বেলা বারোটা নাগাদ লাশগুলোকে কবর দেয়া শেষ করলাম আমরা। তারপর লাঞ্চ সেরে নিলাম। খাওয়ার পর জমিদার ট্রেলনীর সঙ্গে পরামর্শ করে একটা বন্দুক, দুটো পিস্তল, একটা ছুরি আর ম্যাপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডাক্তারচাচা। বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিলেন। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে হেটে গিয়ে ঢুকে পড়লেন পাহাড়ের গোড়ার জঙ্গলে।
আঙিনায় বসে সবই দেখলাম আমি আর আব্রাহাম গ্রে। কোথায় গেলেন ডাক্তারচাচা, ভেবে অবাক লাগল! দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা সরিয়ে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল গ্রে, গেলেন কোথায় ডাক্তার সাহেব?
কোন মতলব আছে নিশ্চয়! বললাম আমি।
বেন গানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন কিনা, কে জানে!
তীব্র কিরণ ছড়াচ্ছে সূর্য। তেতে উঠেছে বালি। আর বসা যাচ্ছে না আঙিনায়। বনের ভেতর গাছপালার ছায়া আছে। ঠান্ডাও বেশ ওখানে। ডাক্তারচাচার পিছু পিছু গেলে মন্দ হয় না! সূর্যের আঁচ থেকে বাঁচতে পারব, কৌতূহলেরও অবসান হবে। পেট ভরাই আছে। দুটো পিস্তল আর কিছু বিস্কুট পকেটে ভরে নিলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম বেড়ার বাইরে। সোজা ছুটে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলে, ডাক্তারচাচা যেখান দিয়ে ঢুকেছেন।
তাকে দেখলাম না। ঘন জঙ্গলের কোথায় হারিয়ে গেছেন, কে জানে! এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলাম, কিন্তু বৃথা। দুর্গে ফিরে যেতে মন চাইছে না। একবার সাগরের দিক থেকে ঘুরে আসার ইচ্ছে চাপল মনে।
গাছপালার ভেতর দিয়ে, ঝোপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি। গাছে গাছে গান গাইছে পাখিরা, ঝোপের ভেতরে পোকামাকড়ের ডাক, পাইনের মিষ্টি গন্ধ, শীতল ছায়া আর বুনো ফুলের চোখ ধাঁধানো রূপ উপভোগ করছি সারাক্ষণ। চলেছি দ্বীপের দক্ষিণ ধারে, ডাক্তারচাচাকে যখন পেলামই না অন্তরীপ পর্যন্ত ঘুরেই আসি।
সামনে সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাতাস বইতে শুরু করল হঠাৎই। এমনিতেই শীতল ছায়ার ভেতর দিয়ে চলেছি, তার ওপর বাতাসে জুড়িয়ে গেল শরীর। সাগরের নোনা গন্ধ মেশানো বাতাস জোরে জোরে টেনে নিলাম ফুসফুসে। একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠল শরীর। একটুও ক্লান্তি অনুভব করছি না।
আরও খানিকটা যেতেই গাছপালার ভেতর দিয়ে চোখে পড়ল ঢেউ খেলানো নীল সাগর। সাদা ফেনায় ঝিলমিল করছে দুপুরের রোদ। এখানকার সাগরের সুন্দর রূপ এই প্রথম দেখলাম। জোর বাতাসে বিশাল সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে। ছল-ছলাৎ শব্দে ফিরে যাচ্ছে আবার ঢেউ, ভেজা বালিতে রেখে যাচ্ছে নোনা ফেনা। অপূর্ব!
আনন্দে শিস দিতে দিতে সাগরের ধার ধরে এগিয়ে চলেছি। অনেকখানি দক্ষিণে গিয়ে বাঁক নিয়েছে তীরভূমি। আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। সাগর এখন আমার পেছনে। সামনে সম্ভবত স্কেলিটন আইল্যান্ড-কঙ্কাল দ্বীপ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম আবার! এতটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে জঙ্গল, ভাবিনি। আরে, এ কোথায় এলাম! সামনেই তো নোঙর করে আছে হিসপানিওলা। সারাক্ষণ একই জায়গায় ঘুরেছি। অথচ আমি ভেবেছি বুঝি বা কতটা পথ পেছনে ফেলে একেবারে দক্ষিণে চলে এসেছি।
হিসপানিওলার মাস্তুলে পতাকা রয়েছে এখনও, তবে ব্রিটেনের পরিবর্তে জলদস্যুদের জলিরোজার ফ্ল্যাগ। জাহাজের দুপাশে বেঁধে রাখা হয়েছে নৌকা দুটো। ডেকের ওপর রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিলভার। লাল টুপি পরা একটা ডাকাতের সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে দুজনেই। লাল টুপির পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও একজন। খানিকক্ষণ কথা বলে পাশের লোকটাকে নিয়ে একটা নৌকায় নামল লাল টুপি। বাঁধন খুলে দাঁড় বাইতে লাগল। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তরীপের দিকে। হ্যাঁ, এইবার অন্তরীপ কোথায় মনে পড়ে গেছে, আর ভুল হবে না। নৌকাটাকে অনুসরণ করার জন্যে আবার বনের ভেতর ঢুকে এগিয়ে চললাম।
কতক্ষণ হেঁটেছি, বলতে পারব না। বেরিয়ে এলাম আবার খোলা জায়গায়। স্পাইগ্লাস পাহাড় দেখা যাচ্ছে। অবাক হয়েই দেখলাম, পাহাড়ের দিকে হেলে পড়েছে সূর্য। পাদদেশের জঙ্গলের মাথায় হালকা ধোঁয়ার মত কুয়াশা জমছে। লালটুপির নৌকাটাকেও হারিয়ে ফেলেছি, দেখতে পাচ্ছি না আর। ওদিকে সাঁঝ হতে বেশি বাকি নেই। রাতের অন্ধকার নামলে ডাকাতের নৌকার দেখা পাওয়া তো দূরের কথা দুর্গে ফেরাই মুশকিল হবে। কিন্তু দুৰ্গটা কোথায়? আঁতকে উঠে উপলব্ধি করলাম, পথ হারিয়ে ফেলেছি।
সাগরের তীর ধরে এগিয়ে চললাম। ইচ্ছে, হাঁটতেই থাকব। এক সময় না একসময় দুর্গের কাছাকাছি পৌছুবই। দূর থেকে পতাকাটা দেখতে পেলে আর অসুবিধে হবে না।
ফার্লংখানেক পেরোতেই একটা প্রকান্ড সাদা মত পাথরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। এটাকে এর আগে কখনও দেখিনি। আসলে এর আগে কখনও এদিকে আসিইনি, দেখব কি করে? এগিয়ে গিয়ে পাথরের রুক্ষ গায়ে হাত বোলালাম। সাঁঝ হয়ে এসেছে। তবে অন্ধকার নামতে কিছুটা দেরি আছে। ধূসর আলোয় পাথরের নিচের ছোট গুহাটা নজরে পড়ল। ঘাস আর লতাপাতায় ঢাকা গুহামুখের চারদিকটা। ভেতরে কি আছে? সাপখোপ? কে জানে কোন ধরনের হিংস্র জানোয়ারও থাকতে পারে এখানে। উবু হয়ে বসে পড়লাম। উঁকি দিলাম ভেতরে। কালো মত কি জানি দেখা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হল। ঈশ্বরের নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। একটু এগিয়ে বুঝে ফেললাম, কালো জিনিসটা কি। একটা তাবু। ছাগলের চামড়ায় তৈরি। ব্রিটেনের জিপসীরা এই ধরনের তাঁবুতেই রাত কাটায়।
তাঁবুটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোন দরজা বা ঢোকার পথ নেই। বসে পড়ে একটা ধার ধরে টান দিলাম। উঠে গেল ওপরের দিকে। ও, কাঠামোটার ওপর কায়দা করে চামড়া বসিয়ে দেয়া হয়েছে শুধু। কেউ নেই। বেন গানের ছাড়া আর কারও তাবু নয় এটা, অনুমান করে নিতে অসুবিধে হল না! তাঁবুর ভেতরে একটা ছোট নৌকা রাখা আছে। ছাগলের চামড়ায়ই তৈরি। ব্রিটেনের অধিবাসীরা চামড়া দিয়ে এমন নৌকা বানায়। এদেরকে ওরা বলে কোরাল। হালকা জিনিস, সহজেই বহন করা যায়। হালকা কাঠের তৈরি একটা দাঁড়ও পড়ে আছে নৌকার পাশে।
নৌকাটা দেখে নতুন এক মতলব এল আমার মাথায়। এতে চড়ে হিসপানিওলায় চলে গেলে হয়ত ডাকাতদের আগামী পরিকল্পনা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনে ফেলতে পারি।
আঁধার নামছে বাইরে। বিস্কুটগুলো খেয়ে নিলাম! পিস্তল দুটো একবার পরীক্ষা করে নিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। তারপর নৌকাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে।
যে পথে এসেছি, সেই পথে হাঁটা শুরু করলাম। সাগরের ধার ধরে হাঁটছি, কাজেই হিসপানিওলা কোথায় নোঙর করা আছে খুঁজে পেতে অসুবিধে হবার কথা নয়। অগত্যা যদি না-ই পারি, নৌকা ভাসিয়ে তীর ধরে বেয়ে যাব। একসময় না একসময় জাহাজটা দেখতে পাবই। তাছাড়া রাতের বেলা আলো জ্বলবে জাহাজে, দূর থেকেও চোখে পড়বে এই আলো। আর হিসপানিওলাকে একবার খুঁজে পেলে দুৰ্গটা খুঁজে পাওয়াও সহজ হবে।
হালকা হলেও কতই বা হালকা হবে একটা নৌকা। তার ওপর একটা দাঁড়ও সঙ্গে আছে। বেশিক্ষণ বয়ে নেয়া সম্ভব হল না আমার পক্ষে। অগত্যা পানিতে ভাসিয়ে তীর ধরে বেয়ে চলাই ঠিক মনে করলাম। ভাটাও শুরু হয়ে গেছে। কাদা পানি ভেঙে একটু বেশি পানিতে নিয়ে গিয়ে নৌকা ভাসালাম। নৌকায় চড়েই টের পেলাম এই জিনিস সামলানো বড় কঠিন।
দাঁড় বেয়ে চলেছি। কিন্তু পথ আর ফুরায়ই না। কতক্ষণ চলেছি জানি না, অন্ধকারে হিসপানিওলাকে প্রায় এড়িয়েই চলে যাচ্ছিলাম। আলো জ্বালেনি জাহাজে ডাকাতেরা। অন্ধকারে আবছা কালো এক বিশাল দানবের মত হিসপানিওলার অবয়ব হঠাৎই ফুটে উঠল চোখের সামনে। নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
নৌকা ঠেকালাম জাহাজের গায়ে। জাহাজের কোথায় নৌকা বাঁধতে হয় জানি। কোরাটাকে বাঁধতে গিয়েই খেয়াল হল আমার, বোট নেই। কে জানে, ওদিকে বাঁধা আছে হয়ত। কিন্তু তা তো নিয়ম নয়!
কোরাকটাকে বেঁধে দাঁড়টাকে ফেললাম নৌকার খোলে। দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠতে যাব এই সময় উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল ডেক থেকে। চমকে উঠলাম। গলাটা ইসরায়েলের। কারও সঙ্গে তর্ক বাধিয়েছে সে। দ্বিতীয় লোকটার কর্কশ কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে চেঁচামেচি। একটা ব্যাপারে অবাক লাগল, মাত্র দুজন লোকের গলাই শোনা যাচ্ছে, তৃতীয় আর কেউই নেই। বাতিও নেই জাহাজে। ব্যাপারটা কি?
হঠাই শোনা গেল ধাতব শব্দ। আঁতকে উঠলাম। এই শব্দ আমার চেনা। ছুরির সঙ্গে ছুরির ঘষা। সেই সঙ্গে তুমুল গালাগালি। জড়িত কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে, দুজনেই মাতাল। আচমকা আর্তনাদ করে উঠল একজন। তীক্ষ্ণ, লম্বিত আর্তকণ্ঠ। ধপ করে একটা আওয়াজ হল, ময়দার বস্তা কাঠের ডেকে গড়িয়ে পড়লে যেমন হয়। তারপরেই সব চুপ। খুন হয়ে গেল নাকি একজন লোক?
আর দ্বিধা না করে তাড়াতাড়ি উঠে এলাম। রেলিং ধরে তীক্ষ্ণ চোখে ডেকের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে আবছা মত দেখা গেল চিত হয়ে ডেকের ওপর পড়ে আছে। একজন লোক। আরেকজন বসে কুকুরের মত হাঁপাচ্ছে। তার হাঁপানির শব্দও শুনতে পাচ্ছি পরিষ্কার। ইসরায়েল হ্যান্ডস বেঁচেই আছে।
পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলাম। অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি জাহাজে আর কোন লোক নেই। ডেকে পড়ে আছে একটা ডাকাতের লাশ। জীবিত বলতে ইসরায়েল হ্যান্ডস আর আমিই আছি এখন জাহাজে। অন্য লোকগুলো কোথায় গেল? বোট নেই। তারমানে এই দুজনকে পাহারায় রেখে দলবল নিয়ে দ্বীপে চলে গেছে সিলভার।
নিঃশব্দে রেলিঙ টপকালাম। তারপর নিঃশব্দেই হেঁটে এসে দাঁড়ালাম ইসারালের পেছনে। মৃদু কণ্ঠে বললাম, যেখানে আছ বসে থাক, ইসরায়েল, নইলে খুলি উড়ে যাবে!
কে? আঁতকে উঠে ঘাড় ফেরাল ইসরায়েল। অন্ধকারে আমাকে চিনতে একটু সময় নিল। ফিসফিস করে বলল, জিম না?
হ্যাঁ, আমি জিমই! জাহাজে আর কে আছে?
আর কেউ নেই। জিম, আমি আহত। প্লীজ, একটা বাতি ধরাও। একটু রাম আনবে…
পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। বাতি আর দিয়াশলাই কোথায় আছে, জানি আমি। অন্ধকারেই দুটো জিনিস খুঁজতে গিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকল। যে জিসিটা যেখানে থাকার কথা, নেই। তবে ওয়াল কেবিনেটের ড্রয়ারে দিয়াশলাই খুঁজে পেলাম। একটা কাঠি জ্বালতেই কেবিনের ভেতরটা দেখতে পেলাম। তছনছ লন্ডভন্ড করে রাখা হয়েছে পুরো ঘরটা। তন্নতন্ন করে কিছু খোঁজা হয়েছে। বোধহয় ম্যাপটাই খুঁজেছে সিলভার।
লণ্ঠন নিয়ে ডেকে বেরিয়ে এলাম আবার। তেমনিভাবে বসে আছে ইসরায়েল। গাল আর কপালের চামড়া কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। হাতেও রক্ত। ডান উরু থেকে নিচের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে।
জিম, বলল ইসরায়েল। ডান পা-টা বোধহয় ভেঙেই গেছে! আহ! একটু রাম এনে দেবে আমাকে?
ইসরায়েলের হাতখানেক দূরে পড়ে থাকা লাশটার দিকে তাকালাম। বুকে বিঁধে আছে একটা বড় ছোরা। গত কয়েকদিনে এত খুনোখুনি দেখেছি, এই লাশটা দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া হল না আমার। লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে ভাড়ারের দিকে চললাম। পুরো জাহাজটাকে লন্ডভন্ড করে ফেলেছে ডাকাতেরা। প্রচন্ড এক ঝড় বয়ে গেছে যেন ছিমছাম হিসপানিওলার ওপর দিয়ে।
মদ এনে দিলাম ইসরায়েলের হাতে। এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে ফেলল সে। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে আমার অনেক গুণগান করল। তাতে মজলাম না আমি। ইসরায়েলকে উঠে দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু পা ভেঙে যাবার দোহাই দিয়ে উঠল না সে। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম না। সন্দেহ হচ্ছে আমার। পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে তাক করলাম। ওই কেবিনে চল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হেঁচড়েই চল!
পিস্তলটার দিকে একবার তাকাল ইসরায়েল। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও নড়ল। দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ঢুকল কেবিনে। খুঁজেপেতে একটা তালা এনে দরজা বন্ধ করলাম। রাতটা কেবিনেই কাটাক ইসরায়েল, সকালে দেখা যাবে কি করা যায়। এই সময় আর দুর্গে ফিরতে ইচ্ছে হল না আমার। তাছাড়া অন্ধকারে পতাকাটা দেখা যাচ্ছে না, খুঁজে পাব না দুৰ্গটা। জাহাজেই রাত কাটানো স্থির করলাম। সিলভার ফিরে এলে দূর থেকেই তার নৌকা দেখতে পাব। লুকিয়ে পড়তে পারব তখন কোথাও। কাজেই একটা গদি এনে কেবিনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম। সারাটা দিন ভয়ানক পরিশ্রম করেছি। আরাম পেয়ে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দুচোখ…
চোখেমুখে রোদের ছটা লাগতে ঘুম ভাঙল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। রাতের বেলা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। না, সিলভার ফিরে আসেনি। তাহলে এত বেলা পর্যন্ত এভাবে ঘুমোতে পারতাম না।
চোখ ডলতে ডলতে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাহাড়টাকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একি? এ তো পাই-গ্লাস পাহাড় নয়! আশপাশের বন আর তীরভূমিও কেমন যেন অচেনা। পাহাড়টা একটা অন্তরীপের ওপারে। গাছপালা তেমন নেই। চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট উঁচু উঁচু বড় বড় পাথরে ছাওয়া অন্তরীপ। জাহাজ থেকে তীর বড় জোর সিকিমাইল দূরে। কিন্তু এখানে কে আনল জাহাজ।
নোঙর পরীক্ষা করতেই বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা। কোন কারণে নোঙর তুলে ফেলা হয়েছে হিসপানিওলার। মাতাল অবস্থায় নিশ্চয় এই কাজ করেছে ইসরায়েল। ভাটার সময় জায়গামতোই ছিল জাহাজটা। কিন্তু জোয়ার আসতেই দক্ষিণা স্রোতের টানে ভেসে চলে এসেছে অন্তরীপের কাছে, রাতের বেলা।
কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইসরায়েল কেমন আছে জানা দরকার। পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলতে গিয়েও একটা কথা মনে পড়ায় ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে ইসরায়েল। তারমানে তার পা ভাঙেনি, মিছে কথা বলেছে।
হাত দিয়ে পকেটের পিস্তল স্পর্শ করে নিলাম একবার। তারপর খুলে দিলাম তালা। দরজা খুলেই দেখি, মেঝেতে বেকায়দা ভঙ্গিতে বসে আছে ইসরায়েল। আমাকে দেখেই পা ভাঙার অভিনয় শুরু করেছে আবার। আরও সাবধান হতে হবে, নিজেকে হুঁশিয়ার করলাম।
ইসরায়েল জানাল, খিদে পেয়েছে তার। ওকে বসতে বলে খাবার আনতে ভাড়ারে গেলাম। রাম আর নেই। খুঁজেপেতে একটা ব্র্যান্ডির বোতল বের করলাম। কিন্তু সামান্যই অবশিষ্ট আছে তাতে। কিছু বিস্কুট নিলাম, আর নিলাম ভিনিগারে ভেজানো ফল, কিছু কিসমিস আর এক টুকরো পনির। ফিরে এলাম কেবিনে। তেমনি বসে আছে ইসরায়েল। এ বোতলটা আর কিছু খাবার তুলে দিলাম ইসরায়েলের হাতে। তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসলাম আমি।
জাহাজটা এখন আমার দখলে, খেতে খেতে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলাম ইসরায়েলকে। খেয়ে উঠেই পতাকাটা বদলে ফেলব।
খাওয়া শেষ করে কেবিনেট খুঁজে একটা পতাকা বের করলাম, ব্রিটেনের পতাকা। তারপর গিয়ে জলি রোজার খুলে ফেলে তার জায়গায় দেশের পতাকা ওড়ালাম। পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত থাকার সময় কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েল, টের পাইনি। আচমকা ঘাড়ের কাছে শীতল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ঘুরতে যেতেই ইসরায়েলের ভয়ঙ্কর গলা শোনা গেল, খবরদার! নড়বে না। আমার পকেটে তার হাত ঢুকে গেল। পিস্তল দুটো বের করে নিল। তারপর বলল, পতাকা যেটা খুশি ওড়াও, ওসব পাগলামিতে কিছু যায় আসে না আমার! ঘাড়ের কাছে থেকে ছুরিটা সরিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সে।
ঘুরে তাকালাম। তেমনি ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বলল সে, জাহাজ এখন আমার দখলে। যা বলছি, শোন। নোঙর তুলে দাও। পাল ওড়াও। তারপর আমি যেদিকে বলব, নিয়ে যাবে।
কি আর করব। পালগুলো জায়গামত খাটানোই আছে। দড়িগুলো টান টান করে বেঁধে দিলেই হল। দিলাম। স্রোতের টানে এমনিতেই ভাসছিল জাহাজ। বাতাস লেগে ফুলে উঠল পাল। গতি বেড়ে গেল। হাল ধরলাম আমি। সত্যিই, জাহাজটা চালানো তেমন কঠিন নয়, জমিদার ট্রেলনী ঠিকই বলেছেন। কিন্তু জীবনে এই প্রথম হাল ধরলাম, ভুল হতেই লাগল। তবু এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলল জাহাজ।
অনুকূল বাতাস আর স্রোতের টানে দুপুর নাগাদ দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে গেলাম। দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে নর্থ ইনলেটের মুখ পর্যন্ত চলে এলাম সহজেই। পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করছে ইসরায়েল।
খাড়ির মাইল দুয়েক ভেতরে ঢুকতে হবে এবার। প্রবেশ পথ খুবই সঙ্কীর্ণ। সাবধান না থাকলে যে-কোন সময় চড়ায় আটকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে জাহাজ। হাল ধরল এসে ইসরায়েল। নিপুণ হাতে চালিয়ে নিয়ে চলল। খুব ধীরে সমস্ত বাধাবিপত্তি এড়িয়ে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। এদিক-ওদিক বার বার মোড় নিতে হচ্ছে। একটা মোর ঘুরতেই সামনে পড়ল বালির চড়া। আর এগোনো যাবে না।
থামাতে দেরি করে ফেলল ইসরায়েল। ঘটে গেল চরম বিপত্তি। প্রচন্ড জোরে বালির চড়ায় ধাক্কা খেল হিসপানিওলা। একটা পাশ উঠে পড়ল বালিতে। কাত হয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী। ভয়ানক জোরে নড়ে উঠল হাল, ঘুরে গিয়ে বাড়ি মারল ইসরায়েলের চোয়ালে-মাথায়। রেলিঙ টপকে ছিটকে গিয়ে পানিতে পড়ল লোকটা। অগভীর পানির তলায় চকচকে বালিতে বেকায়দা ভঙ্গিতে বেঁকে পড়ে রইল সে। ভাবলাম, উঠে পড়বে কিন্তু উঠল না। মাথার কাছ থেকে কালচে-লাল তরল পদার্থের একটা সূক্ষ্ম ধারা রঙিন ধোয়ার মত উঠতে লাগল। বিমূঢ়ের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
আধ মিনিট পরেই ইসরায়েল হ্যান্ডসের দেহের ওপর এসে স্বচ্ছন্দে নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল ছোট ছোট মাছ।