জনবসতিশূন্য দ্বীপ। জীবনে এই প্রথম অজানা অচেনা এলাকায় ঘোরার রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। পেছনে নাবিকদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে চললাম। কতগুলো গাছ দেখতে ওকের মত, কিন্তু আসলে ওক নয় ওগুলো। পাতাগুলো অনেকটা উইলোর মত। অজানা ফুলের গন্ধ বাতাসে। ডালে ডালে বিচিত্র রঙের, বিভিন্ন আকারের পাখি, তদের কিচির মিচিরে মুখরিত হয়ে আছে বনের ভেতরটা। চলতে চলতে মৃদু হিসস শব্দে চোখ মেলে চাইলাম। গাছের কোটর থেকে মাথা বের করে আছে একটা সাপ। চোখে সন্দেহ নিয়ে আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখল সাপটা। তারপর আস্তে আস্তে আবার কোটরের ভেতর গুটিয়ে নিল নিজেকে।
হঠাৎই বেরিয়ে এলাম জঙ্গল থেকে। একখন্ড ফাঁকা জায়গা। লম্বায় মাইল খানেক হবে, প্রস্থে সামান্য কম। চিকচিকে বালিতে ঢাকা। ওপরটায় ছোট ছোট ঢেউ খেলানো। সাগরের তলা থেকে দ্বীপটা জেগে ওঠার পর প্রথম প্রথম নিশ্চয় জোয়ারের পানি পৌঁছত এখানে। চিকচিকে বালির ওপারে একটা পাহাড়, সাদা পাথরে ছাওয়া চূড়ায় ঝলমল করছে বিকেলের রোদ। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করলাম প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ।
আবার এসে ঢুকলাম বনে। মোড় নিয়ে ফাঁকা অঞ্চলটুকুকে পাশে রেখে এগিয়ে চললাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নাম না জানা গাছের এক বিশাল ঝোপের কাছে। ঝোপের নিচে মাটি নয়, বালি। হয়ত অনেক নিচে রস আছে, সেই রস টেনেই লতিয়ে উঠেছে লতাগুলো, ছোট ছোট গাছকে ঘিরে জট পাকিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে ঝোপের। ওপারে আরেকটা ছোট পাহাড়, টিলাই বলা উচিত। একপাশে, টিলার পাদদেশ ঘেঁষে একটা জলা। প্রখর রোদে হালকা বাষ্প উঠছে জলা থেকে। দেখা যাচ্ছে দূরে স্পাই-গ্লাস পাহাড়। বাষ্পের ভেতর দিয়ে দেখছি তো, মনে হচ্ছে কাঁপছে পাহাড়টা।
এতক্ষণ নিস্তব্ধ ছিল, আচমকা চঞ্চলতা জাগল ঝোপঝাড়ের ভেতর। একটা বুনো হাঁস বিচিত্র ডাক ছাড়তে ছাড়তে উড়াল দিল আকাশে। তার পেছন পেছন উড়ে গেল আরেকটা, তারপর আরও একটা। কয়েক মুহূর্তেই ঝোপের ওপরের আকাশে শুধু হাঁস আর হাঁস, পাক খেয়ে উড়ছে ওরা আর চেঁচাচ্ছে। পাখিগুলোর নিরাপদ বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে কেউ।
আমার অনুমান মিথ্যে নয়। আধ মিনিট পরেই ঝোপের একপাশে জঙ্গলের ভেতরে মানুষের গলার আওয়াজ শুনলাম। নাবিকেরা আসছে নিশ্চয়। আরও কাছে এলে সিলভারের গলার স্বর চিনতে অসুবিধে হল না। প্রকৃতি দেখতে দেখতে এতক্ষণ ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এগিয়ে গেলাম গুড়ি মেরে। ওদের আলোচনা শুনতেই তো এসেছি আমি।
নিঃশব্দে পা ফেলে ঝোপের একপাশে একটা বিশাল গাছের গোঁড়ায় এসে দাঁড়ালাম। কথা শোনা যাচ্ছে কয়েক গজ সামনে। কার ওপর যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে সিলভার। ধমকাচ্ছে আর শাসাচ্ছে সে কর্কশ গলায়। ভয় পাচ্ছি, কিন্তু তবু আস্তে করে পাতার বাধা সরিয়ে উঁকি দিলাম। দেখা যাচ্ছে না কিছু। উপুড় হয়ে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে গেলাম আরও গজখানেক। আস্তে করে লতাপাতা সরিয়ে আবার চাইলাম ওপাশে। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম এবার।
সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছে সিলভার। মাটিতে তার পায়ের কাছে পড়ে আছে হ্যাট। ঘামে ভেজা মুখটা চকচক করছে বিকেলের রোদে। তার চেহারা দেখে কেউ বলবে না, ভয়ঙ্কর এক ডাকাতদলের সর্দার সে।
সিলভারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন নাবিক, তার নাম টম।
সিলভার বলল, দেখ টম, বড় বেশি কথা বল তুমি! তোমাকে ভাল লোক মনে করতাম, তাই দলে টানতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি রাজি নও…এর অর্থ কি জানো?
জানি, মৃত্যু, দৃঢ় গলায় বলল টম, কিন্তু তাই বলে আমাকে দিয়ে অসৎ কাজ করাতে পারবে না তুমি। তুমি কি বল, মিস্টার ট্রেলনীর চাকরি নিয়ে এসে, তার নুন খেয়ে, তারই সঙ্গে বেঈমানি করি? আর যেই করুক, জন, আমি করব না। মোহরের লোভ আমার নেই।
এই প্রথম জানলাম, উনিশজন নাবিকের সবাই ডাকাত নয়। একজন ভাল লোককে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। ইস, আগে জানলে তাকেও পিস্তল দিয়ে দিতে পারতেন জমিদার!
কি বলতে যাচ্ছিল সিলভার, কিন্তু বাধা পেল। জলার ওদিক থেকে ভেসে এল একটা দীর্ঘ আর্তচিৎকার। ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে পাহাড়ে। আবার চিৎকার করে আকাশে উঠে পড়ল পাখির দল।
কান পেতে চিৎকারটা শুনল টম। শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতেই লাফিয়ে উঠল, অ্যালান না তো!
হ্যাঁ, অ্যালানই, হাসল সিলভার। ক্রাচে ভর রেখে আরাম করে দাঁড়িয়েছে, তোমার মতই আরেক ভালমানুষ। গেল বোধহয়।
কিন্তু সত্যিকার নাবিকের পরিচয় দিয়েছে সে। ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। জাহাজে এখনও কিছু সৎ লোক আছে নিশ্চয়। তাদের হুঁশিয়ার করতে হবে। তার জন্যে যদি তোমাদের হাতে কুত্তার মত মরতে হয় আমাকে, মরব… দৃঢ় পায়ে ঘুরে দাঁড়াল টম। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে লাগল।
ম্প্রিঙের মতই লাফিয়ে উঠল খোঁড়া ডাকাত। ক্রাচটা তুলে নিয়ে নিচের দিকটা সামনে বাগিয়ে ছুঁড়ে মারল জোরে। শেষ মুহূর্তে টের পেয়ে বোধহয় ঘুরেই দাঁড়াতে যাচ্ছিল টম, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। প্রচন্ড গতিতে গিয়ে ঘাড়ের নিচে ঠিক মেরুদন্ডে আঘাত করল ক্রাচের শক্ত মাথা। কট করে বিচ্ছিরি একটা শব্দ হল। মেরুদন্ড ভাঙার। দড়াম করে ঘাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল সে। মরল না বেহুঁশ হল বুঝলাম না।
আমাকে বিমূঢ় করে দিয়ে এক পায়েই লাফাতে লাফাতে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে গেল সিলভার। টমের পিঠে চেপে বসল। কোমর থেকে ছোরা বার করে বসিয়ে দিল ঘাঁচ করে। আওয়াজ বেরোল না টমের মুখ থেকে। একটানে ছোরাটা টমের পিঠ থেকে বের করে আনল সে। আবার বসাল। দ্বিতীয়বার টেনে বের করে এনে পিঠ থেকে উঠে পড়ল। সবুজ ঘাসে মুছে নিল ছোরার রক্তাক্ত ফলা। আবার কোমরে গুজল ওটা। ক্ৰাচটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বগলে ঠেকাল, যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে টমের পিঠ থেকে। লাল রক্তে ভিজে গেল সবুজ ঘাস।
চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল আমার। মিনিটের ব্যবধানে খুন হল দুজন লোক! একজনের আর্তনাদ শুনলাম, আরেকজন তো চোখের সামনেই পড়ে আছে। দেখতে পাচ্ছি। সংবিৎ ফিরল আমার সিলভারের হুইসেলের শব্দে।
বিচিত্র কাঁপা তীক্ষ্ণ সুরে বাজল হুইসেল। ছড়িয়ে গেল দিকে দিকে। প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে। আবার উড়ল পাখিরা। ওগুলোর শান্তি নেই আজ। হুইসেল বাজিয়ে কোন ধরনের সঙ্কেত করছে সিলভার। কিসের সঙ্কেত? টমকে খতম করা হয়েছে। এটা জানাল? হবে হয়ত। কিন্তু আমার আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয় এখানে। যদি সিলভার বা ডাকাতদের কারও চোখে পড়ে যাই, টম আর অ্যালানের মতই মরতে হবে আমাকেও।
হামাগুড়ি দিয়ে সাবধানে পিছিয়ে এলাম আবার। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি লোপ পায়নি। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম ঝোপের প্রান্তে। এখন সাগর তীরে পৌছতে হবে, কিন্তু পথ তো চিনি না। ভেবেচিন্তে খোলা জায়গাটায় যাওয়া ঠিক করলাম, ওখান থেকে যাহোক একটা ব্যবস্থা হয়ত করতে পারব।
ছুটলাম। এমন দৌড় জীবনে দৌড়াইনি। লতায় পা জড়িয়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম কয়েকবার। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে আমার পেছনে ছুটে আসছে ডাকাতেরা। ভয়ে পেছনে তাকাতে পারছি না। সারাদিনে এই প্রথমবার পাখিগুলোকে ধন্যবাদ দিলাম। ওদের চেঁচামেচিতে আমার পায়ের শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে।
ছুটতে ছুটতে এসে পড়লাম ফাঁকা জায়গাটায়। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। গলা শুকিয়ে কাঠ। ধপ করে বসে পড়লাম বালির ওপরেই। একটু বিশ্রাম না নিলে মনে হচ্ছে বুকটা ফেটেই যাবে।
হঠাৎ শব্দ হল পেছনে। চমকে উঠলাম। ধড়াস করে এক লাফ মারল হৃৎপিন্ডটা। ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেলাম প্রচন্ড আতঙ্কে।