দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুটো বোট। কেবিনে বসে ক্যাপ্টেন আর ট্রেলনীর সঙ্গে কথা বলছি আমি। সকালের মতই বাতাস স্তব্ধ। সামান্যতম হাওয়া নেই। পালে বাতাস লাগাতে পারলে জাহাজে থেকে যাওয়া ছজন ডাকাতকে শেষ করে এক্ষুনি নোঙর তুলে পালাতাম এখান থেকে। কিন্তু নেই বাতাস। তার ওপর হান্টারের কাছে শুনলাম, আমাদের অনুমতি না নিয়েই দ্বীপে চলে গেছে জিম হকিন্স।
আলোচনা তেমন জমছে না। প্রচন্ড গরমে কেবিনে বসে দর দর করে ঘামছি। শেষে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম। বদ্ধ বাতাসে দুর্গন্ধ যেন আরও বেশি ছড়াচ্ছে। জ্বর আর আমাশয়ে পড়ার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছি।
ডেকে, একটা পালের নিচে ছায়ায় বসে আছে ছয় ডাকাত। ওদিকে ডাঙায় বোট দুটো বেঁধে প্রতিটি বোটে একজন করে ডাকাতকে পাহারায় রেখে জঙ্গলে ঢুকে গেছে অন্যেরা। জিমকেও দেখা যাচ্ছে না। কি বোকামিই না করল ছেলেটা! অস্বস্তিকর পরিবেশে পায়চারি করতে লাগলাম ডেকে।
এভাবে আর ভাল লাগছে না। কিছু একটা করা দরকার। মনে মনে ঠিক করলাম হান্টারকে নিয়ে বেরিয়েই পড়ব। জলিবোটটায় করে যেতে পারব দ্বীপে।
ক্যাপ্টেন কিংবা ট্রেলনী বাধা দিল না। জলিবোটে করে চললাম আমি আর হান্টার। আমাদের যেতে দেখে একটু যেন চঞ্চল হয়ে উঠল দুই প্রহরী ডাকাত। এতক্ষণ শিস দিচ্ছিল, বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে তাকাল আমাদের দিকে। সন্দেহ হয়েছে।
ডাকাতেরা যেখানে নেমেছে, সেখানে নামলাম না আমরা। মোড় নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। বাঁক ঘুরতেই ডাকাতদের নৌকাদুটোকে আর দেখা গেল না। নৌকার সামনের দিকটা তীরে ঠেকতেই লাফিয়ে নামলাম আমি। জাহাজ থেকে দুটো পিস্তল নিয়ে এসেছি। প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্যে হ্যাটের সামনের কার্নিসের তলায় একটা বড় রুমাল ঢুকিয়ে কায়দা করে কপাল ঢেকে নিলাম। এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়লাম বনের ভেতর।
শখানেক গজ এগোতেই চোখে পড়ল দুৰ্গটা। একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝর্না বইছে। সেই ঝর্নাটার ধারে চূড়ার কাছাকাছি একটা মজবুত কাঠের বাড়ি। চল্লিশ জন লোক সহজেই এতে থাকতে পারে। দুর্গের কাঠের দেয়ালে একটু পর পরই ফোকর, ভেতর থেকে এগুলোর মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে বাইরের শত্রুদেরকে গুলি করার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এই বাড়িটার বাইরেটা ঘিরে ছফুট উঁচু কাঠের গুঁড়ির দেয়াল। এতই মজবুত, কামানের গোলার আঘাতেও যথেষ্ট কঠিন হবে ভাঙা। চমৎকার জায়গায় রীতিমত পরিকল্পনা করে তৈরি হয়েছে এই বাড়ি। এমনিতেই পাহাড়ের চুড়ায় বসা শত্রুর বন্দুকের কাছে নিচের লোকেরা অসহায়, তার ওপর ওই দুর্গ। ওটার ভেতরে থেকে ছজন সশস্ত্র লোক পুরো এক পল্টন সৈন্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।
আমার সবচেয়ে ভাল লাগল ঝর্নাটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, এই সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেল। খুনের অভিজ্ঞতা নতুন নয় আমার কাছে। সৈনিক ছিলাম এক সময়। যুদ্ধ করেছি। আহতও হয়েছি। আর্তনাদটা শুনে প্রথমেই জিমের কথা মনে হল আমার। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে ডাকাতদের হাতে শেষ হয়ে যায়নি তো ছেলেটা!
সৈনিক কিংবা ডাক্তারের জীবনে গড়িমসির কোন স্থান নেই। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলাম। বন থেকে বেরিয়েই এসে উঠলাম জলিবোটে। হান্টার বসেই আছে, আমার নির্দেশ পেয়ে সামান্যতম সময় নষ্ট না করে দাঁড় বাইতে শুরু করল সে। জাহাজের গায়ে বোট ভিড়তেই দড়ি বেয়ে উঠে এলাম।
ক্যাপ্টেন আর স্কোয়্যার ডেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে-চোখে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা। বনের ভিতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ ওরাও শুনছে। আমাকে দেখেই ছুটে এল দুজনে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করল আমাকে। কিন্তু আমিও ওদের মত চিৎকারই শুনেছি, দেখিনি কিছু।
পালের তলায় বসা ছজনের একজন নাবিককে ইঙ্গিতে দেখিয়ে ফিসফিস করে বললেন ক্যাপ্টেন, লোকটা নতুন। দেখছেন না, মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে, আর কেমন উসখুস করছে?
দেখলাম। তারপর ক্যাপ্টেন আর জমিদারকে নিয়ে কেবিনে চলে এলাম। আলোচনা করে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
কয়েক মিনিটেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম আবার কেবিন থেকে।
কেবিনের পাশে বন্দুক হাতে পাহারায় রাখা হল রেডরুথকে। জাহাজের পেছন দিকে জলিবোটটা এনে বাঁধল হান্টার। তাতে জাহাজের ভাড়ার থেকে নিয়ে টিনের খাবার, বিস্কুট, মাংস, এক বাক্স কন্যাক মদ, ওষুধের বাক্স ইত্যাদি তুলে দিলাম। আর্মারী থেকে নিয়ে এসে তুললাম বারুদ আর বন্দুক। আমাকে সাহায্য করল জমিদার। ডেকের সামনের দিকে রয়েছেন সশস্ত্র ক্যাপ্টেন।
জলিবোটে জিনিসপত্র তোলা শেষ হতেই ডেকে ফিরে এলাম। আমাকে দেখেই পকেট থেকে পিস্তল বের করলেন ক্যাপ্টেন। এগিয়ে গেলেন ডাকাতগুলোর দিকে। কর্কশ গলায় বললেন, এই হারামজাদারা, এটা কি দেখেছিস? তোদের কান্ডকারখানা সবই জানা হয়ে গেছে আমাদের। কাজেই হুঁশিয়ার…
বোকা বনে গেল ছয় ডাকাতই। আমরা ওদের পরিচয় জেনে গেছি, বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে কেবিনের দিকে তাকাল ওরা। কেবিনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসা বন্দুক হাতে রেডরুথকে দেখল। বুঝে গেল, আটকা পড়ে গেছে। করার আর কিছুই নেই ওদের।
জয়েসকে নিয়ে নৌকায় নেমে এলাম। দাঁড় বাইতে শুরু করল হান্টার। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম প্রথমবারে যেখানে নেমেছিলাম, সেখানে। হান্টার আর জয়েসের সাহায্যে দ্রুত ডাঙায় নামালাম মালপত্র। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। এখন দলবল নিয়ে সিলভার এদিকে এসে পড়লে সর্বনাশ।
মালপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে ছয় ফুট বেড়ার ওপর দিয়ে ভেতরে ফেলে দিলাম, মদের বাক্সটা ছাড়া, বোতলগুলো ভেঙে যাবে। জয়েসকে বন্দুক হাতে সেখানে পাহারায় রেখে আবার ফিরে এলাম জাহাজে। আবার জিনিসপত্র বোঝাই করে নিয়ে রেখে এলাম দুর্গে। এভাবে কয়েকবার যাওয়া-আসা করে খাবার-দাবার, বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে নিয়ে গিয়ে রাখলাম দুর্গে। অস্ত্রশস্ত্র আমাদের যা দরকার নিয়ে বাকিগুলো রেলিঙ ডিঙিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম, যেন ওগুলোকে কাজে লাগাতে না পারে ডাকাতেরা।
ভাটা শুরু হয়েছে। আর বেশি দেরি করা যাবে না। তাহলে নৌকা নিয়ে দ্বীপে পৌঁছা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। আর মালপত্র যাবে না, এবারে যাবে লোকজন। প্রথমেই নৌকায় নামল রেডরুথ। জমিদার নামল তারপর। ক্যাপ্টেন নামতে যাবেন, এমন সময় লাফিয়ে উঠে ছুটে এল উসখুস করতে থাকা নাবিকটা, ওর নাম আব্রাহাম গ্রে। আক্রমণ করতে আসছে মনে করে পিস্তল তুললেন ক্যাপ্টেন।
চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, দোহাই স্যার, আমাকে মারবেন না! আমি আপনাদের দলে আসতে চাই!
ক্ষণিকের জন্যে কি ভাবলেন ক্যাপ্টেন। তারপর ডাকলেন, এসো, উঠে পড় নৌকায়! জলদি!
আব্রাহামের পর পরই নৌকায় উঠে এলেন ক্যাপ্টেন। পাঁচজন পূর্ণবয়স্ক লোকের ভারে টালমাটাল অবস্থা ছোট্ট নৌকার। তার ওপর আরও কিছু মালপত্র, যেমনঃ বারুদ, মাংস, রুটির ব্যাগ তোলা হয়েছে জলিবোটে। বার বার কাত হয়ে যাচ্ছে নৌকা, পানি উঠছে। ওদিকে ভাটা শুরু হয়েছে। পশ্চিমে বয়ে চলেছে। একটা প্রবল স্রোত, তারপর চলে গেছে দক্ষিণমুখো। তারমানে নৌকার গতিপথে কোনাকুনি এসে বাঁধা দিচ্ছে এই স্রোত।
দাঁড় টানছে রেডরুথ আর ক্যাপ্টেন, আমি হাল ধরেছি। জোর করে নৌকার গতিপথ ঠিক রাখতে গিয়ে আধ মিনিটেই হাতের পেশীতে ব্যথা হয়ে গেল আমার। না বলে পারলাম না, ক্যাপ্টেন, আরেকটু জোরে টানা যায় না?
না, বললেন ক্যাপ্টেন। তাহলে বেশি দুলবে বোট, ডুবে যাবে।
ক্রমেই গতিপথ থেকে সরে আসছে বোট, পশ্চিমে মোড় নিতে চাইছে।
আমি কিন্তু আর পারছি না, বলেই ফেললাম।
কি বলতে গিয়েও জাহাজের দিকে চোখ পড়ায় থেমে গেলেন ক্যাপ্টেন। চোখ কুঁচকে গেছে। বদলে গেছে গলার স্বর, কামান!
জাহাজের দিকে পেছন ফিরে আছি আমি। বললাম, দুর্গে কামান দাগার কথা ভাবছেন তো? সেটি পারছে না ওরা কিছুতেই। অত ভারি কামান দ্বীপে আনতেই পারবে না…
দুর্গের কথা ভাবছি না আমি, প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বললেন ক্যাপ্টেন, পেছনে চেয়ে দেখুন!
চমকে উঠলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম ব্যাপারটা। চকিতে ঘাড় ফেরালাম। তৎপর হয়ে উঠেছে জাহাজে রয়ে যাওয়া ডাকাতেরা। ডেকে বসানো কামানের ওপরের তেরপল তুলে নিয়েছে। গোলা আর বারুদ বয়ে আনছে দুজনে। ইস, কেন যে কামানের গোলাবারুদগুলো পানিতে ফেলে আসিনি!
ইসরায়েল, কামানের কাছে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখিয়ে বলল গ্রে, ফ্লিন্টের গোলন্দাজ ছিল!
পেশীর ব্যথা অগ্রাহ্য করে জোরে হাল চেপে ধরলাম। প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগলেন ক্যাপ্টেন আর রেডরুথ। নৌকা ডুবে গেলে নাহয় সাঁতরে দ্বীপে যাবার চেষ্টা করব, কিন্তু তার আগেই যদি কামানের গোলা এসে পড়ে তো টুকরো টুকরো হয়ে যাব।
কামানের পেছনে চেম্বারে গোলা ভরতে আরম্ভ করেছে ইসরায়েল।
বন্দুকে কার নিশানা সবচেয়ে ভাল? আমাদের জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
জমিদারের, ট্রেলনীকে দেখিয়ে বললাম।
ব্যাটাকে শেষ করে দিন, ট্রেলনীকে বললেন ক্যাপ্টেন।
পায়ের কাছে রাখা বন্দুকটা তুলে নিল জমিদার। গুলি ভরাই আছে।
তাড়াহুড়ো করবেন না, বললেন ক্যাপ্টেন। তাহলে নৌকা উল্টে যাবে।
দাঁড় টানা বন্ধ করে দিলেন ক্যাপ্টেন, রেডরুথকেও বন্ধ করতে বললেন, এতে নিশানা ঠিক থাকবে ট্রেলনীর। আমি শক্ত হাতে হাল ধরে রইলাম।
ওদিকে কামানে গোলা ভরে ফেলেছে ইসরায়েল। কামানের নলের মুখ ধীরে ধীরে ঘুরছে নৌকার দিকে। গুলি করলেন ট্রেলনী। কিন্তু সজাগ লোক ইসরায়েল। জমিদারকে বন্দুক নিশানা করতে দেখেই বসে পড়ল। তার মাথার ওপর দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের লোকটাকে আঘাত করল গুলি। আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা।
শুধু জাহাজ থেকেই নয়, চিৎকার উঠল তীর থেকেও। চমকে চেয়ে দেখলাম বন থেকে বেরিয়ে এসেছে ডাকাতেরা। নৌকা দুটোয় গিয়ে উঠছে। জাহাজের দিকে খেয়াল থাকায় এতক্ষণ সেদিকে দেখিনি।
ক্যাপ্টেন, চেঁচিয়ে উঠে বললাম। তীরের দিকে দেখুন!
দেখলেন ক্যাপ্টেন। নৌকার অন্যেরাও দেখল।
হুহ, বললেন ক্যাপ্টেন। মিস্টার ট্রেলনী, যে কটাকে পারেন, সাবাড় করে। ফেলুন। দ্বীপে পৌঁছতে পারব কিনা আর, কে জানে!
দ্বীপের কাছাকাছি এসে গেছে আমাদের জলিবোট। আর তিরিশ-চল্লিশবার দাঁড় টানতে হবে বড় জোর। কিন্তু এতক্ষণও টিকতে পারব কিনা সন্দেহ। প্রচন্ড হাঁক ছেড়ে তীর বেগে এগিয়ে আসছে ডাকাতেরা। ওদিকে আবার কামান তাক করছে ইসরায়েল।
নৌকা দুটো লক্ষ্য করে গুলি চালাল জমিদার। দাঁড় বাইছে আবার ক্যাপ্টেন আর রেডরুথ। ধকল সইতে পারল না আর নৌকাটা। কাত হয়েই তলিয়ে গেল পানিতে। ঠিক এই সময় গর্জে উঠল কামান। নৌকাটা ডুবে যাওয়ায় ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে সামনে পানিতে পড়ল গোলাটা। ছিটকে উঠল কাদা আর পানি। ঢেউয়ের প্রচন্ড ঝাপটা খেয়ে উল্টে ডুবে গেলাম। নাকানি-চুবানি খেয়ে বেশ খানিকটা কাদাটে নোনাপানি গিলে ভেসে উঠে দেখলাম, ভিজে বেড়ালের মত অন্যেরাও মাথা তুলছে পানি থেকে। পানির গভীরতা এখানে ফুট তিনেক। কাজেই এগিয়ে যেতে অসুবিধে হল না আমাদের।
দুটো বন্দুক ছাড়া নৌকার আর কোন মালপত্রই বাঁচানো সম্ভব হল না। সবই পানিতে ভিজে অকেজো হয়ে গেল। তীরের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। ভিজে কাপড়-চোপড় নিয়ে কাদা পানি ভেঙে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ওদিকে নৌকা নিয়ে আরও কাছে এসে গেছে ডাকাতেরা।
হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনমতে তীরে এসে উঠলাম আমরা। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, একেবারে কাছে এসে গেছে ডাকাতেরা। ছুটে ঢুকে পড়লাম বনের ভেতরে।
দুর্গের দিকে ছুটেছি আমরা। পেছনে ডাকাতদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। তীরে নামছে ওরা। ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে দুর্গে পৌছতে পারব কিনা সন্দেহ। কাজেই বাধা দেবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দুটো বন্দুকের একটা গ্রে-র হাত থেকে নিলাম আমি, অন্যটা তো ট্রেলনীর হাতে আছেই।
এই সঙ্কট মুহূর্তে সবাই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছি, ট্রেলনী ছাড়া। জমিদার একেবারে শান্ত। এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে তো তার। কোমর থেকে ছোরা বের করে গ্রে-র হাতে তুলে দিল জমিদার।
ছোরাটা নিল গ্রে। ওপর দিকে ছুঁড়ে মারল একবার। বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে আবার নিচে পড়তে লাগল ছোরা। ক্ষিপ্র অভ্যস্ত হাতে সেটা লুফে নিল সে। বুঝলাম, ছুরি খেলায় হাত পাকা এই লোকের।
আবার ছুটতে শুরু করলাম আমরা। গাছপালার ওপাশ থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে ডাকাতেরা। এগিয়ে আসছে আরও কাছে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে সামনে দুৰ্গটাও দেখতে পাচ্ছি। বড় জোর আর চল্লিশ কদম দূরে আছে। একবার ওতে ঢুকে যেতে পারলেই বেঁচে যাব।
ওদিকে বসে বসে সময় নষ্ট করেনি হান্টার, কিছু কাজ করেছে। খুঁজেপেতে দুর্গে ঢোকার প্রবেশ পথ আবিষ্কার করেছে। আমাদেরকে উধ্বশ্বাসে ছুটে আসতে দেখেই এগিয়ে এল সে। পেছনে এই সময় হৈ হৈ করতে করতে গাছপালার এপাশে বেরিয়ে এল ডাকাতেরা। সংখ্যায় সাতজন, নেতৃত্ব দিচ্ছে জোব অ্যান্ডারসন।
আমরা বেড়ার কাছে চলে এসেছি, এই সময় গুলি করল ডাকাতেরা। আমার কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। আর্তনাদ করে উঠল রেডরুথ। পাশে চেয়ে দেখলাম, মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে হতভাগ্য লোকটা।
হান্টারের দেখানো পথে ছুটে ঢুকে পড়লাম দুর্গের আঙিনায়, বেড়ার ভেতরে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বেড়ার ফোকরে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিয়ে সমানে গুলি চালালাম। আমার পাশে জমিদার। ক্যাপ্টেন, হান্টার আর জয়েসও বন্দুক তুলে নিয়েছে। দুর্গের আশ্রয়ে থেকে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছি আমরা, বেশিক্ষণ সইতে পারল না ডাকাতেরা। ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার বনের ভেতরে গিয়ে গা ঢাকা দিল।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর বেড়ার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি, রেডরুথের কি অবস্থা হয়েছে দেখতে হবে। রক্তে ভিজে গেছে মাটি, তার ওপর চুপচাপ পড়ে আছে বেচারা। একবার দেখেই বুঝলাম, আশা নেই। ইতিমধ্যে জমিদারও এসে বসেছে আমার পাশে। দুজনে মিলে ধরাধরি করে মুমূর্ষ রেডরুথকে বেড়ার ভেতরে নিয়ে গেলাম।
কয়েক মিনিট পরেই মারা গেল বেচারা। নিঃশব্দে। যেন আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
কেঁদেই ফেলল জমিদার। দীর্ঘদিন তার কাছে কাজ করেছে রেডরুথ। মায়া বসে যাওয়া স্বাভাবিক।
রেডরুথের পাশ থেকে উঠে এলাম। পায়চারি করছেন ক্যাপ্টেন। এতক্ষণে খেয়াল করলাম, তার পকেটগুলো যেন বেশি ফোলা। আমাকে বার বার চাইতে দেখে একদিকের পকেট থেকে একটা ছোট সাইজের বাইবেল বের করে আনলেন ক্যাপ্টেন। রেডরুথের দিকে বাড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কি বললেন, তারপর আবার পকেটে ভরলেন বাইবেলটা। ওদিকে রেডরুথের হ্যাটটা বেড়ার বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে। জমিদার। লাশের মুখটা ঢেকে দিল হ্যাট দিয়ে।
পকেট থেকে একে একে আরও কিছু জিনিস বের করলেন ক্যাপ্টেন। ব্রিটেনের একটা পতাকা, খুব শক্ত খানিকটা দড়ি, কালির দোয়াত, কলম, ডায়েরী আর কিছু তামাক। নিচে মাটিতে জিনিসগুলো রেখে হান্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যেই বেড়ার ভেতরে ঢোকার পথটা বন্ধ করে ফেলেছে হান্টার।
আঙিনার এক জায়গায় একটা বড়সড় ফার গাছ আছে। হান্টারের সাহায্যে সেটার চূড়ার ডালপালা হেঁটে নিলেন। তারপর নিজে গাছে উঠে খাড়া মগডালে পতাকাটা বেঁধে দিলেন। একটা প্রধান কাজ যেন সেরে এলেন এইমাত্র, এমনিভাবে হাত ঝাড়লেন ক্যাপ্টেন। তারপর আমাদের নিয়ে আসা মালপত্রের হিসেব করতে বসলেন।
হিসেবপত্র শেষ করে আরেকটা পতাকা নিয়ে রেডরুথের দিকে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। লাশের শরীর ঢেকে দিলেন পতাকা দিয়ে। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালেন এভাবে ক্যাপ্টেন। লাশের পাশেই বসে আছে জমিদার, দুচোখে পানি। হাত ধরে তাকে টেনে তুললেন ক্যাপ্টেন, সান্ত্বনা দিলেন। তারপর কাজের কথা শুরু করলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারসাহেব, কদিনের মধ্যে না ফিরলে আপনাদের সন্ধানে জাহাজ আসবে ইংল্যান্ড থেকে?
আগস্টের মধ্যে, বললাম আমি, ব্ল্যান্ডার্স আসবে।
মাথা চুলকালেন ক্যাপ্টেন, ততদিন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়!
মানে?
গোলাবারুদ যা আছে, চলে যাবে। কিন্তু খাবার? বড় জোর দিন দশেক চলবে আর…
এই সময় কামানের গর্জন শোনা গেল। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল গোলাটা। দুর্গ সই করে জাহাজ থেকে কামান দাগছে ডাকাতেরা!
চালিয়ে যাও, বাপধনেরা, খুশি খুশি গলায় বললেন ক্যাপ্টেন। এভাবে গোলাই খরচ করবে শুধু, কাজের কাজ কিছু হবে না। চালাও, শেষ করে ফেল গোলা…
চমকে থেমে গেলেন ক্যাপ্টেন। হাসি মুছে গেল মুখ থেকে। দ্বিতীয় গোলাটা এসে পড়েছে বেড়ার বাইরে! ধুলোর মেঘ উড়ল।
ওই পতাকা, বলল জমিদার, জাহাজ থেকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়! নইলে নিশানা করছে কি করে? ওটা নামিয়ে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ…
পতাকা নামাবো! প্রায় চেঁচিয়েই উঠলেন ক্যাপ্টেন, কিছুতেই না! ওই পতাকাই জানিয়ে দিচ্ছে, ওদেরকে পরোয়া করি না আমরা।
সাঁঝের অন্ধকার না নামা পর্যন্ত কামান দেগে চলল ডাকাতেরা, কিন্তু কোন ক্ষতি করতে পারল না আমাদের। দুৰ্গটা জাহাজ থেকে অনেক দূরে। অত দূর থেকে নিশানা ঠিক রাখা দুষ্কর। গোলার পর গোলা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল, কিংবা এসে পড়ল বেড়ার বাইরে এদিক ওদিক। প্রচন্ড অস্বস্তি আর উত্তেজনার মধ্যে রাখা ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষতিই করতে পারল না ওরা।
অন্ধকার নামতেই কামান দাগা বন্ধ হয়ে গেল। একটা প্রস্তাব দিলেন ক্যাপ্টেন, ভাটার টানে পানি নেমে গেছে। ডুবে যাওয়া জলিবোটটা নিশ্চয় বেরিয়েছে। চলুন না, টিনের খাবারগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসি?
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। জাহাজ থেকে নিয়ে আসা মালপত্রগুলো ইতিমধ্যেই দুর্গের ভেতরে জায়গামত সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলেছি আমরা। কাজেই যে-কোন দুজন লোক দুর্গ পাহারায় থেকে অনন্যরা খাবার উদ্ধারে যেতে পারি।
তৈরি হয়ে এল গ্রে আর হান্টার। দুর্গ পাহারায় রইল জমিদার আর জয়েস।
বন থেকে বেরিয়েই কিন্তু থমকে গেলাম আমরা। আমাদের মতই খাবারগুলোর কথা ভেবে ফেলেছে ডাকাতেরা। সিলভারের নেতৃত্বে একটা বোট এগিয়ে আসছে জলিবোটের খাবার আর গোলাবারুদ নিয়ে যেতে। একটা করে বন্দুক আছে সবারই হাতে। কিন্তু কোথায় পেল ওরা এই বন্দুক? আমাদের সাথে নিয়ে আসা কয়েকটা ছাড়া তো জাহাজের আর সব বন্দুকই পানিতে ফেলে দিয়ে এসেছি!
জলিবোটের জিনিসপত্র আর আমাদের উদ্ধার করা সম্ভব হল না। এখন এগিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। ফিরে এলাম।
সবে বেড়ার ভেতরে ঢুকেছি, এমনি সময় বাইরে কার ছুটে আসা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রবেশ পথটা বন্ধ করার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল জিম।