তোমার কারখানায় কাজে ঢুকব, অলসেন। সেই কথাই তোমায় বলতে এসেছি। তোমার বোতাম কারখানায় আমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দাও-যেকোন কাজ।
চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল অলসেন, তারপর বলল, সেটা এখন খুব সমস্যা। বাইরে কারও পক্ষে সেখানে ঢুকতে পারাই মুস্কিল। একটু : ভেবে অলসেন আবার প্রশ্ন করল, কিন্তু ধরো তোমাকে কাজ দিতে। পারলাম। তোমার স্বামী? সে কি বলবে?
তেজের সঙ্গে গুট্টিয়ারা বলল, আমি তা জানতেও চাই না।
অলসেন হেসে বলল, কিন্তু বউ কোথায় গেল, এটা তো স্বামী মাত্রেই জানতে চাইবে। ভুলে যেয়ো না যে তুমি আর্জেন্টিনায় আছো। পেদরো তোমাকে যখন খুঁজে বের করবে তখন কিন্তু…হ্যাঁ, জানোই তো, তোমাকে তখন আর সে শান্তিতে থাকতে দেবে না। আইন আর জনমত, দুই-ই তার পক্ষে থাকবে।
অন্যমনস্ক হয়ে গুট্টিয়ারা কি যেন ভাবছিল। একসময় দৃঢ় কণ্ঠে সে বলে উঠল, তাহলে চলে যাব কানাডায় কিংবা আলাস্কায়…
সঙ্গে সঙ্গেই অলসেন বলে উঠল, গ্রীনল্যান্ডে কিংবা উত্তর মেরুতে। তারপর পরিহাস ছেড়ে গম্ভীরভাবে সে বলল, কোথায় যাওয়া যায় সেটা না হয় পরেই ভেবে দেখা যাবে। তবে এখানে খাকাটা যে তোমার পক্ষে নিরাপদ হবে না সেটা আমারও মনে হচ্ছে। আর আমি নিজেও অনেকদিন থেকে কোথাও চলে যাবার কথাই ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে তাই ভাবি, কোন কুক্ষণে যে মরতে এসেছিলাম এই ল্যাটিন আমেরিকায়!
গুট্টিয়ারা তার দিকে একাগ্রভাবে তাকিয়ে আছে দেখে উৎসাহিত হয়ে অলসেন আবার বলতে শুরু করল, ..দুঃখের কথা, সেবার আমরা পালাতে পারলাম না। পেদরো তোমাকে জয় করে নিয়ে চলে গেল, ভাঙা একটা মন ছাড়া আর কিছুই রইল না আমার। এখন ইউরোপ যাবার টাকা আমার কাছে নেই, আর মনে হয়, তোমার কাছেও নেই নিশ্চয়। আবেগের উচ্ছাসে অলসেন আবার বলে উঠল, কিন্তু গুট্টিয়ারা, ইউরোপে আমাদের যেতেই হবে। তোমাকে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
গুট্টিয়ারা বলল, সত্যিই?
হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। অন্তত আমাদের পাশের দেশ প্যারাগুয়েতেও যদি পৌঁছতে পারি, আরও ভাল হয় যদি ব্রাজিলে গিয়ে পড়তে পারি, তাহলে পেদরোর পক্ষে তোমাকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে। আর আমরাও তাহলে উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপে পাড়ি দেবার সময় পেয়ে যাব। হ্যাঁ, জানো তো, ডাক্তার সালভাদর আর ইকথিয়ান্ডার এখন জেলে রয়েছে?
অস্ফুট স্বরে গুট্টিয়ারা বলে উঠল, ইকথিয়ান্ডার! তাকে পাওয়া গেছে তাহলে? কিন্তু জেলখানায় কেন?
অলসেন বলল, বিদঘুটে এক মামলায় ইকথিয়ান্ডার আর ডাক্তার সালভাদর দুজনেই আটক হয়ে আছে জেলে।
উদ্বিগ্নভাবে গুট্টিয়ারা বলল, ইকথিয়ান্ডারকে বাঁচানো যায় না?
অলসেন যেন কিছু একটা ভেবে নিল। তারপর বলল, তুমি না বললেও তাকে বাঁচার চেষ্টা আমি করেই চলেছি। এখনও কোন ফল হয়নি। তবে হঠাৎ একজন বন্ধু পেয়ে গেছি। ভদ্রলোক হলেন, স্বয়ং জেলার সাহেব। এই মাত্র তাঁর কাছ থেকে একটা চিরকুট পেয়েছি। আজ রাতেই ইকথিয়ান্ডারকে মুক্ত করতে হবে। আমার সাহায্য চেয়েছেন জেলার। আর ডাক্তার সালভাদরও একটা চিঠি পাঠিয়েছেন আমাকে।
গুট্টিয়ারা বলে উঠল, তোমার সঙ্গে আমিও যাব, অলসেন। ইকথিয়ান্ডারের সঙ্গে আমি দেখা করব।
আপত্তি জানিয়ে অলসেন বলল, তার সঙ্গে তোমার এখন দেখা না হওয়াই ভাল গুট্টিয়ারা!
কেন?
ইকথিয়ান্ডর এখন অসুস্থ।
তার মানে? কি হয়েছে তার?
অলসেন বল, স্থলচর মানুষ হিসেবে সে এখন অসুস্থ, তবে জলচর মাছ হিসেবে সে সুস্থই আছে। ইকথিয়ান্ডার এখন আর বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। ওর মানুষের ফুসফুস দুটো ক্রমশই শুকিয়ে আসছে। ওকে বোধহয় এবার পুরোপুরিভাবে জলেই থাকতে হবে।
কতকটা স্বগতোক্তির মতই গুট্টিয়ারা বলল, তাই থাকুক, তা-ও ভাল। তবে বেঁচে থাকবে তো?
অলসেন বলল, তা থাকবে বটে। কিন্তু তুমি এখন ওর সামনে যেয়ো না। তোমাকে দেখলে ওর মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাবে আর তাতে ওর শ্বাসকষ্টও বৃদ্ধি পাবে। আর তাছাড়া তোমাকে দেখলে। তোমার কাছেই ও থাকতে চাইবে, আর ডাঙায় বাস করলে একেবারেই ও মারা পড়বে।
মাথা নিচু করে গুট্টিয়ারা কি যেন একবার ভেনিল। তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি, অলসেন।
অলসেনও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বড়ই অভাগা ওই ইকথিয়ান্ডার। পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেশবার পক্ষে তার সামনে বিরাট বাধা ওই সাগর, আর এখন থেকে ওই সমুদ্রেই তাকে থাকতে হবে।
গুট্টিয়ারা বলল, কিন্তু কি করে সেখানে সে থাকবে? সেখানে তো শুধু মাছ, কাঁকড়া আর হাঙরই থাকে। একজন মানুষ একলা সেখানে কি করে থাকবে?
অলসেন বলল, এতদিন তো সে তা-ই ছিল। যত দিন না..
অলসেনের কথার ইঙ্গিত গুট্টিয়ারা বুঝতে পারল। লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল। অলসেন আবার বলল। এখন সে আর আগের মত জলের মধ্যে থাকতে পারবে না। তার মন পড়ে থাকবে…
কাতর স্বরে গুট্টিয়ারা বলে উঠল, আর বোলো না, আর বোলো, অলসেন।
অলসেন বলল, তবে সময়ে সবই সয়ে যায়। হয়তো ইকথিয়ান্ডার আবার এক সময় আগের মতই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠবে। মাছ আর কাঁকড়াদের মধ্যেই জীবন কাটিয়ে দিয়ে বুড়ো হয়ে যাবে সে। আর মৃত্যু? সে তো জলে স্থলে সব জায়গাতেই সমান।
গোধূলির আলো আরও ম্লান হয়ে এল। অলসেনের ছোট ঘরে অন্ধকার ঘনিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, এবার আমাকে উঠতে হবে, গুট্টিয়ারা।
গুট্টিয়ারাও উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে অলসেনের সঙ্গে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল, তারপর কাতরভাবে বলল, কিন্তু দূর থেকেও আমি কি তাকে একবার দেখতে পারি না?
পারো। কিন্তু আড়াল থেকে। ওর সামনে তুমি এসো না।
বেশ। কথা দিচ্ছি, আসব ।
কথা বলতে বলতে অলসেন আর গুট্টিয়ারা পথ চলছে। অলসেনের গায়ে এখন ভিস্তিওয়ালার পোশাক। তার ভূমিকা এখন জেলখানার পানি সরবরাহকারীর।