খবরে জানতে পারলাম প্রশাসন বহু বছর পর ঠেগামুখ প্রবেশে সাধারণ বাঙালিদের ওপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে, রাঙ্গামাটি সদর হতে সরাসরি জাহাজ চলাচল। খবর জানতে যতটা না হলো দেরি,তার চাইতেও অনেক বেশি তাড়াতাড়ি ভ্রমণ পাগলুরা নিয়ে নিল প্রস্তুতি।
দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরাও পিছিয়ে নেই। গ্রুপের সবাইকে না জানিয়ে, অনেকটা গোপনেই ছুটলাম ঠেগামুখ। সাতসকালেই রাঙ্গামাটি পৌঁছে, লাইনের জাহাজে না চড়ে রিজার্ভ স্পিডবোটে ভাসলাম। খেয়াল একটাই যত দ্রুত সম্ভব ঠেগা পৌঁছানো যায়। কারণ নিরাপত্তার অজুহাতে প্রশাসনের মর্জি কখন কী হয়।
মহানন্দে ঠেগামুখ যাচ্ছি। কাপ্তাই লেকের নীলাভ পানি, সবুজ পাহাড়- সবই আপন মনে হয়। লেকের জলে ঘুরে বেড়াই সেই ১৯৯৪ সাল হতেই। কিন্তু যতবারই আসি ততবারই কাপ্তাই লেকটাকে নতুন রূপে আবিষ্কার করি। লেক ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের রয়েছে দুঃখভরা ইতিহাস।
এক রাতেই লেকের জলে হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ তাদের ভিটাবাড়ি। কথায় আছে না, কারও পৌষ মাস আবার কারও বা সর্বনাশ। সহায়-সম্বল হারানোদের কষ্টঘেরা কাপ্তাই লেক, বর্তমানে ভ্রমণবিলাসী, পিপাসু ও ভ্রমণ বাণিজ্য, এই তিন দলের জন্যই হয়েছে মোক্ষম সুখস্মৃতি ধারণের অন্যতম দর্শনীয় প্রান্তর।
লেকের স্বচ্ছ জলে দ্রুতগামী বোট সব কিছু পেছনে ফেলে, যেতে যেতে বরকল চেকপোস্টে থামে। কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই ক্যাম্প হতে ছাড়পত্র মিলে। ভালোলাগার পারদ রেড়ে এখন, ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছুইছুই। কারণ বছর সাত আগে, এই বরকলেই আটকে রেখেছিলো ঘণ্টা দুই।
বোটচালক একজন চাকমা। যার ফলে অনেক কিছুই তার চেনা-জানা। সে কখনো লেকের জলে, কখনো খালে, আবার কখনো বা কর্ণফুলীর নদীর জল কেটে এগিয়ে যায়। বুঝতে পারলাম সে শটকাট মারছে। তাতে কী? বরং আমাদের চোখে ধরা পড়ল প্রকৃতির নানান রূপ।
বিশেষ করে নদীর দুইপারের অসাধারণ প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য, আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যাপিত জীবনের চালচিত্র মনে রাখার মতো। শটকাটের যোগসূত্রে আমাদের ভ্রমণের ঝুলিও, ভারি হতে থাকে। প্রকৃতির নজরকাড়া দৃশ্য দেখতে দেখতে, মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই ছোটহরিণা ক্যাম্পে পৌঁছি।
চা-চক্রের সুযোগে কথা হয় হরিণা বাজারে বাঙালি এক যুবকের সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আজ সকাল হতেই নাকি পুনরায় নিষেধাজ্ঞা জারি। তাহলে উপায়? স্থানীয় কোনো উপজাতি ম্যানেজ করতে পারলে নাকি, যাওয়ার সুযোগ মিলতে পারে।
শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ। ম্যানেজও হলো। ক্যাম্পে নাম-ঠিকানা এন্ট্রিও হলো; কিন্তু একি হায়! তীরে এসে তরী ডুবল। যে কারণে এবার ভ্রমণসঙ্গী বেশি কাউকে রাখিনি, তারপরও হয়তো আমাদের কোনো কথার কারণেই ঠেগামুখ যাওয়া ঠেকে গেল। যে ঠেকা সরানো গেলো না পূর্বপরিচিত জনৈক এক লে. কর্নেলকে দিয়ে ফোন করিয়েও; কী আর করা। মলিন মনে স্পিড বোটে বসি।
ফিরতি পথে আবারো বরকল ক্যাম্পে করতে হয় রিপোর্ট। সেই সুযোগে কিছুটা সময় ঘোরাঘুরি। দেখা হয় পাকিস্তান টিলা। যেটাকে এখন বাংলাদেশ টিলা বলা হয়। মূলত এটা একটি উঁচু পাহাড়। সেদিন ছিল সাপ্তাহিক হাটবার।
প্রায় আড়াই কেজি ওজনের দেশি মোরগ দেখে লোভ সামলাতে না পেরে কিনে নিই। পছন্দসই মোরগ পেয়ে ভারাক্রান্ত মনেও সবাই হাসি। ঠিক সন্ধ্যায় রিজার্ভবাজার পৌঁছে হোটেলে উঠি।
ইতোমধ্যে মনে মনে পরের দিনের প্ল্যান করে ফরমান জারি করে দিই। ঘুমাতে হবে তাড়াতাড়ি। সকাল সকাল চলে যাব ফুরমোন পাহাড়। এই ফুরমানে টাকার রক্ষক দুই নাজমুল প্রাণ ফিরে পেয়ে হিসাবে গোঁজামিল হওয়ার পরেও ঘাপটি মেরে রয়- হা-হা-হা।
কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে ঢুঁ মারি স্থানীয় মার্কেটগুলোতে। হালকা কেনাকাটার ফাঁকে এক হোটেল বাবুর্চি দিয়ে রান্না করা মোরগ ভুনা রেডি। ডিনার শেষে সোজা রুমে। একটা সময় ক্লান্ত দেহে, হরেক কিসিমের নাক ডাকা কর্কশ আওয়াজের সঙ্গে দুস্তি পেতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেই।
ফজরের আজানের ধ্বনি শুনে ঘুম ভাঙ্গে। চটজলদি সবাই রেডি। সারাদিন কিনা কী খাই,তাই পেটপুরে নাশতা খেয়ে সিএনজিতে চাপি। ভোরের হাওয়ায় সর্পিল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে সিএনজি চলে। প্রায় ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই মানিকছড়ি যৌথখামার। দৃষ্টির সীমায় ফুরমোন চূড়া।
সিএনজি ছেড়ে ট্রেইল শুরু। আমরা চূড়ায় চড়ব অফরুট দিয়ে। সাধারণত পর্যটকরা এপাশটা দিয়ে ট্র্যাকিং করে না। কিছুদূর ট্রেইল শেষে সুন্দর একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পাড়ায় চোখ আটকায়। তাদের ঘরগুলো বাগানবিলাস ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা। তার ওপর ফুটন্ত ফুলের হাতছানি। এরকম অসাধারণ একটা পাহাড়ি পরিবেশে,কিছুটা সময় চলল ফটোশুট।এরপর ধীরে ধীরে বুনোপথে হাইকিং। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন মুগ্ধতা ভর করে। যেতে যেতে শুরু হলো বন্ধুর পথ। ততক্ষণে কুয়াশা কেটে অগ্নিগর্ভা সূর্যের আলোকছটা।
ফিচার বিজ্ঞাপন
সিঙ্গাপুর ভিসা (বিজনেসম্যান)
মৈনট ঘাট প্রাইভেট ডে লং ট্যুর
ইস্তানবুল, কাপাডোসিয়া ও কুসাডাসি ৭দিন ৬রাত
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর, ফুরমোন চূড়ায় উঠার মূল ট্র্যাকিং শুরু। ততক্ষণে রোদ উঠল চেতিয়ে। মাঝে-মধ্যে জিরানোর সুযোগে পিছু ফিরে দেখি। আসলে আমরা দাঁড়াতে চাইনি। আমাদের দাঁড়াতে বাধ্য করেছে উন্মাদ প্রকৃতি। যতদূর চোখ যায়,শুধু সবুজে ঘেরা ছোটবড় নানান পাহাড়ের চূড়া। দূরের চূড়াগুলো দেখতে পারাটাই যেন ফুরমোন চূড়ায় উঠার শক্তিমত্তা। উঠতে উঠতে পেলাম আর্মি ক্যাম্প।
খানিকটা সময় সেনা সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে আবারো উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে ছুটে চলা। কিছু কিছু জায়গা আছে পা পিছলে পড়লেই হাজার ফুট গিরিখাদে। আসলে পাহাড় ভ্রমণের মজাটা ঠিক এরকম জায়গাগুলোতেই। যে মুহূর্তগুলো অভিযানের মতো হয় রোমাঞ্চকর। শেষ সময়ে ফুরমোন ট্র্যকিংয়ের অ্যাডভেঞ্জার ফ্লিংস কাটতে না কাটতেই চূড়ায় পৌঁছে যাই।
সোবহানআল্লাহ! এ যে আরেক দুনিয়া। যে দুনিয়ায় শুধুই প্রকৃতির বসবাস। চূড়ার পরিধি খুব বেশি নয়। কিন্তু ফুরমোনের উপর দাঁড়িয়ে দূরের ঢেউ খেলানো পাহাড়, ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘ আর নীল আসমানের সৌন্দর্য আপনাকে বারবার ফুরমোন চূড়ায় টানবেই। ফুরমোন শব্দের অর্থ ফুরফুরে মন। এটি চাকমা ভাষা। সত্যিই নামের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
ভূপৃষ্ঠ হতে ১৫১৮ ফুট উচ্চতার ফুরমোন চূড়ার উপর রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। তাই ধর্ম যার যার কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের উপাসনালয়গুলোর প্রতি সম্মান জানানো সবারই দরকার। সেই নীতি-নৈতিকতা হতেই আমরা যথাসম্ভব নীরবতা অবলম্বন করি। পরম করুণাময়ের কাছে অশেষ শুকরিয়া। তিনি আমাকে তার সৃষ্টির রূপ দেখার দৈহিক শক্তি ও মন-মানসিকতা দান করেছেন।
উপাসনালয় হতে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি- শাল, গর্জন,সেগুন ও মূলি বাঁশসহ সারি সারি নানান গাছ দিয়ে ঘেরা বনায়ন। নেমে যাওয়ার সিঁড়িটাও বেশ চমৎকার ডিজাইনের। ধীর পায়ে নামতে শুরু করি। শত শত সিঁড়ির ধাপ। পরে জানা যায়- মোট ধাপ ৭০৭টি। নেমে দেখি ফুরমোনের পাদদেশ আরেক ভিন্ন জগত। প্রাকৃতিক ও সৃজিত মেলবন্ধনে দৃষ্টিনন্দন বন। ট্রেইল ধরে এগোতে থাকি। যতই এগোই ততই এগোতে ইচ্ছে করে। অচেনা পাখির সুরেলা ডাক, শুকনো পাতার মরমর শব্দ; যা আপনাকে নিয়ে যাবে ভাবের জগতে। বনের ভেতর কোথাও কোথাও এতটাই ঘন যে,সূর্যের আলোও হার মেনেছে।
বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। ঘড়ির কাটা ৩টা ছুঁইছুঁই। পেটেও পড়েছে খানিকটা টান। তাই আর দেরি না করে, লোকালয়ের দিকে এগোতে থাকি। এগোতে এগোতে দেখি সে আরেক পৃথিবী! যেখানে রয়েছে শুধু পাহাড়ের খাদে প্রাচীন প্রাচীন সব বৃক্ষরাজি। সেই গল্প আজ আর নয়। কারণ ফিরতি পথের সৌন্দর্য লিখতে গেলে হবে বিরাট কাহিনী। শুধু এতটুকুন না বললেই নয়,ঠেগা যেতে না পারার মানসিক মলিনতা মিলিয়ে গিয়েছিল ফুরমোন ভ্রমণে।
যাবেন কীভাবে:
ঢাকা হতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস দিনে-রাতে ছেড়ে যায় রাঙ্গামাটি। ভাড়া জনপ্রতি পরিবহন ভেদে ৬০০ টাকা হতে ১৪০০ টাকা।
থাকা-খাওয়া:
রিজার্ভবাজার ও বনরুপা এলাকায় বিভিন্ন মানভেদে আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভাড়া বড় রুমে ৬ জনের বেড মাত্র ৬০০ টাকা। আবার ডাবল বেড ৫০০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এছাড়া খাবারেরও প্রচুর রেস্টুরেন্ট রয়েছে। শহর হতে মানিকছড়ি যৌথখামার-সাপছড়ি শালবাগান পুলিশ ফাঁড়ি সিএনজি ভাড়া মাত্র ২৫০ টাকা।
ভ্রমণ তথ্য:
ঠেগা-ছোটহরিণা যেতে চাইলে রিজার্ভবাজার হতে সকাল ৭টা ও দুপুর ২টায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। এছাড়া স্পিডবোটেও যাওয়া যাবে। বর্তমানে ঠেগামুখ সাধারণ বাঙালি প্রবেশ নিষেধ। তবে ইদানীং পর্যটকরা ছোটহরিণায় রাতযাপনে সুযোগ পাবেন। ইতোমধ্যে সেখানে সাধারণমানের বোর্ডিং ব্যবসা চালু হয়েছে।
Source: jugantor
প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।
২০৯ বার পড়া হয়েছে