লাফিয়ে উঠে পড়ল ডাকাতেরা। ছুটোছুটি শুরু করে দিল। যার যার জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। এই সুযোগে টুক করে বেরিয়ে এলাম পিপে থেকে। ছুটলাম জাহাজের পেছনে। ডাক্তার লিভসী আর হান্টারের দেখা পেলাম ওখানেই।
একে একে অনেকেই এসে জড়ো হল সেখানে। ছোট্ট মেঘের আড়ালে ঢুকে গিয়েছিল চাঁদ, লুকোচুরি খেলে যেন বেরিয়ে এল আবার। দূরে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে কালো মেঘের মত দেখা গেল দ্বীপটা।
স্বপ্নের ঘোরে আছি যেন এখনও। মাত্র দুই মিনিট আগে শোনা ডাকাতদের কথাগুলো এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে মনকে। দুঃস্বপ্নের মাঝেই যেন শুনতে পেলাম ক্যাপ্টেন স্মলেটের গলা! জাহাজের মুখ কোনদিকে ফেরাতে হবে নির্দেশ দিচ্ছেন সারেঙকে। দ্বীপের পুব দিকে নিয়ে গিয়ে জাহাজ ভেড়ানোর ইচ্ছে তাঁর।
এর আগে দ্বীপটা দেখেছ কেউ? উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
আমি দেখেছি, বলল জন সিলভার। একটা সদাগরী জাহাজের বাবুর্চি ছিলাম তখন। নিতান্ত দুর্ঘটনার জন্যেই এই দ্বীপে জাহাজ ভেড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন।
ম্যাপে দেখলাম, দ্বীপের পেছনে একটা উপদ্বীপে জাহাজ ভেড়ানোই নিরাপদ। জানো কিছু?
ঠিকই দেখেছেন। ওই উপদ্বীপটার নাম স্কেলিটন আইল্যান্ড। জলদস্যুদের আড্ডা ছিল ওটা। এর উত্তরে একটা পাহাড় আছে, ফোরমাস্ট হিল বলে ওটাকে। প্রধান দ্বীপটার এক প্রান্তে, সাগরে নেমে যাওয়া পাহাড়ের নাম স্পাই-গ্লাস। উঁচু পাহাড়, ওখান থেকে ডাকাতেরা চারদিকের সাগরের দিকে লক্ষ্য রাখত। নামটা ওই জন্যেই হয়েছে।
একটা ম্যাপ আছে আমার কাছে, বলতে বলতে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন ক্যাপ্টেন। একজন নাবিকের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, এই, একটা ল্যাম্প নিয়ে এসো তো।
লণ্ঠনের আলোয় ম্যাপটা দেখল সিলভার। কাছে সরে এসেছি আমি। দেখলাম, চোখ দুটো চকচক করছে ডাকাতটার। বোনসের সিন্দুকে পাওয়া ম্যাপ নয় এটা, তবে তার অবিকল নকল। নকলটা করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই জমিদার ট্রেলনী। সাঙ্কেতিক কথাগুলো লেখা হয়নি, আর লাল কালির ক্রস চিহ্নগুলোও দেয়া হয়নি এই নকলটাতে। জাহাজ চালাতে দরকারও নেই ওগুলোর।
বল তো এখন, সিলভারকে বললেন ক্যাপ্টেন। এই ম্যাপটা ঠিক আছে?
ঠিকই আছে, ঘাড় কাত করে বলল সিলভার। শুধু আমি বুঝলাম, হতাশ হয়েছে সে। নতুন কাগজ দেখে ঠিকই বুঝেছে, বিলি বোনসের সিন্দুকে পাওয়া ম্যাপ নয় এটা। মুখে বলল, চমৎকার ম্যাপ। পরিষ্কার দেখানো আছে সবকিছু। ম্যাপের এক জায়গায় আঙুল রেখে বলল, এই যে, এই জায়গাটাকে ওরা বলত ক্যাপ্টেন কিডের অ্যাঙ্কোরেজ। দক্ষিণ ঘেঁষে বইছে প্রবল স্রোত। চলতে চলতে পশ্চিম তীরের ওদিক থেকে এগিয়েছে উত্তরে। এদিক দিয়ে এসে, ভালই করেছেন ক্যাপ্টেন, দ্বীপে নামতে এদিক দিয়েই সবচেয়ে সুবিধে।
ধন্যবাদ। যাও এখন। দরকার হলে ডাকব আবার, বললেন ক্যাপ্টেন।
ট্রেজার আইল্যান্ড সম্পর্কে সিলভারের জ্ঞান সত্যিই বিস্মিত করল আমাকে। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল সে। ধক করে উঠল বুক। মৃদু হেসে আমার কাঁধে হাত রাখল সিলভার। মাঝে মধ্যেই এভাবে আমাকে আদর করে সে। আজ কিন্তু গা-টা ঘিন ঘিন করে উঠল আমার। দারুণ ভন্ড এই লোকটার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন। কিন্তু তবু কাঁধের ওপর থেকে সিলভারের হাতটা সরিয়ে দিতে সাহস হল না। যদি কিছু সন্দেহ করে বসে?
চমৎকার দ্বীপ ওটা, জিম, বলল সিলভার। ঝর্না কিংবা সাগরের টলটলে পানিতে গোসল করবে, বুনো ফল খাবে, ছাগল শিকার করবে, আর ছাগলের মতই ঘুরে বেড়াবে পাহাড়ে-জঙ্গলে। ইসস, আবার যদি তোমার বয়েসে ফিরে যেতে পারতাম! অন্তত পা দুটো ঠিক থাকলেও চলত! হ্যাঁ, যদি দ্বীপের ভেতরে কোথাও যাও, সারা দিনের খাবার নিয়ে যেও আমার কাছ থেকে।
অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে ক্রাচে ভর দিয়ে চলে গেল সিলভার।
জাহাজের পেছন দিকে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কথা বলছেন ট্রেলনী আর ডাক্তারচাচা। কাছেপিঠে আর কেউ নেই, সবাই চলে গেছে যার যার কাজে। এগিয়ে গেলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে সাবধানে বললাম, ডাক্তারচাচা, কথা আছে। ক্যাপ্টেন আর জমিদারচাচাকে নিয়ে কেবিনে যান। কোন ছুতোয় আমাকে ডেকে পাঠাবেন। সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি আমরা! আমি যাই, রান্নাঘরেই থাকব।
মিনিট কয়েক পরেই আমার ডাক এল। কেবিনে গিয়ে দেখলাম, টেবিল ঘিরে বসে আছেন জমিদার, ডাক্তারচাচা আর ক্যাপ্টেন। টেবিলে রাখা এক বোতল স্প্যানিশ মদ আর একটা পাত্রে কিছু কিসমিস। ওগুলোর দিকে খেয়াল নেই কারও। সমানে পাইপ টেনে চলেছেন ডাক্তারচাচা। পরচুলাটা খুলে রেখে বসেছেন জমিদার। পেছনে, খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে চাঁদ দেখছেন ক্যাপ্টেন।
বলে ফেল, জিম, আমাকে দেখেই বললেন জমিদার।
দরজার কাছে গিয়ে বাইরেটা একবার ভাল করে দেখে এলাম। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে সংক্ষেপে বললাম সব। আমার কথা শেষ না হওয়ার পর্যন্ত টু শব্দটি করলেন না কেউ। চুপচাপ শুনে গেলেন।
আমার বলা শেষ হলে নড়েচড়ে উঠলেন ডাক্তারচাচা। বোতল থেকে মদ ঢেলে এগিয়ে দিলেন জমিদার আর ক্যাপ্টেনের দিকে। নিজেও নিলেন এক গেলাস। এক মুঠো কিসমিস তুলে বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে। নিলাম।
আমার স্বাস্থ্য কামনা করে গেলাসে চুমুক দিলেন তিনজনেই। কয়েকটা কিসমিস মুখে পুরে দিলাম আমি।
মাপ করবেন আমাকে, ক্যাপ্টেন স্পলেট, বললেন জমিদার। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। আমিই আসলে গাধা। তা এখন কি করা যায় বলুন তো?
আমিও কম গাধা নই, বললেন ক্যাপ্টেন। নাবিকদের দলপতি, অথচ দলের লোক কে কেমন বুঝতে পারিনি। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি বিদ্রোহ ঘটবে জাহাজে। ইস, এক্কেবারে ছাগল বানিয়ে ছেড়েছে ওরা আমাকে!
অসামান্য লোক ওই জন সিলভার! বললেন ডাক্তারচাচা, জলদুস্য, কিন্তু কি আশ্চর্য সংগঠন ক্ষমতা!
লোকটাকে সামান্যতম সন্দেহ করলাম না আমি! বললেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু শুধু এসব আলোচনায় তো কাজ হবে না। কিছু একটা করতে হবে আমাদের এবং শীঘ্রি।
আপনি জাহাজের ক্যাপ্টেন, এতদিনে পথে এসেছেন জমিদার। যা ভাল বোঝেন করুন।
আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, বললেন ক্যাপ্টেন। যেমন যাচ্ছি, ঠিক তেমনি। ডাকাতদের বুঝতে দিলে চলবে না, ওদের আসল রূপ জেনে গেছি আমরা। বোঝা যাচ্ছে, গুপ্তধন না পাওয়া পর্যন্ত আপনাদের খুন করবে না ওরা। আমার ওপর হাত তুলবে আরও পরে। কাজেই কিছুটা সময় আমাদের হাতে আছে। তবে আগে হোক পরে হোক, ওদের সঙ্গে লাগতেই হবে আমাদের। এখানে আমরা বারোজন, এছাড়াও আরও তিনজন আছে আমাদের পক্ষে মিস্টার ট্রেলনীর সঙ্গে যারা এসেছে আর কি। আমরা সংখ্যায় কম, কাজেই আমাদেরকেই আগে আক্রমণ চালাতে হবে। জমিদারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন, মিস্টার ট্রেলনী, আপনার লোক তিনজনের ওপর নির্ভর করা যায়?
নিশ্চিন্তে, বললেন জমিদার। তার ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেনের কথার ভঙ্গি থেকেই বুঝে নিলেন।
তাহলে ওরা তিনজন, আর আমরা এই চারজন—অবশ্য জিমকে একজন ধরলে আর কি, হলাম গিয়ে সাতজন। আক্রমণ আমরাই আগে করব, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত চোখ রাখতে হবে ডাকাতদের ওপর। ওদের মতিগতি জানার জন্যে একজন স্পাই দরকার আমাদের। জিমই এই কাজ ভাল পারবে। চটপটে ছেলে, তাছাড়া দলের নেতা সিলভারের সঙ্গে তার দারুণ ভাব। পারবে তো, জিম?
মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম।
সাবধান, জিম! আমাকে হুঁশিয়ার করলেন ডাক্তারচাচা। গুপ্তচরের কাজ কিন্তু সাংঘাতিক কঠিন! মারাত্মক ঝুঁকির কাজ!
তোমার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, জিম… বললেন ট্রেলনী।
অস্বস্তি বোধ করছি। এত বড় বড় লোক আমার ওপর নির্ভর করছেন। নিজেকে অত্যন্ত অসহায় মনে হল। আগামী বিপদের কথা মনে করে বুক কাঁপছে। হিসপানিওলায় এখন মোট লোকের সংখ্যা ছাব্বিশ। তাদের উনিশ জনই বিদ্রোহী। এতগুলো খুনে ডাকাতের বিরুদ্ধে কদিন টিকে থাকতে পারব আমরা?