না না, আমি না। ফ্লিন্ট ছিল ক্যাপ্টেন, সিলভারের গলা শোনা গেল। আমি ছিলাম কোয়ার্টার মাস্টার। সেবারই পা হারিয়েছি আমি। পিউ হারিয়েছিল চোখ…
তার মানে ফ্লিন্টই ছিল সর্দার? একজন প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, বলল সিলভার। ভয়ঙ্কর লোক ছিল। তার দলের সবাই ছিল তারই মত বেপরোয়া, নিষ্ঠুর, খুনী। ওই পিউ ছিল ফ্লিন্টের সহকারী। অথচ দেখ, পিউ, এমনকি ফ্লিন্টও আমাকে পরোয়া করে চলত। ভয়ে ভয়ে থাকত সারাক্ষণ, কখন,আবার ফ্লিন্টকে খুন করে তার সর্দারি নিয়ে নিই। কিন্তু সেরকম কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না। সর্দার হলেই ঝামেলা বাড়ে। তারচেয়ে এমনিতেই যখন সবাই সমঝে চলত আমাকে, কেন খামোকা ঝুঁকি নিতে যাই?
তোমার নাম শুনেছি আগেই, বলল আগের লোকটা। জাহাজে সবচেয়ে কম বয়েসী নাবিক সে। জলদস্যুর দলে ছিলে, তা-ও শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এতদিন।
এখন তো জানলে? এগিয়ে গেল সিলভার। এসো, হাত মেলাও।
বুঝলাম, এই অল্পবয়েসী নাবিকটি আগে ডাকাতদলে ছিল না, কিন্তু আজ থেকে তাকে নিজের দলে টেনে নিল জন সিলভার।
খুব ভাল, ডিক, নাবিকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল অন্য একজন। গলা শুনেই বুঝতে পারছি, ইসরায়েল হ্যান্ডস। আমাদের দলে এসে ভাল করেছ। এই নাবিকগিরি করে আর কয় পয়সা কামাতে? এখন ঠিকমত কাজটা উদ্ধার করতে পারলেই টাকার বিছানায় ঘুমাবে, সিলভারকে বলল, তা বারবিকিউ, আর কতদিন? ক্যাপ্টেন ব্যাটাকে আর সহ্য করতে পারছি না। এভাবে কদিক থাকব আর?
তোমার মাথায় গোবর পোরা, বরাবরই বলে এসেছি, বিরক্ত শোনাচ্ছে সিলভারের গলা। টাকা কি ছেলের হাতের মোয়া, চাইলেই পেয়ে যাবে? সহ্য করতে হবে। দেরি আছে এখনও…
কেন, দেরি কেন? দ্বীপটা তো এসে গেল…
দেরি এই জন্যে, তোমরা কেউ জাহাজ চালাতে জানো না। ওই অসহ্য ক্যাপ্টেনটাকেই সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এখন তো বটেই, ফিরতি পথেও দরকার হবে স্মলেটকে। তাছাড়া, গুপ্তধনের নকশাটাও তো এখনও হাতে পেলাম না। আমি জানি, ট্রেলনী কিংবা ডাক্তার, এদের কারও কাছেই আছে ওটা। এখুনি চোটপাট শুরু করলে বলা যায় না, নকশাটা ধ্বংস করে ফেলতে পারে ওরা। সেক্ষেত্রে সবই মাটি।
নকশার ব্যাপারটা নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন? ওকে কেন দরকার হবে? আমরা জাহাজ চালাতে পারি না কে বলল? নাবিক নই আমরা? এখন কে চালাচ্ছে, শুনি?
তোমরা গতরে খাটছ শুধু, ব্রেনটা ক্যাপ্টেনের। হিসেব জানো? ম্যাপ দেখে বলে দিতে পারবে কোথায় আছ এখন? বলতে পারবে কয়েক ঘন্টা পর কোনদিকে বইবে বাতাস, কতটা জোরে? পারবে না। এজন্যে লেখাপড়া জানা দরকার। জাহাজের হাল ধরা, দাঁড় বাওয়া কিংবা পাল খাটানোর কাজে তোমাদের জুড়ি নেই, কিন্তু পুরো একটা জাহাজকে কন্ট্রোল? সেটা তোমাদের দিয়ে হবে না।
কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি?
এই জন্যেই বলেছিলাম। মাথায় গোবর পোরা আছে। জীবনে অনেক দেখেছি আমি, অনেক ভুগেছি। জাহাজে করে দুর্গম সাগর পাড়ি দিয়েছি, পাহাড়ে চড়েছি, মরুভূমি পেরিয়েছি। অনেক, অনেক লোক দেখেছি, তারা কেউ বোকা, কেউ বা বুদ্ধিমান। অনেক বুদ্ধিমানকে দেখেছি, সামান্যতম ভুলের জন্যে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ভুল কি করেছে জানো? তাড়াহুড়া। কাজেই সাবধান!
কিন্তু একটু রাম খেয়ে হৈ-হুল্লোড়ও করতে পারি না, কুত্তার মত এসে ঘেউ ঘেউ শুরু করে স্মলেট। ব্যাটার ঘাড় ধরে পানিতেই ফেলে দেব একদিন! গজগজ করে উঠল ইসরায়েল।
আরেকটা জিনিস এই রাম! ইসরায়েলের কথায় কান দিল না সিলভার। পিউয়ের কি কম টাকা ছিল? অথচ ভিখিরি হয়ে মরেছে। কেন জানো? রাম গিলে গিলে। ফ্লিন্টের মৃত্যুর কারণও ওই রাম!
তাহলে কি করব আমরা এখন? জানতে চাইল কম বয়েসী নাবিক ডিক।
আপাতত কিছুই না। চুপচাপ শুধু দেখে যাব। জাহাজ দ্বীপে ভেড়াবে ক্যাপ্টেন, নকশার সাহায্যে গুপ্তধন খুঁজে বার করবে ডাক্তার আর ট্রেলনী, তারপর শুরু হবে আমাদের কাজ। প্রথমেই ট্রেলনী আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের খতম করে ফেলব। আমাদের হয়ে জাহাজটাকে আবার নিরাপদ কোন জায়গায় নিয়ে যাবে স্মলেট, এমন কোথাও, যেখান থেকে সহজেই কেটে পড়তে পারি আমরা। সেই সময়, বুঝলে, সেই সময়…
মুন্ডটা ছিড়ে নেব আমি ব্যাটার…
নিও, বলল সিলভার।
ডাকাতদের কথা শুনে বুক কাঁপছে আমার। বুঝতে পারছি, একপেয়ে নাবিক বলতে লঙ জন সিলভারের কথাই বলেছিল বোনস। কি পরিমাণ বিপদে পড়েছি, অনুমান করে আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছে আমার।
এই সময় আবার শোনা গেল সিলভারের কথা, যাক, অনেক তো কথাবার্তা হল। এই ডিক, কয়েকটা আপেল বার কর না পিপে থেকে, খাই।
কাঠ হয়ে গেলাম। আর রক্ষে নেই। এখুনি আমাকে খুন করে পানিতে ফেলে দেবে ডাকাতেরা। উঠে পিপে থেকে বেরিয়ে দৌড় দেবার কথা ভাবছি, এমন সময় বলে উঠল ইসরায়েল, আপেল টাপেল খেয়ে এখন কাজ নেই। তারচে কিছু রাম নিয়ে এসো, মৌজ করি!
ঠিক আছে, বলল সিলভার। এই নাও চাবি। রান্নাঘরের দেরাজে তালা দেয়া আছে। বের করে নিয়ে এসো।
মেট অ্যারোকে কে মদ সরবরাহ করত, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না আর। চেষ্টা করেও হয়ত নিজের দলে তাকে টেনে নিতে পারেনি সিলভার। চালাকি করে অ্যারোর মাতলামিকে কাজে লাগিয়েছে তখন। অন্ধকার ঝড়ের রাতে ঠেলে ফেলে দিয়েছে তাকে জাহাজ থেকে।
রাম নিয়ে এল ডিক। ফ্রিন্টের স্মরণে আর নিজেদের স্বাস্থ্য কামনা করে মদ গিলতে লাগল ডাকাতগুলো।
পিপের ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠছে। চাঁদের আলোয় বেরিয়ে যে পালাব সে উপায়ও আর নেই এখন। দস্যুদের নজরে পড়ে যাব।
কি করব ভাবছি, এই সময় শোনা গেল চিৎকার, ডাঙা, ডাঙা!